আর্কাইভ

Archive for নভেম্বর, 2021

ছাত্রজীবন: দায়িত্ব ও কর্তব্য

একটা মানুষ তার দায়িত্ব সম্পর্কে যখন সচেতন হয়ে ওঠে তখন তার কর্তব্য বা করণীয় নির্ধারণে সে সাধারণত ভুল করে না বা কর্তব্য নির্ধারণ তার জন্য অনেক সহজ হয়ে ওঠে।

ছাত্রজীবনে একজন ছাত্র বা ছাত্রীর জীবন-যাত্রার যাবতীয় খরচ পিতা-মাতা বা অভিভাবকরা বহন করে থাকেন, সংসারের কোন অভাব-অন্টন বা দুঃখ-কষ্টই তারা সন্তানদেরকে বুঝতে দেন না। কেন দেন না?

দেন না এ কারণে, যাতে তোমার কোমল মনে কোন দাগ না পড়ে, তোমার জীবন যেন আনন্দে ভরে ওঠে, সংসারের অভাব-অন্টন বা দুঃখ-কষ্ট যেন তোমার মনকে ছোট করে না দেয়, কোন দুশ্চিন্তা বা মানসিক চাপে তোমার পড়াশোনার মনোযোগে যাতে ব্যাঘাত না ঘটে, তুমি যেন ক্যারিয়ার গঠনে অধিক মনোযোগী হও, অনেক স্বপ্ন নিয়ে বড় হও, সেভাবে নিজেকে গড়ে তোলো।

‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে’ সন্তানের প্রতি বাবা-মা’র এই আশীর্বাদ চিরন্তন। কিন্ত খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা ইত্যাদির খরচ যোগানোর জন্য তোমার কোন চিন্তা করতে হয় না বলে তুমি মনে করতে পারো না যে তুমি তুমি ভাবনাহীন, স্বাধীন এবং তোমার কোন দায়বদ্ধতাও নেই।

আসলে পিতা-মাতা যে সন্তানের জন্য সৃষ্টিকর্তার কত বড় আশীর্বাদ তা একমাত্র সেসব ছেলে-মেয়েরাই ভাল বুঝতে পারবে যাদের বাবা-মা নেই। সন্তান যতদিন না নিজের পায়ে দাঁড়ানোর উপযুক্ত না হয় ততদিন বাবা-মায়ের মনে শান্তি থাকে না। কিন্তু তোমাকেও বুঝতে হবে- তোমার জন্য যে বাবা-মা নিজেদের সর্বস্ব বিলিয়ে দিচ্ছেন, সেই বাবা-মাও এক সময় অক্ষম, অসহায় হয়ে পড়বেন। তোমাকে ভাবতে হবে তোমাকে নিয়ে তোমার বাবা-মা’ও অনেক স্বপ্ন দেখেন।

কাজেই ছাত্রজীবন বল্গাহীন স্বাধীন ও দায়িত্বহীন নয়। তোমার সবচেয়ে বড় দায়িত্ব হলো পিতা-মাতা অক্ষম, অসহায় হওয়ার আগেই সফলভাবে শিক্ষাজীবন সম্পন্ন করে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে উপযুক্ত বা সক্ষম করে গড়ে তোলা; যাতে তুমিও পিতা-মাতাকে সেভাবে সেবা-যতœ করতে পারো যেভাবে তারা তোমাকে আগলে রেখে বড় করে তুলছেন। নিজেকে এমনভাবে গড়ে তোল যাতে তোমার নিজের স্বপ্ন পূরণ করতে পারো, পরিবার ও দেশের মুখ উজ্জ্বল করতে পারো।

আজকের ছাত্র/ছাত্রী আগামী দিনের নাগরিক। তাই তোমার উচিত এমনভাবে নিজেকে গড়ে তোলা, যাতে ভবিষ্যতে দেশের এবং মানুষের উন্নয়নে তুমি ভূমিকা রাখতে পারো এবং তোমার কৃতিত্বে দেশের সুনাম বৃদ্ধি পায়।

একইভাবে, তোমার এমন কিছু করা উচিত নয়, যার ফলে তোমার পিতা-মাতা, তোমার পরিবার, তোমার দেশ লজ্জায় মাথা নত করতে বাধ্য হয়।

তোমাকে উপলব্ধি করতে হবে- ভাল একাডেমিক ক্যারিয়ার গড়ে না তুললে বা অত্যন্ত সফলতার সাথে শিক্ষাজীবন শেষ না করলে তোমার পক্ষে ভাল কোন কর্মসংস্থান করা সম্ভব হবে না। আর যদি সেটা না হয়, তুমি যদি বেকার থাকো, তাহলে না পারবে তুমি নিজের কোন স্বপ্ন পূরণ করতে, আর না পারবে পিতা-মাতা, ভাই, বোন কিংবা নিজের স্ত্রী-সন্তানাদির প্রতি কোন দায়িত্ব পালন করতে।

কেউ যদি মনে করে যে, ছাত্রজীবন হচ্ছে হেসে-খেলে পার করার দিন তাহলে সে নিতান্তই নির্বোধ। নিজের ভবিষ্যত নিয়ে যে ভাবে না, যার কোন স্বপ্ন নেই, যার কোন ভবিষ্যত পরিকল্পনা নেই, তাকে কোন ভাবেই সুস্থ, পরিপূর্ণ বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ বলা যায় না। কেননা, কেবলমাত্র বুদ্ধি প্রতিবন্ধি, মাদকাসক্ত কিংবা চতুস্পদি প্রাণীরাই বোধহীন, বিবেকহীন, পরিকল্পনাহীন হয়ে থাকে।

সুতরাং প্রতিটি ছাত্র/ছাত্রীরই উচিত নিজেদের ক্যারিয়ার গঠনে যতœবান হওয়া। আসলে এটিই একজন ছাত্র বা ছাত্রীর প্রধান কর্তব্য। অধ্যয়নকে সাধনা, তপস্যা বা পবিত্র ধর্মীয় কর্তব্য হিসেবেই নেয়া উচিত। হিন্দু ধর্মে যেমন বলা হয়েছে, ছাত্রনং অধ্যয়নং তপঃ। অর্থাৎ অধ্যয়নই ছাত্রের তপস্যা। ছাত্রজীবনে পড়া-শোনার চাইতে আর কোন কিছুকে গুরুত্ব দেয়া উচিত নয়। যতই দেশের কথা, জাতির কথা আর রাজনীতির কথা বলা হোক না কেন ছাত্রত্বকে বাদ দিয়ে কোন ছাত্র-রাজনীতিকেই সমর্থন দেয়া যায় না। কারণ মেধাশূন্য নেতৃত্ব শেষ পর্যন্ত জাতির জন্য অভিশাপই বয়ে আনে। তাছাড়া অজ্ঞানতা ও মুর্খতার কারণেই জীবন ও জগৎ সম্পর্কে একপেশে ধারণা, কুপমন্ডুকতা, গোঁড়ামী, কুসংস্কার, সাম্প্রদায়িকতা, অন্ধ বিদ্বেষ, প্রতিহিংসা ও সন্ত্রাসবাদ মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। এ কারণে ইসলাম ধর্মে জ্ঞানার্জনের প্রতি অত্যন্ত গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। নারী পুরুষ সবার উপর জ্ঞানার্জনকে নামাজ-রোজার মতই ফরজ বা অত্যাবশ্যকীয় ঘোষণা করা হয়েছে।

এক্ষেত্রে যে বিষয়গুলোর প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে সেগুলো হলো:

১. নিজেকে প্রস্তুত করার অঙ্গীকার করা এবং ক্যারিয়ার প্লান করা

২. রাত জাগার অভ্যাস ত্যাগ করা ও রাত দশটার মধ্যে ঘুমাতে যাওয়া

৩. ভোরে ঘুম থেকে উঠে পরিচ্ছন্ন/পবিত্র হয়ে প্রার্থনা করার পর শরীর চর্চা করা এবং খালি পেটে পানি পান করা (লেবুর রস সহ)

৪. মনোযোগের সাথে নিয়মিত পড়াশোনা করা এবং হোমওয়ার্ক করা

৫. নিয়মিত এবং যথা সময়ে শ্রেণীকক্ষ, বিজ্ঞানাগার, সেমিনারে অংশগ্রহণ করা

৬. স্যার/ম্যাডাম যা বলেন তা মনোযোগ দিয়ে শোনা এবং নোট নেয়া

৭. টিচার যা বলেন তা বোঝার চেষ্টা করা

৮. বিষয়বস্তু নিয়ে পর্যালোচনা করতে শেখা

৯. লেসন বা পাঠ সম্পর্কে পূর্ণ ধারণা লাভের চেষ্টা করা

১০. পঠিত বিষয়ের সারাংশ বা মূলভাব উপলব্ধির চেষ্টা করা

১১. যথাসময়ে এবং নিয়মিত হোমওয়ার্ক/এসাইনমেন্ট সম্পন্ন করে জমা দেয়া এবং মানসম্পন্ন করার চেষ্টা করা

১২. গোজামিল ও অজুহাত বর্জন করা

১৩. পরীক্ষায় অসৎ উপায় অবলম্বন থেকে বিরত থাকা

১৪. প্রাতিষ্ঠানিক সততা ও ন্যায়পরায়ণতা প্রদার্শন করা

১৫. কলেজের শিক্ষকদের সাথে সতর্ক ও সম্মান প্রদর্শনের মাধ্যমে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করা

১৬. কলেজের রিসোর্সগুলো কাজে লাগানোর চেষ্টা করা এবং প্রয়োজনে সহযোগিতা নেয়া

১৭. পড়াশোনায় মনোযোগী ভাল ছাত্রদের সুসম্পর্ক গড়ে তোলা, যারা ক্লাশের বাইরেও কলেজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে।

১৮. শিক্ষাগত সাফল্যের লক্ষ পূরণের জন্য পরিকল্পনা নির্ধারণ, উন্নয়ন ও বাস্তবায়নের চেষ্টা

১৯. সব সময় শিষ্টাচার বজায় রাখবে যাতে তোমার কলেজের শিক্ষা, নিয়ম-নীতি ও সামাজিক পরিবেশের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা হয়।

২০. ভিন্ন মত ও মতাদর্শের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করবে

২১. বড়দের সম্মান করা এবং ছোটদের ¯েœহ করা

২২. খেলাধূলা/বিনোদনে অংশগ্রহণ করা

২৩. সময় মত সব কাজ করা

২৪. রুটিন মেনে চলা এবং সময় নষ্ট না করা

২৫. নিজের এবং পিতা-মাতার ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করা

মোট কথা ছাত্রজীবনের প্রধান কর্তব্য শিক্ষাজীবনে সফলতা লাভে সচেষ্ট হওয়া, ভাল একাডেমিক ক্যারিয়ার গড়ে তোলার চেষ্টা করা, এর জন্য পরিকল্পনা করা, ক্যারিয়ার রোডম্যাপ তৈরি করা এবং তা বাস্তবায়নের দিকে এগিয়ে যাওয়া, ভাল পাঠোভ্যাস গড়ে তোলা। স্কুল, কলেজ ও বিশ^বিদ্যালয়ে সর্বত্র ভাল রেজাল্ট করার পাশাপাশি ভাল-আদর্শ স্টুডেন্ট হওয়ার চেষ্টা করা এবং ভাল ও সৎ স্টুডেন্টদের সাথে মেশা, তাদের নিয়ে স্টাডি গ্রুপ তৈরি করা, খেলাধুলা করা, শিক্ষা প্রতিষ্টানের বিভিন্ন কর্মকা-ে অংশগ্রহণ করা, টিচারদের সাথে ভাল সম্পর্ক গড়ে তোলা, তাদের পড়ামর্শ নেয়া এবং তাদের কাজে সহযোগিতা করা, সামাজিক ও সমাজকল্যাণমূলক কাজে অংশগ্রহণ করা। একই সাথে নেশাখোর, সন্ত্রাসী, জঙ্গি, পড়াশোনায় অমনোযোগী তথা খারাপ স্টুডেন্টদের সাহচর্য ও মাদকাসক্তি থেকে বেঁচে থাকার চেষ্টা করতে হবে। কথায় বলে, সৎ সঙ্গে স¦র্গবাস অসৎসঙ্গে সর্বনাশ।

তবে এটা মনে করা ঠিক নয় যে, ছাত্রজীবন অত্যন্ত নিরস এবং আনন্দদায়ক নয়; বরং সত্যি কথা হলো- এই সময়টাই হলো মানব জীবনের সবচেয়ে সোনালী সময়, ভাবনাহীন আনন্দের সময়। এছাড়া পড়াশোনা এবং অধ্যয়নও অত্যন্ত আনন্দদায়ক, কেননা, এটি তোমার জন্য অজানাকে জানার দরজা উন্মুক্ত করে দেয়।

তুমি শিক্ষামূলক কিছু শখের চর্চা করতে পারো, যেগুলো তোমাকে প্রচুর আনন্দ দিবে আবার শিক্ষণীয়ও হবে। যেমন- তুমি প্রকৃতি বিষয়ে ডিবেটিং সোসাইটি বা ক্লাবে যোগ দিতে পারো যা তোমাকে আত্ম-উন্নয়নে সাহায্য করবে।

বিভিন্ন উপলক্ষে তুমি আবৃত্তি, গান অথবা নাটকের কোন চরিত্রে অভিনয়ও করতে পারো, যার প্রতিটিই অত্যন্ত আনন্দের।

মাঝে মধ্যে তুমি সংক্ষিপ্ত শিক্ষা সফরেও যেতে পারো, এর মাধ্যমে তুমি অনেক সহজে নিজের দেশ দেশের মানুষকে জানতে পারবে।

আর একজন শিক্ষার্থীকে অবশ্যই ডিসিপ্লিন শিখতে হবে; কেননা, এর মাধ্যমেই সে তার জীবনের জন্য সঠিক প্রশিক্ষণ নিতে পারে।

এছাড়া তুমি তোমার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পিকনিক এবং ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদিতেও অংশগ্রহণ করতে পারো, যা তোমাকে আনন্দ ও উৎসাহ প্রদান করবে।

আর এসব কর্মকা-ই টীম-স্পিরিটের ভিত্তিতে পরিচালিত হয় যা উৎসাহব্যঞ্জক।

প্রত্যেক শিক্ষার্থীকেই এই কথাটি মনে রাখতে হবে যে, শিক্ষা গ্রহণই হচ্ছে শিক্ষাজীবনের আসল উদ্দেশ্য এবং এই শিক্ষাগ্রহণকেই সবার উপর প্রাধান্য দিতে হবে। তবে এর পাশাপাশি সে প্রাতিষ্ঠানিক এবং পাঠ্যক্রম বহির্ভূত শিক্ষামূলক কর্মকা-েও অংশগ্রহণ করতে পারে।

ছাত্রজীবনের সবচেয়ে বড় শত্রু কুপ্রবৃত্তির পূজা বা মন যা চায় তাই করে বেড়ানো। কথায় বলে ‘আপনা মাংসে হরিণা বৈরী’ বা নিজের মাংসই হরিণের বড় শত্রু। টগবগে তারুণ্যই ছাত্রজীবনের অহংকার। কিন্তু প্রবৃত্তিপূজা বা কুপ্রবৃত্তির কাছে আত্মসমর্পন বা বল্গাহীন উচ্ছৃংখলা ছাত্রজীবন তথা ক্যারিয়ার গঠনকে ধ্বংস করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। এক্ষেত্রে নিষ্ঠার সাথে ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলা; পূর্ণ মনোযোগের সাথে নামাজ পড়া ও রোজা রাখা, অর্থসহ কোরআন তেলাওয়াত ও হাদীস পাঠ, আত্মিক উন্নতিমূলক ধর্মীয় বই পড়া রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করতে পারে, যা তোমাকে অসৎ সঙ্গ ও কু-অভ্যাস থেকে রক্ষা করে শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা ও সমৃদ্ধি দান করবে। এর ফলে আত্মগঠন তথা জ্ঞানার্জনের পাশাপাশি নৈতিক ও আত্মিক উন্নয়ন সহজ হবে। বলাবাহুল্য শিক্ষার প্রধান উদ্দেশ্যই হল মানুষকে শারীরিক, মানসিক ও আত্মিক উন্নতির মাধ্যমে সর্বোচ্চ নৈতিক আদর্শে উন্নীত করা। আমাদের প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মাদ (সঃ)-এর শিক্ষাই ছিল এটি। তিনি বলেছেন, ‘নৈতিক চরিত্রের পূর্ণতা বিকাশের জন্যই আমাকে পাঠানো হয়েছে’।

দখা যাচ্ছে ছাত্রজীবন মোটেও হেলাফেলার সময় নয়। এ সময়ে যারা প্রাতিষ্টানিক শিক্ষা, চরিত্র গঠন, স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও সৃজনশীলতার বিকাশে যতœবান হয় জীবনের সফলতা তাদের জন্যই অপেক্ষা করতে থাকে। অন্যদিকে এ সময়ে যারা হেলাফেলায় সময় নষ্ট করে, নেশাগ্রস্থ হয়ে ও অসৎ বন্ধু-বান্ধবদের পালায় পড়ে বেঘোরে সময় নষ্ট করে এবং সময়ের কাজ সময়ে করতে পিছপা হয়, পরবর্তী জীবনে তাদের জন্য কেবল আফসোস, হতাশা ও অভিশাপই অপেক্ষা করতে থাকে। অতএব আমরা এ সিদ্ধান্তে আসতে পারি যে, ছাত্রজীবন মোটেই উদ্দেশ্যহীন ও দায়িত্বহীন জীবনের নাম নয়। বরং ছাত্রজীবনেই পালন করতে হয় মানব জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। আর সে দায়িত্ব হচ্ছে নিজেকে গড়ার দায়িত্ব। পৃথিবীকে গড়তে হলে সবার আগে নিজেকে গড়াই হচ্ছে সবচেয়ে বড় দায়িত্ব।

সূত্র: ছাত্রজীবন: সাফল্যের শর্তাবলী

মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের সাফল্য যখন আলোচনায়

সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ইউনিটের ভর্তি-ইচ্ছুক শিক্ষার্থীদের প্রতিযোগিতা হয়ে গেল। করোনা পরিস্থিতি বিবেচনায় ঢাকা ছাড়াও দেশের সাতটি বিভাগীয় শহরে পরীক্ষা কেন্দ্র স্থাপন করা হয়। ফল প্রকাশিত হয়েছে। দেখা যায় অনেকগুলো ইউনিটেই শতকরা প্রায় ৯০ জন ছাত্রছাত্রী পাস নম্বরই পায়নি। এটি দুঃখজনক এবং আমাদের মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাব্যবস্থায় ক্রমবর্ধমান দৈন্যের স্মারক। আবার দেখা গেছে পরীক্ষায় মাদ্রাসশিক্ষার্থীদের অনেকে তুলনামূলক ভালো ফল করেছে। এই ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন মাধ্যমে নানামুখী আলোচনা চলছে।

অনেকেরই অভিযোগ, মাদ্রাসা থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তর উত্তীর্ণ ইংরেজি ভাষায় নিম্নমানের ছাত্রছাত্রীরা ক্রমবর্ধমান হারে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। তাঁরা মনে করেন, মূল্যায়নের জন্য মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকের ফলাফল থেকে বিবেচনার জন্য ৮০ নম্বর নেওয়া হয় বলে মাদ্রাসাশিক্ষার্থীরা সুবিধা পেয়ে যায়। দাখিল ও আলিম পরীক্ষায় তারা এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের চেয়ে অনেক বেশি নম্বর পায় বলে একটি ধারণা অনেকের মধ্যে রয়েছে। ফলে মাদ্রাসাশিক্ষার্থীদের সঙ্গে কলেজ থেকে আসা শিক্ষার্থীরা প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছে।

দাখিল ও আলিম সরকার স্বীকৃত মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরের পরীক্ষা। বর্তমানে দেশের তিনজন ছাত্রের একজন মাদ্রাসার এবং সংখ্যাটি দেড় কোটির মতো বলে অনেকে দাবি করেন। যদিও এসব তথ্যের সমর্থনে নির্ভরযোগ্য কোনো সূত্র পাওয়া যায় না। তবে সংখ্যাটি নিয়ে বড় রকমের বিতর্কে যাওয়ার সুযোগ কম। দেশে মাদ্রাসার সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। আলিয়া মাদ্রাসাগুলোর শিক্ষক-কর্মচারীরা বেসরকারি স্কুল-কলেজের মতো সরকারের এমপিও সুবিধার আওতায় বেতন-ভাতা পেয়ে থাকেন। স্বাধীনতার পরপর ভিন্নমত থাকলেও প্রথম শিক্ষা কমিশনই মাদ্রাসাশিক্ষা বহাল রাখার পক্ষে মত দেয়। আর বর্তমান সরকার কওমি মাদ্রাসাগুলোর ডিগ্রির সমতাকরণ করে এদেরও মূলধারায় এনেছে। ধরে নিতে হবে দেশের বাস্তবতার নিরিখেই এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তবে অভিযোগ সত্য যে কওমি মাদ্রাসা পরিচালনায় সরকারের কোনো নিয়মনীতি বা নিয়ন্ত্রণ নেই। তা সত্ত্বেও এগুলো আছে এবং ক্রমবিকাশ ঘটছে।

আলিয়া মাদ্রাসা থেকে মূলধারার শিক্ষাব্যবস্থায় সুযোগ করে নেওয়া নতুন কোনো বিষয় নয়। স্বাধীনতার আগেও অনেকেই এসেছেন। কৃতী হয়েছেন কেউ কেউ। ঠিক তেমনি আসছে স্বাধীনতার পরও। সফলও হয় অনেকে। আর আসে এবং টিকে থাকে প্রতিযোগিতা করেই। সিভিল সার্ভিসে আসা একজন তো চাকরিজীবনে সাফল্যের পরিচয় দিয়ে সরকারের বেসামরিক প্রশাসনের শীর্ষ পদে ছিলেন। এখনো বিদেশে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছেন। তাদের আমরা ঠেকিয়ে রাখব কেন? তারা তো বরং সমৃদ্ধ করছে আমাদের শিক্ষাজগৎকে। বাঁকা পথে তাদের আগমন বা পথচলা নয়। মূলধারাতেও তাদের অনেক লড়াই করতে হয়েছে। তেমনি এবার একজন এলেন খ ইউনিটে প্রথম স্থান অধিকার করে। জানা যায়, ছাত্রটি সাধারণ লাইনেও কিছুদিন পড়াশোনা করেছিল। বৃত্তি পেয়েছিল পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণিতে। এবার দাখিল ও আলিমে ভালো ফল করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়। তার এ ফলাফল খুব স্বাভাবিক বলে ধরা চলে। এতে কেউ কেউ বিচলিত হচ্ছেন দেখে হতাশ হই। সে ভর্তি পরীক্ষার স্বাভাবিক নিয়মকানুন অনুসরণ করে সফলতার স্বাক্ষর রাখল। আমাদের তো তার মূলধারায় প্রত্যাবর্তনকে স্বাগত জানানোই উচিত।

তবে আলিম ও ফাজিল পরীক্ষায় নমনীয় নম্বর দেওয়ার সুযোগে কেউ বেশি নম্বর পেয়ে সাধারণ লাইনের ছাত্রছাত্রীদের ঠেকিয়ে সুযোগ করে নেওয়ার বিষয় থাকলে সমর্থনযোগ্য নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় নিয়মকানুন ঠিক করেন তার শিক্ষকেরাই। এসব কমিটিতে মাদ্রাসাশিক্ষকদের কোনো প্রতিনিধিত্ব থাকে না। আলিম ও ফাজিল পরীক্ষায় নমনীয় নম্বর দেওয়ার যে অভিযোগের কথা বিভিন্ন মহলে আলোচিত হয়, তা গভীরভাবে বিশ্লেষণ করে দেখা উচিত। যদি এমনটা হয় ভর্তি পরীক্ষায় মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা স্তরের ফলাফলের জন্য নির্ধারিত নম্বর হ্রাস করে নিজেদের পরীক্ষার নম্বর বাড়িয়ে দেওয়া চলে। তবে তা করতে হলে সমভাবে সাধারণ ও মাদ্রাসা দুই ক্ষেত্রের জন্যই করতে হবে। তাই লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড চাই।

বিবেচনায় নিতে হবে যে আমাদের মাদ্রাসাশিক্ষার্থীদের আর্থসামাজিক অবস্থান সাধারণ লাইনের ছাত্রছাত্রীদের চেয়ে পেছনে। তা-ও তাদের জন্য বিশেষ কোনো সুযোগ দেওয়ার দাবি কেউ করে না। তবে প্রাপ্য থেকেও বঞ্চিত করা যাবে না। বরং সাধারণ বিচারে মাদ্রাসাছাত্রদের লেখাপড়ার মান তুলনামূলকভাবে কিছুটা দুর্বল। এ দুর্বলতাকে অতিক্রম করে কেউ যদি ভালো করে, তাকে উৎসাহ দেওয়া উচিত। তা না করে তাদের প্রতি বৈরী আচরণ সমর্থনযোগ্য হবে না। ছাত্রছাত্রীদের এক-তৃতীয়াংশ যদি মাদ্রাসার হয়ে থাকে, তাদের মূলধারায় সম্পৃক্ত করার জন্য নানামুখী পদক্ষেপ দরকার।

মাদ্রাসা থেকে আসা ছাত্রদের ইংরেজি জ্ঞান নিয়ে যে প্রশ্ন উঠছে, তা সম্ভবত ব্যাপকভাবে অন্য অনেকের জন্যও প্রযোজ্য। বিস্ময়ের ব্যাপার, ভর্তি পরীক্ষায় ইংরেজি ন্যূনতম নম্বর ধরে একটি মানদণ্ড আছে। প্রয়োজন মনে করলে সেটা আরও বাড়ানো যায়। অবশ্য সারা দেশের শিক্ষার মানই আজ প্রশ্নবিদ্ধ। সে প্রশ্নের মুখোমুখি শিক্ষার্থী-শিক্ষক সবাই। তার মধ্যেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ই দেশের সেরা, এতে কোনো সন্দেহ নেই। এখানে অনেক মেধাবী শিক্ষক কঠোর শ্রম দিয়ে যাচ্ছেন। রয়েছে অনেক মেধাবী ছাত্র। তেমনি শিক্ষকদের কারও কারও পিএইচডি থিসিস বা গবেষণাপত্র নিয়ে যখন চৌর্যবৃত্তির অভিযোগ ওঠে, শাস্তি হয়, তখন কিন্তু ভিত কেঁপে ওঠে প্রতিষ্ঠানটির। আর সে অভিযোগ আকস্মিক নয়। প্রায়ই আসে।

সহজেই বোঝা যায় সেসব শিক্ষক কিন্তু সবাই ধরাও পড়েন না। তাহলে ধরে নিতে হবে এখানে অনেক গুণী-জ্ঞানী শিক্ষকের পাশাপাশি বিপথগামীও কেউ কেউ আছেন। তাঁরাও পড়াচ্ছেন। তাই এ গলদ থাকবে এবং সেটা ক্রমান্বয়ে বাড়তে পারে। বছর তিনেক আগে সিনেট সভায় ট্রেজারার ইভিনিং কোর্সের নামে বিশ্ববিদ্যালয় নিম্নমানের গ্র্যাজুয়েট তৈরি করছে বলে অভিযোগ করেছিলেন। খণ্ডন করেননি কেউ অভিযোগটি। প্রতিকারও হয়নি। প্রথাটি চলমান। তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদই পাচ্ছে। তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার পরিবেশ এরূপ হলে এখান থেকে উন্নত মেধাবী ছাত্রছাত্রী সরবরাহ কি নিশ্চিত করা যায়? সুতরাং মাদ্রাসাই একমাত্র বাধা হিসেবে চিহ্নিত করবেন না। আরও অনেক গলদ এর মধ্যে আছে।

তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় মাদ্রাসা ছাত্রছাত্রীদের অংশগ্রহণ ও সাফল্য এবং গোটা দেশের মাদ্রাসাশিক্ষার্থীর অনুপাত আলোচনার প্রয়োজন ছিল। অজানা ছিল এগুলোর অনেক কিছুই। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় শ্রেণি হিসেবে মাদ্রাসাশিক্ষার্থীদের সাফল্যে আমরা বিচলিত নই। বরং তাদের মূলধারায় প্রত্যাবর্তনকে স্বাগত জানাই। তবে এ প্রতিযোগিতা যথাযথ হচ্ছে কি না, সেটা দেখার দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের। নতুন পরিস্থিতিতে এটা যাচাই করে দেখার প্রয়োজনও সামনে এসেছে।

আলী ইমাম মজুমদার সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব

১১ নভেম্বর ২০২১

স্মৃতি-যাপন

১.

শীতের সকালে উঠোনে দাঁড়িয়ে রোদ তাপাতাম। বড় থালায় গরম ভাপা পিঠে নিয়ে কুয়াশার ভিতর দিয়ে হেঁটে হেঁটে বস্তির কিশোরীরা আসতো। পিঠেগুলো পাতলা কাপড়ে ঢাকা থাকতো। কী যে অসম্ভব স্বাদ ছিল ওইসব পিঠের! ভাপা পিঠে বড় হয়ে খেয়েছি। কিন্তু অমন স্বাদ আর পাইনি।

নানিবাড়ির বরই ছিল শহরের সবচেয়ে সুস্বাদু। বড় হয়ে বরই অনেক খেয়েছি। নানিবাড়ির বরইয়ের চেয়ে বেশি সুস্বাদু বরই আমি আর খাইনি। শুধু কি নানিবাড়ির বরই, আমাদের বাড়ির সেই পেয়ারা, সেই কাঁঠাল! কখনও কি অত ভালো পেয়ারা বা কাঁঠাল আর কোথাও খেয়েছি? খাইনি। একটুও বানিয়ে বলছি না।

মা রান্না করতো মাটির চুলোয়। ফুঁকনি ফুঁকে ফুঁকে কী যে অসম্ভব কষ্ট করে আগুন জ্বালাতে হতো মা’কে। সব সময় কাঠ থাকতো না, গাছ-গাছালির ডাল পাতা দিয়েই রান্না করতো মা। কিন্তু মা যা কিছুই রান্না করতো, সবকিছুর স্বাদ ছিল অবিশ্বাস্য রকম ভালো। বড় হয়ে সারা পৃথিবীর কত বড় বড় দেশের কত বড় বড় রেস্তোরাঁয় খেয়েছি। কত বড় বড় ব্যাংকোয়টে। মা’র হাতের ওই রান্নার চেয়ে সুস্বাদু আর কোনও রান্না আমি আজ অবধি খাইনি। এর কারণ কি এই যে ছোটবেলার স্বাদ গন্ধ স্মৃতির কোষে কোষে এমনভাবে ঢুকে যায় যে কিছুই আর একে সরাতে পারে না! নাকি অন্য কিছু! মা ছিল জাদুকরের মতো। মাঝারি কোনও হাঁস বা মুরগি রান্না করে বাড়ির আট-ন’জন লোককে দু’বেলা খাওয়াতো। তারপরও কিছু টুকরো রেখে দিত পরদিন সকালে রুটি-মাংসের নাস্তার জন্য। মা’র সবকিছুতে বড় জাদু ছিল। নিজের হাতে লাগানো নারকেল গাছের নারকেল দিয়ে মা তক্তি বানাতো। যখনই তক্তি খাই, মা’র ওই তক্তির তুলনায়, বুঝি, যে, এ কিছুই নয়। মা প্রায় সারা বছরই নিজের বাগান থেকে তুলে শাক সবজি ফল মূল খাওয়াতো। ওগুলোর তুলনা ওগুলোই।

শুনেছি নিজের মা’র রান্নার প্রশংসা সবাই করে। রান্নাঘরই মেয়েদের জায়গা, পুরুষতান্ত্রিক এই ধারণার বিরুদ্ধে আমি ভীষণ প্রতিবাদ করি। কিন্তু রান্নাকে আমি নিখুঁত এক শিল্প বলে মেনেই মা’কে অসাধারণ শিল্পীর মর্যাদা দিচ্ছি, মা বলে মা’র প্রশংসা করছি না। শুধু মা’র নয়, নানির রান্নাও ছিল অতুলনীয়। নানির রান্নাঘরে পিঁড়িতে বসে ভাত খেতাম, মাছ বা মাংস দিয়ে খাওয়া শেষ হলে দুধ-ভাত। দুধ খেলে, নানি বলতো, ব্রেন ভালো হয়। ছোট একটি শিং মাছের টুকরো, বা ছোট একটি মুরগির পাখনা, বা খাসির নলি, আর তার ঝোল দিয়ে এক থালা ভাত খেয়ে কী যে ভীষণ তৃপ্তি হতো! এখন এক বেলাতেই প্রায় এক কিলো মাছ বা মাংস খাওয়া হয়ে যায়। এতেও সেই আগের তৃপ্তি জোটে না!

ছোটবেলার একটি দৃশ্য আমার খুব বেশি ভালো লাগতো। নানির ঘরে বিকেলে বই পড়া হতো, একজন পড়তো, বাকিরা চুপ করে সেই পড়া শুনতো। মামা, খালা, মা, নানি, পড়শি-সবাই শুনতো। কোনও ধর্মের বই নয়। গল্পের বই। ওই বই পড়া শুনতে শুনতেই, আমার বিশ্বাস, আমার বই পড়ার অভ্যেস হয়েছে। বই পড়ার অভ্যেস থেকেই গড়ে উঠেছে বই লেখার অভ্যেস। নানির ঘরের ওই চমৎকার দৃশ্যটা আর কখনও আমি দেখতে পাবো না, যখন ভাবি, বুকের ভিতর নিঃশব্দে একটা কষ্টের স্রোত বইতে থাকে। বইতে থাকেই। মা নেই। সেই মামারা নেই, যে খালা বই পড়তো, সেও নেই। কেমন একটা নেই নেই চারদিকে। শুধু দৃশ্যটা গেঁথে আছে হৃদয়ে।

ছোটবেলার আনন্দগুলো বড় তীব্র ছিল। পরার তিনটে জামা হলে যে সুখ পেতাম, এখন আলমারির তিন শ জামাও সেই সুখ দেয় না। ছোটবেলার অনেক কিছু হারিয়ে গেছে। সকালে মুড়িওয়ালা যেতো। ‘মুড়ি…’র শব্দ শুনে দৌড়ে বেরিয়ে মুড়িওয়ালাকে বাড়িতে ডেকে আনতাম। বাবা পুরো মুড়ির টিনই কিনতো। সেই টিনের মুড়ি সারা মাস খাওয়া হতো। কত কিছু নিয়ে যে ফেরিওয়ালা যেতো! চুড়ি ফিতে যেতো দুপুরবেলায়। ওসবে একটুও আকর্ষণ ছিল না আমার। বাদামওয়ালা, বুটওয়ালা, চানাচুরওয়ালা আইসক্রিমওয়ালা যেতো। বিকেলে বারান্দায় বসে ঝালনুন মিশিয়ে চিনেবাদাম খেতে খেতে গল্প করার সেই আনন্দ এখন আর নেই। সেই দুপুরবেলার তেঁতুল, সেই রোদে দেওয়া মা’র বয়ামের আচার! ওই জীবন আর শত চাইলেও ফেরত পাবো না। যা গেছে তা যেন চিরকালের জন্যই গেছে। বাড়ির মাঠে সেই বৌচি খেলা, সেই চোর চোর, সেই হাডুডু, সেই মার্বেল, সেই লাটিম, ডাংগুলি-আর কি ফিরে আসবে কখনও! আজকালকার বাচ্চারা কমপিউটার গেইম খেলে, ভিডিও গেইম খেলে, এসবই তাদের ভালো লাগে। আমরা একালে জন্মালে আমাদেরও কমপিউটার গেইমই ভালো লাগতো, মাঠে মাঠে দৌড়োনোকে অর্থহীন বলে মনে হতো। ভাগ্যিস তখন জন্মেছিলাম! তখন জন্মেছিলাম বলে ধুলোবালিতে গড়াগড়ি খেয়েছি, যন্ত্রহীন সমাজের স্বাদটা পেয়েছি। হ্যারিকেন জ্বালিয়ে সন্ধেয় পড়তে বসেছি, হাতপাখায় বাতাস করে গ্রীষ্মকাল কেটে গেছে, বুঝিনি কখনও যে বৈদ্যুতিক বাতি বা পাখা থেকে বঞ্চিত হচ্ছি। টেলিভিশন ছিল না, রেফ্রিজারেটর ছিল না, মোবাইল ফোন ছিল না, কমপিউটার ছিল না, কিন্তু কখনও মনে হয়নি কিছুর আর প্রয়োজন আছে, যা আছে তার বাইরে। এখন এই যন্ত্রনির্ভর, অর্থনির্ভর সমাজের অভিজ্ঞতাও হচ্ছে। ইতিহাস পড়ে জানা, আর নিজে যাপন করে জানায় দু’টো দু’রকম সময়ের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছি আমরা। এ আমাদের সৌভাগ্যই বটে। এক জীবনে কত কিছু দেখা হলো। এখানে দাঁড়িয়ে অন্তত কিছুটা হলেও তো ধারণা করতে পারি ভবিষ্যৎটা ঠিক কোন দিকে যাচ্ছে।

দিন দিন মানুষের ধন দৌলত বাড়ছে, জৌলুস বাড়ছে, ভোগ বিলাস বাড়ছে, সাজগোজ বাড়ছে। আগে আমাদের অল্পতে সুখ হতো, এখন অল্পতে সুখ হয় না। আগে দরিদ্র ছিলাম আরো এবং এখনকার চেয়ে সুখী ছিলাম আরো। সুখের সঙ্গে সত্যি বলতে কী ধন দৌলতের খুব একটা সম্পর্ক নেই।

২.

আমার বেশ কিছুদিনের চেনা এক কবি এর মধ্যে বেশ কিছু কবিতা পড়ে ফেলেছেন আমার। ব্লগেই পড়েছেন। বললেন, আমার কবিতা খুব আটপৌরে। আটপৌরে বলতে ঠিক কী বোঝাতে চেয়েছেন জানি না। কী? খুব পাশের বাড়ি পাশের বাড়ি, চিনি চিনি ধরনের? খুব ঘরের কিছু, মাছ ভাত, হলুদ নুন এর মতো? পানের বাটা, চাল-কুমড়ো, দিদি-মা দিদিদের শ্বশুরবাড়ি চলে যাওয়া? কবি আমাকে ঠিক বলেন নি কী। তবে আটপৌরে শব্দটা উচ্চারণ করতেই মা’র পরনের সেই আটপৌরে ধনেখালি শাড়িটা যেন উড়ে এসে আচমকা আমার শরীর, আমার মুখ চোখ ঢেকে দিল। আমি শুধু চোখ বুজে ঘ্রাণ নিলাম আমার মা’র শরীরের। একটা জুঁই ফুল জুঁই ফুল ঘ্রাণ ছিল মা’র শরীরে! কত হাজার বছর মা’কে দেখি না!

মা মারা যাওয়ার পর বেশ কয়েক বছর আমি ঘুমের মধ্যে একটা স্বপ্ন দেখতাম। ওই একটা স্বপ্নই আমি প্রতি রাতে দেখতাম। স্বপ্নটা এমন: মা বাড়িতে আছে, হাঁটছে, হাসছে, কথা বলছে। ঠিক আগের মতো সব কিছু। মা’কে আমরা সবাই খুব আদর যত্ন করছি, খুব ভালোবাসছি, মা’ও বাড়ির সবার খোঁজ-খবর নিচ্ছে, সবাই খাচ্ছে কিনা, ঘুমোচ্ছে কিনা, বাড়ি ফিরছে কিনা দেখছে। মা’র শরীরে অসুখ। কিন্তু অসুখটা নিয়েই মা বেঁচে আছে। মা মারা যাবে এরকম ভাবছে অনেকে, কিন্তু মা আসলে মারা যাচ্ছে না। অথবা মারা গিয়েছিলো, কিন্তু কী করে যেন মৃত্যুকে ঠেলে সরিয়ে বাড়ি ফিরে এসেছে। এই স্বপ্নের নরম পালক কে যেন আমার চোখে মুখে আলতো ছুঁইয়ে ঘুম ভাঙাতো। ঘুম ভাঙার অনেকক্ষণ পর্যন্ত আমার মনে হতো যে স্বপ্নটা বুঝি সত্যি। অনেকক্ষণ, সম্ভবত কয়েক সেকেন্ড। স্বপ্নের জন্য, ঘোরের জন্য, পরাবাস্তবতার জন্য কয়েক সেকেন্ডই অনেকক্ষণ। কয়েক সেকেন্ড পার হলে বুঝে যেতাম, ও স্বপ্ন, মা বেঁচে নেই। খুব কষ্ট হতো। স্বপ্নটা সত্যি হোক, কী যে ভীষণ চাইতাম! মা’র না মরে যাওয়াটা যদি সত্যি সত্যিই সত্যি হতো! স্বপ্নটাকে সত্যি করে ফেলা আর সত্যিটাকে স্বপ্ন করে ফেলার ইচ্ছেটা আমার ভিতরে চিরকাল বোধহয় রয়েই যাবে। আমি ঠিক জানি না কেন আজকাল ওই স্বপ্নটা আমি আর দেখি না। কেন আমি ওই একই স্বপ্ন প্রতি রাতে দেখতাম, সেও জানি না। মা’কে, ঠিকই যে, আজকাল আগের চেয়ে কম মনে পড়ে। মা’কে নিয়ে ‘নেই কিছু নেই’ বইটা লিখে ফেলার পর, আমি লক্ষ্য করেছি, ভিতরে ভিতরে দায়িত্ব পালন করার পর যেমন এক প্রশান্তি জোটে, তেমন জুটেছে। বেদনার তীব্রতা কমে এসেছে ধীরে ধীরে। বইটা লেখার সময় চোখের জল অনেক ঝরেছে। এক হাতে জল মুছেছি, আরেক হাতে লিখেছি। লিখলে, আমার বিশ্বাস, দুঃখ কষ্ট অনেক কমে। সে কারণেই বোধ হয় ওই স্বপ্নটা আমি আর দেখি না। খুব ইচ্ছে করে স্বপ্নটা আবার দেখি। আবার দেখি মা বাড়িতে আছে, হাঁটছে, হাসছে, কথা বলছে। ঠিক আগের মতো সবকিছু। লেখকরা কি খুব স্বার্থপর? আমি তো কবিতা লিখেও অনেক বিরহের যন্ত্রণাকে কমিয়ে ফেলেছি। কমিয়েছি নারীবাদী লেখা লিখে বৈষম্যের বিরুদ্ধে জমে থাকা দীর্ঘ বছরের রাগকে, ক্ষোভকে।

আমি আটপৌরে জীবনই চাই, আমার কবিতাও আমার জীবনের মতো। এক রকম জীবনযাপন করবো, আর আরেক রকম কবিতা লিখবো, তা আমার দ্বারা হবে না। যে ভাষায় কথা বলি, সেই ভাষাটাকে, সেই ভাষার শব্দ আর অক্ষরকেই তো রোপণ করবো কবিতার মাটিতে। জীবনই তো জন্ম নেবে ছত্রে ছন্দে! জীবনকেই তো তুলে নেবো শব্দ থেকে। তুলে নিয়ে শহর বন্দর গ্রাম খালি পায়ে দৌড়ে বেড়াবো। যে জীবনটাকে চিনি না, যে শব্দ আমি প্রতিদিন ব্যবহার করি না, প্রতিদিন শুনি না, যে বাক্য আমি নির্মাণ করি না, যে বাক্য আমি আমার চারপাশের কাউকে নির্মাণ করতে শুনি না, সেই শব্দ বাক্য আমি কবিতায় জড়ো করি না। যে ভাষায় আমি মনে মনে নিজের সঙ্গে কথা বলি না, সে ভাষায় আমি কবিতা লিখি না। লিখলে সেই কবিতাকে, আমি খুব ভালো করে জানি, আমার নিজের কবিতা বলে মনে হবে না। লিখলে সেই কবিতা মিথ্যে কবিতা হবে। মিথ্যের সঙ্গে আমার ওঠাবসা নেই। লেনদেন নেই। কোনও মিথ্যেকে আমি আমার বলে মনে করি না। আমি লেখায় কায়দা খাটাই না, যা-ই লিখি, যা কিছুই লিখি, হৃদয় দিয়ে লিখি। কী লিখলে অত্যাধুনিক কবিতা হবে, কী ঢংএ লিখলে ক্রিটিকদের প্রশংসা পাওয়া যাবে, কী ধরনের ছন্দ হলে নতুন কবিতার ধারা তৈরি হবে, এসব আমার ভাবনার বিষয় নয়। পাঠক আমার লেখা বুঝবে কি না, আমার লেখাকে ভালো বলবে কি না, সে নিয়েও আমি ভাবি না। পাঠককে সুখ আনন্দ জোগাতে আমি কখনও কোনও লেখা লিখিনি। কিছু কথা আমার ভিতর-ঘরে বসে হাঁসফাঁস করে, আমি তাই জানালা দরজাগুলো খুলে দিই। এটুকুই। যা কিছুই লিখি, লিখি আমার মায়ের ভাষায়, যে ভাষা মা আমাকে শিখিয়েছিল সে ভাষায়, হৃদয়ের ভাষায়। ধার করে লিখি না। অনুকরণ করি না। কবিতকে নিয়ে জাদুঘরে নিয়ে যাই না, কবিতাকে পড়ে থাকতে দিই কলমিলতায় ছেয়ে থাকা পুকুরপাড়ে।

দীর্ঘ নির্বাসনের শেকল ছিঁড়ে যখন কলকাতায় এসে থাকতে শুরু করেছিলাম, দুপুরবেলায় বারান্দার রোদে কাপড় শুকোতো আর হাওয়ায় ভাসতো রান্নার সুগন্ধ, হলুদ মরিচের, ধনে জিরের সুগন্ধ। ঠিক ওই ছবিটিকে আমি স্থির করে রাখতাম মনে, ওই ছবিটিই আমাকে আমার শৈশব দিত, কৈশোর দিত। বিদেশের আধুনিক জীবনযাত্রা তুচ্ছ করে ওই ছবিটির জন্য আমি বাঙালির আটপৌরে জীবনের কাছে ফিরেছিলাম। মা’র আটপৌরে শাড়ির আঁচলখানির কাছে। আঁচল ছিঁড়ে ফেলেছে লোকেরা। কিন্তু আমার আটপৌরে কবিতাকে আমি বাঁচিয়ে রেখেছি। ওগুলো ছিঁড়ে টুকরো করতে এখনও পারেনি কেউ। আমার কবিতা থেকে সোঁদামাটির যে ঘ্রাণ আসতো, সে ঘ্রাণ এখনও আসে। সবচেয়ে যে ঘ্রাণটা বেশি আসে, সে আমার মা’র শরীরের জুঁই ফুল জুঁই ফুল ঘ্রাণটা। আর কেউ পায় কি না জানি নি, ঘ্রাণটা আমি পাই। ওই ঘ্রাণটা যতক্ষণ না পাই, ততক্ষণ বুঝি যে আমার কবিতা কবিতা হয়ে ওঠে নি।

– তসলিমা নাসরিন

ওষুধের যত ‘জাদুকরী’ ক্ষমতা

ড. মুনীরউদ্দিন আহমদ  : বিশ্বায়নের যুগে পুঁজিবাদী ও ভোগবাদী সমাজব্যবস্থায় বাস করতে গেলে দৈনন্দিন জীবনে প্রতিনিয়তই আমাদের হাজার পারিবারিক ও সামাজিক সমস্যা মোকাবিলা করতে হয়; যা দৈনন্দিন জীবনে ঘটতে পারে বা ঘটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার অন্তর্গত, তার মোকাবিলায় আমাদের শারীরিক ও মানসিক প্রস্তুতি থাকা জীবনেরই একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। জীবনের এ ধরনের ঘটনাপ্রবাহে ওষুধ গ্রহণ বা প্রদান করা হলে আমাদের উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। প্রথমত, অপরীক্ষিত অবস্থায় যদি একজনকে একটি ওষুধ প্রেসক্রাইব করা হয়, সেটা কাজ করবে কিনা তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। যে ওষুধ জটিল ক্লিনিক্যাল বিষাদগ্রস্ততার উপসর্গে ব্যবহার করা হয়, তা সাধারণত দুঃখ-কষ্ট ও হতাশা দূরীকরণে বা উপসমে কাজ করবে এমন নিশ্চয়তা চিকিৎসাবিজ্ঞান দেয় না। এ ধরনের একটি অপরীক্ষিত ওষুধের ব্যবহারকে অফ লেভেল ব্যবহার বা অননুমোদিত ব্যবহার হিসাবে গণ্য করা হয়। দ্বিতীয়ত, ওষুধ গ্রহণের আগে ওষুধের উপকারিতা ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ভারসাম্য নির্ণয় করতে হয়, যাকে আমরা রিস্ক-বেনেফিট রেশিও বলে থাকি। কার্যকর ও নিরাপদ ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া যত কম হবে, রোগীর জন্য ততই মঙ্গল। ক্যানসার, এইডস বা হৃদরোগে ব্যবহৃত অনেক ওষুধের রিস্ক-বেনেফিট রেশিও মার্জিনাল হওয়া সত্ত্বেও জীবন রক্ষার জন্য এসব ওষুধ ব্যবহার করতে হয়। দৈনন্দিন জীবনের পারিবারিক ও সামাজিক সমস্যাকে স্বাস্থ্য সমস্যা হিসাবে আখ্যায়িত করে ওষুধ প্রদান করলে মূল সমস্যা ঢাকা পড়ে যায় এবং কোনোদিন এর সমাধান হয় না।

কানাডায় প্রেসক্রিপশন ওষুধের বিজ্ঞাপন প্রচার নিষিদ্ধ; কিন্তু পার্শ্ববর্তী দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তা বৈধ। সেখানে প্রেসক্রিপশন ড্রাগের বিজ্ঞাপন প্রচার হলে অসংখ্য টেলিভিশন চ্যানেল ও ম্যাগাজিনের মাধ্যমে কানাডার মানুষ তা অনায়াসে দেখতে পায়। ওষুধের বিজ্ঞাপন দেখলে বা ভাষা পড়লে স্বাভাবিক জীবন আর স্বাস্থ্য সমস্যার মধ্যে পার্থক্য দুর্বোধ্য হয়ে ওঠে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রয়াত সাংবাদিক লিন প্যায়ার ওষুধ কারবারিদের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছিলেন, এরা ওষুধ বিক্রির স্বার্থে ভালো মানুষকে অসুস্থ এবং কিঞ্চিৎ অসুস্থ মানুষকে পুরোদস্তুর অসুস্থ মানুষ হিসাবে প্রমাণ করতে সব রকম কারসাজির আশ্রয় নেয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা মানুষকে বোঝাতে সক্ষমও হয়। অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট ওষুধের বিজ্ঞাপন প্রচার শুধু ওষুধ বিক্রির জন্যই করা হয় না, তারা মানুষকে এও বোঝাতে চেষ্টা করে যে, বিষাদগ্রস্ততা মস্তিষ্কের নার্ভকোষে প্রাকৃতিক রাসায়নিক যৌগের ভারসাম্যহীনতার জন্যই উদ্ভব হয় এবং ওষুধ এ ভারসাম্যহীনতা দূর করে মানুষকে সুস্থ করে তোলে। কিন্তু বিজ্ঞাপনের এ ধরনের জৈবিক বিশ্লেষণ কতটুকু যুক্তিযুক্ত? বিজ্ঞানী জেফরি লাকাস ও জনাথন লিও মস্তিষ্কের রসায়ন ও বিষাদগ্রস্ততার মধ্যে যোগসূত্র প্রমাণ পুনর্মূল্যায়নে সচেষ্ট হন। তারা এ তত্ত্বের সমর্থনে একটিও বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ বা তথ্য খুঁজে পাননি। তারা আরও বিস্তৃতভাবে বর্ণনা করেন, এমন একটিও বৈজ্ঞানিক তথ্য বা তত্ত্ব খুঁজে পাওয়া গেল না, যা সমর্থন করে যে, মস্তিষ্কে সেরোটনিনের ঘাটতির কারণেই মানসিক অসুস্থতার সৃষ্টি হয়। কিন্তু ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ওষুধ কোম্পানিগুলোকে বিজ্ঞাপন প্রচারে অনুমতি দিল, যাতে লেখা থাকবে- মস্তিষ্কে রাসায়নিক ভারসাম্যহীনতা ‘সম্ভবত’ বিষাদগ্রস্ততা উৎপত্তির কারণ। এখানে ‘সম্ভবত’ শব্দটি খুবই গুরুত্ব বহন করে। কোনো বাক্যে বা উক্তিতে ‘সম্ভবত’ শব্দটি ব্যবহার করা হলে তা বৈজ্ঞানিক সত্য বলে প্রমাণিত হয় না। অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট মস্তিষ্কের রাসায়নিক পরিবর্তন সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখতে পারে। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, বিষাদগ্রস্ততা মস্তিষ্কে রাসায়নিক ভারসাম্যহীনতার ফল। কম কথা বলা একজন লাজুক মানুষকে মদ খাওয়ালে তার মুখ দিয়ে কথার খৈ ফুটবে। এর অর্থ কি এই যে, ওই লাজুক মানুষটির শরীরে অ্যালকোহল বা মদের ঘাটতি রয়েছে? আরও একটি উদাহরণ দিই। প্যারাসিটামল খেলে মাথাব্যথা সারে। এর অর্থ এই নয় যে, কারও মস্তিষ্কে প্যারাসিটামলের ঘাটতি রয়েছে। অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট প্রদান করলে মেজাজ পরিবর্তন হয়, হতাশার উপসর্গগুলোর উন্নতি হয়। কিন্তু সেটা ওষুধের কারণে নাকি মনস্তাত্ত্বিক কারণে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। পরীক্ষায় দেখা গেছে, অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট প্রদান করলে দশজন মানুষের মধ্যে ছয়জন ভালো বোধ করেন। অন্যদিকে প্ল্যাসিবো (যে ওষুধে কোনো সক্রিয় উপাদান নেই, যেমন সুগার পিল) প্রদান করলেও দশজনের মধ্যে অন্তত পাঁচজন সুস্থবোধ করেন। এখন সিদ্ধান্তের ব্যাপার আমরা মানসিক রোগীকে ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা করব, নাকি সুগার পিল দিয়ে তাকে সুস্থ করে তুলব।

ওষুধ বিক্রির উদ্দেশ্যে প্রমোটাররা বিজ্ঞাপনে মানুষের মানসিক অবস্থাকে অতিরঞ্জিত করে উপস্থাপন করে। এটি শুধু মানসিক অবস্থার মধ্যে সীমিত নয়। প্রথম যখন রেস্টলেস লেগ সিন্ড্রোমের (অস্থির বা বিরামহীন পদ-উপসর্গ) ওষুধ বাজারে ছাড়া হয়, তখন ডার্টমাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক স্টিড ওলশিন ও লিসা সোয়ার্টজ দুই বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রের সব ধরনের বিজ্ঞাপন অনুসরণ করেছেন। বিরামহীন পা নাচানো হলো এক ধরনের অপ্রীতিকর অবস্থা, যা বিশ্রামে থাকলে উৎপত্তি হয়। যাদের মধ্যে এসব উপসর্গ থাকে, তা হয় অতি মৃদু। খুব অল্পসংখ্যক মানুষের মধ্যে এ উপসর্গগুলো মারাত্মক হতে পারে। কিন্তু দুই-তৃতীয়াংশ বিজ্ঞাপনে বা খবর প্রতিবেদনে অতিরঞ্জিত করে বলা হয়েছে, ১২ মিলিয়ন আমেরিকান এ উপসর্গে আক্রান্ত। এ পরিসংখ্যান গ্রহণ করা হয়েছিল এক ভুল পদ্ধতিতে। তারা এও উল্লেখ করেনি যে, এ উপসর্গগুলোর কারণে মানুষের খুব অসুবিধা হয় না। আবিষ্কৃত ওষুধটিকে অলৌকিক ওষুধ হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়েছিল; যদিও প্ল্যাসিবোর সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায়, আটজনের মধ্যে মাত্র একজন ভালো অনুভব করে। এ ফলাফল বৈজ্ঞানিক বা পরিসংখ্যানের ভাষায় অর্থবহ বা গুরুত্বপূর্ণ নয়। যখন কোনো নতুন ওষুধ বাজারে আসে এবং তার বিপণনের জন্য বিজ্ঞাপন প্রচার করা হয়, তখন মানুষ সাধারণত বিজ্ঞাপনের টেকনিক্যাল শব্দ বা ভাষা অধিকাংশ ক্ষেত্রে বুঝে উঠতে পারে না। তারপরও এসব বিজ্ঞাপন প্রচার করা হয় চিকিৎসকদের ওষুধ প্রেসক্রাইবিংকে প্রভাবান্বিত করার জন্য। অনেক চিকিৎসকসহ এটি খুব কম লোকই জানে ওষুধের অপ্রয়োজনীয় ব্যবহার মারাত্মক বিপদ ডেকে আনতে পারে। সেটা যদি অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট বা মানসিক রোগের ওষুধ হয়, তবে তো কোনো কথাই নেই।

কানাডায় ওষুধের বিজ্ঞাপন বৈধ না হলেও কোম্পানিগুলোকে নামহীন ওষুধের বিজ্ঞাপন প্রচারের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। যেমন কোলেস্টেরল কমানোর একটি নামহীন ওষুধের বিজ্ঞাপনে ফিতা দিয়ে পায়ের আঙুল বাঁধা একটি মৃতদেহ দেখিয়ে বলা হয়েছে, পরীক্ষা ও চিকিৎসা ছাড়া আপনি যে কোনো মুহূর্তে হার্ট অ্যাটাকে মারা যেতে পারেন। অধিকাংশ মানুষের জন্য বিজ্ঞাপনের ভাষা সত্য হয় না। কোনো কোনো বিজ্ঞাপনে দাবি করা হয়, মৃদু গলাব্যথা ভয়ংকর আকার ধারণ করতে পারে। আমি হলে এসব বিজ্ঞাপন দেখে অন্তত একটু থামতাম ও ভাবতাম, কারা এসব বিজ্ঞাপন তৈরি করেছে, কেন করেছে এবং আমার ওপর এসব বিজ্ঞাপনের বক্তব্যের প্রভাব কী। উত্তর পেতে কষ্ট হওয়ার কথা নয়। এর ভালো চিকিৎসা হলো, এসব কুটিল ও জটিল বিজ্ঞাপনের প্রতি প্রত্যেকের স্বাস্থ্যসম্মত অবিশ্বাস তৈরি করা।

যুক্তরাষ্ট্র ও চীনে ইন্টারনেট আসক্তদের চিকিৎসার জন্য ক্লিনিক খোলা হয়েছে। কিছুদিন আগে উঠতি বয়সি এক স্কটিশ যুবককে ইলেকট্রনিক মেসেজ বা বার্তার প্রতি আসক্তির কারণে চিকিৎসা দেওয়া হয়। সে এক বছরে ইলেকট্রনিক বার্তা প্রেরণের জন্য ৪ হাজার ৫০০ পাউন্ড খরচ করে। কর্মদিবসের প্রতি মিনিটে একটি বা প্রতিদিন ৪০০ করে এক মাসে সে ৮ হাজার বার্তা প্রেরণ করে। এ কারণে তাকে চাকরি ছাড়তে হয়। বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে যুবক বলেছিল, যখন আপনি কোনো বার্তা পেয়ে থাকেন, সেটি খুব আনন্দদায়ক। এটি ঠিক পিংপং খেলার মতো। একটি বার্তা পাঠানোর কারণে অন্য একটি বার্তা আপনার কাছে ফিরে আসবে। আমি এটি ভীষণ পছন্দ করি। যুবকের পছন্দ হলে তো চলবে না। এ মানসিকতাকে এক বড় ধরনের ব্যক্তিগত, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সমস্যা হিসাবে দেখা হচ্ছে। এ ধরনের ইন্টারনেট অ্যাডিকশন ডিসঅর্ডারের জন্য ওষুধ চাই। এটি কোনো সমস্যাই নয়। মানবসেবায় নিবেদিতপ্রাণ বহুজাতিক কোম্পানিগুলো এসব সমস্যা সমাধানকল্পে ওষুধ উদ্ভাবনে এক পায়ে দাঁড়িয়ে আছে। অতি স্থুল, অতি দুঃখ, অতি চিকন, অতি সুখ জাতীয় সমস্যা সমাধানে আসছে ওষুধ। একটিমাত্র বড়ি বা ভ্যাকসিন আবিষ্কার করে বায়োটেক মানবসভ্যতার ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক সব সমস্যা নিমিষে উড়িয়ে দেওয়া হবে! এ ধরনের চিকিৎসাকে আমরা রিটেইল থেরাপি বা খুচরা চিকিৎসা হিসাবে আখ্যায়িত করতে পারি। ইতোমধ্যে আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশন কম্পালসিভ শপিংকে (যারা কেনাকাটা না করে থাকতে পারেন না) একটি বড় ধরনের ডিসঅর্ডার বা সমস্যা হিসাবে চিহ্নিত করেছে। স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে উপসংহারে এসেছেন যে, অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট সিটালোপ্রাম কম্পালসিভ শপিং ডিসঅর্ডারে প্রয়োগ করলে খুব ফলপ্রসূ ও নিরাপদ হবে। এ ধরনের ফলপ্রসূ ও নিরাপদ চিকিৎসার জন্য উন্নত বিশ্বে নতুন নতুন ডিসঅর্ডার ও সিন্ড্রোম তৈরি করার এক মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের পথে রয়েছে। আস্তে আস্তে ম্যাজিক বুলেটের মতো ওষুধ আবিষ্কৃত হওয়া শুরু হয়েছে। এসব কল্পকাহিনির শেষ নেই।

কিন্তু প্রশ্ন হলো, আমরা আসলে চলেছি কোথায় আর এসব হচ্ছেটাই বা কী? কেউ ভাবছেন- সর্বত্র এত ওষুধ কেন? এত ওষুধ কি সত্যি সত্যি আমাদের প্রয়োজন? নাকি এখানে ওষুধ কারবারিদের কোনো চক্রান্ত আছে? প্রয়োজনীয়-অপ্রয়োজনীয় ওষুধ খাইয়ে তারা সুকৌশলে আমাদের দেউলিয়া বানিয়ে ছাড়ছেন? আবার কেউ হতাশ হয়ে ভাবছেন, অতসব চিন্তার দরকার আছে কি? যা হচ্ছে হোক না। আমাদের কী-ই বা করার আছে! আমরা কি তাদের কুটিল চাল বুঝি? আমরা তো দাবার চালের ঘুঁটি। আমরা কল্পনার রাজ্যে বাস করি, কল্পনাতেই থাকি। আমরা আমাদের আশা-আকাক্সক্ষা পূরণ করব, আমাদের সব ধরনের অনিরাপদ ও ভোঁতা সীমাবদ্ধতা, দুঃখ-কষ্ট, ছলচাতুরী দূর হয়ে যাবে- যখন আকাশ ফুটতে থাকবে, বিশ্বের সব বরফ গলে যাবে, সব মাছ মারা যাবে, ভূপৃষ্ঠ পুড়ে ছাই হয়ে যাবে এবং অগণিত মানুষ মারা যাবে একের পর এক বোমা বিস্ফোরণে। তারপরও আমাদের মুখে হাসি লেগে থাকবে আর আমাদের মন-প্রাণ আনন্দে নাচতে থাকবে। সব রকম ডিসঅর্ডারেও আমরা অর্ডারে থাকব। আর তা সম্ভব হবে ওষুধ কোম্পানিগুলো কর্তৃক উদ্ভাবিত নতুন নতুন জাদুকরী ওষুধের মাধ্যমে। আসুন, আমরা সবাই নৃত্য করি আর সেই জাদুর ওষুধের জন্য অপেক্ষায় থাকি! ড. মুনীরউদ্দিন আহমদ : প্রফেসর ও বিভাগীয় প্রধান, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ঢাকা

প্রযুক্তি দুনিয়ার দুই রাজধানী

৩০০ বর্গমাইল এক শহরে পৃথিবীর শীর্ষ প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোর হেডকোয়ার্টার

যুক্তরাষ্ট্রের সিলিকন ভ্যালি বিশ্ব প্রযুক্তির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শহর। প্রতি বছরই নতুন নতুন স্টার্টআপ এই শহর থেকে যাত্রা করে। এদের কোনো কোনোটি পৃথিবীর চালচিত্র ও অর্থনীতির গতি বদলে দেয়। সিলিকন ভ্যালি শহরটি যুক্তরাষ্ট্রের সেরা প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো প্রাণকেন্দ্র হিসেবে বিশ্বজুড়ে সমাদৃত। যে কারণে প্রায় শীর্ষ সব প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান এই শহরে তাদের হেডকোয়ার্টার গড়ে তুলেছে। ভিড় করছেন সেরা প্রযুক্তিবিদ ও শিক্ষার্থীরা। বলা হয়, এই শহরে দক্ষ প্রযুক্তিবিদদের বসে থাকার কোনো সুযোগ নেই। বাঘা বাঘা প্রতিষ্ঠানগুলো সেরা কর্মীদের সর্বোচ্চ বেতন সুযোগ সুবিধা দিয়ে নিয়োগ দিয়ে থাকে। সিলিকন ভ্যালি শহরটি যুক্তরাষ্ট্রের উত্তর ক্যালিফোর্নিয়ায়। ৩০০ বর্গমাইল এলাকাজুড়ে সিলিকন ভ্যালির অবস্থান। সান ফ্রান্সিসকোর প্রযুক্তির এই শহরেই গুগল, ইয়াহু, অ্যাপল, অ্যাডোবি, এইচপি, ইন্টেল, ইবে, ওরাকল, আসুস, ফেসবুক, সিমেন্সের মতো বড় বড় কোম্পানির শুরু হয়। ১৯৯৫ সালের পর সিলিকন ভ্যালি হয়ে ওঠে ইন্টারনেট অর্থনীতি এবং উচ্চপ্রযুক্তি সংক্রান্ত বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে। এখন এই শহরে মাঝারি আকৃতির একটি বাড়ি কিনতে গেলেই গুনতে হবে ১০ লাখ মার্কিন ডলার। সিলিকন ভ্যালির সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা সম্ভবত ইস্ট পালো আলটো। এখানে প্রায় ৩০ হাজার মানুষের বাস। এর উত্তরে ফেসবুক, আর দক্ষিণে গুগলের সদর দফতর।  প্রযুক্তির এই শহরে সবকিছুর দামই আকাশছোঁয়া। এখানে বাথরুমসহ এক বেডরুমের ফ্ল্যাটের জন্য ভাড়া গুনতে হয় বাংলাদেশি টাকায় ১-৫ লাখ। এর কারণও রয়েছে। এসব বাসা সাধারণ শীর্ষ প্রতিষ্ঠানগুলোর বড় পদের কর্মীরা ভাড়া নিয়ে থাকেন। তাদের উচ্চ বেতন ও আয়ের কারণেই শহরটিতে বাসা ভাড়া এত বেশি। অনেকে আবার রিক্রিয়েশনাল ভ্যান তৈরি করে নিয়েছেন। এসব ভ্যানের ভিতরে এসি, সোফা, টিভি, রান্নাঘর সবই আছে। সিলিকন ভ্যালির ২০ শতাংশ কর্মী সান ফ্রান্সিসকোর বাইরে থাকেন। স্টকটন বা মডেস্টোর মতো শহরগুলোতে। যেখান থেকে আসতে কর্মীদের দেড় ঘণ্টা গাড়িতে থাকতে হয়। যাতায়াতের জন্য সিলিকন ভ্যালিতে ইলেকট্রিক স্কুটার ব্যবহারের জনপ্রিয়তা এখন ব্যাপক। সিলিকন ভ্যালিতে আয়ের বড় একটি উৎস হতে পারে বক্তৃতা। এখানে বক্তৃতা দিয়ে ১০ হাজার ডলার পর্যন্ত আয় করে বসেন অনেকে। এর পেছনে বড় কারণ দুনিয়া পাল্টে দেওয়া বড় প্রযুক্তিবিদরা বিভিন্ন সেমিনারে হাজির হন। এসব সেমিনার সামনাসামনি বসে শোনার সুযোগও পায় খুব সীমিত সংখ্যক লোক। উচ্চমূল্যে টিকিট কেটে তবেই শুনতে হয় এখানে বক্তৃতা।

বিদেশিদের দখলে প্রযুক্তি শহর

বিশ্বের সবচেয়ে বড় ইন্টারনেট অর্থনীতি ও প্রযুক্তি বাজার কালিফোর্নিয়ার সিলিকন ভ্যালি। এই প্রযুক্তি বাণিজ্য কেন্দ্রে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন বিদেশিরা। ভ্যালিতে কর্মরত কর্মীদের সিংহভাগই বিদেশি নাগরিক। কয়েক বছর আগে সিলিকন ভ্যালির এক বার্ষিক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ভ্যালিতে বিদেশি কর্মীর সংখ্যা ৭৪ শতাংশ, যারা কাজ করেন কম্পিউটার ও গণিত বিভাগে। অর্থাৎ এই দুই বিভাগের ৪ ভাগের ৩ ভাগ পদই বিদেশিদের দখলে। এই কর্মীদের বেশির ভাগেরই বয়স ২৫ থেকে ৪৪ বছরের মধ্যে। প্রযুক্তিতে দক্ষ কর্মীদের মধ্যে ৩৭ শতাংশ কর্মী ক্যারিয়ার গড়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে এসেছেন। এর মধ্যে ক্যালিফোর্নিয়ায় কাজ করছেন ২৭ শতাংশ।

৪০ বছর আগেও এখানে জেলেরা আসত মাছ শিকার করতে

১৯৯০ ও ২০০০-এর দশকে শেনচেন বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল নগরীগুলোর একটি ছিল।  ১৯৭৯ সালে চীনের অর্থনৈতিক সংস্কার ও উন্মোচন নীতি অবলম্বনের পর থেকে শেনচেনে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ খুব দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং নগরীর অর্থনীতিতে গতিসঞ্চার হয়। বর্তমানে শহরটি সারা বিশ্বের মধ্যে অন্যতম প্রধান প্রযুক্তি কেন্দ্র। অনেক গণমাধ্যমে এটিকে ভবিষ্যতের সিলিকন উপত্যকা নাম দেওয়া হয়েছে। ১৯৮০ সালে শেনচেনে চীনের সর্বপ্রথম বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করা হয়। শেনচেনের ২০১৭ সালের প্রাক্কলিত জনসংখ্যা ছিল প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ। এর আয়তন ২ হাজার বর্গকিলোমিটার। বিশ্বের প্রযুক্তি ব্যবসায়ীরা আইটি পণ্য কিনতে এখানে ভিড় করেন। ঝকঝকে সুউচ্চ ভবনে সাজানো গোছানো শহরে চলে জমকালো আলোর খেলা। পরিকল্পিত এই শহরে রয়েছে সবুজের সমারোহ। গত ২০ বছর ধরে চীনের প্রযুক্তিগত উন্নয়ন নিয়ে কারও তেমন মাথাব্যথা ছিল না। তারা অন্যান্য দেশের প্রযুক্তি পণ্যগুলোর অনুলিপি করে অপেক্ষাকৃত সস্তায় বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করছিল। এ জন্যই চীনের পণ্যগুলোকে একটু তাচ্ছিল্যের সঙ্গে দেখছিল মানুষ। তবে তারা এখন মৌলিক গবেষণা এবং প্রযুক্তি খাতে বিনিয়োগ বাড়িয়ে দিয়েছে। এর একটি বাস্তব উদাহরণ হচ্ছে হুয়াওয়ে। অনলাইনভিত্তিক ব্যবসা আলীবাবা যুক্তরাষ্ট্রের এলফাবেট, ওয়ালমার্ট, অ্যামাজন, ই-পেসহ বিভিন্ন অনলাইন বাজারের তুলনায় অনেক এগিয়ে। বিশ্বের বহু দেশ থেকে ব্যবসায়ীরা আইটি পণ্য কেনা ও আইটি প্রযুক্তি নিতে এ শহরে ভিড় করেন। অথচ ৩৭ বছর আগে এ শহরটি মৎস্যজীবীদের মাছ শিকার কেন্দ্রিক অঞ্চল ছিল। এ শহরের এমন রূপান্তর কী করে হলো তা সবার চোখের সামনে। চীন তার যে কয়েকটি শহর দ্রুত বদলে দিয়েছে তার একটি শেনচেন। তাদের নেতা চীনের সাবেক প্রেসিডেন্ট দেং শিয়াও পিং এ শহরের রূপকার। চীনের প্রথম বিশেষায়িত অর্থনৈতিক অঞ্চল এ শহরটি  সাজিয়েছেন তখনকার প্রেসিডেন্ট। এখন শহরটি বিশ্বের অন্যতম অর্থনৈতিক প্রাণকেন্দ্র। এখানে সড়কের ওপর থার্মো প্লাস্টিক রিফ্লেকটিভ রোড মার্কিং স্থাপনের বিষয়টি আকর্ষণীয়। যেখানে পর্যাপ্ত পরিমাণে গ্লাসবেড দেওয়ার ফলে রাতে গাড়ির আলো পড়ার সঙ্গে রিফ্লেক্ট করে পথ দেখিয়ে দেয়। মূল শহরটির অদূরে হংকং। কোথাও ব্রিজের ও-পাশ হংকং, এ-পাশ শেনচেন। কোথাও রাস্তার একপাশ শেনচেন, আরেকপাশ হংকং। মূল শহরের আশপাশে বহুতল ভবনে রয়েছে বিশ্বখ্যাত হুয়াওয়ে, কনকা, স্কাইওর্থ, টেনসেন্ট, ওয়ান প্লাসের মতো দেশীয় প্রতিষ্ঠানের সদর দফতর। শেনচেন শহরে একটি শেয়ারবাজার আছে। এখানে অনেক বহুজাতিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের প্রধান কার্যালয় অবস্থিত, যাদের মধ্যে জেএক্সডি, হাইটেরা, সিআইএমসি, এসএফ এক্সপ্রেস, শেনচেন এয়ারলাইনস, নেপস্টার, হাসি, ইত্যাদি।

এখন ইন্টারনেট বিশ্বে কত ওয়েবসাইট

বিশ্বজুড়ে যেমন ইন্টারনেট ব্যবহারকারী বাড়ছে, তেমনি প্রতিদিনই যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন ওয়েবসাইট। আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের হিসাবমতে, ইন্টারনেট বিশ্বে প্রতিদিন গড়ে যোগ হচ্ছে আড়াই লাখের বেশি ওয়েবসাইট।

১৯৯১ সালের ৬ আগস্ট প্রথম ওয়েবসাইটটি উন্মোচিত হয়েছিল। পথ চলার ৩০ বছরে ১৮৮ কোটিরও বেশি ওয়েবসাইটে সমৃদ্ধ হয়েছে সাইবার বিশ্ব। তবে সংখ্যায় যত হোকই না কেন, সব ওয়েবসাইট তো আর সমানভাবে মানুষের কাছে পৌঁছায় না। কোনো কোনো ওয়েবসাইটের রয়েছে কোটি কোটি ব্যবহারকারী। এর মধ্যে কোনো কোনোটিতে প্রতিদিনই কোটি কোটি মানুষ ঢুঁ মারে। এসব সাইটের মধ্যে গুগল, ফেসবুক, ইউটিউব, টুইটার, উইকিপিডিয়া, ইয়াহু, ইনস্টাগ্রাম, অ্যামাজন প্রভৃতির নাম উল্লেখ করা যেতে পারে।

অলাভজনক সংস্থা উইকিপিডিয়া বাদে যে সাইটের যত ব্যবহারকারী তথা যত ভিউ, তত ব্যবসা! আর কারণেই গুগল কিংবা ফেসবুক এখন ট্রিলিয়ন ডলারের কোম্পানি।

ব্রিটিশ পদার্থবিজ্ঞানী টিম-বার্নস-লি সুইজারল্যান্ডের সার্ন গবেষণা কেন্দ্র থেকে ১৯৯১ সালে প্রথম ওয়েবসাইটটি চালু করেন। শুরু হয় ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবের যাত্রা। ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবের পথিকৃৎ টিম-বার্নস-লির বানানো প্রথম ওয়েবসাইটটির ঠিকানা হচ্ছে  http://info.cern.ch

এক বছরের মাথায় ইন্টারনেট বিশ্বে যুক্ত হয় ১০টি ওয়েবসাইট। ১৯৯৪ সালে ইয়াহুর যাত্রার বছরে ওয়েবের সংখ্যা ছিল তিন হাজার। গুগলের আত্মপ্রকাশের বছরে ইন্টারনেটে ছিল ২০ লাখের বেশি সাইট। আর মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে ২০০ কোটির মাইলফলক ছুঁতে যাচ্ছে ওয়েবসাইট।

চিঠির জবাবে প্রকৌশলী প্রেমিকা

নভেম্বর 1, 2021 ১টি মন্তব্য

সার্কিট,

তোমার বাড়ির রঙের মেলায় দেখেছিলাম অসিলোস্কোপ; অসিলোস্কোপের নেশা আমায় ছাড়ে না। তাই আমার অ্যানালগ হৃদয়ের ক্যাটালগ থেকে তোমার নাম ‘শিফট-ডিলিট’ করতে পারছি না! কিন্তু তোমার কাজের ফ্লোচার্ট দেখলে আমি সত্যিই অ্যাংরি বার্ড হয়ে যাই! ইচ্ছা করে, চতুর্থ গতিসূত্রে তোমাকে ফেলে দিই। সূত্রটি নিশ্চয়ই মনে আছে, কেউ যদি আলোর চেয়ে বেশি গতিতে বৃত্তাকারে ঘুরতে থাকে, তাহলে সে নিজের পশ্চাতে নিজেই লাথি দিতে পারে!

তুমি একা পিকে সিনেমাটি দেখেছ জেনে আমার রাগ এক্সপোনেনশিয়ালি বেড়ে পিকে চলে গেছে! শেষ টার্মে চাকরি না খুঁজে এভাবে মুভিখোর হয়ে পড়ে থাকলে যে পরে শর্টসার্কিটেড হয়ে পড়ে থাকবে, সেই খেয়াল আছে? খুব তো ব্রডকাস্ট করছ, সার্কিটওয়ালে থ্রিজি গতিতে প্রিয়া লে জায়েঙ্গে; এদিকে ডাক্তার পাত্র কিন্তু ‘থ্রি পয়েন্ট ফাইভ–জি’ গতিতে আমাকে নেওয়ার জন্য সিগন্যাল পাঠিয়েই যাচ্ছে! সেই সিগন্যালের ‘সিগন্যাল-টু-নয়েজ রেশিও’ ইতিমধ্যে বাবার মন জয় করে ফেলেছে।

স্টার্টিং টর্ক একটু বেশি হয়ে গেছে! রাগ কোরো না, সার্কিটক্যাট আমার। আসলে আমি আমাদের ভালোবাসায় গতি সঞ্চার করে প্রেমের টার্বাইন আরও জোরসে ঘোরাতে চাই! মনে রেখো, জীবনে সিরিজ বা প্যারালাল যে বর্তনীতেই চলি না কেন, বিজলির ইলেকট্রনে লেখা আছে শুধু তোমারই নাম।

ইতি

তোমার বিজলি

(আসিফ মেহ্দী)