আর্কাইভ

Archive for মে, 2019

রমজানে অবতীর্ণ হয়েছে প্রধান চারটি আসমানি কিতাব

মুহাম্মাদ হেদায়াতুল্লাহ : রমজান মাস যেসব অনন্য বৈশিষ্ট্যে সমৃদ্ধ তার অন্যতম হলো, রমজানে আল্লাহ তাআলা আসমানি কিতাব অবতীর্ণ করেছেন। শুধু কোরআন নয়, অন্যান্য আসমানি কিতাবও রমজানে অবতীর্ণ হয়েছে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘আমি তা কদরের রাতে অবতীর্ণ করেছি।’ (সুরা : কদর, আয়াত : ১) হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘মূলত কোরআন লাইলাতুল কদরে একসঙ্গে পৃথিবীর আসমানে অবতীর্ণ হয়েছে। অতঃপর তা দীর্ঘ ২৩ বছরব্যাপী রাসুল (সা.)-এর ওপর অবতীর্ণ হয়েছে।’ (ইবনে কাসির ও তাফসিরে কুরতুবি) রমজানে অন্যান্য আসমানি কিতাব অবতীর্ণ হওয়া প্রসঙ্গে রাসুল (সা.) বলেন, ‘ইবরাহিম (আ.)-এর ওপর সহিফাগুলো রমজানের প্রথম রাতে অবতীর্ণ হয়। রমজানের ষষ্ঠ দিনে তাওরাত অবতীর্ণ হয়। ১৩ রমজানে ইনজিল অবতীর্ণ হয়েছে। জাবুর রমজানের ১৮তম দিনে অবতীর্ণ হয়। কোরআন অবতীর্ণ হয় রমজানের ২৪তম দিনে।’ (মুসনাদে আহমাদ : ১৬৯৮৪)

আসমানি কিতাবের অভিন্ন লক্ষ্য উদ্দেশ্য

কোরআন ও হাদিস অধ্যয়ন করলে বোঝা যায়, আল্লাহ তাআলা প্রতিটি যুগে মানুষের সুপথপ্রাপ্তির জন্য অসংখ্য নবী-রাসুল প্রেরণ করেছেন। সব নবী-রাসুলের মূল উদ্দেশ্য ছিল এক ও অভিন্ন। যেমন— মহান আল্লাহ বলেন, ‘আমি প্রত্যেক উম্মতের মধ্যে রাসুল প্রেরণ করেছি, (তারা মানুষকে এ কথা বলেছে) তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো এবং তাগুত তথা সর্বপ্রকার শয়তানকে পরিহার করো।’ (সুরা : নাহল, আয়াত : ৩৬)

অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি আপনার পূর্বে যত রাসুল প্রেরণ করেছি সবার কাছে এই ওহি পাঠিয়েছি, আমি ছাড়া আর কোনো ইলাহ বা উপাস্য নেই, অতএব সবাই যেন একমাত্র আমার ইবাদত করে।’ (সুরা : আম্বিয়া, আয়াত : ২৫)

অতএব, আসমানি কিতাব ও বিধি-বিধান নানা রকম হলেও সব নবী-রাসুলের ওপর অবতীর্ণ কিতাবের মূল লক্ষ্য ছিল এক। তা হলো তাওহিদ বা আল্লাহর একত্ববাদের ঘোষণা দেওয়া এবং একমাত্র তাঁর ইবাদতের আহ্বান জানানো।

আসমানি কিতাবের ওপর ঈমান

একজন মুমিন হিসেবে আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ সব কিতাবের ওপর ঈমান আনা আবশ্যক। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘তোমরা বলো! আমরা ঈমান এনেছি আল্লাহর প্রতি এবং যা আমাদের ওপর এবং ইবরাহিম, ইসমাঈল, ইসহাক, ইয়াকুব ও তাদের সন্তানদের ওপর অবতীর্ণ হয়েছে এবং যা ঈসা, মুসা ও অন্যান্য নবীর ওপর অবতীর্ণ হয়েছে, আমরা তাদের মধ্যে কোনো পার্থক্য করি না এবং আমরা তাঁরই কাছে আত্মসমর্পণকারী।’   (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১৩৬)

এ আয়াত থেকে প্রমাণিত হয়, যে কোনো একটি আসমানি কিতাবের প্রতি বিশ্বাস করলে ঈমান পরিপূর্ণ হবে না। সব আসমানি কিতাবের প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস রাখতে হবে। কোনো একটি অস্বীকার করলে সেই ব্যক্তি আল্লাহর কাছে মুমিন হিসেবে গণ্য হবে না। তবে হ্যাঁ, সব আসমানি কিতাবের প্রতি বিশ্বাসের ধরন এক হবে না এবং হওয়ার সুযোগ নেই। ইসলামী ধর্মবিশ্বাস অনুযায়ী মুসলিমরা কোরআনকে আল্লাহর কিতাব এবং আবশ্যপালনীয় হিসেবে বিশ্বাস করবে। আগের কিতাব সম্পর্কে তাদের বিশ্বাস হলো, এগুলো আল্লাহর পক্ষ অবতীর্ণ এবং সত্য গ্রন্থ, তবে তার কার্যকারিতা কোরআনের মাধ্যমে স্থগিত হয়ে গেছে। আগের আসমানি কিতাবগুলোতে মুহাম্মদ (সা.) ও পবিত্র কোরআন সম্পর্কে স্পষ্টভাবে সুসংবাদ রয়েছে। মুহাম্মদ (সা.)-এর পরিচিতিমূলক গুণাবলিও তাতে বর্ণনা করা হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘যারা বার্তাবাহক উম্মি নবীর অনুসরণ করবে, যার কথা তারা তাদের কাছে থাকা তাওরাত ও ইনজিলে লিপিবদ্ধ পেয়েছে।’ (সুরা আরাফ, আয়াত : ১৫৭)

নবী (আ.)-এর ওপর অবতীর্ণ প্রধান কিতাব চারটি। তা হলো তাওরাত, জাবুর, ইনজিল ও কোরআন। রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘তাওরাতের বদলে আমাকে সুরা বাকারা থেকে সুরা তাওবা তথা সাতটি বড় সুরা দেওয়া হয়েছে। জাবুরের বদলে সুরা ইউনুস থেকে সুরা কাসাস পর্যন্ত তথা শতাধিক আয়াতবিশিষ্ট সুরা দেওয়া হয়েছে। ইনজিলের বদলে আমাকে সুরা আনকাবুত থেকে সুরা হুজরাত তথা মাসানি সুরা দেওয়া হয়েছে। সুরা কফ থেকে শেষ পর্যন্ত মুফাসসাল বা ছোট সুরাগুলো আমাকে বেশি দেওয়া হয়েছে।’ (তাবরানি, হাদিস : ৮০০৩; মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ১৭০৩)

নিম্নে প্রধান চারটি আসমানি কিতাব সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো—

জাবুর কিতাব

জাবুর অর্থ লিপিবদ্ধ। পবিত্র কোরআনের ভাষ্য অনুযায়ী, জাবুর আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে দাউদ (আ.)-এর ওপর অবতীর্ণ হয়েছে। বনি ইসরাঈলের জন্য অবতীর্ণ এই কিতাবে দাউদ (আ.)-এর বিভিন্ন তাসবিহাত বা আল্লাহর গুণাবলিমূলক কথার বর্ণনা এসেছে। কথিত আছে যে জাবুর কিতাব দাউদ (আ.), সোলায়মান (আ.) ও কয়েকজন নবীর ছন্দোবদ্ধ কথামালার সমষ্টি।

দাউদ (আ.)-এর গোত্রের মাতৃভাষা ছিল ইউনানি। তাই ‘জাবুর’ ইউনানি বা অ্যারামাইক ভাষায় অবতীর্ণ হয়। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই আমি তোমার কাছে ওহি প্রেরণ করেছি, যেমন নুহ ও তাঁর পরবর্তী নবীদের কাছে প্রেরণ করেছিলাম; ইবরাহিম, ইসমাঈল, ইসহাক, ইয়াকুব ও তাঁর বংশধর; ঈসা, আইউব, ইউনুস, হারুন ও সোলায়মানের কাছে ওহি প্রেরণ করেছিলাম এবং দাউদকে জাবুর দিয়েছিলাম।’ (সুরা : আন-নিসা, আয়াত : ১৬৩)

অন্য আয়াতে বলা হয়েছে, ‘আমি তো নবীদের কতককে কতকের ওপর মর্যাদা দিয়েছি এবং দাউদকে জাবুর দিয়েছি।’ (সুরা : বনি ইসরাঈল, আয়াত : ৫৫)

তাওরাত কিতাব

‘তাওরাত’ শব্দটি হিব্রু ভাষায় শিক্ষা দেওয়া, দিকনির্দেশনা প্রদান বা নীতি প্রণয়ন করার অর্থে ব্যবহৃত হয়। ইহুদি গোষ্ঠীর জীবনবিধান হিসেবে তা মুসা (আ.)-এর ওপর অবতীর্ণ হয়েছে। খ্রিস্টানদের ভাষ্য অনুযায়ী, এ গ্রন্থটি ‘আল কিতাবুল মুকাদ্দাস’ বা বাইবেলের ‘ওল্ড টেস্টামেন্ট’ (Old testament বা আল আহদুল কদিম)-এর অন্তর্ভুক্ত। ৩৮টিরও বেশি অধ্যায়ে প্রণীত ‘কিতাবুল মুকাদ্দাস’ সর্বমোট তিন ভাগে বিভক্ত।

এক. সফরের পাঁচটি অধ্যায়। গবেষক ও ইহুদিদের অনেক গোষ্ঠীর কাছে এটি তাওরাত হিসেবে সমাদৃত। তাওরাত মূলত পাঁচটি ‘সফর’ বা গ্রন্থের সমন্বিত রূপ। দুই. সফরুল আনবিয়ার ২০টি অধ্যায়। তিন. মাকতুবাতের ১৩টি অধ্যায়। বাইবেলের এ অধ্যায়গুলো এক সঙ্গে ‘তানাক’ (tanakh) নামেও পরিচিত। আর ইহুদিদের একটি গোষ্ঠী ‘ফিররিস’রা তাদের বিভিন্ন বিধি-বিধান মৌখিকভাবেও সংরক্ষণ করেছিল, যা ‘তালমুদ’ নামে পরিচিত। (আল আকিদাতুল ইসলামিয়্যাহ, আবদুর রহমান হাবানকাহ; আল ইয়াহুদিয়্যাহ, ড. আহমাদ শিবলি)

কোরআনুল কারিমে ‘তাওরাত’ শব্দটি উল্লেখ করে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আমি তাওরাত অবতীর্ণ করেছি, যাতে আছে পথনির্দেশনা ও আলো। আল্লাহর অনুগত নবীরা তদনুসারে ইহুদিদের পরিচালনা করত এবং খোদাভীরু ও জ্ঞানীরাও, কারণ তাদের আল্লাহর কিতাব সংরক্ষণের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল এবং এ ব্যাপারে তারা সাক্ষী ছিল।’ (সুরা : মায়িদা, আয়াত : ৪৪)

অন্য আয়াতে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘অতঃপর আমি মুসা (আ.)-কে কিতাব দিয়েছিলাম সৎকর্মশীলদের প্রতি পরিপূর্ণ অনুগ্রহ করে, যা সব কিছুর বিশদ বিবরণ, পথনির্দেশ ও দয়াস্বরূপ ছিল, যাতে তারা তাদের প্রতিপালকের সাক্ষাতের ব্যাপারে বিশ্বাস করে।’ (সুরা : আনয়াম, আয়াত : ১৫৪)

তাওরাতের বিকৃতি : তাওরাত আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ হলেও তা কালক্রমে কিছু অসাধু ও ধর্মব্যবসায়ীর দ্বারা বিকৃত হয়েছে। আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে তাওরাতের বিকৃত হওয়ার কথাও বর্ণনা করেছেন। তাদের সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘তাদের মধ্যে একদল লোক আছে, যারা কিতাবকে জিব দ্বারা বিকৃত করে, যাতে তোমরা তাকে আল্লাহর কিতাবের অংশ মনে করো; কিন্তু তা কিতাবের অংশ নয় এবং তারা বলে, এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে, অথচ তা আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত নয়, তারা জেনেশুনে আল্লাহ সম্পর্কে মিথ্যা বলে।’ (সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ৭৮)

সামান্য অর্থের বিনিময়ে ইহুদিদের তাওরাতের বিধি-বিধান পরিবর্তন সম্পর্কেও পবিত্র কোরআনে বর্ণনা এসেছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘অতএব তাদের জন্য ধ্বংস, যারা নিজ হাতে কিতাব রচনা করে এবং সামান্য অর্থের জন্য বলে এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে, নিজ হাতে তারা যা রচনা করেছে এ জন্য তাদের ধ্বংস হোক, তারা যা উপার্জন করেছে এ জন্য তাদের ধ্বংস হোক।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ৭৯)

তাওরাত-ইনজিল সম্পর্কে মুসলমানের করণীয় : কোরআন ছাড়া অন্যান্য আসমানি কিতাব কালক্রমে অপব্যাখ্যা ও বিকৃতির শিকার হয়েছে। ফলে হারিয়ে গেছে তার মৌলিকত্ব এবং যার সত্য-মিথ্যা নিরূপণ সত্যিই দুরূহ। এ জন্য রাসুল (সা.) সাহাবাদের সতর্ক করেন, যেন তাঁরা আগের কিতাবের প্রতি উত্সুক না হন। জাবের (রা.) থেকে বর্ণিত, একদিন ওমর (রা.) তাওরাতের একটি অংশ আরবিতে লিখে রাসুল (সা.)-এর কাছে এসে পড়তে শুরু করেন। তা শুনে রাসুল (সা.)-এর চেহারা পরিবর্তিত হয়ে যায়। এক আনসারি সাহাবি বললেন, হে ওমর, তোমার ধ্বংস হোক, তুমি রাসুল (সা.)-এর চেহারা দেখছ না? তখন রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমরা আহলে কিতাবদের কিছু জিজ্ঞেস করবে না। তারা নিজেরা পথভ্রষ্ট হয়েছে। তারা কখনো তোমাদের সঠিক পথ দেখাবে না। নতুবা তোমরা হয়তো সত্যকে মিথ্যা সাব্যস্ত করবে কিংবা মিথ্যাকে সত্য বলবে। ওই সত্তার শপথ, যার হাতে আমার প্রাণ, মুসা (আ.) এখন তোমাদের মাঝে এলে আমাকে বাদ দিয়ে তোমরা তাকে অনুসরণ করলে অবশ্যই তোমরা পথভ্রষ্ট হবে। মনে রেখো, তোমরা সব উম্মতের মধ্যে শ্রেষ্ঠ উম্মত, আমি সব নবীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ নবী।’ (মুসনাদে আহমাদ : ৪৩৯)

ইনজিল কিতাব

ইউনানি বা গ্রিক ভাষায় ব্যবহৃত ইনজিল (gospel) শব্দের অর্থ সুসংবাদ বা মুক্তির সুসংবাদ। খ্রিস্টানদের বিশ্বাস অনুযায়ী, ঈসা বা ইয়াসু (আ.)-এর আগমনের সুসংবাদ। পবিত্র কোরআন অনুযায়ী, আল্লাহ তাআলা বনি ইসরাঈলের হিদায়াতের জন্য ঈসা (আ.)-এর ওপর ইনজিল অবতীর্ণ করেন।

খ্রিস্টানদের বিশ্বাস অনুযায়ী, ‘কিতাবুল মুকাদ্দাস’ বা বাইবেল প্রধানত দুই ভাগে বিভক্ত—এক. ‘আল আহদুল কাদিম’ বা ওল্ড টেস্টামেন্ট; দুই. ‘আল আহদুল জাদিদ’ বা নিউ টেস্টামেন্ট। খ্রিস্টানদের বিশ্বাস অনুযায়ী, ঈসা (আ.)-এর আবির্ভাবের আগ পর্যন্ত মুসা (আ.)-এর তাওরাতসহ অপরাপর গ্রন্থের সমন্বিত রূপ হলো ওল্ড টেস্টামেন্ট। এতে প্রায় ৩৮টি বা তারও বেশি গ্রন্থ থাকলেও সব কয়টি ইহুদিদের সব গোষ্ঠীর কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।

আর ঈসা (আ.)-এর ওপর অবতীর্ণ ইনজিলসহ আরো কিছু কিতাবের সমন্বিত রূপ হলো নিউ টেস্টামেন্ট (New testament)। ইনজিলের মধ্যেও চার ধরনের ইনজিল বিদ্যমান। মথি (Matthew), মার্ক (Mark), লুক (Luke) ও ইউহান্না (John) নামের এ চারটি ইনজিল ঈসা (আ.)-এর মৃত্যুর অনেক পর তাঁর সঙ্গীরা রচনা করে। (আল মাসিহিয়্যাহ, ড. আহমদ শিবলি)

বাইবেল তথা খ্রিস্টানদের ধর্মীয় গ্রন্থের বর্ণনার সূত্র ও লেখক সম্পর্কে পুরোপুরি জানা যায়নি, যা গ্রহণযোগ্য হওয়ার জন্য অত্যন্ত জরুরি। তেমনি প্রায় প্রতিটি বর্ণনায় রয়েছে অগণিত ভুলভ্রান্তি, অসামঞ্জস্য ও অসত্য ঘটনাবলি। তাই এসবকে আল্লাহর কালাম মনে করা প্রশ্নসাপেক্ষ। (মুখতাসারু ইজহারিল হক, মাওলানা রহমাতুল্লাহ কিরানাভি)

ইনজিল ছিল তাওরাতের পরিপূরক। তাই মুসা (আ.)-এর ওপর অবতীর্ণ তাওরাত কিতাবে বর্ণিত অনেক বিধি-বিধানের সঙ্গে ইনজিলের সাদৃশ্য ছিল। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘আমি তাদের পর তাওরাতের সত্যায়নকারীরূপে ঈসা বিন মারিয়াম (আ.)-কে প্রেরণ করেছি। মুত্তাকিদের জন্য পথনির্দেশ ও উপদেশরূপে তাঁকে ইনজিল প্রদান করেছি তাঁর পূর্বে অবতীর্ণ তাওরাতের সত্যায়নকারীরূপে, যাতে ছিল উপদেশ ও আলো।’ (সুরা : মায়িদা, আয়াত : ৪৬)

মহান আল্লাহ আরো বলেন, ‘তিনি সত্যসহ আপনার ওপর কিতাব নাজিল করেছেন, পূর্বে যা এসেছে তার সত্যায়নকারীরূপে, আর তিনি নাজিল করেছিলেন তাওরাত ও ইনজিল কিতাবদ্বয়।’ (সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ৩)

কোরআন শরিফ

মানুষ ও জিন জাতির হিদায়াতের জন্য সর্বশেষ নাজিলকৃত কিতাব আল-কোরআন। সর্বশেষ নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর ওপর আরবি ভাষায় তা অবতীর্ণ হয়েছে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘যারা ঈমান আনল, ভালো কাজ করল এবং মুহাম্মদ (সা.)-এর ওপর অবতীর্ণ কিতাবের ওপর ঈমান আনল, যা তাদের রবের পক্ষ থেকে সত্য কিতাব, তিনি তাদের গুনাহ ক্ষমা করবেন এবং তাদের অবস্থা ভালো করবেন।’ (সুরা : মুহাম্মাদ, আয়াত : ২)

অন্য আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আমি আপনার ওপর কোরআন অবতীর্ণ করেছি, যাতে আপনি মানুষকে সুস্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দিন আপনার কাছে আসা বিষয়াদি এবং তারা যেন এগুলো নিয়ে চিন্তা করে।’ (সুরা : নাহল, আয়াত : ৪৪)

কোরআনুল কারিমে আল্লাহ তাআলা মানবজাতির পূর্ণাঙ্গ হিদায়াত ও পথনির্দেশ রেখেছেন। সব সময় ও সব স্থানের জন্য উপযুক্ত একটি জীবনব্যবস্থা উপহার দিয়েছে কোরআন। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘আজ আমি তোমাদের জন্য এই দ্বিন পরিপূর্ণ করেছি, তোমাদের ওপর আমার নিয়ামত পূর্ণাঙ্গ করেছি এবং তোমাদের জন্য দ্বিন হিসেবে ইসলাম মনোনীত করেছি।’ (সুরা : মায়িদা, আয়াত : ৩)

কোরআনের হেফাজত ও সংরক্ষণের দায়িত্ব স্বয়ং আল্লাহ গ্রহণ করেছেন। তাই আজ পর্যন্ত এতে কোনো প্রকার পরিবর্তন-পরিবর্ধন ও সংযোজন-বিয়োজন করার প্রয়োজন হয়নি। যেভাবে কোরআন অবতীর্ণ হয়েছিল, সেভাবেই এখনো বিদ্যমান আছে। একটি অক্ষর, এমনকি হরকতেরও রদবদল হয়নি আজ পর্যন্ত। কিয়ামত পর্যন্ত এটি এমনই থাকবে। আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘আমি  কোরআন অবতীর্ণ করেছি এবং আমি তা হেফাজত করব।’ (সুরা : হাজর, আয়াত : ৯) অর্থাৎ কোনো প্রকার বাড়ানো বা কমানো থেকে আল্লাহ তাআলা কোরআনকে হেফাজত করেছেন। জিন ও মানুষের কেউ এতে কোনো কিছু অনুপ্রবেশ করাতে পারবে না। কারণ আল্লাহ তাআলা নিজেই তা সংরক্ষণের দায়িত্ব নিয়েছেন। তাই তা অনন্তকাল সংরক্ষিত থাকবে। (তাফসিরে কুরতুবি)

সর্বশেষ আসমানি কিতাব হিসেবে কোরআন পুরো মানবজাতির জন্য অবতীর্ণ হয়েছে। ফলে অতীতের সব বিধি-বিধানও রহিত হয়েছে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘আপনি বলুন, হে লোকেরা, আমি তোমাদের সবার কাছে আল্লাহর রাসুল হিসেবে প্রেরিত হয়েছি।’ (সুরা : আরাফ, আয়াত : ১৫৮)

আল্লাহ তাআলা আরো বলেন, ‘আমি আপনার ওপর সত্যসহ কিতাব অবতীর্ণ করেছি ইতিপূর্বে অবতীর্ণ কিতাবের সত্যায়নকারী ও তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে।’ (সুরা : মায়িদা, আয়াত : ৪৮)

এখানে কোরআনকে তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। অর্থাৎ অতীতের সব কিতাবের ব্যাপারে সাক্ষ্য দেবে এবং ত্রুটি-বিচ্যুতি বর্ণনা করবে। (মাজমুউল ফাতওয়া : ৪৩/১৭)

অন্যান্য আসমানি কিতাবের ব্যাপারে ইসলামের নির্দেশনা হলো, তাদের কিতাবে বর্ণিত বিষয়াদি সম্পর্কে কোনো মন্তব্য না করা। চুপ থাকাই উত্তম। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘আসমানি কিতাবপ্রাপ্তদের তোমরা সত্যায়ন করবে না এবং মিথ্যাবাদীও বলবে না। তোমরা শুধু বলবে, আমরা ঈমান এনেছি আল্লাহর প্রতি, আমাদের ওপর যা অবতীর্ণ হয়েছে এবং তোমাদের ওপর যা অবতীর্ণ হয়েছে তার প্রতিও।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৭৩৬২)

পবিত্র কোরআনে ১১৪টি সুরা আছে, যার ৮৬টি মক্কায় অবতীর্ণ এবং ২৮টি মদিনায় অবতীর্ণ। মক্কি সুরায় সাধারণত তাওহিদ, রিসালাত, আখিরাত, জান্নাত, জাহান্নাম, হিসাব ও আমল সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। আর মাদানি সুরাগুলোতে সাধারণত হালাল, হারাম, ইসলামী বিধি-নিষেধ, আচার-ব্যবহার, সমাজ-রাষ্ট্র সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। প্রসিদ্ধ মতানুসারে কোরআনের আয়াতের সর্বমোট সংখ্যা ছয় হাজার ২৩৬। (মাবাহিস ফি উলুমিল কোরআন, ড. মান্না কত্তান)

পবিত্র কোরআনের ৩০টি পারা বা অংশ রয়েছে। সাত দিনে কোরআন খতম করার সুবিধার্থে পুরো কোরআনকে সাত মনজিলে ভাগ করা হয়েছে। তা হলো : ১. সুরা ফাতেহা থেকে সুরা নিসা, ২. সুরা মায়েদা থেকে সুরা তাওবা, ৩. সুরা ইউনুস থেকে সুরা নাহল, ৪. সুরা বনি ইসরাইল থেকে সুরা ফুরকান, ৫. সুরা শুয়ারা থেকে সুরা ইয়াসিন, ৬. সুরা সাফফাত থেকে সুরা হুজুরাত, ৭. সুরা ক্বফ থেকে সুরা নাস।

কোরআনের ১৪টি স্থান তিলাওয়াতাকালে সিজদা দিতে হয়। ৫১৪টি রুকু আছে। এ ছাড়া শব্দসংখ্যা হলো ৭৭ হাজার ৪৩৯ এবং হরফসংখ্যা তিন লাখ ৪০ হাজার ৭৪০। (আল ইতকান ফি উলুমিল কোরআন)

লেখক : গ্রন্থকার ও গবেষক

২১টি উপদেশ যা আপনাকে নতুন করে ভাবতে শেখাবে

miamoto mushahiএকটি যন্ত্র পরিচালনা করতে হলেও কিছু সুনির্দিষ্ট নিয়ম-পদ্ধতি অনুসরণ করতে হয়। আর আমাদের জীবন তো একটা মহাযন্ত্র! একে সুষ্ঠু বিধিমালা ব্যতিরেকে সঠিকভাবে পরিচালনা করা এক অসম্ভব কল্পনা ছাড়া আর কিছুই নয়। মানুষ যেন তার জীবনকে সাফল্যমন্ডিত করতে পারে। এজন্য যুগযুগ ধরে পন্ডিত ব্যক্তিরা বিভিন্ন দিকনির্দেশনা দিয়ে আসছেন। আর এই নির্দেশিকাগুলো অনুসরণ করে অনেকেই তাদের জীবনকে আলোকিত করেছেন। মিয়ামোতো মুশাসি হলেন এমনি এক দিকপাল যিনি ছিলেন একজন জাপানি বৌদ্ধ গুরু।

তিনি তার মৃত্যুর দুই সপ্তাহ আগে ২১টি জীবন বিধি ব্যক্ত করেন। আশা করা যায়, এই নিয়মনীতিগুলো আপনি আপনার জীবন পরিচালনায় প্রয়োগ করে নিজেকে একজন আদর্শ মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হবেন । এই আদর্শগুলো আপনার চিন্তা ভাবনাকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করবে। আপনি যদি বিপথগামীও হয়ে থাকেন, তবে সঠিক পথের নিশানা পাবেন। সর্বোপরি, আপনার জীবন হবে আলোকিত।

১. বাস্তবতা মেনে নিন

সবকিছু সাদরে গ্রহণ করে নিতে পারা একটা ভালো গুণ। এটা আপনার সবধরনের মানসিক চাপকে দূরীভূত করবে। সহ্য করার শক্তি বেড়ে যাবে।

২. নিজেকে প্রয়োজনের অধিক আনন্দে মাতাবেন না

একজন মানুষ হিসেবে আমরা তখনই অসুখী যখন আমাদের যা আছে তাতে সন্তুষ্ট হতে পারি না এবং আরও অধিক প্রত্যাশা করি। আমাদের চাহিদা শেষ হবে না, আমাদের একটি ইচ্ছা পূরণ হলে আরেকটা পাওয়ার আকাঙ্খা জাগবে। আমরা শুধু পেতেই চাইবো। এটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এর অর্থ এই না যে, আমরা আনন্দ করবো না! এর অর্থ হলো আমরা অবিরত সুখ প্রত্যাশা করবো না, কিন্তু আমরা আমাদের প্রতিটি মুহূর্তকে আনন্দের সাথে উপভোগ করবো।

৩. জীবন পরিচালনার জন্য ক্ষণিকের অনুভূতি বা আবেগের প্রতি নির্ভরশীল হবেন না

আমাদের অনুভূতি ও আবেগগুলো চিরস্থায়ী নয়। তাই আবেগের বশবর্তী হয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নিবেন না বরং চিন্তা বিবেক-বুদ্ধির সাহায্য নিন। আবেগময় কোনো কাজ আপনার আপনার জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলতে পারে।

৪. নিজের চেয়ে বিশ্ববাসীর জন্য গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করুন

চীনা একটি প্রবাদ আছে, ‘আপনি যদি এক ঘন্টার জন্য সুখ পেতে চান তাহলে ঘুমিয়ে পড়–ন, যদি একদিনের জন্য আনন্দ পেতে চান তবে মাছ ধরুন, যদি এক বছরের জন্য সুখ পেতে চান তবে একটি ভাগ্যকে গ্রহণ করুন আর যদি সারাজীবনের জন্য সুখ পেতে চান তাহলে অন্যকে সাহায্য করুন।’ তাই আপনি যদি প্রকৃত সুখী হতে চান, তবে মানুষের জন্য নিজেকে বিলিয়ে দিন। মানুষের কল্যাণে নিজেকে নিমগ্ন রাখুন।

৫. আকাঙ্খার দাসত্ব করবেন না

অধিক আকাঙ্খা আপনাকে যন্ত্রণা এনে দিবে, আপনি আপনার বর্তমান অবস্থায় সন্তুষ্ট হতে পারবেন না। ক্রমাগত চাহিদা বৃদ্ধি পেতে থাকবে। তাই কখনোই আকাঙ্খার দাস হবেন না।

৬. যা ঘটেছে তার জন্য চিন্তিত বা দুঃখিত হবেন না

এটা সত্য যে, যা ইতিপূর্বে ঘটেছে তা আপনি পরিবর্তন করতে পারবেন না। ঘটে যাওয়া কোনো বিষয় নিয়ে যদি দুঃখিত হন তবে তা আপনার আগামী দিনের সুখ, আনন্দ ও সাফল্যকে মুছে ফেলতে পারে। তাই কখনোই কোনো ঘটে যাওয়া বিষয় নিয়ে চিন্তিত ও দুঃখিত হবেন না।

৭. কখনও ঈর্ষান্বিত হবেন না

অপরের ভালো কিছু দেখে যদি নিজেকে অসুখী মনে করেন বা অন্যের আনন্দে আনন্দিত হতে না পারেন! তবে এই অভ্যাসটা আজই ত্যাগ করুন। আপনার নিজের দিকে তাকান আর আপনার যা আছে তাতেই সন্তুষ্ট থাকুন।

৮. বিচ্ছেদকে মেনে নিন

পৃথিবীতে সবকিছু আপনার ইচ্ছানুযায়ী হবে না। আপনি হয়তো ভাবেন, এই বিষয় বা ব্যক্তি আপনার সাথে থাকা প্রয়োজন কিন্তু হঠাৎ যদি এগুলো হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন তবে এই বিচ্ছেদকে মেনে নিন ।

৯. বিরক্তি ভাবকে প্রশ্রয় দিবেন না

আপনাকে বিভিন্নরকম পরিস্থিতি থেকে শিখতে হবে। কঠিন কোন মুহূর্তের সম্মুখীন হলেই ভেঙে পড়বেন না এমনকি অভিযোগও করবেন না বরং বুদ্ধি দিয়ে পরিস্থিতি মোকাবেলা করুন। এতে ভবিষ্যৎ-এ এরকম কোনো কঠিন অবস্থার মুখোমুখি হলে তা সহজেই সমাধান করতে পারবেন।

১০. ইন্দ্রিয় লালসার ক্রীতদাস হবেন না

লালসার অনুভূতি আপনাকে হয়তো তাৎক্ষণিক আনন্দ দিবে কিন্তু পরক্ষণেই আপনাকে যন্ত্রণাগ্রস্থ করবে।

১১. পক্ষপাতদুষ্ট হবেন না

পক্ষপাতিত্ব আপনার বিবেক-বুদ্ধিকে অকার্যকর করে দিবে। আপনি তখন অন্ধভাবে কোনোকিছুর অনুসরণ করতে চাইবেন। তাই এমন মানসিকতা থেকে নিজেকে দুরে রাখুন।

১২. নিজেকে একই স্থানে অবরুদ্ধ রাখবেন না

সকল স্থান আপনার জন্য উপযোগী হবে না এটাই স্বাভাবিক। তাই নিজেকে একস্থানে আটকে রাখবেন না। চারিদেকে আপনার সুযোগ-সুবিধাগুলো অনুসন্ধান করুন। সফল হওয়ার জন্য আপনাকে আপনার উপযুক্ত প্রতিবেশ খুঁজে নিতেই হবে।

১৩. খাদ্যদ্রব্য ভক্ষণের প্রতি আসক্ত হবেন না

এটা সত্য যে,সুস্বাস্থের জন্য ভালো ও পুষ্টিকর খাবার প্রয়োজন। তবে আপনি যদি কোনো খাদ্যের প্রতি অধিক আসক্ত হয়ে পড়েন তাহলে তা আপনার নিকট নেশাদ্রব্যে পরিণত হবে। আর এটা আপনার জীবনের জন্য বড় ধরনের হুমকিস্বরূপ।

১৪. বর্তমানকে বেশি প্রাধান্য দিন

অতীতকে আপনি শতচেষ্টা করেও কোনো পরিবর্তন করতে পারবেন না আর বর্তমানই সময়ের পরিক্রমায় অতীতে পরিণত হবে আবার ভবিষৎও বর্তমানে রুপান্তরিত হবে। তাই বর্তমানকে গুরুত্ব দিয়ে কাজ করে যান, সফলতা আপনাআপনি চলে আসবে।

১৫. প্রথাগত ধারণার অন্ধভক্ত হবেন না

প্রথাগত ধ্যান-ধারণা ও কর্মকে সম্মান করুন কিন্তু নিজস্ব চিন্তাভাবনা দিয়ে এগুলো যাচাই-বাছাই করুন। সময়ের সঙ্গে-সঙ্গে সবকিছুই বদলাতে থাকে, তাই অন্ধভাবে ঐতিহ্যগত বিষয়গুলো অনুসরণ করে সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলতে ব্যর্থ হতে পারেন।

১৬. বিনা প্রয়োজনে অস্ত্র বা হাতিয়ার ব্যবহার করবেন না

যেখানে সেখানে আপনার অস্ত্র ব্যবহার থেকে দূরে থাকুন এটা আপনার জীবনের জন্য ক্ষতি বয়ে নিয়ে আসতে পারে কারন সব পরিস্থিতিই অস্ত্র ব্যবহারের জন্য উপযুক্ত নয়।

১৭. মৃত্যুকে ভয় পাবেন না

আমরা জানি যে, আমাদের মৃত্যুবরণ করতে হবে। তাই এটা নিয়ে ভীত হওয়ার কিছু নেই। বরং যদি মৃত্যুচিন্তা মাথা ঘুরপাক খায় তবে আপনি কোনো কাজে মনযোগ দিতে ও সঠিকভাবে সম্পাদন করতে পারবেন না। তাই মৃত্যুভয় থকে দূরে থাকুন।

১৮. সকল চিন্তা, অনুভূতি ও কাজের প্রতি অধিক সচেতন হন

আপনি যা করেন যা বলেন তার জন্য আপনি-ই দায়ী। তাই আপনার কাজ ও কথার প্রতি মনযোগী হন। তা না হলে ভুল পথে আপনার জীবন পরিচালিত হয়ে যেতে পারে।

১৯. সৃষ্টিকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করুন

আপনার প্রভু আপনাকে কি দিয়েছে! আপনার বিপদে সাহায্য করেছে কি! আপনি সুখি আছেন কি! এগুলো না ভেবে বরং সর্বাবস্থায় আপনার প্রভুর প্রতি আপনার ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করুন ।

২০. জীবনব্যাপী জ্ঞান অর্জন করবেন

আপনার জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত থেকে কিছু না কিছু শেখার চেষ্টা করবেন। আর এই অনুশীলন মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত চালিয়ে যাবেন।

২১. লক্ষ্য থেকে পিছপা হবেন না

আপনি আপনার জীবনের লক্ষ্য স্থির করুন এবং সেই লক্ষ্য অর্জন করতে যত বাধাবিপত্তি আসুক না কেনো! সবকিছু মোকাবেলা করে সামনে যেতে থাকবেন কখনও পিছু হটবেন না ।

পৃথিবীতে চলতে গিয়ে আমাদের জীবনকে বিভিন্ন পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে এগিয়ে নিতে হয়। কখনও আমরা আনন্দে থাকি আবার দেখা যায়, পরক্ষণেই কোনো ঘটনার প্রেক্ষিতে আমাদের উপর হতাশা, দুঃখ, দুশ্চিন্তা ও যন্ত্রণা প্রভৃতি আচ্ছন্ন করে। এ সব পরিস্থিতিতে আমাদেও প্রয়োজন হয় এমন কোনো দিকনির্দেশনা যা অনুসরণ করে আমরা আমাদের জীবনকে সাফল্যমন্ডিত ও আনন্দময় করে উপস্থাপন করতে পারি।

সূত্র: ইয়ুথ কার্নিভাল ব্লগ

বিভাগ:জীবনযাপন

‘অনুভূতি’-‘উসকানি’-‘ভাবমূর্তি’র চাষাবাদ বন্ধ হোক

terrorism prevention-8 -artজোবাইদা নাসরীন : পর পর ঘটে যাওয়া কয়েকটি ঘটনা সামাজিক মাধ্যমের সক্রিয় অনেককেই আতঙ্কগ্রস্ত করে তুলেছে। আতঙ্কের মাত্রা এমনই, এখন কেউ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কোনও লেখায় লাইক দেওয়া, কোনও বিষয়ে নিজস্ব মতামত বা মন্তব্য প্রদান, এমনকি ছবি বা কোনও লেখা শেয়ার করতেও ভয় পাচ্ছেন। কখন কাকে গ্রেফতার করা হবে, কখন কার বিরুদ্ধে মামলা হবে-এই ভয়েই এই অবস্থা। প্রত্যেকটি মুহূর্তই এখন টেনশনের, ভয়ের।

বাংলাদেশ বর্তমানে কয়েকটি সামাজিক রোগে ভয়াবহ আক্রান্ত। এই ভয়াবহ রোগগুলোর কয়েকটি হচ্ছে ‘ভাবমূর্তি’, ‘অনুভূতি’ এবং ‘উসকানি’। এগুলোতে আক্রান্ত হয়ে পড়েছে খোদ প্রতিষ্ঠানগুলোও। গত কয়েকদিন বেশ কয়েকজন সক্রিয় চিন্তাশীল মানুষ গ্রেফতার হয়েছেন। তার মধ্যে একজন হলেন বাংলাদেশের লিটলম্যাগ আন্দালনের অন্যতম পথিকৃৎ কবি হেনরী স্বপন। হেনরী স্বপনের দেওয়া একটি ফেসবুক স্ট্যাটাসে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগ করে বরিশালে খ্রিস্টান ধর্মযাজক ফাদার লাকাবা লিএল গোমেজ হেনরী স্বপনসহ তিন জনের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দায়ের করেছিলেন। সেই মামলায় গ্রেফতার হয়েছিলেন তারা। এর পরেই গ্রেফতার করা হয়েছে আইনজীবী ইমতিয়াজ মাহমুদকে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি খাগড়াছড়ির একটি ঘটনা উল্লেখ করে ফেসবুক টাইমলাইনে একটি পোস্ট দেন এবং প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। এবং সেটিতে ‘উসকানি’র অভিযোগ এনে ২০১৭ সালে মামলা করেন খাগড়াছড়ির একজন বাঙালি। এর আগে এ মাসের ৯ তারিখে বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌন হয়রানি সম্পর্কে গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর এবং সম্পাদকীয় মতামত ফেসবুকে শেয়ার দেওয়ার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ভাবমূর্তি’ নষ্ট করার অভিযোগে শোকজ করা হয়েছে গোপালগঞ্জে বঙ্গবন্ধু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচ শিক্ষার্থীকে। এরই মধ্যে আবার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক মাইদুল ইসলামকে বাসার সামনে এসে গালিগালাজ করে হুমকি দিয়ে গেছেন কয়েকজন। তিনি প্রচণ্ড রকমের নিরাপত্তাহীনতায় আছেন। এর আগে তিনিও গ্রেফতার হয়েছিলেন কোটাবিরোধী আন্দোলনকে ‘উসকে’ দেওয়ার অভিযোগে। আর সেই মামলাটি করেছিলেন চট্টগ্রামের এক ছাত্রলীগ নেতা।

হেনরী স্বপন এবং ইমতিয়াজ মাহমুদ উভয়েই জামিনে কারাগার থেকে বের হয়ে এসেছেন। এই গ্রেফতারের বিষয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক প্রতিক্রিয়াও হয়েছে। এই কয়েকটি ঘটনা বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখতে পাই, অনুভূতিতে আঘাত, উসকানি, ‘ভাবমূর্তি’ নষ্ট এগুলোর একটি রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। কে কখন কোন বিষয়ে অনুভূতিতে আঘাত বোধ করবেন সেটির কোনও নির্দিষ্ট সংজ্ঞা বাংলাদেশের আইনে নেই। তবে এর চরিত্র কাটাছেঁড়া করলে দেখা যায়, সংখ্যাগরিষ্ঠরাই সবেচেয়ে বেশি ‘অনুভূতিপ্রবণ’। তারাই বারবার অনুভূতিতে আঘাত পায়। তাদের জাতীয়তাবাদী অনুভূতি আহত হয়, ধর্মীয় অনুভূতি আহত হয়, যৌন সংখ্যালঘুদের দেখলে সংখ্যাগরিষ্ঠ নারী-পুরুষের অনুভূতি আহত হয়, দরিদ্র কিছু বললে মধ্যবিত্ত বা ধনীদের শ্রেণি অনুভূতি আহত হয়। অপরদিকে প্রতিবছর যে হিন্দুদের প্রতিমা ভাঙচুর হয়, সে সময় কখনও বলা হয় না হিন্দুধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করা হয়েছে। এমনকি যখন রামুতে বৌদ্ধ মন্দির ভাঙচুর করা হলো ২০১২ সালে তখনও কিন্তু এই প্রসঙ্গ আসেনি যে বৌদ্ধদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করা হয়েছে। আমাদের দেশে জাতিগত এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘু নিয়ে যে ধরনের বুলিং/হেয় করার মনস্কতা সামাজিকভাবে চর্চিত হয় সেগুলোকেও কখনও জাতিগত বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হিসেবে হাজির করা হয় না। সুতরাং অনুভূতি বিষয়টা একেবারেই রাজনৈতিক। তবে কখন কার বিপরীতে এটি ব্যবহৃত হবে সেটি বলা কঠিন।

এখন আসি ‘ভাবমূর্তি’র প্রশ্নে। সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত শব্দ। ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠানের ‘ভাবমূর্তি’ নষ্ট হচ্ছে বলে সামাজিক হাহাকার প্রায়শ শোনা যায়। এদেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে যখনই যৌন হয়রানির অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে তখনই এটিকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করা হয় ‘ভাবমূর্তি’ রক্ষার প্রশ্নে। প্রতিষ্ঠানগুলোতে যৌন হয়রানি হবে, সেখানে সেই যৌন নিপীড়ক ব্যক্তিকে বাঁচানোর বিষয়টিকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা তাহলে প্রতিষ্ঠানকে সম্মানিত করে? সেটাতে কোনও ধরনের ‘ভাবমূর্তি’ নষ্ট হয় না? কিন্তু সেসব বিষয়ে আন্দালন হলেই ‘ভাবমূর্তি’ নামক সিন্ধুকে রাখা বস্তুটি খান খান করে ভেঙে পড়ে? অথচ হওয়ার কথা ছিল উল্টোটি। অনেকে আবার বলেন, ‘এগুলোর প্রতিবাদ করা আমার রুচিতে বাধে’। এই কথা দ্বিধাহীনভাবে বলা যায়, এ ধরনের অপরাধের ক্ষেত্র চুপ থাকা, লুকানোর চেষ্টা করাই অরুচিশীল এবং প্রতিবাদটাই বরং রুচির পরিচয় এবং সুস্থ ‘ভাবমূর্তি’র পরিচয়।

‘উসকানি’ কিংবা ‘ইন্ধন’ শব্দটিও আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন নয়, বরং ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত শব্দ। উসকানির সংজ্ঞা কী? মানুষ কখন উসকানি বোধ করে? প্রায়শ উসকানি শব্দটা শোনা যায় সরকারদলীয় মন্ত্রী এবং নেতাদের দেখে। বিশেষ করে গার্মেন্টস কিংবা ছাত্র আন্দালনের নৈতিক জোরকে স্বীকার না করে বিরোধী দলের উসকানি কিংবা বিশেষ মহলের ইন্ধন হিসেবে প্রচার করেন তারা। অর্থাৎ ক্ষমতার গায়ে আঁচড় পড়া যে কোনও কিছুই ‘উসকানি’ হিসেবে পাঠ করা হয় এবং এর মধ্য দিয়ে আন্দোলনকারীকে একরকমভাবে ‘প্যাসিভ’ বা নিষ্ক্রিয় হিসেবে দেখার চেষ্টা করা হয়। যেখানে তাদের অন্যের উসকানির ‘পুতুল’ হিসেবে হাজির করার এ এক ধরনের জোর চেষ্টা থাকে। এর সাথে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে আইনের যোগসূত্রও মিলে যায় কখনও কখনও। আইসিটি অ্যাক্টের ৫৭ ধারা বিভিন্ন সময়ে সমালোচনা এবং দাবির বিলুপ্ত হলেও নতুন আইন ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের মধ্যে ৫৭ ধারার সব উপাদান আছে, যার কারণে এই আইনে মামলা দায়ে করার প্রবণতা ক্রমশ বাড়ছে। মানুষের প্রতিবাদ, প্রতিরোধের বোধকেই উসকানি হিসেবে ঠাওরে গ্রেফতার করে এটি থেকে মানুষকে ক্রমশ দূরে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে রাষ্ট্রীয়ভাবেই। তবে কোনও বক্তব্যের বিরুদ্ধে চট করে উসকানির অভিযোগ আনা নিশ্চিতভাবেই মত প্রকাশের স্বাধীনতার পরিপন্থী।

খুব লক্ষ্য করলে দেখবেন অনুভূতিতে আঘাত, উসকানি-ইন্ধন আর ‘ভাবমূর্তি’ নষ্ট এই তকমাগুলোর মধ্যে এক ধরনের যোগসূত্র আছে। আর এই যোগসূত্রটি তৈরি করছে স্বয়ং রাষ্ট্র। এটি প্রতিবাদহীনতা তৈরি করা এক বড় ধরনের আকাঙ্ক্ষা। আমাদের হাজার হাজার টাকা লুট হচ্ছে, দুর্নীতি হচ্ছে, কৃষক ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে না, পাটকলের শ্রমিকরা বেতন পাচ্ছে না, যৌন হয়রানি, ধর্ষণ নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে যাচ্ছে। আর আমরা এদিকে চাষাবাদ করেই যাচ্ছি ক্ষমতার অনুভূতির, উসকানির আর ভাবমূর্তির…

লেখক: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

পরীক্ষা না থাকলে কী হয়?

girl at examমুহম্মদ জাফর ইকবাল : আমি জানি আমার এই লেখার শিরোনাম দেখে সবাই চমকে উঠবে। অনেকে ভাববে আমি মনে হয় পাগল হয়ে গেছি। যারা আমাকে চেনেন তারা ভাববেন এটি নিশ্চয়ই এক ধরনের কৌতুক কিংবা স্যাটায়ার। আমাদের লেখাপড়ার পুরো ব্যাপারটিই হচ্ছে পরীক্ষানির্ভর। সারা বছর ছেলেমেয়েরা পরীক্ষা দেয়, যে স্কুল যত “ভালো” তাদের পরীক্ষা তত বেশি। বারো বছর লেখাপড়া করার সময় তারা একবার কিংবা দুইবার নয়, চার চারবার পাবলিক পরীক্ষা দেয়। স্কুলের লেখাপড়ার (কিংবা পরীক্ষার) ওপর অভিভাবকদের ভরসা নেই, তাই তাদের ছেলেমেয়েদের কোচিংয়ে ঢুকিয়ে দেন, সেখানেও তারা পরীক্ষার পর পরীক্ষা দেয়। নানা নামে গাইড বই বিক্রি হয়, সেখানে প্রশ্ন এবং উত্তর লেখা থাকে, ছেলেমেয়েরা সেগুলো মুখস্থ করে পরীক্ষা দেওয়ার জন্য। দেশের নামিদামি পত্রিকারা শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে আহাজারি করে কুম্ভিরাশ্রু বিসর্জন করে, কিন্তু তারা নিজেরা নিয়মিত গাইড বই ছাপিয়ে যায়, ছেলেমেয়েরা যেন ঘরে বসে পরীক্ষা দিতে পারে। দেশের অভিভাবকদের বেশিরভাগই মনে করেন লেখাপড়ার মানে হচ্ছে পরীক্ষা দেওয়া। ভালো লেখাপড়া মানে পরীক্ষায় ভালো গ্রেড পাওয়া। কাজেই আমি যদি বলি “পরীক্ষা না থাকলে কী হয়”, তাহলে দেশের সকল মানুষ যদি আমাকে উন্মাদ ভাবেন তাহলে তাদের দোষ দেওয়া যায় না। কিংবা তারা যদি মনে করেন আমি একটা রসিকতা করছি এবং এই লেখার মাঝে সেই রসিকতাটি খুঁজতে থাকেন তাহলেও তাদের মোটেও দোষ দেওয়া যায় না।

আমি কিন্তু উন্মাদ হয়ে যাইনি কিংবা রসিকতা করার জন্য এই লেখাটি লিখছি না, আমি যথেষ্ট সিরিয়াসলি এটা বলছি। বর্তমান যে শিক্ষানীতিটি আছে সেটি তৈরি করার জন্য যে কমিটি তৈরি করা হয়েছিল আমি তার একজন সদস্য ছিলাম এবং আমার স্পষ্ট মনে আছে আমরা সেখানে বলেছিলাম প্রাইমারি স্কুলের প্রথম তিন বছর কোনও পরীক্ষা থাকবে না। আমরা যে খসড়াটি জমা দিয়েছিলাম তার অনেক পরিবর্তন করে সেটা পাস করানো হয়েছিল। কারণ, আমরা মাত্র দুটি পাবলিক পরীক্ষার কথা বলেছিলাম, কিন্তু এখন আমরা সবাই জানি এই দেশের বাচ্চাদের অনেক কষ্ট দিয়ে চারটি পাবলিক পরীক্ষা নেয়া হয়। কাজেই লেখাপড়ার প্রথম তিন বৎসর কোনো পরীক্ষাই থাকবে না এই সিদ্ধান্তটি শিক্ষানীতিতে আদৌ আছে কিনা আমি জানি না। কিন্তু যেহেতু মনে করা হয় লেখাপড়া মানেই হচ্ছে পরীক্ষা, কাজেই আমরা সবাই জানি এই দেশের একেবারে দুধের বাচ্চাটিকেও পরীক্ষা দিতে হয় এবং সেই পরীক্ষায় একটু উনিশ-বিশ হলে অভিভাবকেরা বাচ্চাদের জীবনটিকে ওলট-পালট করে ফেলেন।

কিন্তু অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্যি, পৃথিবীর অনেক দেশে বাচ্চাদের জীবন থেকে পরীক্ষা নামক অভিশাপটি দূর করে দেওয়া হয়েছে। পৃথিবীর কোন দেশে সবচেয়ে ভালো লেখাপড়া হয় জিজ্ঞেস করা হলে সাধারণত ফিনল্যান্ডের নামটি বলা হয়। সেই দেশের বাচ্চারা তাদের জীবনের প্রথম পরীক্ষাটি দেয় ষোল বছর বয়সে। কোনও পরীক্ষা না দিয়েই তারা যেটুকু শেখার কথা সেটুকু শিখে যাচ্ছে। তাহলে আমরা কেন আমাদের দেশে লেখাপড়া এবং পরীক্ষা সমার্থক করে ফেলেছি?

এ ব্যাপারে কিছুদিন আগে আমার একটি চমকপ্রদ অভিজ্ঞতা হয়েছে। একদিন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র আমার সাথে দেখা করতে এসেছে। সে কোনও একটি ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে পড়াশোনা করে। যারা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি প্রক্রিয়া জানেন তারা সবাই অনুমান করতে পারবেন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে ভর্তি হওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। তার সাথে কথা বলতে বলতে আমি প্রায় হঠাৎ করে জানতে পারলাম সে পিতৃমাতৃহীন একজন পথশিশু হয়ে বড় হয়েছে। তার বয়স যখন তেরো কিংবা চৌদ্দ তখন তার হঠাৎ লেখাপড়া করার শখ হয়েছে। নিজে নিজে বর্ণ পরিচয় করে প্রথম ভর্তি হয়েছে অষ্টম শ্রেণিতে অর্থাৎ প্রথম  থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত তার কোনও লেখাপড়া নেই। পড়াশোনায় যথেষ্ট মনোযোগী ছিল বলে সে স্কুল শেষ করে কলেজ এবং কলেজ শেষ করে ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, সে জীবনে কোনও কোচিং বা প্রাইভেট পড়ে নি এবং পথে ঘাটে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে অভ্যাস হয়ে গেছে বলে এখনও বালিশ ছাড়া ঘুমায়!

নিঃসন্দেহে এই ছেলেটি মোটেও আর দশজন সাধারণ ছেলেমেয়ের মতো নয়। কিন্তু তার জীবন থেকে আমি একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় শিখেছি। একজন ছাত্র বা ছাত্রী যদি অষ্টম শ্রেণি থেকে তার লেখাপড়া শুরু করে, সে যদি চায় তাহলে স্কুল-কলেজ শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় শুরু করে দিতে পারবে। সেই থেকে আমি ভাবছি তা-ই যদি সত্যি হয় তাহলে কেন আমরা প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পরীক্ষার পর পরীক্ষা নিয়ে একজন ছাত্র বা ছাত্রীর জীবনটিকে বিষময় করে তুলি? কেন তাকে আনন্দময় একটা পরিবেশে বড় হতে দিই না, কোনও চাপ না দিয়ে তাকে নিজের মতো করে পরবর্তী জীবনে লেখাপড়া করার জন্য প্রস্তুত হতে দিই না? এমন নয় যে এটি খুবই আজগুবি একটা কথা, পৃথিবীতে এই মুহূর্তে অনেক দেশে এমনটি করা হয়। পরীক্ষা নেই বলে সবাই ফাঁকি দিয়ে চূড়ান্ত একটি করে গবেট তৈরি হচ্ছে না, বরং উল্টো ব্যাপারটি ঘটছে। তাদের শৈশবটি হচ্ছে আনন্দময় এবং অন্য দেশের ছেলেমেয়েদের থেকে তারা ভালো শিখছে। কারণ, তারা শিখছে নিজের ইচ্ছায়, নিজের আনন্দে!

২.
পরীক্ষা নির্ভর লেখাপড়া তো অনেক দিন থেকেই হচ্ছে। আমরা ছেলেমেয়েদের পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে ভয় দেখিয়ে চাপ দিয়ে তাদের পড়াশোনা করিয়ে যাচ্ছি। গাইড বইয়ের ব্যবসায়ী,আর প্রাইভেট এবং কোচিং ব্যবসায়ীদের ছাড়া অন্য কারো খুব বড় লাভ হয়েছে বলে তো মনে হয় না। কিছুদিন হলো আমি টের পেয়েছি কোচিং ব্যবসায়ীরা যথেষ্ট সংগঠিত। কোচিং ব্যবসা বন্ধ নিয়ে আলাপ-আলোচনা শুরু হওয়ার পর হঠাৎ একদিন ঘণ্টাখানেকের মাঝে আমার কাছে অসংখ্য ই-মেইল এসে হাজির। প্রত্যেকটা ই-মেইলের বক্তব্য একই ধরনের। কোচিং যে আমাদের দেশের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার জন্য কতো প্রয়োজনীয় এবং এই কোচিং করে যে দেশের লেখাপড়া কতো এগিয়ে গেছে সেটাই হচ্ছে মূল বক্তব্য। আমি খুবই অবাক হয়ে তাদের সবার ই-মেইলের উত্তর দিয়ে তাদের কাছে জানতে চাইলাম হঠাৎ করে তারা এই ব্যবসার গুণকীর্তন করতে শুরু করেছেন কেন? কোনও কোচিং ব্যবসায়ী কী তাদের আমার কাছে এরকম “লবিং” করার জন্য প্ররোচিত করেছে? বলতে গেলে কেউ সেই ই-মেইলের উত্তর দেয়নি, একজন ছাড়া। তিনি লিখেছেন যে মোটেও এই ই-মেইলটি পাঠাননি। অন্য কেউ তার ই-মেইল হ্যাক করে আমার কাছে এই মেইলটি পাঠিয়েছে। আমি অনুমান করছি, কোচিং ব্যবসায়ীরা আধুনিক তথ্য প্রযুক্তিতে যথেষ্ট দক্ষ,তারা শুধু এই ব্যবসা করে ছাত্রছাত্রীদের বারোটা বাজিয়েই সন্তুষ্ট নন, তাদের ব্যবসা যেন বন্ধ না হয়ে যায় সেজন্যে যত রকম প্রচারণা চালানো যায় সেগুলোও খুবই দক্ষতার সাথে করে যাচ্ছে।

যাই হোক, আমি আবার মূল বক্তব্যে ফিরে যাই,আমরা বহুদিন থেকে পরীক্ষাকেন্দ্রিক লেখাপড়া করে যাচ্ছি তাতে আমাদের সাফল্য কতোখানি? ২০১৫ সালের একটা রিপোর্ট অনুযায়ী, তৃতীয় শ্রেণির ছেলেমেয়েদের শতকরা ৩৫ ভাগই যেটুকু বাংলা পড়ার কথা সেটুকু বাংলা পড়তে পারে না, শতকরা ৬০ ভাগই যেটুকু গণিত জানার কথা সেটুকু গণিত জানে না। যখন তারা পঞ্চম শ্রেণিতে উঠেছে তখন আগের সমস্যা কাটিয়ে ওঠার বদলে সমস্যা আরও বেড়ে গেছে। তখন শতকরা ৮০ ভাগ ছেলেমেয়ে যেটুকু জানার কথা সেটুকু জানে না। সংখ্যাটি অবিশ্বাস্য,মেনে নিতে কষ্ট হয়। মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের একটা রিপোর্ট বের হয়েছে, সেখানে তারা আমাদের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার অবস্থাটা একটু অন্যভাবে উপস্থাপন করেছে। তাদের হিসাব অনুযায়ী আমাদের ছেলেমেয়েদের জীবনের প্রথম ১১ বছরের লেখাপড়ার মাঝে সাড়ে চার বছর পরিমাণ সময় লেখাপড়া হয় না। অর্থাৎ আমরা তাদের ১১ বছরে সাড়ে ছয় বছরের সমান পড়িয়েছি।

বিষয়টি নিয়ে যে পরিমাণ হইচই আলোচনা হওয়ার কথা ছিল সেটি হয়নি। অবাক হওয়ার কিছু নেই,সমস্যার সমাধান করা কঠিন,মেনে নেওয়া অনেক সহজ। তখন কাউকেই কিছু করতে হয় না,এক দুইটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেই নিজের কাছে নিজে দায়মুক্ত থাকা যায়। নানা প্রতিষ্ঠানের নানা ধরনের জরিপ নানা পরিসংখ্যানের কতটুকু খাঁটি কিংবা কতটুকু বিশ্বাসযোগ্য আমি সেই আলোচনায় যাচ্ছি না। আমি শুধু সবাইকে মনে করিয়ে দিতে চাই, এই দেশের প্রায় পাঁচ কোটি ছেলেমেয়ে স্কুল কলেজ মাদ্রাসায় পড়াশোনা করে। তাদের সবাইকে যদি একটুখানিও ঠিক করে পড়াশোনা করানো যায় সেটি বিশাল একটি ব্যাপার। ঠিক সেরকম আমরা যদি তাদের লেখাপড়া করাতে একটুখানিও ব্যর্থ হই সেটা ঠিক সেরকম বিশাল একটা বিপর্যয়। কতোটুকু লেখাপড়া হয়েছে তার সঠিক পরিমাপ করার জন্য সবাই মিলে গবেষণা করতে থাকুক, কিন্তু কোনো রকম গবেষণা না করেই আমরা অন্তত একটা বিষয় বলে দিতে পারি। সেটি হচ্ছে আমাদের দেশের ছেলেমেয়েদের জীবনটি হচ্ছে আনন্দহীন। পরীক্ষার জন্য ছুটতে ছুটতে যে জীবনটা গাইড বই আর কোচিং সেন্টার দিয়ে বেঁধে ফেলা হয়েছে সেই জীবনে একটা শিশুর জীবনকে উপভোগ করার সময় কোথায়? মস্তিষ্কের মাঝে তথ্য ঠেসে দেওয়াটা শিক্ষা নয়, বইপত্রে তথ্য আছে, যখন দরকার সেই তথ্য দেখে নেয়া যাবে-মুখস্থ করে সেটা মাথায় ঢোকাতে হবে কেন? শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য মস্তিষ্ককে শানিত করে রাখা, যেন সেটি সমস্যার সমাধান করতে পারে,অনেক তথ্য দিয়ে দিলে সেটা বিশ্লেষণ করতে পারে,নতুন কিছু করতে পারে। শিক্ষার উদ্দেশ্য মোটেও তথ্য মুখস্থ করা নয়।

৩.
কেউ যেন মনে না করেন আমি বলছি আগামীকাল থেকে বাংলাদেশের সব স্কুল কলেজ থেকে হুট করে সব পরীক্ষা তুলে দেওয়া হোক! শুধু তা-ই নয়, ফিনল্যান্ডে যে মডেল কাজ করেছে আমাদের দেশেও সেই মডেল কাজ করবে তারও কোনও নিশ্চয়তা নেই। ফিনল্যান্ডে সবচেয়ে লোভনীয় চাকরি হচ্ছে স্কুলে শিক্ষকতা,আমাদের দেশে ঠিক তার উল্টো! আমাদের দেশে শিক্ষকের চাকরিতে সম্মান নেই,অর্থবিত্ত বা সুযোগ-সুবিধা নেই,বড় হওয়ার সুযোগও নেই। ফিনল্যান্ডের শিক্ষকেরা প্রত্যেকটা ছাত্রছাত্রীকে আলাদা আলাদা করে বড় করে তোলেন, আমাদের দেশে স্কুলে গিয়ে দেখা যায় সেখানে শিক্ষক নেই, বাচ্চারা নিজেরা নিজেরা হইচই চেঁচামেচি করে সময় কাটাচ্ছে! শিক্ষার জন্যে আরও অনেক টাকা খরচ না করলে আমরা এর চাইতে বেশি কী আশা করতে পারি?

তারপরও আমাদের লেখাপড়ার পুরো বিষয়টা আলাদা আলাদা করে ভেবে দেখার সময় হয়েছে। যখনই আমরা গতানুগতিক নিয়মের বাইরে গিয়ে ছেলেমেয়েদের কিছু একটা শেখানোর চেষ্টা করেছি, তারা সেই সুযোগটা গ্রহণ করেছে। এই দেশের অলিম্পিয়াডগুলো হচ্ছে তার উদাহরণ। সারা পৃথিবীর সাথে প্রতিযোগিতা করে অলিম্পিয়াডের প্রতিযোগীরা সোনা রুপা কিংবা ব্রোঞ্জপদক নিয়ে আসছে। আমি খুবই আনন্দিত হয়েছি যখন দেখেছি আমাদের প্রাইমারি স্কুলগুলোতে গণিত অলিম্পিয়াড পদ্ধতি ব্যবহার করে ছেলেমেয়েদের গণিত শেখানো যায় কিনা সেটি নিয়ে একটি পাইলট প্রজেক্ট শুরু হয়েছে। সত্যি সত্যি সেটা যদি কাজে লাগানো যায় তাহলে অন্ততপক্ষে গণিত শেখার সময় ছেলেমেয়েরা বাধাধরা নিয়মের বাইরে গিয়ে একটুখানি হলেও আনন্দমুখর পরিবেশে শিখতে পারবে।

লেখাপড়ার ব্যাপারে সারা পৃথিবীতেই একটা পরিবর্তন আসছে। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স কথাটা আমরা খুব ঘন ঘন শুনতে পাচ্ছি। অটোমেশান এবং আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের কারণে পৃথিবীতে খুব তাড়াতাড়ি মানুষের গতানুগতিক প্রয়োজন কমে আসবে,সবাই আশঙ্কা করছে, দেখতে দেখতে কোনও একদিন সাধারণ গতানুগতিক মানুষেরা আবিষ্কার করবে এই পৃথিবীতে তার প্রয়োজন নেই। পৃথিবীর সবাই সেই সময়টার মুখোমুখি হওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে, আমাদেরও নিতে হবে। সেই সময়টাতে যান্ত্রিক মুখস্থবিদ্যার পারদর্শী মানুষের কোনও প্রয়োজন থাকবে না,তাই আমাদের ছেলেমেয়েদের এমনভাবে প্রস্তুত করতে হবে, যেন তারা সমস্যার মুখোমুখি হতে পারে,সমস্যার সমাধান করতে পারে,প্রয়োজনে নতুন নতুন ধারণা দিতে পারে।

তার জন্যে যদি পরীক্ষা তুলে দিতে হয় সেটাও নিশ্চয়ই তুলে দেয়া যাবে। তবে আগে যেভাবে হুট করে একজন আমলা কিছু একটা বড় পরিবর্তন করে ফেলতেন সেভাবে নয়। চিন্তাভাবনা করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে,আলাপ আলোচনা করে,গবেষণা করে।

তার কারণ আমাদের সবার সবচেয়ে বড় লক্ষ্য হতে হবে এই দেশের শিশু-কিশোরদের একটা আনন্দময় শৈশব উপহার দেয়ার। সেটি যদি করতে না পারি তাহলে তারা আমাদের কোনও দিন ক্ষমা করবে না।

বই বিস্ময়কর এক শক্তি!

boimela-crowd-18সাকী মাহবুব : মলাটবন্দী মুদ্রিত পৃষ্ঠার সমষ্টির নাম বই। বই দুই অরের অতি ছোট্ট একটি শব্দ হলেও এর রয়েছে বিস্ময়কর শক্তি। দেশে দেশে, কালে কালে, যুগে যুগে বিশ্ব ইতিহাসের গতিপথ পাল্টে দিয়েছে এই বই। ‘আঙ্কেল টমস ক্যাবিন’ নামের একটি বই সামুদ্রিক ঝড়ের মতো ভাসিয়ে নিয়ে গেল শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চলা বিশ্ব মানবতার চরম অভিশাপ দাস প্রথাকে। মেকিয়া ভেলির ‘দি প্রিন্স’, অর্থনীতিবিদ অ্যাডাম স্মিথের ‘ওয়েলথ অব নেশনস’, টমাস পেইনের ‘কমনসেন্স’ প্রকাশের পরেই যেন ঝড় তোলে সাগরের এপার থেকে ওপারে সমান তালে। ‘কমনসেন্স’ প্রকাশের ছয় মাসের মাথায় ১৭৭৬ সালে আমেরিকা তার স্বাধীনতা ঘোষণা করে। হিটলারের ‘মেইন ক্যাম্প’ শতাব্দীর সর্বশ্রেষ্ঠ প্রচারধর্মী বই হিসেবে অনেকটাই স্বীকৃত। এটি বিংশ শতাব্দীর সর্বাধিক প্রভাব বিস্তারকারী বই হিসেবে পরিচিত।

পৃথিবীর এক নায়কেরা সব সময়ই বইয়ের আশ্চর্য মতা ও গুরুত্ব সম্পর্কে সজাগ ছিলেন। যখনই তারা কোনো বিরোধী পরে মতামত কিংবা প্রতিবাদের কণ্ঠ রোধ করতে চেয়েছেন তখনই তারা বিরুদ্ধ মতবাদের বইপত্র ধ্বংসে নিয়োজিত হয়েছেন। হিটলারের ‘মেইন ক্যাম্প’-এর অন্যতম উদাহরণ। বইয়ের মধ্যে যে প্রচণ্ড অ্যাটোমিক বিস্ফোরক নিহিত রয়েছে সে কথা অত্যাচারী শাসকের চাইতে ভালো আর কেউ জানে না।

রেনেসাঁ থেকে শুরু করে বিংশ শতাব্দী পর্যন্ত ইতিহাস, অর্থনীতি, সভ্যতা ও সংস্কৃতি, বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারার ওপর কিছু কিছু বই ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছে। চিন্তাচেতনা ও আদর্শে এইভাবে পুরো সমাজে এনেছে প্রচণ্ড বিপ্লব। এনে দিয়েছে নতুন সমাজের ইঙ্গিত। প্রখ্যাত মুসলিম সমাজ বিজ্ঞানী ইবনে খালদুন তার চুয়াত্তর বছর জীবনের মধ্যে মাত্র চারটি বছরের শ্রমে লিখেছিলেন এক অমর গ্রন্থ ‘আল মুকাদ্দামা’। বইটি রচনার পর প্রায় সাত শ’ বছর পেরিয়ে গেলেও আজো তা পাঠকদের কাছে এক বিস্ময়।

বিশ্ব ইতিহাসের আর এক বিস্ময়কর হিরো ইবনে সিনা হাজার বছর আগেই লিখে গেছেন চিকিৎসাশাস্ত্রের অমর গ্রন্থ ‘কানুন ফিত তিব’ চিকিৎসাবিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে তার পরিচালিত গবেষণা নিয়ে রচিত গ্রন্থ ‘কানুন’ নামক গ্রন্থটিই তাকে বিগত হাজার বছর ধরে হিরো বানিয়ে রেখেছে এবং এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, যতদিন এই বিশ্ব টিকে থাকবে ততদিনই তিনি সেই আসনে সমাসীন থাকবেন। কারণ, আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভিত্তিই টিকে আছে তার সেই গবেষণার ওপরেই। একখানা বই-ই আধুনিক মেডিক্যাল সাইন্সের দ্বার খুলে দিয়েছে ইউরোপের সামনে। চতুর্দশ শতাব্দীর শেষ প্রান্তে এসে এই ‘কানুন যাকে ‘বাইবেল অব মেডিক্যাল সাইন্স’ বলা হচ্ছে তা ল্যাটিন ভাষায় প্রথম অনুবাদের পরে পুরো ইউরোপজুড়ে এতটাই সাড়া পড়ে যায় যে, ষোড়শ শতাব্দীর প্রথম তিন দশকেই এই বিশাল গ্রন্থটির মোট পনেরোটি সংস্করণ প্রকাশিত হয়। আর এর পরে পুরো ষোড়শ শতাব্দীজুড়ে এই একই বইয়ের ২০টির ও বেশি সংস্করণ বের হয়। ইউরোপিয়ানরা খুশি হয়ে ইবনে সিনাকে চিকিৎসা জগতের রাজপুত্র বলে বরণ করে নিয়েছেন।

মোঙ্গলরা আব্বাসীয় সাম্রাজ্যে আক্রমণ চালিয়ে বাগদাদের কয়েক লাখ লোককে হত্যা করেছিল। পুরো বাগদাদকে শ্মশান বানিয়ে দিয়েছিল। তারা মুসলিম উম্মাহর সবচেয়ে বড় তি যেটা করেছিল, তা হলো তারা কয়েক লাখ বই সংবলিত ‘দারুল হিকমাহ’ নামের বিশ্বের সবচেয়ে বড় লাইব্রেরিটা ধ্বংস করেছিল। মানব সভ্যতার মহামূল্যবান বইগুলো এক এক করে ফোরাত নদীতে ফেলেছিল। ফোরাতের স্রোত বন্ধ হয়ে গিয়েছিল বইয়ের স্তুপের কারণে। দীর্ঘ দিন ফোরাতের সেই পানি বাগদাদবাসী ব্যবহার করতে পারেনি। কারণ, তা ওই সব বইয়ের কালি আর মণ্ডুতে বিষাক্ত হয়ে উঠেছিল। মোঙ্গলেরা সেসব বই ধ্বংস করেছিল, কারণ তারা শুনেছিল তখনকার দিনের দুই বিশ্ব পরাশক্তি, দুই সুপার পাওয়ার, রোমান ও পারস্য সভ্যতার ধবংস করতে পেরেছিল যে যাযাবর পশ্চাৎপদ বর্বর আরবরা, তাদের মূল শক্তি নিহিত ছিল এই বইয়ের মধ্যেই। এ কারণেই তাদের সমস্ত রাগ ছিল বইয়ের ওপরে। বস্তুত তাদের বিশ্বাস আর ধারণা অমূলক ছিল না।

মুসলমানেরা একটিমাত্র বইয়ের মাধ্যমে বিশ্বের সবচেয়ে বড় বিপ্লবটা সাধন করতে পেরেছিল। সেই বই তথা আরবি ভাষার সেই কিতাবটা হলো মহাগ্রন্থ পবিত্র আল কুরআন। আধুনিক বিশ্বের সবচেয়ে বড় বিস্ময় আল কুরআন। পৃথিবীর ইতিহাস সাী, এই আল কুরআনই আরব উপত্যকার মেষ পালকদের বিশ্ববিজয়ী জাতির আসনে অধিষ্ঠিত করে দিয়েছিল। নিরর ক্রীতদাস, রাখাল, মরু যাযাবর, গোত্রীয় কলহে বিধ্বস্ত এবং অজ্ঞতা ও অন্ধতায় নিমজ্জিত বিচ্ছিন্ন এক জনগোষ্ঠীকে এই কুরআনই শাশ্বত জ্ঞানে উদ্ভাসিত করে ঈমানের রজ্জুর নিবিড় বন্ধনে ঐক্যবদ্ধ করে দিয়েছিল। এদেরকেই আল কুরআন জগতসেরা শাসক, দিগি¦জয়ী সেনাপতি, অসীম সাহসী ন্যায় বিচারক, নির্ভীক দুঃসাহসী দূত, নিবেদিত প্রাণ এবং নির্যাতিত মানবতার প্রাণের বন্ধু বানিয়ে দিয়েছিল। এদেরকেই আল কুরআন বিশ্বসেরা অধ্যাপক, দার্শনিক, চিকিৎসাবিজ্ঞানী, জ্যোতির্বিজ্ঞানী, ইতিহাসবিদ, হাদিস বিশারদ, কুরআনের মুফাসসির, প্রকৌশলী, ও সমরবিদ বানিয়ে দিয়েছিল। এই কুরআনই ইতিহাসের রোম সাম্রাজ্য ও পারস্য সাম্রাজ্যের পতন ঘটিয়ে দিয়েছিল। এই কুরআনই পশ্চিমের রাবাত কর্ডোভা থেকে পূর্বের ব্রুনাই-জাকার্তা পর্যন্ত এবং দণি সাগরের সমগ্র উপকূল থেকে নিয়ে বরফে ঢাকা উত্তরাঞ্চলীয় দেশগুলোর মানব হৃদয়গুলোকে অনাবিল আলোতে উদ্ভাসিত করে তুলেছিল।

বাংলাদেশের প্রথম প্রোগ্রামার

programmer hanifuddinমোস্তাফা জব্বার: এখনো অনেকে জানে না যে, বাংলাদেশের প্রথম কম্পিউটার প্রোগ্রামার কে? এমনকি যারা কম্পিউটার বিজ্ঞান পড়ে তারাও জানে না যে কার হাত ধরে ১৯৬৪ সালে আমরা কম্পিউটারের যুগে পা ফেলেছিলাম। মানুষটি যেমনি বিস্মৃত তেমনি ঘটনাটিও। অতি সম্প্রতি বিষয়টি আমাদের কোনো কোনো মিডিয়ার নজরে পড়েছে। সেটিও একটি সম্মাননা পাওয়ার পর।

এই বিষয়টি দৈনিক সমকাল পত্রিকায় এভাবে বলা হয়েছে- ‘দেশের প্রথম কম্পিউটার প্রোগ্রামার হানিফউদ্দিন মিয়াকে মরণোত্তর সম্মাননা জানিয়েছে আইসিটি বিভাগ ও বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতি। বাংলাদেশ আইসিটি এক্সপো-২০১৫ শীর্ষক মেলার সমাপনী আয়োজনে হানিফউদ্দিন মিয়ার স্ত্রী ও সন্তানের হাতে সম্মাননা স্মারক তুলে দেওয়া হয়। … সম্মাননা স্মারক তুলে দেন অর্থমন্ত্রী (সাবেক) আবুল মাল আবদুল মুহিত। অনেকটা পাদপ্রদীপের আলোয় না থাকা প্রয়াত এই প্রোগ্রামার এই ছোট আয়োজনের মাধ্যমে নতুন করে আলোচনায় উঠে এসেছিলেন।

বাংলাদেশের প্রথম কম্পিউটারটি আসে ১৯৬৪ সালে (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে)। সেটি ছিল আইবিএম মেইন ফ্রেম ১৬২০ কম্পিউটার। বৃহদাকৃতির ওই কম্পিউটারটি স্থাপন করতে দুটি বড় রুম ব্যবহার করতে হয়েছিল। ঢাউস আকারের সেই কম্পিউটারটিকে ঢাকার আণবিক শক্তি কমিশনে স্থাপন করা হয়। এটি ছিল দ্বিতীয় প্রজন্মের একটি ডিজিটাল মেইনফ্রেম কম্পিউটার।

এখানে বিশেষ উল্লেখ্য, বাংলাদেশ তথা তৎকালীন পাকিস্তানের প্রথম কম্পিউটার আইবিএম ১৬২০ তার হাত ধরেই বাংলাদেশ আণবিক শক্তি কমিশনে (টিএসসি সংলগ্ন) স্থাপিত হয়। পরমাণু শক্তি কমিশনের বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলীরা এবং দেশের স্বনামধন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ অনেক প্রতিষ্ঠান বৈজ্ঞানিক তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ, প্রোগ্রাম উন্নয়ন, প্রশিক্ষণ এবং নানামুখী গবেষণা কাজে এটি ব্যবহার করেন।

তবে ঢাকার আণবিক শক্তি কমিশনে তৎকালীন পাকিস্তানের প্রথম কম্পিউটারটি কেন স্থাপিত হয়েছিল তা জানা প্রয়োজন। হানিফউদ্দিন মিয়া ছাড়া অন্য কেউ এ কম্পিউটার তদারকি এবং পরিচালনার যোগ্য ছিলেন না। এ জন্য সরকার হানিফউদ্দিন মিয়াকে পশ্চিম পাকিস্তানে যাওয়ার আহ্বান জানাল। তবে ওই আহ্বান প্রত্যাখ্যান করেন হানিফউদ্দিন। ফলে কম্পিউটারটি ঢাকার আণবিক কমিশনে স্থাপনে অনেকটা বাধ্য হয় পাকিস্তান সরকার। এখনকার সময়ে বিদেশ মানেই স্বর্গ। সেই সময়ে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের জন্য পাকিস্তানই ছিল স্বর্গ। কিন্তু হানিফউদ্দিন সেই স্বর্গের হাতছানি প্রত্যাখ্যান করেন। এ দেশে কজন এমন মানুষ ছিল বা এখনো আছে?

বাংলাদেশের গৌরব, নাটোরের এই কৃতী সন্তান পরমাণু বিজ্ঞানী হানিফউদ্দিন মিয়া ১৯২৯ সালের ১ নভেম্বর নাটোরের সিংড়ার হুলহুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। স্কুলশিক্ষক বাবা রজব আলী তালুকদারের দুই ছেলে ও এক কন্যাসন্তানের মধ্যে জ্যেষ্ঠ তিনি। সংসারে অভাব না থাকলেও উচ্চশিক্ষার জন্য জায়গির থাকতে হয় তাকে। ১৯৪৬ সালে ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটি থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। ১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম বিভাগে আইএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৫১ সালে কৃতিত্বের সঙ্গে বিএসসিতেও প্রথম বিভাগ লাভ করেন।

এরপর ১৯৫২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই এমএসসি পরীক্ষায় ফলিত গণিতে প্রথম শ্রেণিতে স্বর্ণপদকসহ প্রথম স্থান অর্জন করেন। এরপর ১৯৬০ সালে ইনস্টিটিউট অব ইনফরমেশন থিওরি এন্ড অটোমেশন, চেকোস্লোভাক একাডেমি অব সায়েন্স, প্রাগ থেকে অ্যানালগ কম্পিউটার টেকনিক এবং ডিজিটাল কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।

১৯৬৪ সালে সিস্টেম অ্যানালিসিস, নিউমেরাল ম্যাথমেটিকস, অ্যাডভান্স কম্পিউটার প্রোগ্রামিং, অপারেশন রিসার্চে এমআইটি (যুক্তরাষ্ট্র) কম্পিউটার সেন্টার থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। ১৯৭৫ সালে আইবিএম রিসার্চ সেন্টার লন্ডন থেকে অপারেটিং সিস্টেম ও সিস্টেম প্রোগ্রামিংয়ে ট্রেনিং করেন। তারপর তিনি ১৯৭৫ থেকে ১৯৮০ সালে আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থায় (ওঅঈঊ) প্রোগ্রামার অ্যানালিস্ট হিসেবে অ্যানালাইসিস, ডিজাইন, সফটওয়্যার ইমপ্লিমেশন অব কম্পিউটার অ্যাপ্লিকেশন প্রোগ্রাম সংক্রান্ত বিষয়ে কর্মরত ছিলেন। তিনি ১৯৮৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে খ-কালীন শিক্ষকতা করেন।

এ ছাড়া বিভিন্ন সময়ে তিনি অঙ্কশাস্ত্র ও কম্পিউটার বিষয়ে শিক্ষকতা করেছেন। পারিবারিক জীবনে স্ত্রী ফরিদা বেগম ও এক পুত্র এবং দুই কন্যাসন্তানের জনক দেশের প্রথম কম্পিউটার প্রোগ্রামার মো. হানিফউদ্দিন মিয়া। নাটোর জেলার সিংড়া উপজেলার হুলহুলিয়া গ্রামের এই কৃতী সন্তান বাংলাদেশ অ্যাটোমিক এনার্জি কমিশনের কম্পিউটার সার্ভিস ডিভিশনের ডিরেক্টর পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বিষয় কম্পিউটার সায়েন্স ও নিউমেরাল ম্যাথেমেটিকস থাকা সত্ত্বেও শিল্প-সাহিত্যসহ আরো নানাবিধ বিষয়ে জ্ঞান অর্জনের প্রতি তার ছিল অপরিসীম আগ্রহ। তিনি বাংলা ও ইংলিশ ছাড়াও উর্দু, আরবি, হিন্দি, জার্মান ও রাশিয়ান ভাষা জানতেন।

এদিকে ২০০১ সালে দেশে ব্যবহৃত প্রথম কম্পিউটারটিকে জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘরে সংরক্ষণ করা হয়। এর এক বছর আগে ২০০০ সালে নিজ গ্রাম হুলহুলিয়া হাই স্কুলে দুটি আইবিএম ডেস্কটপ কম্পিউটার উপহার দেন তিনি। এরপর থেকেই এই গ্রাম থেকে ডাক্তারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে কম্পিউটার প্রকৌশলীর সংখ্যা। ছোট্ট এই গ্রাম থেকে বেড়ে উঠেছেন শতাধিক প্রকৌশলী। ২০০৭ সালের ১১ মার্চ না ফেরার দেশে পাড়ি জমান তিনি। তবে মৃত্যুর আগে তিনি বিভিন্ন সময়ে গণিতশাস্ত্র ও কম্পিউটার বিষয়ে শিক্ষকতা করেছেন। বাংলাদেশ গণিত সমিতিরও অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা তিনি। বাংলাদেশ কম্পিউটার বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রার সঙ্গে মোহাম্মদ হানিফউদ্দিন মিয়ার নাম গভীরভাবে সম্পৃক্ত।

হানিফউদ্দিন মিয়াকে নিয়ে আমার নিজের খুব ছোট স্মৃতিচারণ রয়েছে। ১৯৯৭ সালের এপ্রিলে বাংলাদেশ টেলিভিশন প্রথম আমাকে কম্পিউটার বিষয়ক একটি অনুষ্ঠান করার অনুমতি প্রদান করে। বাংলাদেশে কম্পিউটার নিয়ে এর আগে আর কোনো অনুষ্ঠান হয়নি। কম্পিউটার অনুষ্ঠানটি বরাবরই শিক্ষামূলক। তবে প্রথম কয়েকটি অনুষ্ঠান আমি একটু ভিন্ন মাত্রার করার কথা ভেবেছিলাম।

সেজন্যই আমি ১৯৬৪ সালে বাংলাদেশে আসা প্রথম কম্পিউটার নিয়ে আমার প্রথম টিভি অনুষ্ঠানটি সাজাই। তখনই জানা গেল কম্পিউটারটি সাভারের পরমাণু শক্তি কমিশনে আছে। আমরা সেখানে যাব ভাবলাম। লুৎফর ভাই বিটিভির আউটডোর ক্যামেরা ইউনিট বরাদ্দ নেন। আমি চাইলাম সেই কম্পিউটার যিনি প্রথম ব্যবহার করেন তার একটি সাক্ষাৎকার নেব। বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতির প্রথম সভাপতি এস এম কামালের কাছে খোঁজ পেলাম মো. হানিফউদ্দিন মিয়ার। পরে জানলাম বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতির দ্বিতীয় সভাপতি সাজ্জাদ হোসেনের ভায়রা তিনি। সাজ্জাদ ভাই পালিয়ে বিয়ে করেছিলেন এবং হানিফউদ্দিন সেই বিয়ের অনুঘটক ছিলেন।

সেই সাক্ষাৎকারটি ছিল বাংলাদেশের কম্পিউটারের ইতিহাসে এক বড় ধরনের মাইল ফলক। কারণ হানিফউদ্দিন সেদিন বলেছিলেন এ দেশে কম্পিউটার আসার কথা। আমি অবাক হয়েছিলাম এটি জেনে যে, তিনি বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানের লাহোরে যেতে রাজি না হওয়ায় আমরা কম্পিউটারটি পাই। আমি স্মরণ করতে পারি, ভিডিও ক্যামেরায় সামনে সেটি তার প্রথম কথা বলা। অনেকটাই লাজুক টাইপের এই মানুষটির ব্যবহার এতটাই অমায়িক ছিল যে আমি অভিভূত হয়ে যাই।

এরপর বহুদিন তার খবর রাখিনি। কামাল ভাই কম্পিউটার সমিতির আশপাশে থাকলেও সাজ্জাদ ভাই অনেকটা দূরে সরে যাওয়ায় আমি আর তার খবর নিতে পারিনি। আমি জানতাম, তিনি উত্তরায় থাকেন। আর কোনো সংযোগ আমার ছিল না। কিন্তু ২০১৪ সালে বাংলাদেশে কম্পিউটার আসার ৫০ বছর পূর্তিতে আমি হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকি যে, কেমন করে এই সুবর্ণজয়ন্তীটি আমরা উদযাপন করতে পারি। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমার যে আমি তখন কোনো প্লাটফরম খুঁজে পাইনি সেই মাহেন্দ্রক্ষণটি উদযাপন করার জন্য। পরমাণু শক্তি কমিশন সেটি উদযাপন করেনি।

২০১৫ সালের শুরুতে আমি সাভারের পিএটিসিতে সরকারি কর্মকর্তাদের একটি ব্যাচের ক্লাস নিতে গেলে সেখানে আমি হানিফউদ্দিনের কথা বলি। বস্তুত আমি ’৯৭ সালের পর যখনই সুযোগ পেয়েছি তখনই হানিফউদ্দিন মিয়ার কথা বলেছি। ক্লাস শেষে বেরিয়ে আসার পর এক তরুণ এসে জানাল তার বাড়ি হুলহুলিয়া গ্রামে, যে গ্রামে হানিফউদ্দিন জন্ম নিয়েছেন এবং যেখানে তার কবরও আছে। আমি তার কাছে হানিফউদ্দিনের বংশধরদের কারো ঠিকানা চাইলাম। তিনি তার ছেলে শরীফ হাসান সুজার ফোন নম্বর ও বাসার ঠিকানা দিলেন। সেদিন মনে হলো হাতে আকাশের চাঁদ পেলাম।

এমনিতেই ২০১৪ সালের শুরুতে বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতির সভাপতি থাকাকালে বাংলাদেশে কম্পিউটার আসার ৫০ বছর উদযাপনের জন্য চেষ্টা করি। তার আগে বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতির ২৫ বছর উদযাপনের জন্যও চেষ্টা করি। কিন্তু দেশের রাজনৈতিক অবস্থা আমার সহায়ক হয়নি। তবে আমি হাল ছাড়িনি। আমার নিজের কাছে মনে হয়েছে আর কিছু না হোক দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের মানুষদের কাছে অন্তত হানিফউদ্দিন মিয়ার নামটা পৌঁছানো দরকার।

তালিবানের ইসলাম প্রতিষ্ঠা

talebans armedএক আফগান ডাক্তার যিনি ১৯৯৯-২০০০ সালে আফগানিস্তানে ছিলেন, এখন ইউকেতে ডাক্তারী করছেন, উনার মাধ্যমে শুনা.

তালিবানেরা আফগানিস্তানের বাজারে মাঝে মধ্যে রেইড় দিত, ইসলামের নিয়ম কানুন পালন হচ্ছে কিনা দেখতে. এখানে আমার আপত্তি নাই. কিন্তু যেটা শুনে আমার কান্না পেল সেটা হচ্ছে: তারা বাজারে বেচাকেনা করতে আসা লোকদের দাড়ি কতটা লম্বা তা মাপতো – দাড়ি সুন্নত মত (তাদের পরিভাষায়) রাখছে কিনা সেটা দেখতো. তা না হলে সবার সামনেই বেত্রাঘাত!

হাতের মুটি ছোটবড় হতে পারে, তাই তারা বৈজ্ঞানিক পন্থা অনুসরন করত! সমান বিচার করার জন্য তারা একটা চুঙ্গা (funnel) ব্যবহার করত. চুঙ্গার নিচ দিয়ে কিছু দাড়ি বের হলে রক্ষা, নয়তো কোয়াশ কোয়াশ!

রাশিয়াকে বিতাড়িত করার পর মুজাহিদ গ্রুপ গুলি যখন নিজেরা সংঘাতে লিপ্ত, তখন মোল্লা উমর মাদরাসার ছাত্রদের নিয়ে অনেকটা হঠাৎ করেই আফগানিস্তানের শাসনভার গ্রহন করেন. হঠাৎ করে হলেও তাদের জনসমর্থন এবং শিকড় কত গভীরে তার নমুনা আমরা এখন দেখতে পাচ্ছি. আমেরিকাও এখন তালিবানের সাথে আপোষ করছে.

হয়তো তালিবানরা আবার আফগানিস্তানে (তাদের পরিভাষায়) ইসলামী হুকুমত কায়েম করবে! আবার চুঙ্গার এই অভিনব ব্যবহার শুরু হবে!

আমি কিন্তু রসিকতা করার জন্য এই বিষয়ের অবতারণা করি নাই. এই সমস্যা শুধু তালিবানের বা আফগানিস্তানের না. আমি বুয়েটে থাকতে দেখিছি তাবলীগের সোহবতে অনেকে হঠাৎ করে দাড়ি, টুপি, পান্জাবি পড়া শুরু করে দেয়. এটাকে সুন্নতি লেবাছ বললেও কার্যকলাপে বুঝা যেত তারা এটাকেই ইসলামের প্রধান কাজ – ফরজের চেয়েও বেশী মনে করত.

সাধারন মুসল্লীরাও দাড়ি, টুপি, পান্জাবি পরা কাউকেই শুধু নামাজে ইমামতি করার জন্য আগিয়ে দেয়. আমার মনে হয়, আবু জেহেল, আবু লাহাব যদি এখন নামাজের সময় মসজিদের জায়গার আশে পাশে থাকত তাহলে, আবু জেহেল, আবু লাহাবকেই নামাজে ইমামতি করার জন্য অনুরোধ করত! দাড়ি, টুপি, পান্জাবি পরাটাকে এখন ইসলাম ভাবা হয় – যেই মাপকাঠিতে নবীর (স) জামানায় কাফিরা অগ্রগামী ছিল.

বর্তমান জামানার মুসলমানদের বুদ্ধিবৃত্তিক অবস্হা দেখে আমার সব সময় কান্না পায়! ইনফ্লেশানে অাপত্তি, কিন্তু কাগজের টাকা ব্যবহারে আপত্তি নাই. প্রতিনিয়ত রিবার মধ্যে ডুবে আছে, আর ব্যাংকের সুদকেই একমাত্র হারাম বলছে. আবার কোনো ব্যাংক “সুদ” শব্দ ব্যবহার না করে কিছু আরবী শব্দ ব্যবহার করলে সব “মুনাফা” হয়ে যায়! সবই বাহ্যিক, সবই সুপারফিসিয়াল ইসলাম! আর চুঙ্গা দিয়ে এখন এই ইসলাম মাপা হয়!

পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘আপনি বলুন, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবাসতে চাও তাহলে আমার অনুসরণ করো।’ (সূরা আলে ইমরান : ৩১)

রসুল পৃথিবীতে এসেছিলেন ন্যায়, শান্তি, সুবিচার প্রতিষ্ঠা করতে। এ লক্ষ্যে তিনি আমৃত্যু সংগ্রাম করে গেছেন। আমরা সেই সংগ্রামের পথকে ত্যাগ করে দাড়ি রাখা আর আরবীয় জোব্বা পরাকেই রসুলের অনুসরণ বলে গ্রহণ করে নিয়েছি। এখন পরহেজগার মুসলিম বা মোমেন বলতে সত্যদীন প্রতিষ্ঠার কোনো সংগ্রামী মানুষ বোঝায় না, বোঝায় একজন দাড়ি চেক রুমাল ও টুপিওয়ালা মানুষকে। ওগুলো না থাকলে আপনি ইসলামের কোনো বিষয়ে কথাই বলার অধিকার রাখেন না।

এরপরেও একটা আইডেন্টিটির দরকার আছে,এখনকার মুসলমান চেনার উপায় নেই, নাম জিজ্ঞেস করতে হয়, বেশির ভাগ বাংগালী মুসলমান নাম শুনার পরেও সন্দেহ থেকে যায়, নাম জিজ্ঞেস করার সুযোগ না থাকলে পরিচয়ের জন্য আগা কাটা কি কাটা না দেখতে হয়.

ইসলামকে ইসলাম দিয়ে মেরুদন্ডহীন ইসলাম তৈরীর করার গভীর ষড়যন্ত্র হল তবলীগ। ফাজায়েল আমলগুলো পড়ে দেখেন, বিশেষ করে ফাজায়েলে হজ্ব,ফাজায়েলে দরুদ।

মানুষ যখন হারামে ডুবে যায়, তখন শয়তান চেষ্টা করে সেই সুযোগে মানুষকে দিয়ে সেই হারামকে হালাল বানিয়ে নেবার প্রচেষ্টায়। তখন মানুষ ভাবে, আমি যে হারামের মধ্যে ডুবে আছি, সেটা আসলে টেকনিক্যালি হারাম না, হালাল। এভাবেই পাপ ধীরে ধীরে কুফরে পরিনত হয়। কেন জানি বারবার আপনার পোষ্টে ব্যাংকের সুদকে হালাল বানাবার একটা প্রচ্ছন্ন প্রচেষ্টা অনুভব করি। আমি ভুল হতে পারি।

দাড়ি আর ছয় কুল্লি জোব্বায় আটকে আছে ইসলামী ঐক্য ইসলামী বিজয়!

একে তো সঠিক ইসলামী শিক্ষা নেই তারপর গোঁড়ামীর কারণে শিখতে চায় না। নিজেরা চিন্তা- গবেষণা করবে না, কেউ তা করে সংশোধনের চেষ্টা করলে আপত্তি জানাবে। এরা হাজার বছর আগে সংকলিত হাদীস ও ফিকাহ নিয়ে মশগুল থাকতে ভালবাসে। এমনকি কোরানের সাম্প্রতিক তাফসীরগুলো পড়তে অনাগ্রহী।

ইসলামে গোঁড়ামি এবং জবরদস্তি এদু’য়ের কোনটারই সুযোগ নেই। আর প্রত্যেক মানুষেরই উচিত আল্লাহর হিদায়াত (আল-কুরআন) বিষয়ে চিন্তাভাবনা করা। যেমনটা আল্লাহ বলেন,

وَلَقَدۡ يَسَّرۡنَا ٱلۡقُرۡءَانَ لِلذِّكۡرِ فَهَلۡ مِن مُّدَّكِرٍ

আমি কোরআনকে সহজ করে দিয়েছি বোঝার জন্যে। অতএব,কোন চিন্তাশীল আছে কি? তবে চিন্তাভাবনা করার এই পথটা সঠিক হতে হবে। তার জন্য উসুল আল ইলম,সঠিক ভিত্তি চাই। ভুল চিন্তাভাবনা শুধু ভুল গন্তব্যেই পৌছে দিবে।

হাজার বছরের পুরানো তাফসীরগুলোর মত চমৎকার প্রজ্ঞাময় তাফসীর আমি দ্বিতীয়টা খুঁজে পাইনি। সেটা আরবী ভাষা অধ্যয়ন করার পরে। কুরআনকে পরিপুর্ণভাবে অনুধাবন করার জন্য প্রাচীন আরবী ভাষায় লিখিত তাফসীরগুলোর কোন তুলনা নেই।

কেবল একটি পয়েন্ট বিবেচনা করুন, কোরানে ১০০০ এর বেশী আয়াত রয়েছে বিজ্ঞান বিষয়ক। আপনি এসবের কোন তাফসীর পছন্দ করবেন? আধুনিক নাকি হাজার বছর আগের? তাছাড়া আল্লাহপাকের এই বাণীটির কী হবে, “তারা কি কোরান নিয়ে চিন্তা – গবেষণা করে না? নাকি তাদের অন্তরে তালা পড়ে গিয়েছে?” সূরা মুহাম্মদ,২৪।

বিজ্ঞান বিষয়ক আয়াতের কথা তো কেউ অস্বীকার করেনি। কিন্তু তার মানে এই নয় যে,কুরআনের আগের তাফসীর সমূহ মূল্যহীন। আর বিজ্ঞান ছাড়াও কুরআনে আরো অনেক বিষয় আছে, সেকথা ভুলে গেলে কি চলবে? যেমন কুরআন কেনো আরবী ভাষায়? অন্য ভাষায় নয় কেনো? এ বিষয়ে কি কিছু চিন্তা করার আছে না নেই?

দাড়ি বড় করলে সমস্যাটা কি ? রসুল সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহ প্রতিষ্ঠায় কেউ জোর দিলে কি সমস্যা । দাড়ি রাখা নিয়ে বিশুদ্ধ মত হচ্ছে এটা ওয়াজিব । ওয়াজিব পালনে বাধ্য করবে না?

নিশ্চই দাড়ি শেভ করা কাউকে ইমামতি দেয়ার কথা বলতেছেন না । দাড়ি শেভ কারী ফাসেক তাকে ইমামতি দিবে কেন ?

বানরেরা মানুষকে অনুসরণ করতে অক্ষম,তবে অনুকরণ তো করতেই পারে। Riyadul Hassan এর টাইমলাইন থেকে।

আপনার মন্তব্যে আপনি সত্য দ্বীন প্রতিষ্ঠার কথা উল্লেখ করেছেন। সেই প্রসংগে তিনটি শব্দ উল্লেখ করেছেন, মু’মীন, মুসলিম, পরহেজগার। এই তিনটি শব্দের পার্থক্য অনুধাবন করুন, হয়তো দ্বীন প্রতিষ্ঠায় কাজে আসবে।

আপনার বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নয়ন দেখে আমি সত্যিই বিমোহিত। আপনি দাড়ি জুব্বাকে আবু জাহেলের আবু লাহাবের ড্রেস হিসেবে দেখছেন, কিন্তু রাসুলুল্লাহ সাঃ, আবু বকর, ওমর সহ আরো লক্ষাধিক সাহাবী রা: পোশাক হিসেবে দেখছেন না! সত্যিই অনেক বুদ্ধি ভিত্তিক উন্নয়ন।। জুব্বার কথা না হয় বাদ দিলাম, কিন্তু আপনি দাড়ির মত একটা ওয়াজিব সুন্নত নিয়ে এ ধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নয়ন না দেখালেই ভালো…

হযরত উমর(রা) যখন খলিফা, তখন উনি গুরত্ব দিয়েছেন যেন সদূর ফোরাত নদীর তীরে একটি কুকুরও না খেয়ে মারা যায়. কিন্তু মসজিদে নববী তখনও খেজুর পাতায় ভন্গূর কাঠামো অার পাথর, নুড়ি, ধুলা মাটিতে জীর্ণশীর্ণ!

নবী(স) এবং সাহাবে কেরামগন কিসে প্রধান্য দিতেন, আর আমরা এখন কিসে দিচ্ছি?

তালিবানদের ক্ষমতায় আসার পর যুদ্ববিধ্বস্ত দেশে কি প্রাধান্য পাওয়া উচিত ছিল,আর তারা কি প্রাধান্য দিয়েছিল?

এখন দাড়ি প্রধান বিষয় নয়। তওহিদের ভিত্তিতে ঐক্য হওয়া প্রধান বিষয়।

তালিবানরা চুঙা দিয়ে মেপে দাড়ি রাখতে বাধ্য করে। এই কাহিনি লিখেছেন। ভাল কথা। অথচ এই তালিবানদের ইসলামী আচরনে অনুপ্রাণিত হয়ে, তালিবানদের হাতে বন্দী জীবন যাপন করা সত্ত্বেও প্রাক্তন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের শ্যালিকা লরেন বুথ ইসলাম গ্রহন করেন। সেটা কেন? কেমন করে? কোন আচরনের কারনে হলো? সে কাহিনি কি লিখার প্রয়োজন নেই? এক পেশে কাহিনি কখনো সত্য হয় কি?

সোস্যাল ক্রাইসিস!

Social-Media-64হাবিবা বিনতে নুরুন্নবী : প্রায় ভাবি বাংলাদেশের মানুষের চিন্তাভাবনা, ধ্যান ধারনার জায়গাটা বরাবরই অতি ক্ষুদ্র গন্ডীর মধ্যে কেন ঘুরপাক খায়? যৌক্তিক, বাস্তবসম্মত, সময়োপযোগী, সৌজন্যবোধ, আন্তরিকতা আর অফ কোর্স একতরফা নয় বরং সচেতনতার সাথে সার্বিক দিক বিবেচনা করে যে কোন সিদ্ধান্ত কিংবা অভিমত, পদক্ষেপের এখানে যেন আকাল পড়েছে। আগে ভাবতাম সোস্যাল মিডিয়ায় কে কি বললো, কি ইফেক্ট পড়লো এগুলা নিয়ে চিন্তা করলেই সময় নষ্ট, বাস্তব জগতে মিডিয়ার ভূমিকাতেই বেশি গুরুত্ব দিতাম। কিন্তু সময় এখন অনেক গড়িয়েছে। আজকাল মানুষ সোস্যাল মিডিয়াকেই যেকোন আন্দোলন ও দাওয়াহর কাজে, মতামত, পরামর্শদানে, অফিসিয়াল, আনঅফিসিয়াল সমস্ত ক্ষেত্রে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়। যার ফলে এ অঙ্গন হতে গা বাঁচিয়ে সমাজ পরিবর্তনের চিন্তা করা যাচ্ছে না। কিন্তু এই মিডিয়ার ব্যবহারে অধিকাংশই সচেতন নয় বরং বিনোদনকামী। অথচ এটি এখন শুধু বিনোদনের ক্ষেত্র নয়, রাজনৈতিক অরাজনৈতিক সকল সম্পর্ক এর সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

কদিন আগে সাফা কবির নামক একজন মডেল তার পরকালে অবিশ্বাসের ভিডিও কে কেন্দ্র করে যে ট্রল এর ঝড় বয়ে গেল বিষয়টা কতটুকু যৌক্তিক? তার নিজস্ব বিশ্বাস নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে হেনস্তা করাটা যেমন আমার কাছে মূর্খামী মনে হয়েছে তেমনি মুসলমানদের বিশ্বাস, দ্বীনের সৌন্দর্যবোধ ও দ্বীন প্রচারের যে চারিত্রিক ও বাস্তবিক দিক কতটা নীচে নেমে গেছে সেটাও লক্ষণীয়। হুম… আমাদের ঈমানী বিশ্বাসের ওপর আঘাত হানুক এমনটি আমরা চাইবেনা কিন্তু বিশ্বাসের চারিত্রিক প্রতিফলনতো হওয়া উচিত আমাদের কর্মক্ষেত্র, কথাবার্তা, মোয়ামালাত ইত্যাদির মধ্য দিয়ে। হোক না তা সামাজিক মাধ্যম, হোকনা তা বাসে, চা দোকানে, চাকুরীক্ষেত্রে। কেউ আমাকে চিনেনা, জানেনা বলেইকি আমার অসুন্দর, লাগামহীন কথা ও কাজ ফেইসবুকে প্রকাশ করতে হবে, নিজের রাগ ঝাড়তে হবে? আমার দু কাঁধে সওয়ার কিরামান কাতিবিন কি আমার কৃতকর্ম লিখছেন না, আল্লাহ কি দেখছেননা আমি রাতের আঁধারে আর দিনের আলোতে কি করছি?

সামাজিক মাধ্যমসমূহকে যথেচ্ছা ব্যবহার করার দিকে সচেতন হওয়া দরকার। কারণ এটি এখন মানুষের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা দেখতে পাই সোস্যাল মিডিয়ার তীব্র প্রতিক্রিয়ায় ও জনগণের সমর্থনে নুসরাত হত্যার সঠিক ইতিহাস, যে সরকারের ছত্রছায়ায় কুলাঙ্গার সিরাজের নানা ঘৃণ্যনীয় কর্মকা- ক্রমে শিকড় গজাচ্ছিল, সে সরকার এখন বাধ্য হচ্ছে তার সঠিক বিচার করার। এমনি অনেক ঘটনা ছড়িয়ে আছে চারদিক। তাই সঠিক মতামত, চিন্তাশীলতা, সচেতনতাকে পুঁজি করে ইসলামের আদর্শকে হাতিয়ার করে এর ব্যবহার করা উচিত। বাস্তব ক্ষেত্রে কোন মানুষের সামনে বা সমাজের সামনে আমি নিজেকে প্রেজেন্ট করি সেভাবেই সোস্যাল অঙ্গনে প্রেজেন্ট করা চাই।

মানুষের মধ্য সমালোচনা করা আর হাস্যরস করার ফ্রিকোয়েন্সী দেখে মনে হচ্ছে এ প্রজন্ম দ্বীনের প্রায়োগিক দিকটি সম্পর্কে অচেতন ও সাথে সাথে সমাজ ও রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে তার ভূমিকা ও অবদান সম্পর্কে অজ্ঞ, তার জীবনের চলার পথে কোন আদর্শ নেই, নেই কোন কালা কানুন। চলছে তো চলছেই, কোন কিছুকেই সিরিয়াসলি নিচ্ছেনা বা নিলেও তার থেকে নির্যাস নিয়ে কর্তব্য স্থির করতে পারছেনা। যে যেদিকে টানছে সেদিকেই গলার রশি ধরিয়ে দিচ্ছে যেন। কয়েকদিন মাওলানা মিজানুর রহমান আজহারীর সিক্সপ্যাক নিয়ে মানুষজন এই দল সেই দলের কাঁদা ছোড়াছুড়ির দর্শক হিসেবে ভূমিকারত ছিল আবার কয়েকদিন বনানীর নাইমকে নিয়ে রাজনৈতিক স্ক্যান্ডাল…। এত তামাসার ভিতর দিয়ে এক তামাসার জাতিতে বিবর্তিত হয়ে গেছি আমরা, ইভেন তামাসার সরকারও আমাদের নিয়ে তামাসা করে যেমন বিমান হাইজ্যাকের ঘটনা। এই তামাসাপ্রিয় বাঙালীর নাকে মুলা ঝুলানোর সব রকম ষড়যন্ত্রের সুযোগ যেকোন দল বা গোষ্ঠী এখানে লুফে নেয় রাতদিন। এগুলা দাবানোর একমাত্র উপায় :

– আমাদেরকে ঈমান, আখলাক, দ্বীন প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সচেতন হতে হবে,
– পরস্পর পরস্পরকে নিয়ে দোষারোপ করার পরিবর্তে ভালবাসা ও আন্তরিকতা হাত বাড়িয়ে সংশোধন করতে হবে,
– দ্বীনের দাওয়াতী চরিত্র হাসিল করা আর দ্বীন পালনে কৃপণতা বা সংকোচ না করা,
– মানুষের ভালো কাজসমূহের তারিফ করা, খারাপ কাজ সমূহ সংশোধনের ব্যক্তি পর্যায়ে চেষ্টা করা তাতে সংশোধন না হলে সামাজিকভাবে সবাই মিলে তাকে সাহা্য্েযর হাত বাড়িয়ে দেয়া। তার দ্বারা সমাজ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকলে বিদ্রুপ, বিদ্বেষ, ঘৃণা ছড়ানোর পরিবর্তে গঠনমূলক পদক্ষেপ নেয়া ও মৌখিক প্রতিবাদ করার পাশাপাশি তা দমন করার চেষ্টা করা,
– নাস্তিকদের ও বিধর্মীদের প্রশ্ন ও বিদ্বেষের যৌক্তিক ও সৌজন্যপূর্ণ উত্তর প্রদান করা, তাদেরকে তাদেরই মত আক্রমণ করে দাওয়াতের ক্ষেত্রকে কলুষিত না করা,
– অযথা গালাগাল, কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য, বিদ্বেষ না ছড়ানো, অহেতুক তুচ্ছ বিষয়ে মানুষের পিছনে না লাগা,
– ক্ষতিকর বিষয়সমূহের প্রতিবাদ জানানো, ভাল বিষয়সমূহের প্রচার ও প্রসার,
– কেউ কেউ ইচ্ছে করেই মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য বিতর্কিত মন্তব্য ও পোস্ট প্রদান ও ছবি আপলোড করে। এ সকলকে ছড়ানোর পরিবর্তে তার থেকে ভালো, রুচিশীল ও উদাহরনযোগ্য কিছু উদ্যোগ ও অবদান রাখা ও শেয়ার করা,
– নানা উস্কানীমূলক কথা ও কাজে উসকে না উঠে বাস্তবে মানুষের কাছে সঠিক আদর্শ পৌঁছে দেয়ার কাজ করা,
– সমাজের মন্দ কাজগুলো উত্তম কাজ দিয়ে ঢেকে দেয়া,
– দলাদলি, বিভক্তি থেকে দূরে থাকা,
– নিজেদের ঈমান নিজেরাই রক্ষা করতে বেশি বেশি জ্ঞান অর্জন ও আলেম ওলামাদের দ্বারস্থ হওয়া যেন কেউ সহজেই বিভ্রান্ত না করে,
– আলেমদের মতানৈক্য ও দলাদলির দিকে কর্ণপাত বা গ্রাহ্য না করে যে বিধানটি অধিক কোরআন ও হাদীসমূখী তা পালন করা,
– দুষ্টচক্রের নাস্তিক বা বিধর্মী বা ভন্ড বা নামধারী আলেমদের কার্যকলাপ সম্পর্কে সচেতন থাকার জন্য ইসলাম ও জাহেলিয়াতের সকল দিক সম্পর্কে ধারনা অর্জন ও দূরে থাকার পন্থা অবলম্বন করা।

মালবারে ইসলাম প্রচারে খোরাসানী প্রচারক দল

খালেদ সাইফুল্লাহ সিদ্দিকী : ইসলাম প্রচারের ক্ষেত্রে তিনজন সাধক প্রচারকের মালাবারের হিন্দু রাজার দরবারে গমন এবং তার কাছে রাসূলুল্লাহ (সা.) কর্তৃক চন্দ্র দ্বিখন্ডিত হওয়ার ঘটনা এবং রাজার ইসলাম গ্রহণের অপূর্ব কাহিনী তুলে ধরছি। বিভিন্ন ইতিহাস গ্রন্থে ঘটনাটি বিভিন্নভাবে উল্লেখিত হলেও এখানে আমরা বিখ্যাত গ্রন্থ ‘তোহফাতুল মোজাহিদীনে’র বরাতে বর্ণিত তথ্যাবলির আলোকে ঘটনাটি আমাদের আলোচ্য বিষয়। হিজরী দ্বিতীয় শতকে কয়েকজন ইসলাম প্রচারক, বুজর্গ-সাধক হিন্দুস্থানে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে আগমন করেছিলেন। তাদের উদ্যোগ প্রচেষ্টার বিবরণ এই :

শেখ শরীফ ইবনে মালেক, ভ্রাতা মালেক ইবনে দীনার, তাদের ভ্রাতুষ্পুত্র মালেক ইবনে হাবীব এবং তাদের অন্য কয়েকজন সঙ্গী সিংহল দ্বীপে অবস্থিত ‘আদম দুর্গ’ জিয়ারতের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। পথে ‘কারাঙ্গানূর’ নামক স্থানে অবতরণ করেন। তাদের আগমনের খবর যখন মালাবারের রাজার কাছে পৌঁছে তখন তিনি তাদের সকলকে তলব করেন। তারা যখন পৌঁছেন, তখন রাজা তাদের স্বাগত জানান এবং আদরযত্ম করেন।

শেখ শরীফ রাজার এ উত্তম আচার-ব্যবহারে সাহসী হয়ে রাসূলুল্লাহ (সা.)- এর অবস্থা ও ঘটনাবলি রাজার নিকট তুলে ধরেন এবং ইসলামের আরকান ও তার বাস্তবতা রাজাকে বুঝিয়ে বলেন। এতদ্ব্যতীত ‘শক্কুল কামার’ (চাঁদ দ্বিখন্ডিত হওয়ার) মোজেযার স্বরূপ বর্ণনা করেন। এসব কথা প্রচারের ফলে রাজার অন্তরে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর রিসালতের ওপর দৃঢ় বিশ্বাস জন্মে। তাঁর প্রতি মোহাব্বত-ভালোবাসায় তার বুক আলোকিত হয়ে ওঠে এবং তাঁর প্রতি সততার সাথে ঈমান আনেন। উল্লেখ্য, এ বর্ণনায় রাজার নামটি উল্লেখ নেই এবং ঘটনাটি ভিন্নভাবে নামসহ অন্যত্র বর্ণিত হয়েছে।

রাজার ইসলাম গ্রহণের পর শেখ শরীফ যখন রাজার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে যেতে চান, তখন তিনি তাগিদ করে তাকে বললেন, ‘আদম দুর্গ জিরায়ত শেষে তিনি যেন স্বীয় সঙ্গীসহ ‘কারাঙ্গানূরে’ ফিরে আসেন। আমি আপনাদের সঙ্গে মক্কা মোয়াজ্জমায় হজ করতে এবং রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর রওজা মোবারক জিয়ারতের উদ্দেশ্যে অবশ্যই আরবে গমন করব।’ রাজা তাদের এ কথাও বুঝিয়ে দেন যে, ‘আমার এ ইচ্ছার কথা মালাবারেইসলাম প্রচারের ক্ষেত্রে তিনজন সাধক প্রচারকের মালাবারের হিন্দু রাজার দরবারে গমন এবং তার কাছে রাসূলুল্লাহ (সা.) কর্তৃক চন্দ্র দ্বিখন্ডিত হওয়ার ঘটনা এবং রাজার ইসলাম গ্রহণের অপূর্ব কাহিনী তুলে ধরছি। বিভিন্ন ইতিহাস গ্রন্থে ঘটনাটি বিভিন্নভাবে উল্লেখিত হলেও এখানে আমরা বিখ্যাত গ্রন্থ ‘তোহফাতুল মোজাহিদীনে’র বরাতে বর্ণিত তথ্যাবলির আলোকে ঘটনাটি আমাদের আলোচ্য বিষয়। হিজরী দ্বিতীয় শতকে কয়েকজন ইসলাম প্রচারক, বুজর্গ-সাধক হিন্দুস্থানে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে আগমন করেছিলেন। তাদের উদ্যোগ প্রচেষ্টার বিবরণ এই :

শেখ শরীফ ইবনে মালেক, ভ্রাতা মালেক ইবনে দীনার, তাদের ভ্রাতুষ্পুত্র মালেক ইবনে হাবীব এবং তাদের অন্য কয়েকজন সঙ্গী সিংহল দ্বীপে অবস্থিত ‘আদম দুর্গ’ জিয়ারতের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। পথে ‘কারাঙ্গানূর’ নামক স্থানে অবতরণ করেন। তাদের আগমনের খবর যখন মালাবারের রাজার কাছে পৌঁছে তখন তিনি তাদের সকলকে তলব করেন। তারা যখন পৌঁছেন, তখন রাজা তাদের স্বাগত জানান এবং আদরযত্ম করেন।

শেখ শরীফ রাজার এ উত্তম আচার-ব্যবহারে সাহসী হয়ে রাসূলুল্লাহ (সা.)- এর অবস্থা ও ঘটনাবলি রাজার নিকট তুলে ধরেন এবং ইসলামের আরকান ও তার বাস্তবতা রাজাকে বুঝিয়ে বলেন। এতদ্ব্যতীত ‘শক্কুল কামার’ (চাঁদ দ্বিখন্ডিত হওয়ার) মোজেযার স্বরূপ বর্ণনা করেন। এসব কথা প্রচারের ফলে রাজার অন্তরে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর রিসালতের ওপর দৃঢ় বিশ্বাস জন্মে। তাঁর প্রতি মোহাব্বত-ভালোবাসায় তার বুক আলোকিত হয়ে ওঠে এবং তাঁর প্রতি সততার সাথে ঈমান আনেন। উল্লেখ্য, এ বর্ণনায় রাজার নামটি উল্লেখ নেই এবং ঘটনাটি ভিন্নভাবে নামসহ অন্যত্র বর্ণিত হয়েছে।

রাজার ইসলাম গ্রহণের পর শেখ শরীফ যখন রাজার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে যেতে চান, তখন তিনি তাগিদ করে তাকে বললেন, ‘আদম দুর্গ জিরায়ত শেষে তিনি যেন স্বীয় সঙ্গীসহ ‘কারাঙ্গানূরে’ ফিরে আসেন। আমি আপনাদের সঙ্গে মক্কা মোয়াজ্জমায় হজ করতে এবং রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর রওজা মোবারক জিয়ারতের উদ্দেশ্যে অবশ্যই আরবে গমন করব।’ রাজা তাদের এ কথাও বুঝিয়ে দেন যে, ‘আমার এ ইচ্ছার কথা মালাবারের কোনো লোকের নিকট প্রকাশ করবেন না।’
যখন শেখ শরীফ এবং তার সঙ্গীগণ হারমাইন শরীফ জিয়ারত শেষে দ্বিতীয়বার কারাঙ্গানূরে প্রত্যাবর্তন করেন, তখন রাজাও সব লোকের সঙ্গে জাহাজে আরোহণ করে আরবে রওনা হন এবং সাম্রাজ্য পরিচালনার দায়িত্ব তার এক নায়েবের ওপর অর্পণ করে যান। মক্কা ও মদীনায় কিছু দিন অবস্থান করার পর তিনি এই উদ্দেশ্যে স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের ইচ্ছা প্রকাশ করেন যে, সেখানে গিয়ে তিনি ইচ্ছেমতো ইসলামের তবলীগ প্রচারে আত্মনিয়োগ করবেন এবং স্থানে স্থানে মসজিদ নির্মাণ করবেন।

কিন্তু পথেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং এ রোগেই তিনি ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুর পূর্বে শেষ অবস্থায় রাজা নিজের সঙ্গীদের ওসিয়ত করে যান যে, ‘মালাবারে দ্বীনে হকের প্রচারের জন্য তিনি যে দৃঢ় সংকল্প করেছিলেন তা যেন কোনো অবস্থাতেই মুলতবি হয়ে না যায়, তোমরা সেখানে ঘরে ঘরে গিয়ে লোকদের খোদার বাণী পৌঁছে দেবে।’ এ উদ্দেশ্যে রাজা এক খানা জোরালো পত্রও তার নায়েবের নামে লিখে শেখ শরীফের হাতে প্রদান করেন।

শেখ শরীফ ও তাঁর সঙ্গীরা চিঠিখানাসহ কারাঙ্গানূরে আসেন এবং রাজার নায়েবের নিকট হস্তান্তর করেন। নায়েব চিঠিখানা পাঠ করার পর কয়েকটি ভূমিখন্ড এবং দু-চারটি বাগান শেখ শরীফ ও তার সঙ্গীদের প্রদান করেন, যাতে তারা সেখানে বসবাস করতে পারেন এবং বাগানের আয় দ্বারা নিজেদের জীবিকা নির্বাহ করতে পারেন। রাজা তাদের সাম্রাজ্যের সর্বত্র ঘুরে ঘুরে তবলীগ করার এবং সকল স্থানে মসজিদ নির্মাণের অনুমতি প্রদান করেন।

মালেক ইবনে দীনার কারাঙ্গানূরে তার বসবাসের জন্য বাড়িঘর নির্মাণ করেন। সেখানে তিনি একটি মসজিদ নির্মাণ করেন এবং স্থায়ীভাবে অবস্থান করতে মনস্থ করেন। এছাড়াও তিনি সেখানে স্থানীয়ভাবে ইসলাম প্রচারে আত্মনিয়োগ করেন।

ইবনে দীনারের ভ্রাতুষ্পুত্র মালেক ইবনে হাবীব কিছুদিন পর কারাঙ্গানূরে ইসলাম প্রচার শুরু করেন। অতঃপর প্রতিটি স্থানে মসজিদ নির্মাণের জন্য কারাঙ্গানূর হতে যাত্রা করেন। তিনি প্রথমে ‘কুলিন’ শহরে পৌঁছেন, সেখানে তার পরিবারবর্গের বসবাসের ব্যবস্থা করেন এবং একটি মসজিদ কায়েম করেন। এর পর ‘হুবাই মুবাদি’ শহরে যান। সেখানে তিনি কিছু কিছু লোককে মুসলমান করেন এবং মসজিদ নির্মাণ করে, একটির পর একটি শহরের দিকে রওনা হন এবং সেখানে তবলীগ করেন, তাছাড়া লোকদের মুসলমান করার পর সেখানেও বহু মসজিদ কায়েম করতে থাকেন।

অতঃপর হুবাই মুবাদিতে প্রত্যাবর্তন করেন এবং সেখানে তিন মাস অবস্থানকালে তবলীগ অব্যাহত রাখেন। ফের সেখান থেকে রওনা হয়ে ‘জারাফাতান’, ‘দারাফাতান’, ফিন্দারিয়া’ এবং ‘শালিয়াতে’র শহরগুলোতে গমন করেন এবং ঐ সব শহরে তবলীগের পর বহু মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন। শালিয়াতে তিনি পাঁচ মাস অবস্থানকালে তবলীগ করেন।

অতঃপর মালেক ইবনে হাবীব কারাঙ্গানূরে অবস্থানকারী তার চাচা মালেক ইবনে দীনারের নিকট প্রত্যাবর্তন করেন, যাতে নতুন রাজার সাথে সাক্ষাৎ করে নির্মিত মসজিদগুলোর ওয়াক্ফ ইত্যাদির ব্যবস্থা করা যায়। রাজার ফরমান ইত্যাদি লাভ করে তিনি আবার এক দীর্ঘ সফরে বের হন এবং সমস্ত মসজিদের উপযুক্ত দেখভালের ব্যবস্থা করে কারাঙ্গানূরে ফিরে আসেন। এবার তার অন্তর খোদার রহমত এবং তার করুণা অনুগ্রহের জন্য শোকর আদায় করেন। কেননা সেখানে অতীতে ব্যাপকভাবে মূর্তিপূজা চালু ছিল।

অতঃপর মালেক ইবনে দীনার ও মালেক ইবনে হাবীব তাদের সংশ্লিষ্ট সঙ্গীদের নিয়ে কুলিন শহরে চলে আসেন। সেখানে মালেক ইবনে হাবীব স্থায়ীভাবে বসবাস আরম্ভ করেন। কিন্তু মালেক ইবনে দীনার তার স্বদেশ খোরাসানে চলে যান। পরবর্তীকালে ইবনে হাবীব তার ছেলেদের কুলিনে পুনর্বাসিত করেন এবং তিনি স্ত্রীসহ কারাঙ্গানূরে চলে আসেন এবং সেখানে স্বামী-স্ত্রী উভয় ইন্তেকাল করেন।

মালাবারের হিন্দু রাজার দরবারে খোরাসানের প্রচারক দলের ইসলাম প্রচারের ফলে রাজার মুসলমান হয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে গোটা মালাবার রাজ্যে ইসলামের আলো বিকশিত হওয়ার ঘটনা ইসলামী ইতিহাসের এক গৌরবময় অধ্যায়।র কোনো লোকের নিকট প্রকাশ করবেন না।’

যখন শেখ শরীফ এবং তার সঙ্গীগণ হারমাইন শরীফ জিয়ারত শেষে দ্বিতীয়বার কারাঙ্গানূরে প্রত্যাবর্তন করেন, তখন রাজাও সব লোকের সঙ্গে জাহাজে আরোহণ করে আরবে রওনা হন এবং সাম্রাজ্য পরিচালনার দায়িত্ব তার এক নায়েবের ওপর অর্পণ করে যান। মক্কা ও মদীনায় কিছু দিন অবস্থান করার পর তিনি এই উদ্দেশ্যে স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের ইচ্ছা প্রকাশ করেন যে, সেখানে গিয়ে তিনি ইচ্ছেমতো ইসলামের তবলীগ প্রচারে আত্মনিয়োগ করবেন এবং স্থানে স্থানে মসজিদ নির্মাণ করবেন।

কিন্তু পথেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং এ রোগেই তিনি ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুর পূর্বে শেষ অবস্থায় রাজা নিজের সঙ্গীদের ওসিয়ত করে যান যে, ‘মালাবারে দ্বীনে হকের প্রচারের জন্য তিনি যে দৃঢ় সংকল্প করেছিলেন তা যেন কোনো অবস্থাতেই মুলতবি হয়ে না যায়, তোমরা সেখানে ঘরে ঘরে গিয়ে লোকদের খোদার বাণী পৌঁছে দেবে।’ এ উদ্দেশ্যে রাজা এক খানা জোরালো পত্রও তার নায়েবের নামে লিখে শেখ শরীফের হাতে প্রদান করেন।

শেখ শরীফ ও তাঁর সঙ্গীরা চিঠিখানাসহ কারাঙ্গানূরে আসেন এবং রাজার নায়েবের নিকট হস্তান্তর করেন। নায়েব চিঠিখানা পাঠ করার পর কয়েকটি ভূমিখন্ড এবং দু-চারটি বাগান শেখ শরীফ ও তার সঙ্গীদের প্রদান করেন, যাতে তারা সেখানে বসবাস করতে পারেন এবং বাগানের আয় দ্বারা নিজেদের জীবিকা নির্বাহ করতে পারেন। রাজা তাদের সাম্রাজ্যের সর্বত্র ঘুরে ঘুরে তবলীগ করার এবং সকল স্থানে মসজিদ নির্মাণের অনুমতি প্রদান করেন।

মালেক ইবনে দীনার কারাঙ্গানূরে তার বসবাসের জন্য বাড়িঘর নির্মাণ করেন। সেখানে তিনি একটি মসজিদ নির্মাণ করেন এবং স্থায়ীভাবে অবস্থান করতে মনস্থ করেন। এছাড়াও তিনি সেখানে স্থানীয়ভাবে ইসলাম প্রচারে আত্মনিয়োগ করেন।

ইবনে দীনারের ভ্রাতুষ্পুত্র মালেক ইবনে হাবীব কিছুদিন পর কারাঙ্গানূরে ইসলাম প্রচার শুরু করেন। অতঃপর প্রতিটি স্থানে মসজিদ নির্মাণের জন্য কারাঙ্গানূর হতে যাত্রা করেন। তিনি প্রথমে ‘কুলিন’ শহরে পৌঁছেন, সেখানে তার পরিবারবর্গের বসবাসের ব্যবস্থা করেন এবং একটি মসজিদ কায়েম করেন। এর পর ‘হুবাই মুবাদি’ শহরে যান। সেখানে তিনি কিছু কিছু লোককে মুসলমান করেন এবং মসজিদ নির্মাণ করে, একটির পর একটি শহরের দিকে রওনা হন এবং সেখানে তবলীগ করেন, তাছাড়া লোকদের মুসলমান করার পর সেখানেও বহু মসজিদ কায়েম করতে থাকেন।

অতঃপর হুবাই মুবাদিতে প্রত্যাবর্তন করেন এবং সেখানে তিন মাস অবস্থানকালে তবলীগ অব্যাহত রাখেন। ফের সেখান থেকে রওনা হয়ে ‘জারাফাতান’, ‘দারাফাতান’, ফিন্দারিয়া’ এবং ‘শালিয়াতে’র শহরগুলোতে গমন করেন এবং ঐ সব শহরে তবলীগের পর বহু মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন। শালিয়াতে তিনি পাঁচ মাস অবস্থানকালে তবলীগ করেন।

অতঃপর মালেক ইবনে হাবীব কারাঙ্গানূরে অবস্থানকারী তার চাচা মালেক ইবনে দীনারের নিকট প্রত্যাবর্তন করেন, যাতে নতুন রাজার সাথে সাক্ষাৎ করে নির্মিত মসজিদগুলোর ওয়াক্ফ ইত্যাদির ব্যবস্থা করা যায়। রাজার ফরমান ইত্যাদি লাভ করে তিনি আবার এক দীর্ঘ সফরে বের হন এবং সমস্ত মসজিদের উপযুক্ত দেখভালের ব্যবস্থা করে কারাঙ্গানূরে ফিরে আসেন। এবার তার অন্তর খোদার রহমত এবং তার করুণা অনুগ্রহের জন্য শোকর আদায় করেন। কেননা সেখানে অতীতে ব্যাপকভাবে মূর্তিপূজা চালু ছিল।

অতঃপর মালেক ইবনে দীনার ও মালেক ইবনে হাবীব তাদের সংশ্লিষ্ট সঙ্গীদের নিয়ে কুলিন শহরে চলে আসেন। সেখানে মালেক ইবনে হাবীব স্থায়ীভাবে বসবাস আরম্ভ করেন। কিন্তু মালেক ইবনে দীনার তার স্বদেশ খোরাসানে চলে যান। পরবর্তীকালে ইবনে হাবীব তার ছেলেদের কুলিনে পুনর্বাসিত করেন এবং তিনি স্ত্রীসহ কারাঙ্গানূরে চলে আসেন এবং সেখানে স্বামী-স্ত্রী উভয় ইন্তেকাল করেন।

মালাবারের হিন্দু রাজার দরবারে খোরাসানের প্রচারক দলের ইসলাম প্রচারের ফলে রাজার মুসলমান হয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে গোটা মালাবার রাজ্যে ইসলামের আলো বিকশিত হওয়ার ঘটনা ইসলামী ইতিহাসের এক গৌরবময় অধ্যায়।

৫০০ বছরেও বাড়ি ভাড়া বাড়েনি

ফুগেরেইশাহরীয়া কবির : মানুষের মৌলিক চাহিদার একটি বাসস্থান। কিন্তু দৈনন্দিন জীবনে বাড়ি ভাড়া মহা বিড়ম্বনার এক নাম। বছর না ঘুরতেই বাড়িওয়ালা নানা অজুহাতে বাড়ি ভাড়া বাড়িয়ে দেন।

কিন্তু পৃথিবীতে এমনও স্থান রয়েছে যেখানে এক দুই বছর নয়, গত পাঁচ শ বছরে একবারের জন্যও বাড়ি ভাড়া বাড়েনি। অদ্ভুত এই শহরটির নাম ফুগেরেই। জার্মানির অগসবার্গে অবস্থিত ছবির মতো সাজানো এই গ্রাম প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৫১৪ সালে। জ্যাকব ফুগার নামের এক ধনী ব্যক্তি শহরটির প্রতিষ্ঠাতা। শহরটির গোড়াপত্তনের সময় স্থানীয় দরিদ্র মানুষের কথা মাথায় রেখে জ্যাকব ফুগার একটি হাউজিং কমপ্লেক্স প্রতিষ্ঠা করেন। তার নামের সাথে মিল রেখে হাউজিং কমপ্লেক্সটির নামকরণ করা হয়।
কমপ্লেক্সের প্রতিটি বাড়ির বার্ষিক ভাড়া নির্ধারণ করা হয় ওই সময়ের মুদ্রায় এক রিহিনিস গিল্ডার যা বর্তমানে এক মার্কিন ডলার বা চুরাশি টাকার সমান। কয়েক শ বছর পেরিয়ে গেলেও সেই ভাড়া এক পয়সাও বাড়েনি। তবে বাড়ি ভাড়ার পাশাপাশি বাসিন্দার কাছ থেকে সামান্য কিছু টাকা নেয়া হয় গির্জা ও রাস্তা মেরামতের জন্য।

৬৭টি বাড়ি এবং ১৬৭টি এপার্টমেন্ট মিলিয়ে ফুগেরেই গ্রামের বাসিন্দা বর্তমানে ১৪২ জন। অধিকাংশ বাসিন্দা কয়েক পুরুষ ধরে এখানে বাস করছেন। ছোটখাটো কিছু সমস্যা থাকলেও তারা এই হাউজিং কমপ্লেক্স ছেড়ে কোথাও যেতে চান না। কারণ এত সস্তায় এরকম ছবির মতো সাজানো বাড়ি মিলবেই বা কোথায়!

জ্যাকবের স্বপ্ন ছিল দরিদ্র মানুষ যেন তাদের সাধ্যের মধ্যে বাড়ি ভাড়া পায়। তবে এখানে বসবাসের জন্য তিনি কিছু শর্ত জুড়ে দিয়েছিলেন। বাসিন্দাকে অবশ্যই ক্যাথলিক এবং কমপক্ষে অগসবার্গের দুই বছরের বাসিন্দা হতে হবে। এছাড়া রাত দশটায় কারফিউ মেনে চলতে হবে ও স্থানীয় চার্চে তিনবার তাকে প্রার্থনার অঙ্গীকার করতে হবে। বাসিন্দাদের জন্য এখন পর্যন্ত এই শর্ত বহাল রয়েছে।

বিভাগ:বিচিত্র