আর্কাইভ

Archive for সেপ্টেম্বর 13, 2016

আমেরিকামুখী ভারত!

india-america-handshakeশুভ কিবরিয়া : এক সময় আমেরিকার চোখ ছিল পাকিস্তানের দিকে। পাকিস্তানকে বন্ধু বানিয়ে এই অঞ্চলে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভুত্বের বিরুদ্ধে লড়েছে আমেরিকা। আফগানিস্তানে রাশিয়া সমর্থিত সরকার এবং কম্যুনিস্টদের উৎখাত করতে পাকিস্তানেই ঘাঁটি গেড়েছিল আমেরিকা। এই কম্যুনিস্ট বিরোধী লড়াইয়ে ইসলামপন্থিদের জিহাদি জোশের অস্ত্র, অর্থ সরবরাহ এসেছিল খোদ মার্কিনিদের কাছ থেকে। পাকিস্তান ছিল তার মাধ্যম। পাকিস্তানে এফ১৬ বোমারু বিমান বিক্রি করে প্রতিবেশি ভারতকে চাপে ফেলেছিল তখন আমেরিকা। আশির দশকের সেই রাজনীতি এখন নেই। পুরো ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গেছে রাজনীতির সেই গতিমুখ। পাকিস্তানের সঙ্গে সেই প্রেমময় মাখামাখি সম্পর্ক নেই এখন আমেরিকার। পাকিস্তানের সঙ্গে আমেরিকার ভালবাসাময় রাজনৈতিক সম্পর্কের পুরোপুরি বিচ্ছেদ ঘটেনি বটে, তবে দু’দেশের প্রেমের তালে এখন ভাটির টান। এবং সেই প্রেমময় উত্তেজনার অতীত দিনের জোশের ফসল হিসেবে পাকিস্তানে ‘জঙ্গিবাদ’এখন আমেরিকান উপহার। আমেরিকা ও পাকিস্তানের উত্তুঙ্গ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের ফসল হিসেবে ‘জঙ্গিবাদ’ শুধু পাকিস্তানকেই পেছনে টানেনি গোটা দক্ষিণ এশিয়ায় এক অগ্নিময় বিপদকে জান্তব করেছে।

০২.

এখন সেই পাকিস্তানপ্রেম থেকে মুখ ফিরিয়েছে আমেরিকা। দক্ষিণ এশিয়ায় নতুনভাবে ভারতপ্রেমে মশগুল আমেরিকা। একসময় গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে আমেরিকায় সফর করতে ভিসা দিতে অস্বীকার করেছে আমেরিকা। এখন সেই নরেন্দ্র মোদি ভারতের প্রধানমন্ত্রী। সেই মোদিই ইতোমধ্যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আমেরিকায় চার চারবার রাষ্ট্রিক সফর সেরেছেন। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাও নরেন্দ্র মোদির আমন্ত্রণে ভারতে এসেছেন। ভারত ও আমেরিকার বড় বড় মন্ত্রিরা প্রায়শই দু’দেশ সফর করছেন। সম্প্রতি আমেরিকায় সফররত ভারতীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী মনোহর পারিকর আমেরিকান প্রতিরক্ষামন্ত্রী অ্যাশ কার্টারের সঙ্গে এক অসাধারণ চুক্তিও স্বাক্ষর করেছেন। পেন্টাগনে অ্যাশ কার্টার ও মনোহর পারিকর সামরিক সহযোগিতার যে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি সই করেছেন, তার নাম লজিস্টিক একচেঞ্জ মেমোরেন্ডাম অফ আর্টিকেল বা এলইএমও। এই চুক্তির মধ্য দিয়ে দু’দেশ নানা প্রয়োজনে একে অন্যের সামরিক ঘাঁটি ব্যবহার করতে পারবে। সামরিক ও মানবিক প্রয়োজনে ভারতের আকাশ, নৌ, বিমান পথে বাধাহীন ব্যবহারের সুযোগ পাবে আমেরিকা। যৌথ মহড়া, সামরিক সরঞ্জাম জোগান, জ্বালানি তেল রিফুয়েলিং সহ দু’পক্ষের সামরিক অংশের মধ্যে থাকবে বাধাহীন সহযোগিতা। এই চুক্তির আওতায় ভারতের মাটিতে সামরিক ঘাঁটি নির্মাণ ছাড়া আর সব রকম সামরিক সহযোগিতাই পাবে আমেরিকা। এই চুক্তির বড় দিক হচ্ছে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় প্রযুক্তি উদ্ভাবনে দু’দেশ পরস্পরকে সহায়তা করবে। প্রতিরক্ষা বাণিজ্যে, সমরাস্ত্র উৎপাদনে ভারতআমেরিকা এখন যৌথ ব্যবস্থা নিতে পারবে। ইতোপূর্বে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা যে সমঝোতায় পৌঁছেন, তার আওতায় ভারতে ব্যাপক বিনিয়োগ করবে আমেরিকা। এই বিনিয়োগের একটা বড় অংশ হবে প্রতিরক্ষা খাতে। যৌথ উদ্যোগে সমরাস্ত্র উৎপাদন হবে ভারতে, আমেরিকান বিনিয়োগে। নরেন্দ্র মোদি রাষ্ট্রিক ও ব্যক্তি খাতে এই বিনিয়োগ সহজ করতে ভারতের অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ নীতিমালাতেও ব্যাপক পরিবর্তন এনেছেন। ফলে এটা এখন প্রকাশ্য সামনের দিনগুলোতে ভারতে উৎপাদিত ভারতমার্কিন যৌথ বিনিয়োগে উৎপাদিত অস্ত্র খুঁজবে নতুন বাজার।

০৩.

আমেরিকায় বসে যখন ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী সামরিক সহযোগিতার চুক্তি স্বাক্ষর করছেন, ঠিক তখন ভারতে সফর করেছেন আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি। বারাক ওবামা প্রশাসনের মেয়াদকালের শেষ সময়ে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ভারত সফর অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। বাংলাদেশ ঘুরে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি ভারতের এক গুরুত্ববহ দ্বিপাক্ষিক কৌশলগত ও বাণিজ্য ডায়ালগে অংশ নেন। ভারত ও আমেরিকা গত এক দশকে বাণিজ্য ও স্ট্র্যাটেজিক খাতে পরস্পরকে বিশেষ সুবিধা দিতে এই কৌশলগত চুক্তিতে উপনীত হয়েছে। কৌশলগত, সামরিক, বাণিজ্যিক, উদ্ভাবনী, প্রযুক্তিগত ও সাংস্কৃতিক খাতে উভয় দেশ যে দ্বিপাক্ষিক গাটছাড়া বেঁধেছে, তাতে ভারতমার্কিন সম্পর্ক এক নতুন দিগন্তে প্রবেশ করেছে। এখন দেখার বিষয় মার্কিনিদের এই আগ্রহের হেতু কী? আর ভারত এই সুমধুর মার্কিনপ্রেম থেকে কী সুবিধাই নেবে?

এক. মার্কিন থিংক ট্যাংক বারাক ওবামা প্রশাসনের শাসনামলে যে দীর্ঘমেয়াদি পররাষ্ট্রনীতি নিয়েছে তার মূল কথা হচ্ছে ‘লুক ইস্ট’। পূর্ব দিকে মনোযোগ দাও। বাড়ন্ত অর্থনীতির, সম্ভাবনার, বিকাশমান এশিয়ার অর্থনীতির সুবিধার অংশীদার হতে চায় আমেরিকা। এশিয়ার বৃহৎ দেশ হিসেবে, আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে ভারত তাই আমেরিকার বড় পছন্দ।

দুই. এখনকার কূটনীতির মূল লক্ষ্য হচ্ছে বাণিজ্য ও সামরিক সুবিধা। ভারতের বৃহৎ বাজার আমেরিকার কাছে শুধু লোভনীয় নয়, একে দীর্ঘমেয়াদি স্থায়ী রূপ দিতে পারলে তা মার্কিন অর্থনীতিকে নতুন দিশা দিতে পারে। বিশেষত প্রযুক্তি ও সমরাস্ত্র বাণিজ্যে ভারতকে কেন্দ্র করে যে বৃহৎ বাজার তৈরি করার সুবিধা আছে, তা পুরোপুরি কাজে লাগাতে চায় আমেরিকা। সে কারণেই ভারত, এখন আমেরিকার প্রথম পছন্দ।

তিন. এই অঞ্চলের সমুদ্রপথ, খনিজসম্পদ, কৌশলগত সামরিক সুবিধা দিতে একটা শক্ত অবস্থান চায় আমেরিকা। প্রতিদ্বন্দ্বী চীনকে রুখতে একটা শক্তিমান আঞ্চলিক মিত্রও দরকার আমেরিকার। এই বিবেচনায় ভারত হচ্ছে সবচাইতে সুবিধাজনক স্থান। অন্যদিকে আমেরিকায় থাকা ৩০ লাখ শিক্ষিত ভারতীয় বংশোদ্ভুত আমেরিকান, যারা এখন আমেরিকার নাগরিক এবং আমেরিকার শিক্ষাপ্রযুক্তিবাণিজ্যবিজ্ঞান খাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে, এই শক্তিমান অংশটিকেও নতুন উদ্দীপনায় ব্যবহার করতে চায় আমেরিকা। ভারতপ্রীতির সেটাও একটা বড় কারণ আমেরিকার জন্য।

০৪.

এটা তো গেল আমেরিকার দিক। ভারত কেনো এই নতুন দিক বদল ঘটাতে চাইছে তাদের পররাষ্ট্রনীতির। যে ভারত যুগের পর যুগ জোটনিরপেক্ষ নীতিতে এগিয়েছে সেই ভারত হঠাৎ করে আমেরিকার দিকে এত ঘন হয়ে ঝুঁকছে কেন? কারণ;-

এক. ভারত আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আরও শক্তিমান ভূমিকা রাখতে চায়। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে স্থায়ী সদস্য হতে খুবই আগ্রহী ভারত। ভারতের উচ্চাকাঙ্ক্ষা

দক্ষিণ এশিয়ার মুরুব্বি হিসেবে নিজের ভূমিকাকে টেকসই করা। আর্থিক ও সামরিক শক্তিতে চীনকে ঠেকিয়ে আরও উঁচুতে উঠতে চায় ভারত। ভারতের এই অগ্রযাত্রায় চাই একজন শক্তিমান পরাশক্তির প্রত্যক্ষ মদদ। রাশিয়ার সেই রমরমা অবস্থা আর নেই। তাই পুরনো বন্ধু রাশিয়াকে পেছনে ফেলে এখন আমেরিকার বন্ধুত্ব তার চাইই চাই। সে কারণেই প্রায় ন্যাটো সদস্যদের মর্যাদা নিয়েই আমেরিকার সাথে সামরিক ও বাণিজ্যিক গাটছড়া বাঁধতে দরজা খুলে দিয়েছে ভারত।

দুই. উদারনৈতিক অর্থব্যবস্থার আওতায় নতুনধারার অর্থনীতিতে বিদেশি বিনিয়োগ পেতে আগ্রহী ভারত। নরেন্দ্রমোদির ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ আওয়াজ আমেরিকান ঘরানার ইন্টেলেজেনসিয়ার মাথা থেকেই আসা। ভারতে আসো , বিনিয়োগ করো , বাজার বাড়াও এই খোলা নীতির আওতায় প্রচলিত শিল্পায়নের বাইরে সমরাস্ত্র বাণিজ্যের বিকাশমান বাজারে ঢুকতে চায় ভারত। সে কারণেই তার দরকার একটা পরাশক্তি বন্ধু। প্রয়োজন শক্তিমান অংশীদার। সেই প্রয়োজনই তাই অবশ্যম্ভাবি করে তুলেছে আমেরিকার সহায়তা। সেটা পেতেই ভারত তার আকাশ , নৌ, স্থল আমেরিকাকে খুলে দিতে মনস্থির করেছে।

তিন. /১১এর পর পৃথিবীব্যাপী ইসলামি জঙ্গিবাদের বিস্তার ঘটেছে । দক্ষিণ এশিয়া তার ব্যতিক্রম নয়। এই ইসলামোফোবিয়ার বিরুদ্ধে ‘ওয়ার অন টেরর’ লড়াইকে একটা বাণিজ্যিক চেহারা দিতে পেরেছে আমেরিকা। এই বাণিজ্য থেকে সুবিধা নিতে চায় ভারত। সেখানেও আমেরিকার সাথে গাঁটছড়া বাধার একটা আপাত লাভ আছে। সেটাকে কাজে লাগিয়েছে ভারত। আমেরিকান মিত্রতার সেটাও একটা বড় কারণ।

চার. ভারতের অর্থনৈতিক চেহারা বড় হচ্ছে। তার সাথে বাড়ছে ভারতের রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষাও। প্রতিবেশি দেশগুলোর ওপর এক ধরণের প্রভাব বিস্তারের আকাঙ্ক্ষা ভারতের প্রকাশ্য। নেপাল, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে ভারত সেই সামর্থ্য দেখিয়েছে। আঞ্চলিক শক্তি ভারত ক্রমশ আন্তর্জাতিক শক্তি হয়ে উঠতে আকাঙ্ক্ষি। এই আকাঙ্ক্ষার টেকসই বাস্তবায়ন দেখতে হলে অর্থনীতি ও রাজনীতিতে ভারতকে আরও বড় হয়ে ওঠতে হবে। এই বড় হয়ে ওঠার জন্যও দরকার আমেরিকার মতো মিত্রের ঘন সান্নিধ্য।

০৫.

একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় আমেরিকামুখিনতাই এখন ভারতের অভীষ্ট লক্ষ্য। এর পরিণাম কী , এর ভালোমন্দ কী সেটা নিয়ে ভাবনার অবকাশ আছে। ভারতীয় রাজনীতিতে বিশেষত রাষ্ট্রক্ষমতায় কট্টর মৌলবাদী হিন্দুত্ববাদ জায়গা নিয়েছে। ভারতীয় প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতায় হিন্দু মৌলবাদের বড় ধরনের উত্থান ঘটেছে। ভারতের রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ সর্বত্র এই র‌্যাডিকালাইজেশন বা জঙ্গিত্ব প্রাতিষ্ঠানিক শক্ত ভিত পেয়েছে। এই কট্টরপন্থা ভারতের অর্থনীতি, রাজনীতি ও সমাজকে কতটা টেকসই সুস্থিরতা দেবে সেটাও বিবেচ্য। এই ক্ষত নিয়ে আমেরিকান মিত্রতা ভারতকে আগামী দিনে কতোটা খুশিতে রাখবে তা বলা মুশকিল। তবে আপাতত এটুকু বলা যায় আমেরিকামুখী ট্রেনে ভারতের এই নবযাত্রা চলবে জোরেই। বেশ জোরেই।

সূত্রঃ বাংলা ট্রিবিউন, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৬

পাকিস্তানি বুদ্ধিজীবীর চোখে মীর কাসেম আলীর ফাঁসি

mir-kasem-hanged-artপারভেজ হুদভয় : পাকিস্তানের পররাষ্ট্র দপ্তর বলেছে, বাংলাদেশে মীর কাসেম আলীর ফাঁসি কার্যকরের ঘটনায় পাকিস্তান ‘গভীরভাবে মনঃক্ষুণ্ন’। নির্যাতন, একাধিক হত্যা এবং অগ্নিসংযোগের অভিযোগে মীর কাসেম ২০১৪ সালে বাংলাদেশের একটি আদালতে দোষী সাব্যস্ত হন। তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। তবে পাকিস্তান ওই বিচারপ্রক্রিয়াকে ‘ত্রুটিপূর্ণ’ আখ্যা দিয়েছে।

কিন্তু পাকিস্তান কেন বাংলাদেশের বিচারিক প্রক্রিয়ার শুদ্ধতা নিয়ে এতটা চিন্তিত? আর কেনইবা পাকিস্তান সরকার আরেক দেশের নাগরিকের মৃত্যুদণ্ডে এতটা গুরুত্ব দেয়, যিনি কিনা জঘন্য অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত? উত্তরটা হলো বাংলাদেশের প্রসঙ্গ উঠলে পাকিস্তান নিজের অতীতে আটকা পড়ে থাকে।

পাকিস্তানি পররাষ্ট্র দপ্তর কেন এ রকম কঠোর বক্তব্য দিয়েছে, তার ব্যাখ্যা কেবল একজন মানুষের জীবন নিয়ে অবাস্তব উদ্বেগের মধ্যে মেলে না। বিশ্বজুড়ে অগণিত মানুষের মৃত্যুদণ্ড হচ্ছে। আর সেগুলো গতানুগতিক বলেই গণ্য হয়। পাকিস্তানের সামরিক ও বেসামরিক প্রতিষ্ঠানগুলো এসবের ভয়াবহতা নিয়ে উচ্চবাচ্য করে না। সত্যিটা হলো, পাকিস্তানের নিজ নাগরিকেরা বিদেশি ভূখণ্ডে নিহত হচ্ছেন। অথচ সে বিষয়ে নীরবতা লক্ষণীয়। সৌদি আরবে কতজন পাকিস্তানির শিরশ্ছেদ হয়েছে, সেই দীর্ঘ তালিকার কথা ভেবে দেখুন। মাদক চোরাচালানের অভিযোগে নামকাওয়াস্তে আদালতে তাঁদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশের বিচারিক প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতার প্রশ্নে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এবং অন্যান্য শীর্ষস্থানীয় মানবাধিকার সংগঠন জোরালো উদ্বেগ জানিয়েছে। তারা বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধের বিচারপ্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। এসবের মধ্যে রয়েছে মামলার প্রস্তুতির জন্য আসামিপক্ষের আইনজীবীদের পর্যাপ্ত সময় না দেওয়া এবং সাক্ষীর সংখ্যা ইচ্ছামতো সীমিত রাখার অভিযোগের বিষয়গুলো। তবে পাকিস্তান বাংলাদেশে অস্বচ্ছ বিচারের অভিযোগ করতে পারে না। কারণ, পাকিস্তানের নিজস্ব বিচারব্যবস্থার ভিত আরও বেশি নড়বড়ে।

বাংলাদেশের সঙ্গে তুলনা করা যাক। দেশটিতে যুদ্ধাপরাধের বিচার হচ্ছে একটি বেসামরিক আদালতে। কিন্তু পাকিস্তানে যেসব বেসামরিক মানুষ রাষ্ট্রবিরোধী কার্যক্রমের দায়ে অভিযুক্ত, তাঁদের বিচার হচ্ছে রুদ্ধদ্বার সামরিক আদালতে। তাঁদের পছন্দমতো আইনজীবী নিয়োগেরও সুযোগ দেওয়া হয় না। সামরিক আদালতের নথিপত্র দেখার সুযোগও কারও নেই। এটা বিচারিক স্বচ্ছতার আধুনিক ধ্যানধারণার সঙ্গে সম্পূর্ণ অসংগতিপূর্ণ।

মীর কাসেমের বিচার এবং মৃত্যুদণ্ড নিয়ে পাকিস্তানের মাথাব্যথার কারণ একটিই। আর সেটা হলো তিনি পাকিস্তানপন্থী মিলিশিয়া বাহিনী আলবদরের সাবেক প্রধান ছিলেন। আলশামস ও রাজাকার বাহিনীর সঙ্গে আলবদরও পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছিল। তারা ১৯৭১ সালের বিদ্রোহ দমনের জন্য অহেতুক বর্বর চেষ্টা চালায়। ওই ঘটনায় পাকিস্তানের ঐক্যে ভাঙন ধরে এবং পূর্ব পাকিস্তান নামের ভূখণ্ডটি স্বাধীন বাংলাদেশে রূপ নেয়।

মীর কাসেম একা নন। যুদ্ধাপরাধের দায়ে ২০১৩ সালের ডিসেম্বর থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশে পাঁচজন সুপরিচিত ইসলামি নেতার ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। ১৯৭১ সালে ওই মিলিশিয়া নেতাদের কার্যকলাপ যাই হোক না কেন, পাকিস্তানের কর্তৃপক্ষ তাঁদের পাশে দাঁড়ানোর প্রয়োজন অনুভব করে। কারণ, দ্বিজাতি তত্ত্বে দেশটি আদর্শিকভাবে অটল রয়েছে।

আমি যেমনটা স্কুলে শিখেছি, পাকিস্তান সৃষ্টির জন্য দ্বিজাতি তত্ত্ব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এ তত্ত্বের দুটি গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তির প্রতি নজর দেওয়া যাক। প্রথমত, মুসলিম ও হিন্দুরা মৌলিকভাবে ভিন্ন এবং অবশ্যই হিন্দুদের পাকিস্তান ছেড়ে চলে যেতে হবে। কারণ, এটা মুসলিমদের দেশ। দ্বিতীয়ত, বিশ্বের মুসলিমরা একক জাতি (উম্মাহ)। স্থানীয় গোষ্ঠী, ভাষা ও সংস্কৃতিগত ব্যবধানের বাধা অতিক্রমের শক্তি এর আছে।

প্রথম বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক বা নতুন করে মূল্যায়নের প্রয়োজন এখন নেই। কারণ, পাকিস্তান ও ভারত পৃথক দুটি রাষ্ট্র হিসেবে নিজ নিজ পথ বেছে নিয়েছে। পাকিস্তানের হিন্দু জনসংখ্যা কমতে কমতে ১ বা ২ শতাংশে নেমে এসেছে এবং আরও কমছে।

একটি ক্ষুদ্র, নিপীড়িত এবং আতঙ্কিত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী হিসেবে জনজীবনে তাদের কোনো ভূমিকা নেই।

দ্বিতীয় বিষয়টি অবশ্যই ১৯৭১ সালের ঘটনাবলির আলোকে বিবেচনা করতে হবে। পাকিস্তানের সরকার এবং জিহাদি সংগঠনগুলোর (টিটিপি, আলকায়েদা এবং ইসলামিক স্টেটের মধ্যে রক্তাক্ত সংঘাত চলছে। এছাড়া দুই মুসলিম প্রতিবেশী আফগানিস্তান ও ইরানের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক ভালো নয়। এতে এটা স্পষ্ট যে ইসলামি সংহতি এ ক্ষেত্রে যথেষ্ট কার্যকর নয়। মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে চলছে ভ্রাতৃঘাতী লড়াই। ইরানিরা মুসলিমই নয় বলে সৌদি আরবের প্রধান মুফতি সম্প্রতি ঘোষণা দিয়েছেন।

অন্যদিকে দৃঢ় হচ্ছে সৌদিইসরায়েলি মৈত্রী। এসব বিষয় যেন ইঙ্গিত দিচ্ছে, উম্মাহ একটি সংশয়পূর্ণ ধারণা।

তারপরও বলতে হয়, ১৯৭১ সালে দ্বিজাতি তত্ত্ব অকার্যকর হওয়ার পরও পাকিস্তান যে নিজেকে দ্রুত নবায়ন করতে পেরেছিল তা তার কৃতিত্ব। আর এটি করার সময় পাকিস্তান বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করে, যেসব আদর্শের ভিত্তিতে তার সৃষ্টি হয়েছিল, সেগুলোর মুখাপেক্ষী না হয়েও সে কেবল টিকে থাকা নয়; এগিয়ে যেতেও সক্ষম।

আজকের পাকিস্তানও বিশ্ব মুসলিম ঐক্যের পক্ষে গলাবাজি চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কার্যত বাস্তবতা এবং জাতি গঠনের অগ্রাধিকারই ক্রমে বেশি করে এর চরিত্রকে প্রভাবিত করছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, চীনপাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডর নিয়ে পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন মহল খুব উৎসাহিত। অথচ চীন একটি কমিউনিস্ট রাষ্ট্র এবং সেখানে মুসলিম জীবনাচার সুস্পষ্টভাবেই এড়িয়ে চলা হয়।
দ্বিজাতি তত্ত্বকে পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে যাওয়ার এখনই সময়। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে দ্বিজাতি তত্ত্বই পাকিস্তান সৃষ্টি করেছে। তবে এই তত্ত্ব বর্তমানে পরিহার করা হলে কোনো ক্ষতি নেই। টিকে থাকার জন্য জাতিরাষ্ট্রের কোনো তত্ত্বের প্রয়োজন পড়ে না। উদাহরণ হিসেবে আর্জেন্টিনা এবং নেদারল্যান্ডসের কথা তোলা যায়। সেখানে কোনো জাতীয় ভাবাদর্শ নেই, কিন্তু দেশ দুটি তাদের মতো করে স্থিতি ও উন্নতি অর্জন করছে।

পাকিস্তানকে বুঝতে হবে, পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যকার ভাষাগত, জাতিগত এবং সাংস্কৃতিক বৈপরীত্যের জন্য ভারত দায়ী ছিল না। এক মায়ের গর্ভে জন্ম নেওয়া দুটি ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের সন্তানের মতো আমাদেরও ভিন্নতা ছিল। দীর্ঘ সময় পর্যন্ত একত্রে থাকার সুযোগ আমাদের আসলেই ছিল না। এর পাশাপাশি ভুল শাসনের কারণে ওই সম্পর্ক আরও দ্রুত ভেঙে পড়ে।

জুলফিকার আলী ভুট্টোর মন্তব্য ইধার হাম, উধার তুম (আমরা এ প্রান্তে, তোমরা ওই প্রান্তে) অঞ্চল দুটির বিভক্তির ইঙ্গিত করেছিল।
জন্মের সময়ের খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে আটকে থাকা বাংলাদেশের ভবিষ্যতের জন্য মঙ্গলজনক হবে না। যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে তৃপ্তি পাওয়া যেতে পারে, কিন্তু এর দ্বারা শান্তি, স্থিতি ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। বরং অতীতের বেদনাময় ওই অধ্যায়কে বন্ধ করে সামনে এগিয়ে যাওয়ার এখনই সময়।

এ ক্ষেত্রে পাকিস্তানের দায়িত্ব বাংলাদেশের তুলনায় বেশি। পাকিস্তানের উচিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ভুল ইতিহাস পড়ানো বন্ধ করা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে পড়ানো ইতিহাসে পূর্বের বাঙালিদের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানের নৃশংসতার ঘটনা এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। বরং সেখানে যুদ্ধাপরাধের ঘটনাকে সমর্থন করা হয়েছে এবং ১৯৭১এর ঘটনাকে অস্বীকার করা হয়েছে। পাকিস্তানের উচিত বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করা। এ ক্ষেত্রে সত্য এবং মীমাংসাই কাম্য।

পারভেজ হুদভয়: পদার্থবিদ্যা ও গণিত বিষয়ের অধ্যাপক।

সূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো, ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৬

রাজনীতিতে বাঙালী চরিত্র

design-58আবুল কাসেম ফজলুল হক : বাংলাদেশের রাজনৈতিক উন্নতি কেবল কামনা করলেই হবে না। তার জন্য সাধনা ও সংগ্রাম লাগবে। ইংরেজ শাসন থেকে স্বাধীনতা লাভের জন্য, পাকিস্তান থেকে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য যে রকম প্রচেষ্টা লেগেছিল এবং বাংলাদেশের রাজনীতিকে সুস্থ, স্বাভাবিক, প্রগতিশীল ধারায় উত্তীর্ণ করার জন্য তার চেয়ে কম প্রচেষ্টা লাগবে—এমনটা ভাবা যায় না।

এ দেশে রাজনীতিকে সাধারণত যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয় না। যখন কোনো ব্যক্তি অন্য কোনো ব্যক্তিকে বলেন, ‘আপনি আমার সঙ্গে রাজনীতি করছেন’ তখন ওই ব্যক্তি ‘রাজনীতি’ কথাটাকে ‘ধূর্ততা’ কিংবা ‘প্রতারণা’ অর্থে ব্যবহার করেন। ‘যে লঙ্কা যায়, সেই রাবণ হয়’—এই কথাটি এ দেশে যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। লঙ্কা বলতে রাষ্ট্রক্ষমতা এবং রাবণ বলতে দুঃশাসক বোঝানো হয়। ‘হুজুগে বাঙালি’ কথাটাও বাঙালির রাজনৈতিক চরিত্রের প্রতি কটাক্ষ। ‘বাঙালি ঈর্ষাপরায়ণ, পরশ্রীকাতর’—এ কথাও চালু আছে। বাঙালিকে বলা হয় ‘কলহপ্রবণ, ঝগড়াটে’। বাঙালির ইতিহাসে যাঁরা খুব আগ্রহী হয়েছেন তাঁরা বলেছেন, ‘বাঙালির সঙ্গশক্তি হয় না।’ বাঙালি অভিহিত হয়েছে ‘আত্মবিস্মৃত’, ‘আত্মভ্রষ্ট’, ‘আত্মঘাতী’ বলে। বাঙালিকে অনেকেই বলেছেন আত্মকেন্দ্রিক, সমাজবিমুখ, উগ্র, অসহিষ্ণু, নেতিপ্রবণ (কেবল প্রতিবাদপ্রতিরোধে আগ্রহী, গঠনমূলক চিন্তায় অনীহ), তর্কপ্রবণ, রঙ্গপ্রিয়, ভোগলিপ্সু, কর্মকুণ্ঠ, অলস, ভীরু, ভাবালু। বাঙালি মস্তিষ্কের উর্বরতা ও অপব্যবহার সম্পর্কেও বলা হয়েছে অনেক কথা।

বাঙালি সম্পর্কে এসব কথা বলা হয়েছে বিশেষ বিশেষ ব্যর্থতার পটভূমিতে আবহমান কালের ইতিহাসকে সামনে নিয়ে। কিন্তু ইতিহাসের সব পর্যায়ে বাঙালি চরিত্রকে এক রকম দেখা যায় না। কোনো জাতির জাতীয় চরিত্রই ইতিহাসের সব পর্যায়ে এক রকম থাকে না। প্রতিটি ঐতিহাসিক কালেরই স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য থাকে। কোনো কোনো ঐতিহাসিককালে কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাঙালি উন্নত মানসিকতার ও অসাধারণ সৃষ্টিশক্তিরও পরিচয় দিয়েছে। বাঙালি চরিত্রে অনেক প্রশংসনীয় বৈশিষ্ট্যও আছে। প্রগতির জন্য ভালো দিকগুলোতেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া দরকার এবং মহৎ সম্ভাবনা খোঁজ করা দরকার।

বাংলা ভাষার লেখকরা এবং হিন্দুমুসলমান সমাজসংস্কারকরা জনসাধারণের ওপর গভীর আস্থা নিয়ে লিখতেন এবং কাজ করতেন। মধুসূদন, বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, শরত্চন্দ্র, বেগম রোকেয়া, কাজী আবদুল ওদুদ, নজরুল ইসলাম, জসীমউদ্দীন বাংলার মানুষের অন্তহীন শক্তি ও সম্ভাবনায় আস্থাশীল ছিলেন বলেই সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন বিস্ময়কর রকম সুন্দর ও কল্যাণকর সাহিত্য। বাংলার মানুষের সরলতা ও শুভবুদ্ধিতে তাঁরা মুগ্ধ ছিলেন। চিত্তরঞ্জন দাশ, সুভাষচন্দ্র বসু, এ কে ফজলুল হক, মওলানা ভাসানী, শেখ মুজিবুর রহমান বাংলার জনসাধারণের শক্তি ও সম্ভাবনার ওপর সম্পূর্ণ আস্থাশীল ছিলেন। জনগণের সমর্থন তাঁরা লাভ করেছিলেন। জনজীবনে তাঁরা দীর্ঘস্থায়ী প্রভাবও বিস্তার করে গেছেন। অবশ্য তাঁরা কেউ স্বজ্ঞানে বাঙালি জাতির মূল রাজনৈতিক প্রবণতার ও জাতীয় চরিত্রের পরিবর্তন সাধনের কথা ভাবেননি। তবে তাঁদের নেতৃত্বের মধ্য দিয়ে বাঙালির জাতীয় চরিত্রের ঘনীভূত প্রকাশ ঘটেছে। জাতীয় চরিত্র গঠনে তাঁদের প্রত্যেকেরই অসাধারণ প্রভাব আছে।

বাঙালি চরিত্র নিয়ে যাঁরা গভীরভাবে চিন্তা করেছেন, তাঁদের অনেকেই বলেছেন : সাধারণ বাঙালি দল গঠনে ও নেতৃত্ব সৃষ্টিতে অনীহ, তারা স্বভাবত আত্মকেন্দ্রিক, ব্যক্তিতান্ত্রিক, egocentric, egoistic তাদের সামাজিক চেতনা ও সামাজিক গুণাবলি কম, তারা নিজেরা নিজেদের মধ্য থেকে নিজেদের জন্য নেতৃত্ব সৃষ্টি করতে পারে না, তাদের মধ্যে যারা যোগ্য, তারা কেউ কাউকে মানতে চায় না। আমরা দেখতে পাই, উত্তেজনার সময় সভাসমাবেশে শামিল হওয়ার, আর এক দলের পক্ষে ও অন্য দলের বিপক্ষে সরব হওয়ার বাইরে সাধারণত অন্য কোনো প্রকার রাজনৈতিক দায়িত্বের কথা এ দেশের লোকে ভাবতে চায় না। লোকে হীন স্বার্থান্বেষী ধূর্ত লোকদের তৈরি করা হুজুগে সহজে মাতে। নেতৃত্ব সৃষ্টিতে সাধারণ মানুষেরও যে দায়িত্ব আছে, এই কথাটাও কেউ চিন্তা করতে চায় না। রাজনীতিকে নিরাপদ ভাবতে না পেরে সবাই রাজনৈতিক দায়িত্ব গ্রহণ থেকে দূরে থাকাকেই শ্রেয় জ্ঞান করে। কেবল হীন স্বার্থান্বেষীরা রাজনীতিতে এগিয়ে যায়। তবে কোনো কোনো ঐতিহাসিক পর্যায়ে অবস্থা অন্য রকমও দেখা গিয়েছে, এবং তখন বড় অর্জন সম্ভব হয়েছে। সভ্য জগতে বাঙালি টিকে আছে এবং তার উন্নতির সম্ভাবনা আছে।

ভালো অর্থে সমালোচনা ও আত্মসমালোচনার ঐতিহ্য নেই বাঙালির রাজনৈতিক ইতিহাসে। ভুলত্রুটি স্বীকার করার ও সংশোধন করার প্রবণতা এ দেশের রাজনীতিতে এখন দুর্লভ। সামরিক শাসনের জন্য রাজনীতিবিদরা, শাসক শ্রেণির বুদ্ধিজীবীরা এবং  সাধারণ লোকও কেবল সেনাপতিদের ক্ষমতালিপ্সাকেই দায়ী করেন, রাজনৈতিক নেতাদের রাজনৈতিক দলগুলোর ও রাজনীতির দুর্বলতাকে বিবেচনায়ই ধরেন না।

১৯৮০এর দশকের শুরু থেকে সিভিল সোসাইটি অর্গানাইজেশনগুলো রাজনীতিবিদদের দুর্বলতা, ত্রুটিবিচ্যুতি ও অনুচিত কাজের সুযোগ নিয়ে সব ধরনের রাজনীতির ও সব ধরনের সরকারি কার্যক্রমের বিরুদ্ধে ক্রমাগত প্রচার চালিয়ে সাধারণভাবে রাজনীতির প্রতিই জনসাধারণের মনকে বিষিয়ে দিয়েছে। এ কাজে বিবিসি রেডিও অত্যন্ত সক্রিয় ও কার্যকর ভূমিকা পালন করেছে। বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা, সিএনএন, স্কাই নিউজ, আলজাজিরা—এসব প্রচারমাধ্যম বাংলাদেশের স্বার্থে নয়, পশ্চিমা বৃহৎ শক্তিবর্গের বিশ্বগ্রাসী কার্যক্রমের সাফল্যের জন্য কাজ করে। এ কাজের জন্য দেশেবিদেশে তাদের সংবাদপত্র, সাময়িকপত্র ও গবেষণাপত্রও আছে।

আর অন্তর্বর্তীকালীন অরাজনৈতিক, নির্দলীয়, নিরপেক্ষ, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাধ্যমে জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠানের যে ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়েছিল, তার সূত্র ধরে বাংলাদেশের নির্বাচন প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়ে পড়ে ইউরোমার্কিন আধিপত্যবাদীরা। সংবিধানের সংশোধন (২০১১) দ্বারা অন্তর্বর্তীকালীন অরাজনৈতিক নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যবস্থা বিলুপ্ত করার পরেও আগের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিদেশি শক্তি সক্রিয় আছে। বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, রাজনীতির ভেতরে রাজনীতি শেষ হয়ে যাচ্ছে এবং রাষ্ট্রের সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়ে পড়েছে। রাষ্ট্র ও রাজনীতি সম্পর্কে জনমনে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। সরকার ও আওয়ামী লীগ, বিএনপি প্রভৃতি রাজনৈতিক দল জাতীয় সংসদের নির্বাচন করার সামর্থ্যও রাখে না। এ অবস্থায় ইউরোমার্কিন আধিপত্যবাদীরা বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সব ব্যবস্থার ওপর কর্তৃত্ব নিয়ে নিয়েছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে কর্তৃত্ব বিস্তারের এই কার্যক্রমে ভারতও এখন তত্পর হয়েছে। আমাদের বুঝতে হবে যে রাজনীতি ও রাষ্ট্রব্যবস্থার স্বাধীনতা ও উন্নতি ছাড়া কোনো জাতি উন্নতি করতে পারে না।

বাঙালি চরিত্রকে উন্নত করতে হলে বৈদিক যুগের আর্য ঋষিদের থেকে একালের চিন্তাশীলদের পর্যন্ত, দেশিবিদেশি যে মনীষীরা বাঙালি চরিত্র সম্পর্কে মতামত প্রকাশ করেছেন, তাঁঁদের সবার মতামতকেই যথোচিত গুরুত্ব দিয়ে বুঝতে হবে, এবং বিচারবিবেচনা করে উন্নত নতুন ভবিষ্যৎ সৃষ্টির উপযোগী নতুন দৃষ্টিভঙ্গি, নতুন কর্মসূচি, নতুন কর্মনীতি ও কার্যক্রম অবলম্বন করতে হবে। ইতিহাসের শিক্ষাকে যথোচিত গুরুত্ব না দিয়ে কখনো উন্নতির ধারায় উত্তীর্ণ হওয়া যাবে না। Neoliberalism-এর কার্যধারাকে পর্যায়ক্রমে পরিহার করতে হবে এবং স্বাধীনতা ও প্রগতির অনুকূল নীতিমালা ও কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে।

ইতিহাসে দেখা যায়, এ দেশে স্থানীয়ভাবে কিংবা জাতীয়ভাবে যখন মানুষ খুব বিপদে পড়েছে তখন কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে কিংবা অভ্যুত্থানে ফেটে পড়েছে। অবস্থার চাপে বাধ্য হয়ে সাময়িকভাবে মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগেও মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। কিন্তু অবস্থার প্রবল চাপ যখন থাকেনি, তখনই ঐক্যের স্থলাভিষিক্ত হয়েছে কলহকোন্দল, ঈর্ষাবিদ্বেষ, চক্রান্ত, ষড়যন্ত্র, অনৈক্য, বিভে`| Live and let other & live, Love and be loved, peaceful co-existence—এসব বোধ বাঙালি জীবনে অল্পই দেখা গেছে। গণবিক্ষোভ ও গণঅভ্যুত্থানের প্রকৃতির সঙ্গে নেতৃত্বের প্রকৃতি বিচার করলে তাতেও রাষ্ট্রচিন্তা ও রাজনীতির দুর্বলতারই পরিচয় পাওয়া যায়। বিপ্লববাদী আন্দোলন, স্বদেশি আন্দোলন, অসহযোগ আন্দোলন, মার্ক্সবাদী আন্দোলন, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, একাত্তরের স্বাধীনতাযুদ্ধ এবং পরবর্তীকালের স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভ ও আন্দোলনগুলোর মতো বিরাট সব ঘটনার ও সংশ্লিষ্ট নেতৃত্বের চরিত্র বিচার করলে মূলত এটাই বোঝা যায়। যুদ্ধ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মহামারি, বন্যা ইত্যাদির মধ্যে জনচরিত্রের যে পরিচয় প্রকাশ পায়, তাতে জনচরিত্রের সামান্য অংশই বোঝা যায়। জনচরিত্রকে বোঝার জন্য আপত্কালীন আচরণের চেয়ে সাধারণ অবস্থার আচরণ অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

প্রাচীনকাল থেকেই এ দেশের মানুষ সঙ্গশক্তি গড়ে তোলায় নেতৃত্ব সৃষ্টিতে ও রাষ্ট্র গঠনে দুর্বলতার পরিচয় দিয়ে আসছে। এই দেশটাকে মধ্যযুগে শাসন করেছে তুর্কিপাঠানমোগলরা; আধুনিক যুগে ইংরেজরা; সবাই বিদেশি, বিভাষী, বিজাতি, বিধর্মী, বিজয়ী। পাকিস্তান আমলেও বাঙালিদের ওপর কৃর্তত্ব করেছে পাঞ্জাবিরা। বাংলাদেশকালে কী দেখা যাচ্ছে? রাজনীতিকে করে তোলা হয়েছে বৃহৎ শক্তিবর্গের স্থানীয় দূতাবাসগুলোর অভিমুখী। এ দেশের মানুষ নিজেরা, নিজেদের থেকে, নিজেদের জন্য কল্যাণকর নেতৃত্ব সৃষ্টি করতে পারছে না। এ রকম রাজনৈতিক নেতৃত্ব নিয়ে কোনো রাষ্ট্রের সার্বিক উন্নতি অসম্ভব। উন্নত রাজনৈতিক নেতৃত্ব সৃষ্টি করতে হবে। তার জন্য নতুন চিন্তা ও নতুন আয়োজন লাগবে।

যাঁরা এখন ক্ষমতায় আছেন, দেশের রাজনৈতিক অবস্থা নিয়ে তাঁদের যথেষ্ট সন্তুষ্ট দেখা যায়। যেসব দল এখন জাতীয় সংসদে নেই, তাদের মধ্যে চলমান রাজনীতি নিয়ে অসন্তোষ দেখা যায়। তারা পরিবর্তন চায়। কিন্তু তাদের রাজনৈতিক আচরণে কেবল দুর্বলতাই প্রকটিত হয়। দুর্বলরা প্রবলদের সঙ্গে পারে না। বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে অধিকাংশই এনজিও ও সিএসওতে সক্রিয়। তাঁদের রাজনৈতিক চিন্তায় ও রাজনৈতিক তত্পরতায় বাংলাদেশ নিঃরাজনীতিকৃত হয়। নিঃরাষ্ট্রকরণের (anarchism) কার্যক্রম চালাচ্ছে বিশ্বায়নবাদীরা। বিশ্বায়ন তো সাম্রাজ্যবাদেরই উচ্চতর স্তর। বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল, ন্যাটো, জিসেভেন, বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়—এগুলোই তো বিশ্বায়নের কর্তৃপক্ষ। বাংলাদেশে যে রাজনৈতিক অবস্থা চলছে, তাতে রাজনীতির উন্নতি গতানুগতিক চিন্তা ও গতানুগতিক কাজ দিয়ে হবে না।

সূত্রঃ দৈনিক যুগান্তর, ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৬