বিনা বেতনে ১৫ বছর পড়ানো
তিস্তার চরে বিনা বেতনে দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে শিক্ষার আলো ছড়াচ্ছেন মোসলেম উদ্দিন। কোনো দিন স্কুল কামাই দেননি। সবার আগে স্কুলে যান, বের হন সবার পরে। এই আলোর দিশারির গল্প বলছেন রায়হান রাশেদ
বাড়ি তাঁর লালমনিরহাটের কালীগঞ্জের ভোটমারী ইউনিয়নের শৌলমারী গ্রামে। বয়স ৮০ ছুঁইছুঁই। ১৯৬৯ সালে কালীগঞ্জের হাজরানিয়া দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক (এসএসসি) পাস করেন। অভাবের কারণে নিয়মিত পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারেননি।
মানুষের জমিতে কাজ করে টাকা-পয়সা জমিয়ে পড়তেন।
মোসলেম উদ্দিনের দুই ছেলে ও চার মেয়ে। চরে সে সময় উচ্চ বিদ্যালয় ছিল না। তা ছাড়া অভাব তো পিছু ছাড়েনি। ফলে সন্তানদেরও বেশিদূর পড়াতে পারেননি। ‘মুই (আমি) যখন স্কুলে যাং (যাই), তখন শৌলমারী চরৎ আর কোনো স্কুল আছিল নাহ। বালুর মধ্য দিয়ে হাঁটি ছয় কিলোমিটার দূরে যায়া উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়ি আসছিনুং। সংসারে অভাবও আছিল সেই সময়। লেখাপড়া ওই পর্যন্ত।’ রংপুরের আঞ্চলিক ভাষায় বললেন মোসলেম।
স্কুলের জন্য মানুষের দ্বারে দ্বারে গিয়েছেন
তিস্তার এই দুর্গম চরে মাধ্যমিক বিদ্যালয় না থাকায় প্রাথমিকের পর বেশির ভাগ ছেলেমেয়ে ঝরে পড়ত। মোসলেম মাঠে কাজ করতেন আর সন্ধ্যায় শিশু-কিশোরদের অক্ষরজ্ঞান শেখাতেন। পাড়ার ঘরে ঘরে খোঁজ নিতেন।
কিশোরদের দেখলেই পড়তে যেতে বলতেন। কাউকে কাউকে কানমলা দিয়ে বলতেন, ‘কাল থেকে স্কুলে যাবি। পড়তি আসবি।’ তবে গ্রামে উচ্চ বিদ্যালয় না থাকায় প্রাইমারির পর ছেলেমেয়েদের তেমন জোর দেওয়া যেত না। মোসলেম স্বপ্ন দেখতেন, গ্রামে একটি উচ্চ বিদ্যালয় হবে। ছেলেমেয়েরা আর ঝরে পড়বে না। কিন্তু তাঁর নিজের তো স্কুল করার মতো সামর্থ্য নেই।
গ্রামবাসীকে ডেকে স্কুলের কথা বলতেন। এক সময় এলাকাবাসীও বুঝল স্কুলের গুরুত্ব। সবার আগ্রহে উবা নামের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান গ্রামে স্কুল করার উদ্যোগ নেয়। সহযোগিতার হাত বাড়ান বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান। স্কুলের নাম ‘নদী ও জীবন নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়’।
মোসলেম সেই স্কুলের জন্য দিনরাত খেটেছেন। পাড়ায় পাড়ায় গিয়ে ধান, ভুট্টা সংগ্রহ করতেন। সেগুলো বেচে মিস্ত্রিদের মজুরি দিতেন। মিস্ত্রিদের সঙ্গে গায়েগতরেও খাটতেন। স্কুলঘর নির্মাণের পর ঘরে ঘরে গিয়ে শিক্ষার্থী নিয়ে আসতেন। বললেন, ‘আমার তো টেকা নেই, গতর দিয়া খাটছি। স্কুল প্রতিষ্ঠার সময় মুই মানুষের বাড়িত গিয়া ধান, ভুট্টা কালেকশন করি আনছং। তারপর সেগুলে বেচিয়া মিস্ত্রিক টাকা দিছি। মিস্ত্রির সাথে কাজ করি স্কুলটাকে সাজাইছি। মানুষের বাড়িত যায়া ছওয়া-পোয়াগুলেক বুঝিয়া স্কুলে ডাকে আনছি। তখন তিনশত ছওয়া-পোয়া আছিল। এখন এতগুলে নাই। ভালো শিক্ষক নাই। তাই আর কি ছওয়াগুলেও অন্য স্কুলে চলি গ্যাইছে।’ ২০০৮ সালে চালু হওয়া বিদ্যালয়টিতে এখন ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানো হয়। শিক্ষার্থী ১৩৯ জন। শিক্ষক ৯ জন। বিদ্যালয়টি এখনো এমপিওভুক্ত হয়নি।
বিনা বেতনের মাস্টার
শুরুর দিকে খুব উৎসাহের সঙ্গে চললেও ধীরে ধীরে বিদ্যালয়টিতে লেখাপড়ার মান নিম্নগামী হতে শুরু করে। মোসলেম একদিন স্কুলে শিক্ষকদের সঙ্গে মতবিনিময় করলেন। সপ্তম শ্রেণিতে গিয়ে দেখলেন, শিক্ষার্থীরা গল্প করছেন। জানলেন, ইংরেজি স্যার আসেননি। তিনি প্রায়ই আসেন না। শিক্ষার্থীদের জন্য মোসলেমের মায়া লাগে। তিনি বই নিয়ে পড়াতে থাকেন। শিক্ষার্থীরা খুশি হয়। পরদিনও মোসলেম স্কুলে গিয়ে ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণির ইংরেজি প্রথম ও দ্বিতীয় পত্রের ক্লাস নিলেন। তাঁর পাঠদানের আন্তরিকতায় মুগ্ধ শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা। সেই থেকে এভাবে টানা ১৫ বছর ইংরেজি পড়াচ্ছেন তিনি। বিনা বেতনে। ‘মুই শিক্ষার্থীদের কথা চিন্তা করি পড়াং। বেতন-ভাতার কথা চিন্তা করি না। ছওয়াগুলে আমাক দাদু কয়া ডাকায়। এতে মুই মেলা আনন্দ পাই।’ বললেন মোসলেম।
এখন মোসলেমের মন পড়ে থাকে স্কুলে। শিক্ষার আলো বিলাতেই ভালোবাসেন তিনি। বললেন, ‘অল্প অ্যাকনা জমি চাষাবাদ করি, গ্রামের বাড়িত প্রাইভেট পড়ায়ে সামান্য যা টাকা দেয়, সেইটা দিয়া কোনো রকম সংসার চালাই। গরিব শিক্ষার্থীদের কাছ থাকি টাকা নিই না। ছেলেমেয়েদের পড়বার পায়া মোর মেলা ভালো লাগে। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কাজটা করি যাবার চাং (চাই)।’
এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া মুশকিল
২০০৮ সাল থেকে এক দিনও স্কুল কামাই দেননি মোসলেম। ঝড়-বৃষ্টি কিংবা কাঠফাটা রোদ—কোনো কিছু আটকাতে পারেনি অদম্য এই মানুষটিকে। স্কুলে তিনি আসেন সবার আগে, যান সবার পরে। তাঁর প্রতি খুশি স্কুলের শিক্ষক, অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরা। সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী সোমাইয়া আক্তার বলল, ‘স্যার খুব ভালো পড়ান।’
মোসলেমের ছাত্র ছিলেন নজরুল ইসলাম। এখন তিনি কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী। বললেন, ‘স্যার খুব যত্ন নিয়ে আমাদের ইংরেজি পড়াতেন। তিনি তো চাকরি করেন না, মনের টানে স্কুলে আসেন।’ কুড়িগ্রামে ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়ছেন আজিজুল ইসলাম। বললেন, ‘স্যার অনেক ভালো মনের মানুষ। বিনা বেতনে এত বছর ধরে কেউ পড়াচ্ছেন, এমনটি কোথাও দেখিনি।’ কালীগঞ্জ কলেজে অনার্স পড়ুয়া আল আমিন বললেন, ‘তাঁর কাছে ২০১৬ সালে পড়েছি। স্যারের এখন অনেক বয়স হয়েছে। তবু শিক্ষার্থীদের টানে স্কুলে আসেন।’
তাঁরা বললেন
উত্তরাধিকার সূত্রে ৬০ বিঘা জমি পেয়েছিলেন। দুই বিঘা বাদে সবই গেছে পদ্মার পেটে। সেই জমিই তাঁর সম্বল। প্রাইভেট পড়িয়ে পান সামান্য কয়টি টাকা। এরই মধ্যে সন্তানদের বিয়ে দিয়েছেন। তাদের আলাদা সংসার। এখন অভাবেই কাটে মোসলেমের। কিন্তু এতে স্ত্রী বেনোয়ারা বেগমের খেদ নেই। তাঁর স্বামীকে সবাই সালাম দেয়, স্যার ডাকে, এতেই খুশি তিনি। বললেন, ‘উনাক সবাই মোসলেম উদ্দিন স্যার কয়া ডাকায়। তাতেই উনি খুশি, হামরাও খুশি।’
বিদ্যালয়টির পরিচালনা কমিটির সভাপতি মোবারক আলী বলেন, ‘বিদ্যালয়টি এমপিওভুক্ত না হওয়ায় শিক্ষকদের দুঃখ কাটছে না।’ প্রধান শিক্ষক মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘স্কুলে ইংরেজির শিক্ষক নিয়মিত আসেন না। এ অবস্থায় মোসলেম উদ্দিনই একমাত্র ভরসা।’
এই আলোর দিশারিকে নিয়ে ৩০ মে প্রচ্ছদ প্রতিবেদন ছাপা হয়েছিল কালের কণ্ঠ’র অবসরে পাতায়। শিরোনাম ‘বিনা বেতনে ১৫ বছর’। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অসংখ্য মানুষ প্রতিবেদনটি শেয়ার দিয়ে মোসলেমকে অভিনন্দন জানিয়েছে। সেই প্রতিবেদনের সূত্র ধরে ৩১ মে মোসলেমকে সংবর্ধনা দিল লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলা প্রশাসন। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জহির ইমাম বলেন, ‘কালের কণ্ঠে প্রকাশিত ফিচারটি আমার নজরে আসে। আমার উপজেলায় এমন একজন সাদা মনের মানুষ রয়েছেন জেনে খুবই ভালো লাগল।’ ৩১ মে উপজেলা পরিষদের মাসিক সভায় মোসলেম উদ্দিনের হাতে সম্মাননা স্মারক তুলে দেওয়া হয়েছে। নগদ পাঁচ হাজার টাকাও প্রদান করা হয়েছে।
সংবর্ধনা পেয়ে দারুণ খুশি মোসলেম। বললেন, ‘মুই শিক্ষার্থীদের কথা চিন্তা করি পড়াং। বেতন-ভাতার কথা চিন্তা করি না। এতে মুই মেলা আনন্দ পাই। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কাজটা করি যাবার চাং (চাই)।’ ৩১ মে, ২০২৩
বঙ্গবন্ধু হত্যা এবং উল্টো পথে যাত্রা
মো. জাকির হোসেন : গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী বিশ্বের নানা প্রান্তে আগস্ট মাস যেভাবে আসে, বাংলাদেশ ভূখণ্ডে আসে তা থেকে ভিন্নতা নিয়ে। শোকের মাতম নিয়ে আসে আগস্ট। এই মাসের ১৫ তারিখে কিছু বিশ্বাসঘাতক ইতিহাসের মহান কিংবদন্তি, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি, বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করেছিল। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর নোবেলজয়ী পশ্চিম জার্মানির নেতা উইলি ব্রানডিট যথার্থই বলেছিলেন, ‘মুজিবকে হত্যার পর বাঙালিদের আর বিশ্বাস করা যায় না।
যে বাঙালি শেখ মুজিবকে হত্যা করতে পারে, তারা যেকোনো জঘন্য কাজ করতে পারে।’ বাঙালির প্রতি অতল ভালোবাসায় বঙ্গবন্ধু নিজের ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়া, সুখ-আরাম-আয়েশকে বিসর্জন দিয়েছেন। পরিবারের প্রতি দায়িত্বকে গৌণ করেছেন। বাংলার মানুষের মুক্তির জন্য বছরের পর বছর জেল খেটেছেন। ফাঁসির রজ্জু গলায় পরতে নিজের জীবনকে তুচ্ছ করেছেন। কোনো বাঙালি তাঁকে হত্যা করে আত্মঘাতী হবে, তা বঙ্গবন্ধু কল্পনায়ও ঠাঁই দেননি। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে অর্জিত স্বাধীনতাকে খুনিচক্র ও তাদের দোসররা মেনে নিতে পারেনি। খুনি ও তাদের সহযোগীরা স্বাধীনতার পর থেকেই বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করে।
স্বাধীনতাকে অর্থবহ করার জন্য বঙ্গবন্ধুর গৃহীত অর্থনৈতিক মুক্তি ও শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় একটি দল। তারাও স্বাধীনতাবিরোধীদের সঙ্গে হাত মেলায়। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের কারিশমায় ঈর্ষান্বিত দেশি-বিদেশি দোসররাও জোটবদ্ধ হয়েছিল। আর এসবেরই পরিণতি বিশ্ব ইতিহাসে বিরল ১৫ আগস্টের লোমহর্ষক হত্যাকাণ্ড।
স্মরণাতীত কাল থেকে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড বিশ্বে অনেকবার হয়েছে। বিশ্বের বরেণ্য রাজনৈতিক ব্যক্তিরাও হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। কিন্তু ইতিহাসে এমন আরেকটি উদাহরণ খুঁজে পাওয়া যায় না, যেখানে একটি জাতির স্থপতিকে হত্যার পাশাপাশি তাঁর স্ত্রী, তিন পুত্র, দুই পুত্রবধূ, ভ্রাতাসহ বাসায় উপস্থিত পরিবারের সব সদস্যকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। রাজনৈতিক কারণে একটি জাতির পিতার শিশুপুত্রকেও হত্যা করা হয়েছে — এমন একটি ঘটনাও ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। পিতার দুই কন্যা সেদিন বিদেশে অবস্থান করায় বেঁচে গিয়েছেন। ওই দিন বাসায় থাকলে কি তাঁরাও হত্যার শিকার হতেন না? মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন করায় খুনি ও তাদের দোসররা বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের বিরুদ্ধে প্রতিশোধের সুযোগ খুঁজছিল। ১৫ আগস্টের নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে তাদের সেই প্রতিশোধের প্রতিফলন ঘটে। বঙ্গবন্ধুর সারা জীবনের স্বপ্ন ছিল একটি শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠা। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির এই দর্শনকে মুছে ফেলতে চেয়েছে খুনি ও তাদের দেশি-বিদেশি দোসররা। তাই খুনি ও তাদের দোসররা বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সম্ভাব্য ধারক-বাহক তাঁর রক্তের উত্তরসূরি সবাইকেসহ শিশু রাসেলকে পর্যন্ত হত্যা করেছে।
বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ একে অপরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। একটিতে আঘাত করলে অপরটিতে তার মারাত্মক অভিঘাত সৃষ্টি হবে, এটিই স্বাভাবিক। জাতির জনককে নির্মমভাবে হত্যার পর দ্য টাইমস অব লন্ডনের ১৯৭৫ সালের ১৬ আগস্ট সংখ্যায় একটি তাত্পর্যপূর্ণ মন্তব্যসহ উল্লেখ করা হয়, ‘শেখ মুজিবকে সব সময় স্মরণ করা হবে। কারণ তাঁকে ছাড়া বাংলাদেশের বাস্তব কোনো অস্তিত্ব নেই।’ আজ থেকে ৪৮ বছর আগে কী দারুণ সত্য অনুধাবন ও উচ্চারণ করেছিল দ্য টাইমস অব লন্ডন! খুনিরা বাংলাদেশকে নেতৃত্বহীন করতে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ধারাবাহিকতায় মুজিবনগর সরকারের নেতৃত্বদানকারী জাতীয় চার নেতাকেও জেলের অভ্যন্তরে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করে। পিতার খুনিদের বিচার করা যাবে না মর্মে দায়মুক্তি আইন প্রণয়ন করে বিচারহীনতার বর্বর সংস্কৃতি চালু করেছে। বাংলাদেশ সৃষ্টিতে নেতৃত্বদানকারী রাজনীতির উত্কৃষ্ট অংশটিকে হত্যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্র ও রাজনীতিতে অমানিশার শুরু। এরই বেদনাদায়ক চিত্র আজকের রাষ্ট্র ও রাজনীতিতে সতত দৃশ্যমান। আগুনে পুড়িয়ে শত শত মানুষকে হত্যা করার রাজনীতির প্রচলন হয়েছে। অসাম্প্রদায়িকতার মন্ত্র নিয়ে সৃষ্ট বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতা বীভৎসরূপে ফিরে এসেছে। ভোটের আগে ও পরে নজিরবিহীন সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় জঙ্গিবাদের উত্থান হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগকে নির্মূল করা রাজনৈতিক দলের নীতি ও আদর্শ হিসেবে গৃহীত হয়েছে। পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা আইএসআই ও ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ বাংলাদেশের রাজনীতিতে সক্রিয় নিয়ামক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যা ও একই ধারাবাহিকতায় জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করা না হলে বিএনপি নামের সংগঠনের জন্ম হতো না। বিএনপির জন্ম না হলে স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত রাজনীতিতে পুনর্বাসিত ও রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে পারত না। বঙ্গবন্ধুর খুনিরা ফ্রিডম পার্টি গঠন করে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে সংসদকে কলঙ্কিত করতে পারত না। পশ্চিমা কয়েকটি রাষ্ট্র যেভাবে বাংলাদেশকে তাদের অঙ্গরাষ্ট্র পরিগণিত করে সার্বভৌমত্বে নগ্ন হস্তক্ষেপ করছে, তা করতে পারত না। সর্বোপরি রাজনীতির এমন দুর্বৃত্তায়ন আর সর্বনাশ ঘটত না। বয়সীদের কাছে শুনেছি, হক সাহেব (শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক), সোহরাওয়ার্দী সাহেব, ভাসানী সাহেব, শেখ সাহেব (বঙ্গবন্ধু), সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাহেব, তাজউদ্দীন সাহেব, মনসুর আলী সাহেব, কামারুজ্জামান সাহেব যখন রাজনীতি করতেন, সেটি ছিল খাঁটি রাজনীতি। দেশ ও জনগণের কল্যাণ ছাড়া অন্য কোনো ভাবনা তাঁদের মধ্যে ছিল না। যেকোনো ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত ছিলেন তাঁরা। ব্যক্তি-পরিবারের লাভ-লোকসান তাঁদের বিবেচ্য ছিল না। রাজনীতি করে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়ে গাড়ি-বাড়ি ও আলিশান জীবনযাপনের স্বপ্ন দেখেননি তাঁরা। মওলানা ভাসানী টাঙ্গাইলের সন্তোষে একটি কুঁড়েঘরে বাস করতেন। ধারকর্জ, বন্ধুবান্ধবের সহযোগিতা ও হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশন থেকে ঋণ নিয়ে ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাড়িটি নির্মাণ করা হয়। ঢাকায় বঙ্গবন্ধু পরিবারের মাথা গোঁজার কোনো ঠাঁই ছিল না। পাকিস্তানি শাসকের ভয়ে বঙ্গবন্ধু পরিবারকে অনেকেই বাড়ি ভাড়া দিতে রাজি হতো না বিধায় বঙ্গমাতা পিডাব্লিউডি থেকে বরাদ্দ পাওয়া জায়গায় বাড়ি নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। জীবদ্দশায় বঙ্গবন্ধু হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশনের ঋণ শোধ করে যেতে পারেননি। ১৯৮১ সালে শেখ হাসিনা দেশে ফেরার পর ঋণের অবশিষ্টাংশ শোধ করেন।
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী তাঁর ওকালতির টাকা দিয়ে দলে অর্থায়ন করতেন। আওয়ামী লীগের অনেক রাজনীতিবিদ সততার পরাকাষ্ঠা হয়ে একচালা টিনের ঘরে আমৃত্যু বসবাস করেছেন। গাড়ি নয়, রিকশায় চড়েছেন। ব্যক্তিগত গাড়ি না থাকায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর বিড়ম্বনার শিকার হয়েছেন। কারণ সংসদ ভবনে রিকশা প্রবেশ নিষিদ্ধ। এখন সব কিছুই কল্পকাহিনি মনে হবে। এ কথা অস্বীকার করার জো নেই, আমাদের রাজনীতি আকৃতি-প্রকৃতি আর রূপ-রস-রুচির বিবেচনায় এর আসল অবয়ব হারিয়ে বীভৎস আকার ধারণ করেছে। রাতের অন্ধকার আর প্রকাশ্য দিবালোকে রাজনীতির আদর্শ-উদ্দেশ্যের ক্রমাগত বস্ত্রহরণে এটি অনাকাঙ্ক্ষিত হয়ে পড়ছে। অনেকের মতে, রাজনীতির নামে যা চলছে, তাকে রাজনীতি বললে বোধ করি রাজনীতি শব্দটিরও অসম্মান হয়।
এক সময় রাজনীতিতে যোগদান অত্যন্ত সম্মানজনক বিষয় ছিল, রাজনীতিবিদরা পূজনীয় ছিলেন। তখন রাজনীতির মূলমন্ত্র ছিল অতল দেশপ্রেম আর জনকল্যাণ। রাজনীতির দীক্ষা ছিল ত্যাগ আর ব্যক্তিগত আশা-আকাঙ্ক্ষার বলিদান। এখন রাজনীতি নিয়ে মানুষ যারপরনাই বিরক্ত। ক্ষুব্ধ-ক্রুদ্ধ মানুষ রাজনীতি ও রাজনীতিকদের কষে গালি দিতে দ্বিধা বোধ করে না।
অতল দেশপ্রেম আর ত্যাগ-তিতিক্ষার পূজনীয় রাজনীতি কেন, কেমন করে নষ্ট আর অশ্লীল হলো? ১৯৭৫ সালে রাজনৈতিক নেতৃত্বের উত্তম অংশটিকে নির্মূল করে অপরাজনীতির সব ক্ষেত্র প্রস্তুত করা হয়। বঙ্গবন্ধু ও চার জাতীয় নেতাকে হত্যার মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের রাজনীতি মূলধারা থেকে সাইডলাইনে চলে যেতে বাধ্য করা হয়। জিয়া রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের পর ভয়ংকর বহুদলীয় গণতন্ত্র চালু করেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সুবিধাবাদী নেতাদের নিয়ে দল গঠন করেন। রাজনীতিবিদদের ক্রয়-বিক্রয় আর আদর্শের বস্ত্রহরণের রাজনীতির নতুন যুগের সূচনা হয়। রাজনীতি কলুষিত হয়ে পড়ে। রাজনীতিবিদদের লোভ-লালসার হাত ধরে রাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়নের প্রচলন হয়। রাজনীতিতে টাকা এবং টাকাওয়ালাদের প্রভাব বাড়তে শুরু করে। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান রাজনীতি সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছিলেন ‘মানি ইজ নো প্রবলেম’ এবং ‘আই উইল মেক পলিটিকস ডিফিকাল্ট ফর দ্য পলিটিশিয়ান্স’। সেই থেকে প্রকৃত রাজনীতিবিদদের জন্য রাজনীতি সত্যি কঠিন হয়ে পড়ল। ত্যাগী রাজনীতিকের সংখ্যা ক্রমাগতই কমতে থাকল। ‘মানি ইজ নো প্রবলেম’ যদি রাজনীতির নিয়ামক হয়, তখন একটি দেশের দুর্নীতির অভয়াশ্রম হয়ে উঠতে আর কোনো কিছুর দরকার পড়ে না।
জিয়ার হাত ধরে দুর্নীতিবাজ নব্য ধনীদের বড় অংশের উত্থান হয় এবং রাজনীতিতে তাদের পুনর্বাসন হয়। ব্যবসায়ী, অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা, সাংবাদিক, শিক্ষক, আইনজীবী, অবসরপ্রাপ্ত আমলা— বলতে গেলে সব পেশাজীবীই রাজনীতিতে ঢুকে পড়তে শুরু করেন। অন্য পেশা থেকে যাঁরা এসেছেন, তাঁদের বেশির ভাগই এসেছেন মূলত ‘রাজনীতিতে অর্থ উপার্জন কোনো সমস্যাই নয়’ এই সত্যকে মন্ত্রজ্ঞান করে। তাঁদের প্রায় সবারই ‘সিদ্ধিলাভ’ হয়েছে। ‘বাইরের লোক’ রাজনীতিতে এসে শুধু রাজনীতিকেই কলুষিত করেননি, যে পেশা থেকে এসেছেন, সেই পেশাও তাঁদের মাধ্যমে কলুষিত, দুর্নীতিগ্রস্ত হয়েছে। একজন ব্যবসায়ী সরকারি দলে যোগ দিয়ে টাকার পাহাড় গড়ে ব্যবসায়ী সমাজে ‘অনুকরণীয়’ দৃষ্টান্ত হয়ে যাচ্ছেন। তাঁকে অনুসরণ করে অন্য ব্যবসায়ীরাও টাকার পাহাড় গড়ার সহজ ফর্মুলা রপ্ত করছেন। সাবেক সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তা, সাংবাদিক, আইনজীবী, শিক্ষকদের হাত ধরেও রাজনীতির অঙ্গনসহ পুরো দেশটি এভাবেই দুর্নীতিগ্রস্ত হয়েছে। দুর্বৃত্তায়নের রাজনীতির প্রচলন হয়েছে। এসব লুটেরা, দুর্নীতিপরায়ণ রাজনীতিবিদের অনেকেই টাকা দিয়ে পদ-পদবি কিনে নিচ্ছেন। রাজনীতিতে হাইব্রিডদের এখন রমরমা বাজার।
রাজনীতির এমন দুর্বৃত্তায়ন চলতে পারে না। মুক্তিযুদ্ধের মূলনীতিকে সমুন্নত করতে হবে। বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি, দর্শন ও চেতনাকে লালন করতে হবে। এই দর্শন ও চেতনা হলো সাম্য, মানবিক মর্যাদা আর ন্যায়বিচারের মাধ্যমে শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা। রাজনীতির দুর্বৃত্তায়নে এবং পশ্চিমাদের, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের অনানুষ্ঠানিক আগ্রাসনে দেশ বিপদাপন্ন। রাজনীতিকে রাহুমুক্ত ও আগ্রাসন প্রতিরোধ করতে হলে সব অভিমান, ক্ষোভ ভুলে মুক্তিযুদ্ধের সব পক্ষকে এগিয়ে আসতে হবে। সৃষ্টি করতে হবে একাত্তরের মতো ইস্পাত কঠিন ঐক্য ও সংহতি। তা না হলে রাষ্ট্র ও রাজনীতি গভীর থেকে গভীরতর অমানিশায় ডুবতে থাকবে। অতল সেই অন্ধকার থেকে বাংলা ও বাঙালি জাতিকে মুক্ত করা কঠিন হয়ে পড়বে। ১ আগস্ট, ২০২৩
লেখক : অধ্যাপক, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
‘ময়লার’ ভেতরেও বাণিজ্যের ‘চোখ’
জাহাঙ্গীর কিরণ : ঢাকার দুই সিটিতে মোট ওয়ার্ড ১২৯টি। এগুলোর মধ্যে ৯৩টি ওয়ার্ড আগে ছিল। ৩৬টি ওয়ার্ড নতুন। উত্তর সিটি করপোরেশনে ২ লাখ ৬৯ হাজার ২২৯টি এবং দক্ষিণ সিটিতে ২ লাখ ৫৮ হাজার ৫৩৩টি হোল্ডিংসহ দুই সিটি করপোরেশনে প্রায় ৫ লাখ ২৭ হাজার ৭৬২টি হোল্ডিং রয়েছে। প্রতিটি হোল্ডিংয়ের বিপরীতে রয়েছে ১ থেকে ১০০টিরও অধিক ফ্ল্যাট বা বাসা। একটি হোল্ডিংয়ে রয়েছে গড়ে ৫টি ফ্ল্যাট। প্রতি ফ্ল্যাট থেকে গড়ে প্রতি মাসে ১৫০ টাকা করে চাঁদা আদায় করা হয়। এই হিসাবে বাসাবাড়ি থেকে বর্জ্য সংগ্রহ বাবদ মাসে প্রায় ৪০ কোটি টাকার বাণিজ্য হচ্ছে, যা বছরশেষে দাঁড়ায় প্রায় ৪৭৪ কোটি টাকায়।
এছাড়া রাজধানীতে প্রায় ১৫ হাজার রেস্তোরাঁ রয়েছে। প্রতিটি রেস্তোরাঁ থেকে বর্জ্য সংগ্রহ বাবদ মাসে ১ থেকে ১০ হাজার টাকা নেয়া হচ্ছে। গড়ে ১ হাজার ৫০০ টাকা হিসেবে রেস্তোরাঁ থেকে মাসে আদায় হচ্ছে ২ কোটি ২৫ লাখ টাকা, বছরশেষে যার পরিমাণ দাঁড়ায় ২৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ দুই সিটি থেকে বর্জ্য সংগ্রহ বাবদ বছরে আদায় করা হচ্ছে ৫০১ কোটি টাকা। অথচ প্রতি অর্থবছরে বাসিন্দাদের কাছ থেকে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন প্রায় ২০০ কোটি পরিচ্ছন্নতা কর আদায় করেছে। হোল্ডিং ট্যাক্সের সঙ্গে ৩ শতাংশ হারে পরিচ্ছন্নতা করের নামে এই টাকা নেয়া হচ্ছে নাগরিকদের কাছ থেকে। সবমিলিয়ে পরিচ্ছন্নতা বিল বাবদ বছরে ৭০০ কোটি টাকা গুনতে হচ্ছে রাজধানীবাসীকে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অল্প সময়ে কম পুঁজি ব্যবহার করে এত বিপুল পরিমাণ অর্থ অন্য কোনো খাত থেকে আয় করা সম্ভব নয়। তারা বলছেন, দুই সিটির একেকটি ময়লার ভাগাড় যেন স্বর্ণের খনি। আর এই কারণেই ময়লার কারবারিরা ক্ষমতার বলয় সৃষ্টি করে প্রতিটি এলাকাকে কুক্ষিগত করে রাখছে। এ নিয়ে ক্ষমতার দ্ব›দ্বও দেখা দিয়েছে বহু স্থানে। এলাকায় যার প্রভাব যত বেশি সেই ভাগিয়ে নিচ্ছে ময়লা।
কারবার নিয়ে কাড়াকাড়ি
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৫৩ নম্বর ওয়ার্ডের রানাভোলা, সিরাজ মার্কেট এলাকার বর্জ্য সংগ্রহ করতেন মো. শহীদ। সিটি নির্বাচনের পর স্থানীয় কাউন্সিলর নাছির উদ্দিনের লোকজন ময়লা কেড়ে নিয়েছেন। ওই এলাকায় এখন তারাই করাচ্ছেন বর্জ্য সংগ্রহের কাজ। উত্তরের ৫৪ নম্বর ওয়ার্ডের কামারপাড়া এলাকায় ১০ বছর ধরে বর্জ্য সংগ্রহ করত পরিবেশ বন্ধু ক্লিনিং সার্ভিস। সংস্থাটির সভাপতি নাগর আলী ওয়ার্ড শ্রমিক লীগের সাবেক তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক। সিটি নির্বাচনের পর লিটন সিকদার ও মো. নাসির নামের দুই ব্যক্তি ওই প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের মারধর করে ময়লা সংগ্রহের কাজ দখল করে নেয়। তারা স্থানীয় কাউন্সিলর লোক হিসেবে পরিচিত। এ বিষয়ে মেয়রের কাছে লিখিত অভিযোগ করেও সুরাহা পাননি নাগর আলী।
৭ নম্বর ওয়ার্ডের রূপনগর আবাসিক এলাকার ৬ থেকে ৮ এবং ১১ থেকে ২২ নম্বর সড়কের বর্জ্য সংগ্রহ করতেন ওয়ার্ড শ্রমিক লীগের সভাপতি আমীর আলী। অভিযোগ ওঠেছে, সিটি নির্বাচনে বর্তমান কাউন্সিলরের বিরোধী প্রার্থীর হয়ে কাজ করায় কাছ থেকে ময়লা সংগ্রহের কাজটি দখল করে নেয় কাউন্সিলরের লোকজন। ২৯ নম্বর ওয়ার্ডে এক দশকেরও বেশি সময় ধরে ময়লা সংগ্রহের কাজ করত দুস্থ মানুষের কথা (ভিওডি) নামের একটি প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটি উত্তর সিটির সংরক্ষিত ২৯, ৩০ ও ৩২ নম্বর ওয়ার্ডের নারী কাউন্সিলর শাহীন আক্তারের। এই ওয়ার্ডটি মোহাম্মদ পুরের তাজমহল রোড, জয়েন্ট কোয়ার্টার (আজিজ মহল্লা), হাজি চিনু মিয়া রোড (টিক্কাপাড়া) ও জান্নাতবাগ (বিজলি মহল্লা) নিয়ে গঠিত। গত নির্বাচনে ২৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর হন সলিম উল্লাহ ওরফে সলু। দায়িত্ব গ্রহণের চার মাসের মাথায় ময়লা নেয়ার কাজটি দখলে নেন তিনি। গত অক্টোবর থেকে কাউন্সিলরের প্রতিষ্ঠান স্বপ্ন মানবিক কল্যাণ সংস্থা (স্বমকস) ময়লা সংগ্রহের কাজ করছে।
রাজধানীর পশ্চিম আগারগাঁও এলাকায় বর্জ্য সংগ্রহ করত এ টু জেড মিডিয়া অ্যান্ড সোশ্যাল সার্ভিস সেন্টার। ২০ বছর ধরে প্রতিষ্ঠানটি এ কাজ করে। কিন্তু স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলরের ছোট ভাই ও শেরেবাংলা নগর থানা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি আসাদুজ্জামানের নেতৃত্বে কিছু ব্যক্তি এই বর্জ্য সংগ্রহের কাজ দখল করে নেয় বলে অভিযোগ রয়েছে। দুই সিটির প্রায় প্রতিটি ওয়ার্ডেই ময়লার কারবার নিয়ে এমন কাড়াকাড়ি চলে আসছে।
বাণিজ্য হয় যেভাবে
বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ময়লা সংগ্রহে নিয়োজিত কর্মীরা জানান, যারা বাসা থেকে প্রতিদিন ময়লা সংগ্রহ করেন তাদের মাসিক বেতন কমবেশি ৩ থেকে ৮ হাজার টাকা। আর আছে ভ্যান খরচ। কেউ যদি ২ হাজার ফ্ল্যাটের ময়লা সংগ্রহ করেন আর ১৫০ টাকা করে মাসে আদায় করেন তাহলে তার মাসিক আয় ৩ লাখ টাকা। এর জন্য ৪-৫টি ভ্যানগাড়ি আর ৮ জন কর্মী লাগবে। তাদের বেতন ও সামান্য ভ্যান খরচ বাদ দিলে বাকি টাকা লাভ। তিন ভাগের এক ভাগে খরচ ধরলেও মাসে লাভ ২ লাখ টাকা।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০১৯ সালের খানা জরিপ অনুযায়ী, প্রতি খানায় গড়ে সদস্যসংখ্যা ৪ দশমিক ২ জন। আর বিশ্বব্যাংকের হিসাবে বর্তমানে ঢাকার জনসংখ্যা ১ কোটি ৮০ লাখ। সে হিসাবে ঢাকায় পরিবার রয়েছে ৪২ লাখ ৮৫ হাজার ৭১৪টি। বর্জ্য সংগ্রহকারীদের তথ্য অনুযায়ী, বাসাবাড়ি থেকে বর্জ্য পরিবহন সুবিধা নিচ্ছে রাজধানীর ৮০ শতাংশের মতো পরিবার। প্রতিটি ফ্ল্যাট বা পরিবার থেকে ময়লা বাবদ গড়ে ১৫০ টাকা করে ধরলে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে বাসাবাড়ি থেকে বর্জ্য সংগ্রহ বাবদ মাসে প্রায় ৫১ কোটি টাকা আদায় হয়, বছরে যা প্রায় ৬১২ কোটি টাকা। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন প্রতিবছর যে গৃহকর আদায় করে, তার চার ভাগের ১ ভাগ নেয় পরিচ্ছন্নতা বাবদ। গত অর্থবছরে নগরবাসীর কাছ থেকে পরিচ্ছন্নতা কর আদায় করা হয়েছে ১১৬ কোটি টাকার বেশি। সে হিসেবে ৭০০ কোটি টাকারও বেশি পরিচ্ছন্নতা বিল দেন নগরবাসী। এছাড়া রেস্টুরেন্টগুলো থেকেও বছরে সাড়ে ৩ কোটি টাকার মতো ময়লা বাণিজ্য হয়।
মিলেমিশে বাণিজ্য সিটি করপোরেশন আইন অনুযায়ী, সিটি করপোরেশনের দায়িত্ব হচ্ছে বাসাবাড়ির ময়লা-আবর্জনা নির্দিষ্ট স্থান থেকে সংগ্রহ করে ডাম্পিং স্টেশনে নিয়ে ফেলবে। এজন্য করপোরেশন নগরীর বিভিন্ন স্থানে ময়লা ফেলার পাত্র বা অন্য কোনো আঁধারের ব্যবস্থা করবে। আর নাগরিকেরা তাদের বাসাবাড়ির বর্জ্য করপোরেশনের নির্ধারিত বিনে পৌঁছে দেবে। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন প্রতিবছর যে গৃহকর আদায় করে, তার চার ভাগের এক ভাগ নেয় পরিচ্ছন্নতা বাবদ। গত অর্থবছরে নগরবাসীর কাছ থেকে পরিচ্ছন্নতা কর আদায় করা হয়েছে ১১৬ কোটি টাকারও বেশি। কিন্তু সিটি করপোরেশন বাসাবাড়ি থেকে ময়লা সংগ্রহ করে না। তারা ময়লা নেয় সেকেন্ডারি ট্রান্সফার সেন্টার এসটিএস (বাসাবাড়ি থেকে সংগ্রহ করা বর্জ্য যেখানে জমা করা হয়) থেকে। আর বাসাবাড়ি থেকে এসটিএস পর্যন্ত ময়লা নেয় বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা, যা এখন মূলত স্থানীয় প্রভাবশালীদের দখলে।
অভিযোগ রয়েছে, স্থানীয় প্রভাবশালীরা যাতে বাণিজ্য করতে পারেন সেই সুবিধা নিশ্চিত করতেই সিটি করপোরেশনগুলো পরিচ্ছন্নতা বিল আদায়ের পরও নিজেরা ময়লা আনছে না। তবে সিটি করপোরেশনগুলোর দায়িত্বশীলরা বলছেন, গৃহকরের মধ্যে পরিচ্ছন্নতা কর বাবদ যে টাকা নেয়া হয়, তা মূলত সড়ক ঝাড়ু দেয়া এবং এসটিএস থেকে ল্যান্ডফিল্ডে ময়লা পরিবহনের ব্যয়। এই কারণেই বাসাবাড়ি থেকে ময়লা সংগ্রহ করে আনা যায় না।
অনিয়ম বাড়বে নতুন নিয়মে
২০২০ সাল থেকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন বাসাবাড়ির বর্জ্য সংগ্রহের দায়িত্ব দেয় দরপত্রের মাধ্যমে তবে এতে বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা ফেরেনি বরং বেড়েছে বিশৃঙ্খলা; পাশাপাশি বাড়তি ফি দিতে হচ্ছে নগরবাসীর। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনও তাদের এলাকার বাসাবাড়ির বর্জ্য সংগ্রহে বার্ষিক চুক্তির ভিত্তিতে তৃতীয় পক্ষকে নিবন্ধন দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। নতুন নিয়মে দরপত্রের মাধ্যমে একটি ওয়ার্ডে একটি প্রতিষ্ঠানকে ময়লা সংগ্রহের দায়িত্ব দেয়ার পথে যাচ্ছে সংস্থাটি। উত্তর সিটির বোর্ড সভায় এরই মধ্যে এই প্রস্তাব অনুমোদিত হয়েছে।
উত্তর সিটির মেয়র আতিকুল ইসলাম এ বিষয়ে জানান, বাসাবাড়ির বর্জ্য সংগ্রহের কাজ কে পেল, কে পেল না, সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। জনগণ সেবা পেল কি না, সেটা মুখ্য বিষয়। কিছু ওয়ার্ডে পরীক্ষামূলকভাবে নতুন ব্যবস্থাপনা চালু করা হবে। সফলতা পেলে অন্য ওয়ার্ডে তা চালু করা হবে। নির্ধারিত ফির বেশি নিলে জনগণ অ্যাপের মাধ্যমে জানাতে পারবে। বেশি টাকা নিলে তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
তবে যারা দীর্ঘদিন ধরে বর্জ্য সংগ্রহের কাজে যুক্ত তাদের অভিযোগ, বর্জ্য সংগ্রহের কাজটি ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মী ও কাউন্সিলরদের নিয়ন্ত্রণে দিতে সিটি করপোরেশন এমন উদ্যোগ নিচ্ছে। দরপত্রে অংশ নিতে আবেদনপত্রে ওয়ার্ড কাউন্সিলরের স্বাক্ষর বাধ্যতামূলক করার এমন সন্দেহ পোক্ত হচ্ছে। ইতোমধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে এই নিয়মে বর্জ্য সংগ্রহের কাজ চালু হয়েছে। অধিকাংশ ওয়ার্ডে কাজ পেয়েছে ক্ষমতাসীন দল ও কাউন্সিলরের লোকজন। এসব প্রতিষ্ঠানকে দোকানপ্রতি ৩০ টাকা এবং বাসাবাড়ি থেকে ১০০ টাকা করে নেয়ার নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল। কিন্তু বেশির ভাগ এলাকায় ইচ্ছা মতো টাকা নিচ্ছে বলে অভিযোগ আছে।
সমাধানে দরকার সুনির্দিষ্ট নীতিমালা এবং কঠোর তদারকি
বর্জ্য নিয়ে বাণিজ্য বন্ধ করতে এবং নাগরিক সুবিধা নিশ্চিতে বেশ কিছু পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। নগর পরিকল্পনাবিদ এবং ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, রাজশাহী-খুলনাতে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সিটি করপোরেশনই করে কিন্তু ঢাকাতে কর নিলেও সেই সেবা দিচ্ছে না করপোরেশন। এখন যদি উল্টো এটাকে ব্যবসায় পরিণত করে তবে একদিকে সাধারণ মানুষের খরচ বাড়বে এবং এ বর্জ্য নিয়ে বাণিজ্যকে আরও প্রমোট করা হবে। সিটি করপোরেশনের এ ধরনের সিস্টেম কাউন্সিলর এবং ক্ষমতাসীন নেতাদের বলয়ের সুরক্ষা দিতে তৈরি করেছে। শৃঙ্খলা আনা ছাড়া এ ধরনের ব্যবস্থা দিয়ে সমাধান হবে না।
তিনি বলেন, সিটি করপোরেশন যদি জনবল বাড়িয়ে নিজেরা এই দায়িত্ব পালন করত, তাহলে জনগণের জন্য এই দিকটা আরও সাশ্রয়ী হতো। আর সিটি করপোরেশনেরও রাজস্ব আদায় হতো। কিন্তু এখন মধ্যস্বত্বভোগীরা লাভবান হচ্ছে।
নগরবিদদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সভাপতি আকতার মাহমুদ বলেন, নাগরিকদের ভোগান্তির মতো বিষয়গুলোতে সিটি করপোরেশনের নজরদারির ঘাটতি রয়েছে। ময়লা সংগ্রহের কাজটি করার ক্ষেত্রে সিটি করপোরেশনগুলোর সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকা এবং তার কঠোর তদারকি প্রয়োজন। ২৭ জুলাই ২০২৩
শমসের গাজীর রহস্যময় সুড়ঙ্গ
আজাদ মালদার : কালের আখ্যান হয়ে এখোনো অখ্যাত বাংলার বীর শমশের গাজীর সুড়ঙ্গ। অবিভক্ত বাংলায় তৈরী হওয়া এ সুড়ঙ্গের এখন এক মুখ বাংলাদেশ অন্য মুখ ভারতে। সুড়ঙ্গ ও শমশের গাজীর ভিটা নিয়ে রয়েছে আরো অনেক উপাখ্যান।
ফেনীর শমসের গাজীর সুড়ঙ্গপথ সম্পর্কে কমবেশি অনেকের জানা। ছাগলনাইয়ার চম্পকনগরে ভারতের সীমান্ত এলাকাটি মূলত শমসের গাজীর স্মৃতি বিজড়িত স্থান। সেখানে আছে শমসের গাজীর সুড়ঙ্গ, শমসের গাজী বাঁশের কেল্লা রিসোর্ট, দীঘিসহ অনেক কিছু। তবে তার প্রাসাদসহ অন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার ধ্বংসাবশেষ ভারতের ত্রিপুরার মধ্যে ভাগ হয়ে গেছে।
ফেনীর ঐতিহ্যবাহী দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে এ স্থানটি অন্যতম। সেখানে গেলে পর্যটকরা শমসের গাজীর সুড়ঙ্গপথে ঢুঁ না মেরে কখনো ফেরেন না। সুড়ঙ্গপথ পানে তাকালেই রহস্যময় এক অনুভূতির সৃষ্টি হয় সবার মাঝে, জাগে কৌতূহল। কেন জমিদার শমসের গাজী এ সুড়ঙ্গপথটি তৈরি করেছিলেন। শমসের গাজী কৃষক-আন্দোলনের মধ্য দিয়ে অর্জন করেন জমিদারি।
সে সময় তিনি চোর ডাকাত ও জলদস্যুদের রুখতে এক শক্তিশালী বাহিনী গড়ে তোলেন। বর্তমান ফেনী জেলার ছাগলনাইয়া উপজেলাতে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তার পিতার নাম পীর মুহাম্মদ মতান্তরে পেয়ার মুহাম্মদ খান এবং মাতার নাম কৈয়্যারা বিবি।
তারপর নিজের জ্ঞান, শক্তি, দক্ষতা ও পরিশ্রম দিয়ে তিনিও একসময় হয়ে ওঠেন জমিদার। টানা এক যুগ ত্রিপুরা রাজ্য শাসন করেন এই বীর। ভাটির বাঘ বলে পরিচিতি লাভ করেন। বহু যুদ্ধক্ষেত্র দাঁপিয়ে বেড়িয়েছেন বীর শমসের। শত্রু সেনা বিনাশ করতে কখনো পিছপা হননি। তার কাছে কোণঠাসা হয়ে পড়ে ইংরেজ বেনিয়ারা। ১৭৫৭ সালে ব্রিটিশ ঐপনিবেশিক শক্তির আগ্রাসন প্রতিহত করতে গিয়ে মৃত্যুবরণ করেন তিনি।
শমসের গাজী নবাব সিরাজুদ্দৌলার পর তিনিই ঔপনিবেশিক শক্তির হাতে প্রথম নিহত হন। বহু কৃতিত্ব রয়েছে তার। মৃত্যুর আগে তিনি দুর্গ ও রাজধানী গড়েন। প্রতিরক্ষার জন্য আধুনিক রণকৌশলে সাজান পুরো এলাকাতে । ফেনীর ছাগলনাইয়ার চম্পকনগর ও জগন্নাথ সোনাপুরের বর্তমান ভারত সীমান্ত এলাকাটি শমসের গাজীর স্মৃতি বিজড়িত স্থান। এখানেই রয়েছে শমসের গাজীর সুড়ঙ্গপথ ও শমসের গাজীর দীঘি। তিনি তার রাজকীয় বাড়ির পাশে ৪.৩৬ একর জায়গা জুড়ে দীঘি এবং একটি সুড়ঙ্গ পথ নির্মাণ করেন। গাজীর সুড়ঙ্গ পথটি নিয়ে রয়েছে অনেক গল্প ও উপাখ্যান। ইতিহাসের এই আশ্রমটি দেখতে প্রতিনিয়তই এখানে ভীড় করেন পর্যটকরা।
সুড়ঙ্গের অদূরেই রয়েছে শমশের গাজীর একটি দিঘী। যাকে এক খুইল্লাও বলা হয়। এদিঘীটিকে নিয়েও রয়েছে নানা গল্প। দেখতে ছোট হলেও এ দিঘীটি এখনও কেউ ডিল ছুড়ে পার করতে পারেননি। স্থানীয় প্রবীণরা বলেন, এতে অলৌকিক শক্তি আছে। যে শক্তির কারণে ডিল ছুড়ে পার করা যায় না।
বিভিন্ন শ্রেনী ও পেশার লোকজন ঘুরতে ও দেখতে আসেন শসসের গাজীর সুড়ঙ্গ ও দিঘিেকে। তারা বলেন, শমসের গাজীর দিঘী ও সুড়ঙ্গ এলাকাটি এখন ব্যক্তিগতভাবে বাগানে পরিণত হছে। তাদেরকে দশটাকা ফি দিয়ে প্রবেশ করতে হয়।তারা এখানে ঘুরতে আসেন। এখানে দায়িত্বে থাকা প্রবীণ ব্যক্তি জানান, তিনি শুনেছেন এখনও শমশের গাজীর দিঘীর নিচে গাজীর আস্ত্রাগার ও ধন-সম্পদ রয়েছে। সেই অজানা জগত এখনও কেউ আবিষ্কার করতে পারেননি। এনিয়ে দুদেশের প্রশাসনিক পর্যায়ে মিটিং ও হয়েছে বিশ বছর আগে। রাস্তা মেরামতের দাবি জানান দর্শনার্থীরা। যেহেতু সীমান্ত এলাকায়, নিরাপত্তার বিষয় নিয়ে তারা শংকিত। দুদেশের পতাকা বৈঠকের মাধ্যমে একটি চুক্তিতে দর্শনীয় স্থানের ঐতিহ্য ধরে রাখতে সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
ফেনীর জেলা প্রশাসক আবু সেলিম মাহমুদ- উল হাসান বলেন, এ জায়গাটি ফেনীর ইতিহাস ও ঐতিহ্যের অংশ। এটি এখন জেলার অন্যতম পর্যটন স্পটও। দারুণ সম্ভাবনা রয়েছে এই স্পটের। দর্শনার্থীদের নিকট আকর্ষণীয় করতে এখানে আরো বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করা যেতে পারে।
নিরাপত্তার বিষয় নিয়ে উচ্চ মহলে জানাবেন বলে জানান জেলা প্রশাসক আবু সেলিম মাহমুদ-উল হাসান। সর্বশেষ সমশের গাজীর বীরর্ত্রের প্রতি সম্মান রেখে, ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে সংরক্ষন করার জন্য সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড সহ বিভিন্ন পদক্ষেপ একান্ত দরকার। যাযাদি, ১১ জুলাই ২০২৩
ব্রিকস ও মার্কিন ডলারের ভবিষ্যৎ
এম এ খালেক : বিশ্বব্যাপী বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ হিসেবে মার্কিন ডলারের একাধিপত্য কি শেষ হতে চলেছে? পারিপাশির্^ক অবস্থা এবং পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে অর্থনীতিবিদদের অনেকেই এমন আশঙ্কা করছেন। রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে মার্কিন ডলারের পর দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা ইউরোপীয় ইউনিয়নের একক মুদ্রা (জার্মানি মুদ্রা ব্যতীত) একক মুদ্রা ইউরো’র পাশাপাশি ব্রিকস দেশগুলো (ব্রাজিল, রাশিয়া, ইন্ডিয়া, চায়না ও সাউথ আফ্রিকা) জোট খুব শীঘ্রই একক মুদ্রা চালু করতে যাচ্ছে। চলতি আগস্ট মাসের ২৪ তারিখে দক্ষিণ আফ্রিকায় অনুষ্ঠিতব্য ব্রিকস জোটের শীর্ষ সম্মেলনে একক মুদ্রা চালুর ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে বলে জানা গেছে।
বেশ কয়েক বছর ধরেই ব্রিকস জোট একটি একক মুদ্রা চালুর ব্যাপারে ইতিবাচক আলোচনা করে আসছিল। রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হরার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার উপর ব্যাপক অর্থনৈতিক বিধি-নিষেধ আরোপ করলে ব্রিকস জোটভুক্ত দেশগুলোর জন্য একক মুদ্রা প্রচলনের বিষয়টি প্রাধান্য পায়। মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে অনেক দেশই রাশিয়ান রুবলের মাধ্যমে লেনদেন করতে ব্যর্থ হয়। এতে রাশিয়া বেশ কিছুটা সমস্যায় পতিত হয়। বিশেষ করে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো রাশিয়ান পণ্য ক্রয়ের ক্ষেত্রে সমস্যায় পড়ে। রাশিয়া এসময় শর্তারোপ করে যে, রাশিয়া থেকে জ¦ালানি তেল ও গম আমদানি করতে হলে সংশ্লিষ্ট দেশকে রুবলের মাধ্যমে মূল্য পরিশোধ করতে হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ সময় ডলারে সংরক্ষিত রাশিয়ান রিজার্ভ আটকে দেয়। এসব কারণে ব্রিকস জোটের নিজস্ব একক মুদ্রা প্রচলনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়। উল্লেখ্য, ব্রিকস অত্যন্ত সম্ভাবনাময় একটি অর্থনৈতিক জোটে পরিণত হবার মতো সব ধরনের উপকরণই বিদ্যমান রয়েছে। ২০০৬ সালে ব্রাজিল, রাশিয়া, ইন্ডিয়া ও চীনের সমন্বয়ে ব্রিক জোট গঠিত হয়। পরবর্তীতে ২০১০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা এই জোটে যোগদান করলে এর নতুন নামকরণ করা হয় ব্রিকস। ব্রিকস অত্যন্ত সম্ভাবনাময় একটি অর্থনৈতিক জোট। যদিও খুব শীঘ্রই এটি অর্থনৈতিক জোটের পাশাপাশি ন্যাটোর মতো সামরিক জোটে পরিণত হবার সম্ভাবনা রয়েছে। চীন চাচ্ছে ব্রিকসের সদস্য সংখ্যা দ্রুত বাড়িয়ে একে আরো শক্তিশালি জোটে পরিণত করতে। কিন্তু ইন্ডিয়া এবং ব্রাজিল জোটের সদস্য সংখ্যা বাড়ানোর ব্যাপারে মোটেও আগ্রহী নয়। আর রাশিয়া এই ইস্যুতে কিছুটা হলেও ‘ধীরে চলো’ নীতি গ্রহণ করেছে। অন্তত ৪০টি দেশ ব্রিকসের সদস্যভুক্ত হবার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেছে। আরো ২৪টি দেশ ব্রিকসের সদস্য না হলেও প্রস্তাবিত একক মুদ্রা ব্যবস্থায় যুক্ত হতে চায়। কাজেই আগামীতে ব্রিকস যদি বিশে^র সবচেয়ে শক্তিশালী অর্থনৈতিক জোট হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে তাহলেও অবাক হবার কিছু থাকবে না।
ব্রিকস জোটভুক্ত দেশগুলো বর্তমানে বিশ্ব অর্থনীতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে। এই জোটভুক্ত দেশগুলোর অধিকারে রয়েছে বিশ্বের মোট স্বর্ণের ২৬ শতাংশ, জ্বালানি তেলের ৪০ শতাংশ, ৪৬ শতাংশ গম ও অন্যান্য দানাদার খাদ্য। ব্রিকস দেশগুলোর মোট জনসংখ্যা ৩ দশমিক ২ বিলিয়ন, যা বিশ্ব জনসংখ্যার ২৬ দশমিক ৭ শতাংশ। দেশগুলোর মোট জিডিপি’র পরিমাণ হচ্ছে ১৯ দশমিক ৬ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। বিশে^র মোট উৎপাদনের ২৩ দশমিক ২ শতাংশ এসব দেশে সম্পাদিত হয়। জোটভুক্ত দেশগুলোর সম্মিলিত আয়তন হচ্ছে ১৫ কোটি ৩ লাখ ৪৬ হাজার ১০০ বর্গমাইল। অর্থনৈতিকভাবে ব্রিকস জোট অত্যন্ত সম্ভাবনাময়। ২০০৯ সাল থেকে ব্রিকস জোটভুক্ত দেশগুলো বার্ষিক ভিত্তিতে শীর্ষ সম্মেলনের আয়োজন করে চলেছে। এর মধ্যে চীন সর্বাধিক ১৪টি শীর্ষ সম্মেলনের আয়োজন করে। ব্রিকসের প্রতিটি শীর্ষ সম্মেলন কোনো বড় ধরনের মতান্তর ছাড়াই সম্পন্ন হয়েছে। ব্রিকসের এবারের শীর্ষ সম্মেলন নানা কারণেই বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। বিশেষ করে রাশিয়ার জন্য এবারের সম্মেলন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধে জোটভুক্ত দেশগুলো রাশিয়ার প্রতি সহানুভূতিশীল। যুদ্ধ চলাকালীন রাশিয়া ভারত ও চীনের জন্য তুলনামূলক কম মূল্যে জ¦ালানি তেল সরবরাহ করে।
আগামীতে ব্রিকস জোটভুক্ত দেশগুলো শুধু অর্থনৈতিক জোট হিসেবে থাকবে নাকি পাশাপাশি সামরিক জোট হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে তা সময়ই বলে দেবে। তবে চীন সর্বাত্মকভাবে চাচ্ছে ব্রিকস জোট অর্থনৈতিক জোটের পাশাপাশি সামরিক ক্ষেত্রেও অবদান রাখুক। তাই তারা সমমনা দেশগুলোকে ব্যাপকভাবে এই জোটে সম্পৃক্ত করতে চাচ্ছে। চীন তার পছন্দনীয় দেশগুলোকে ব্রিকসের সদস্য করার ব্যাপারে খুবই আগ্রহী। আগামী ২৪ আগস্ট দক্ষিণ আফ্রিকায় অনুষ্ঠিতব্য ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলন নানা কারণেই বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। এই সম্মেলনের মাধ্যমে সদস্যভুক্ত দেশগুলো যদি একক মুদ্রা চালু করার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে তাহলে বিশ^ অর্থনীতি, বিশেষ করে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের পরিবর্তন সাধিত হবে। অর্থনীতিবিদদের অনেকেই মনে করছেন, আগামীতে বিশ^ব্যাপী বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে। বিশেষ করে অনেক দেশই মার্কিন ডলারের পরিবর্তে অন্য কোনো মুদ্রায় বৈদেশিক রিজার্ভ সংরক্ষণের উদ্যোগ নিতে পারে। রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রা ডলার এমনিতেই কিছুটা হলেও বিপর্যায়ের মধ্যে রয়েছে। গত বছর বিশ্ব ব্যাপী বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের ক্ষেত্রে মার্কিন ডলারের অবদান ৪৭ শতাংশে নেমে এসেছে। অথচ ২০২১ সালে বিশ^ব্যাপী বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের ৫৫ শতাংশ সংরক্ষণ করা হতো মার্কিন ডলারে। অনেক দেশেই মার্কিন ডলার বা অন্য কোনো মুদ্রার পরিবর্তে স্বর্ণ রিজার্ভ হিসেবে সংরক্ষণ করার ক্ষেত্রে আগ্রহ প্রদর্শন করছে। ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিল তাদের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, ১৯৭১ সাল থেকে এ পর্যন্ত প্রতি বছর স্বর্ণে বিনিয়োগ করে মুনাফা হয়েছে ৮ শতাংশ করে। ২ থেকে ৫ শতাংশ মূল্যস্ফীতির সময়ে বিশ্বে স্বর্ণের মূল্য ৮ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২২ সালে বিশ্ববাজারে দৈনিক গড়ে ১৩ হাজার ২০০ কোটি মার্কিন ডলার মূল্যমানের স্বর্ণ বিক্রি হয়েছে। বিশ্বে বিনিয়োগকারি এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিকট যে পরিমাণ স্বর্ণ মজুত আছে তার মোট মূল্য ৪ দশমিক ৮ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমান।
বিশ্বে আন্তর্জাতিক মুদ্রা বলে কিছু নেই। তবে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা এবং স্থিতিশীলতার কারণে মার্কিন ডলার অনেকটাই আন্তর্জাতিকতা অর্জন করেছে। বিশ্বে খুব কম দেশই আছে যারা মার্কিন ডলার গ্রহণ করতে চায় না। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে মার্কিন ডলারের সেই রমরমা অবস্থা যেনো আর নেই। বিশ্ব রিজার্ভ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে মার্কিন ডলারের অংশীদারিত্ব ক্রমশ কমছে। ‘ডি-ডলারাইজেশন’ বা আর্থিক ব্যবস্থা ডলার মুক্ত করার ক্ষেত্রে বিশ্ব জুড়ে আওয়াজ উঠেছে। অনেক দেশই এখন চাইছে মার্কিন ডলারের পরিবর্তে অন্য কোনো মুদ্রাকে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ হিসেবে গ্রহণ করতে। এর ফলে বিশ্ব রিজার্ভ ব্যবস্থায় মার্কিন ডলারের অংশীদারিত্ব দ্রুত কমে যাচ্ছে। অনেকেই মনে করছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ডলারকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য ব্যবহার করছে। বিশ^ব্যাপী বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ হিসেবে মার্কিন ডলারের অবস্থান কিভাবে দুর্বল হয়ে যাচ্ছে তার একটি দৃষ্টান্ত উল্লেখ করা যেতে পারে। ২০০১ সালে মোট বিশ্ব বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের ৭৩ শতাংশ সংরক্ষিত হতো মার্কিন ডলারে। ২০২০ সালে তা ৫৫ শতাংশে নেমে আসে। ইন্টারন্যাশনাল মানিটারি ফান্ড (আইএমএফ) অবশ্য বলছে, এখনো বিশ্বের মোট রিজার্ভের ৫৮ শতাংশ মার্কিন ডলারে সংরক্ষণ করা হয়। রাশিয়ার উপর মার্কিন অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর ডলারের অবস্থান আরো দুর্বল হয়ে পড়ে। এই হার এখন ৪৭ শতাংশে নেমে এসেছে। দুই দশক আগের তুলনায় ডি-ডলারাইজেশন প্রক্রিয়া ১০ গুণ দ্রুতগতিতে সম্পন্ন হচ্ছে। রাশিয়া এবং তার মিত্র দেশগুলো চাচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ হিসেবে মার্কিন ডলারের দ্রুত পতন ঘটুক। কারণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ডলারকে ‘রাজনৈতিক অস্ত্র’ হিসেবে ব্যবহার করছে। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হবার পর পশ্চিমা বিশ^, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ন্যাটোভুক্ত দেশগুলো রাশিয়ার উপর ব্যাপক অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এমনকি নিরাপদ এবং নির্ভরযোগ্য লেনদেন ব্যবস্থা সুইপট থেকে রাশিয়াকে বহিষ্কার করা হয়। যুদ্ধের আগে রাশিয়ার রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৬২ হাজার কোটি মার্কিন ডলার। এর অর্ধেক বাজেয়াপ্ত অথবা জব্দ করা হয়। বিশ^ব্যাপী আর্থিক লেনদেন কার্যক্রমে যে মুদ্রা সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় তা হচ্ছে মার্কিন ডলার। দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধের পর থেকেই মার্কিন ডলারের আধিপত্য শুরু হয় বিশ^ব্যাপী মুদ্রা ব্যবস্থায়। সেই অবস্থা চলে আসছিল। কিন্তু বর্তমানে মার্কিন ডলার অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে।
বিভিন্ন সংস্থা বিশ্ব বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের যে পরিসংখ্যান প্রদান করে তার মধ্যে কিছুটা ভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়। বিশেষ করে আইএমএফ’র প্রতিবেদনে দেখা যায়, এখনো মার্কিন ডলার রিজার্ভ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে শক্তিশালি অবস্থানে রয়েছে। সহসাই এই অবস্থান দুর্বল হবার আশঙ্কা নেই। কিন্তু বিশ্বের বেশির ভাগ অর্থনীতিবিদ আইএমএফ’র দেয়া পরিসংখ্যান এবং তথ্য বিশ্বাস করতে চান না। আইএমএফ বিশ্ব রিজার্ভ সংরক্ষণের যে পরিসংখ্যান প্রদর্শন করেছে তাতে দেখা যায়, ২০২২ সালের ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত বিশ্বের মোট রিজার্ভের ৫৮ দশমিক ৩৬ শতাংশ সংরক্ষিত হচ্ছিল মার্কিন ডলারে। দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল ইউরোপীয় ইউনিয়নের একক মুদ্রা ইউরো। ইউরোতে বিশ^ রিজার্ভের ২০ দশমিক ৪৭ শতাংশ সংরক্ষিত হচ্ছিল। জাপানি ইয়েনের মাধ্যমে রিজার্ভ সংরক্ষিত হচ্ছিল ৫ দশমিক ৫১ শতাংশ। বৃটিশ পাউন্ডের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ সংরক্ষিত হচ্ছিল ৪ দশমিক ৯৫ শতাংশ। চীনা ইউয়ানের মাধ্যমে ২ দশমিক ৬৯ শতাংশ, কানাডিয়ান ডলারে ২ দশমিক ৩৮ শতাংশ, অস্ট্রেলিয়ান ডলারে ১ দশমিক ৯৬ শতাংশ এবং অবশিষ্ট ৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ রিজার্ভ সংরক্ষিত হতো অন্যান্য মুদ্রায়। রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার কারণে রাশিয়া কিছুটা হলেও সমস্যায় পতিত হয়েছে। এই সুযোগে চীন তার মুদ্রার ব্যবহার এবং গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর জন্য সচেষ্ট হয়েছে। বিশ^ বাণিজ্যে চীনের ব্যাপক সাফল্য পরিলক্ষিত হচ্ছে। গত বছর রাশিয়া চীন থেকে যে পণ্য আমদানি করে তার ২৩ শতাংশ মূল্য পরিশোধ করেছে মার্কিন ডলারের পরিবর্তে ইউয়ানে।
ব্রিকস জোটের উদ্যোগে নতুন একক মুদ্রা প্রচলনের উদ্যোগের পাশাপাশি আরো কিছু পদক্ষেপ ইদানিং লক্ষ্য করা যাচ্ছে যা মার্কিন ডলারের একাধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারে। বিভিন্ন দেশ তাদের বন্ধুভাবাপন্ন দেশগুলোর সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক ভিত্তিতে বাণিজ্য শুরু করার উদ্যোগ নিচ্ছে। বাংলাদেশ ও ভারত রুপিতে বাণিজ্যিক লেনদেন শুরু করেছে যদিও তা সীমিত পরিসরে। চীন সৌদি আরবের সঙ্গে ইউয়ানের মাধ্যমে লেনদেন শুরু করেছে। সৌদি আরবের সঙ্গে চীনের আর্থিক ও বাণিজ্যিক লেনদেন অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় বেশি হচ্ছে। ভারত ব্রাজিল ও ইউনাইটেড আরব আমিরাতের সঙ্গে রুপিতে বাণিজ্য শুরু করেছে। আরো কয়েকটি দেশের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক মুদ্রায় বাণিজ্যিক লেনদেন শুরু হবে খুব সহসাই। মধ্যপ্রাচ্যে চীনের প্রভাব বৃদ্ধি পাচ্ছে অত্যন্ত দ্রুতগতিতে। সম্প্রতি চীনের মধ্যস্থতায় সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে। আইএমএফ বা অন্য কোনো সংস্থা যাই বলুক না কেনো মার্কিন ডলার আন্তর্জাতিক বাজারে প্রচন্ড চাপের মধ্যে রয়েছে। বিশেষ করে ব্রিকস জোট যদি একক মুদ্রা প্রচলনের বাস্তবসম্মত উদ্যোগ গ্রহণ করে তাহলে মার্কিন ডলার সত্যি সত্যি বিপাকে পতিত হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডলারের সম্ভাব্য পরিণতি সম্পর্কে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমেদ বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে মার্কিন ডলার এখনো শক্তিশালি অবস্থানে রয়েছে। বিশে^র অনেক দেশই মার্কিন ডলারে তাদের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ সংরক্ষণ করে। একটি দেশের মুদ্রা শুধু তার আর্থিক ব্যবস্থাপনার কারণে গ্রহণযোগ্যতা পায় না। দেশটির রাজনৈতিক অবস্থান এবং বিশ^ রাজনীতিতে তার অবস্থানও এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। তাই মার্কিন ডলার তার মর্যাদা হারাবে এটা এখনই নিশ্চিত করে বলা যায় না। ২ আগস্ট ২০২৩