মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয় ফিলিস্তিনের পক্ষে
জামালউদ্দিন বারী : এ সপ্তাহে প্রকাশিত মার্কিন লেখক-গবেষক ক্রিস হেজেস’র লেখা একটি নিবন্ধের শিরোনাম ছিল ‘রিভল্ট ইন দ্য ইউনিভার্সিটিজ’। গাজায় হামাস নির্মূলের নামে সাত মাস ধরে চলা গাজা যুদ্ধে ফিলিস্তিনি গণহত্যার বিরুদ্ধে বিশ্ববিবেক জেগে উঠেছে। বিশেষত, ইসরাইলের আত্মরক্ষার নামে জায়নবাদী ইসরাইলী বাহিনীর প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা শর্তহীন সমর্থন-সহযোগীতার কারণে যুদ্ধ একটি প্রলম্বিত হত্যাযজ্ঞে রূপ নেয়ার প্রেক্ষাপটে পশ্চিমা জনগণ এখন আর একটি গণহত্যার দায়ভার বহন করতে ইচ্ছুক নয়। এমনকি ইসরাইলের সাধারণ বাসিন্দারাও এখন কষাই নেতানিয়াহুর যুদ্ধাপরাধের দায় নিতে প্রস্তুত নয়। গত বছর ৭ অক্টোবর হামাসের আকস্মিক দুঃসাহসী অভিযানের পর থেকে জিম্মি উদ্ধার ও হামাস নির্মূলের নামে গাজায় নির্বিচার বোমা বর্ষণ ও গণহত্যার বিরুদ্ধে সাধারণ ইসরাইলী নাগরিকরা নেতানিয়াহুর পদত্যাগ ও যুদ্ধবিরতির দাবিতে রাস্তায় নামে। নেতানিয়াহুর হামাস নির্মূলের বাগাড়ম্বর ইতোমধ্যে ফাটা বেলুনের মতো চুপসে গেছে। সাত মাসে প্রায় ১৫ হাজার শিশুসহ ৩৫ হাজার ফিলিস্তিনিকে হত্যা এবং প্রায় ৭৫ হাজার মানুষকে পঙ্গুত্ব এবং ২০ লক্ষাধিক মানুষকে বাস্তুচ্যুত করেও তারা হামাসের হাতে আটক একজন ইসরাইলী বন্দীকেও মুক্ত করতে পারেনি। অবশেষে দেড়মাস আগে দেয়া হামাসের প্রস্তাব মেনে নিয়ে একটি নতুন বন্দি বিনিময় ও যুদ্ধ বিরতির আলোচনা চলছে বলে জানা যাচ্ছে। অন্যদিকে গাজা উপত্যকার সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা হিসেবে পরিচিত, ১০ লক্ষাধিক বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনির শেষ আশ্রয় রাফাহ এলাকায় বড় ধরনের সামরিক অভিযানের প্রস্তুতি নিচ্ছে ইসরাইলী সেনাবাহিনী। এখানে যে কোনো ধরনের সামরিক অভিযান-আগ্রাসন আরো বড় ধরনের হত্যাযজ্ঞ, গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ সৃষ্টি করতে পারে। পুরো উত্তর ও দক্ষিণ গাজাকে ধ্বংসপুরিতে পরিণত করেও যখন হামাস নির্মূল তো দূরের কথা, এতটুকু দুর্বলও করতে পারেনি, সেখানে রাফায় সামরিক অভিযান চালানোর মানে হচ্ছে, অহেতুক যুদ্ধকে প্রলম্বিত করা। গণবিক্ষোভ ও জনরোষে গদি হারানোর ভয়ে আক্রান্ত নেতানিয়াহু নিজের গদি টিকিয়ে রাখতে যুদ্ধ পরিস্থিতিকে প্রলম্বিত করতে চাচ্ছে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কেউ কেউ মন্তব্য করেছেন। শুধু গদি হারানোই নয়, নেতানিয়াহু এখন গ্রেফতার আতঙ্কে দিনাতিপাত করছেন। ইসরাইলী পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্টের আলোকে সম্প্রতি আইসিএইচ অনলাইনে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ইসরাইলের জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের সদস্যরা সম্প্রতি একটি গোপন বৈঠকে মিলিত হয়েছিল। তারা ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু, প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট এবং সেনা প্রধান হার্জি হালভির বিরুদ্ধে হেগের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। বিশেষত, ২০২২ সালে ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে রাশিয়ান প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনের বিরুদ্ধে যে ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল, গাজায় ইসরাইলের গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধের মাত্রা তার চেয়ে অনেকগুণ বেশি। গাজায় গণহত্যা এবং ইসরাইলের সামরিক-রাজনৈতিক ব্যর্থতা এখন এক চূড়ান্ত পরাজয় ও পতনের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। ডিপস্টেটের স্টাবলিশমেন্টের নিষেধাজ্ঞা, প্রতিবন্ধকতা ও নিপীড়ন উপেক্ষা করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে হাজার হাজার শিক্ষার্থীর প্যালেস্টাইন সলিডারিটি ক্যাম্পেইনে যোগ দেয়া এবং স্বাধীন ফিলিস্তিনের পক্ষে এবং ইসরাইলে বিনিয়োগ ও সহায়তার বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার মধ্যে এক নতুন ভূরাজনৈতিক মেরুকরণের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।
বিংশ শতকের দুইটি বিশ্বযুদ্ধে সাবেক বিশ্বব্যবস্থার মূল্যবোধসহ সবকিছু ভেঙ্গে পড়ার মধ্যদিয়ে নতুন পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থা গড়ে ওঠার সাথে সাথে মধ্যপ্রাচ্যে অস্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় ইসরাইল নামের একটি অবৈধ রাষ্ট্র গড়ে তোলা এবং ফ্রাঙ্কেনস্টাইন দানবের মত বেড়ে ওঠার খেসারত দিতে হচ্ছে গোটা বিশ্বকে। গাজা যুদ্ধে ইসরাইলী গণহত্যার দৃশ্য বিগত ৭৫ বছর ধরে চলা জায়নবাদী নিপীড়ন ও এথনিক ক্লিনজিংয়ের স্মৃতিকেই যেন আরো জীবন্ত করে তুলেছে। ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী চক্র একটি হেজিমনিক এজেন্ডা সামনে রেখে ইসরাইল নামক ফ্রাঙ্কেনস্টাইন দানবকে নিজেদের জ্বালানি ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তার স্বার্থে কাজে লাগিয়েছে। ভোগবাদী জীবনদর্শন এবং একচেটিয়া পুঁজিবাদী চিন্তাধারার রাজনৈতিক-অর্থনীতির আলোকে গোটা পশ্চিমা বিশ্ব মূলত জায়নবাদী লবির করতলগত হয়ে পড়েছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতি ও অর্থনীতির উপর কাদের প্রভাব বেশি? এমন প্রশ্নের জবাবে সকলেই একবাক্যে ইসরাইলপন্থী লবি ও থিঙ্কট্যাঙ্কগুলোর কথা বলবেন। সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশিত এক ভিডিও সাক্ষাতকারে অস্ট্রেলিয়ার এক সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যে অস্ট্রেলিয়ার রাজনীতিতে জায়নবাদী লবির প্রভাব ও নিয়ন্ত্রকের ভূমিকার কথা উঠে আসে। বিশ্বের একনম্বর সামরিক-অর্থনৈতিক পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতি, অর্থনীতি ও প্রশাসনের উপর ইসরাইলী লবির প্রভাব একটি প্রবাদতুল্য অভিধায় উপনীত হয়েছে। তারাই দীর্ঘ ৭০ বছর ধরে ইসরাইলকে একটি মারকুটে অজেয় শক্তির তকমা সাঁটিয়ে বসে আছে। পারমাণবিক মারণাস্ত্রের ব্যবহারের মাধ্যমে ব্যাপক জনগোষ্ঠিকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার সক্ষমতা প্রমাণের মধ্যদিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিজয় নিজের ভাণ্ডারে নেয়ার পর থেকে সামরিক শক্তিই যেন বিশ্বের কর্তৃত্ব-নেতৃত্বের মানদণ্ডে পরিণত হয়েছে। বিশাল মধ্যপ্রাচ্যের উপর ইসরাইলের অনৈতিক ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ আধিপত্য পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের প্রতিভূ রূপে আবির্ভূত হয়েছে। ফিলিস্তিনি জনগোষ্ঠিকে নির্মূল এবং ক্রমবর্ধমান ভূমি দখলের পৈশাচিক তৎপরতার বিরুদ্ধে হামাস-হেজবুল্লাহর অভাবনীয় অসম সাহসী প্রতিরোধের মুখে গত ২ দশকে ইসরাইলী বাহিনী বার বার লেজ গুটিয়ে পালিয়ে গেলেও তাদের আগ্রাসী ভূমিকা ক্রমেই বেশি অবমাননাকর, রক্তাক্ত ও প্রাণঘাতী হয়ে উঠেছিল। দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া ফিলিস্তিনিরা ৭ অক্টোবর ইসরাইলের দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে প্রথম বড় প্রত্যাঘাত করেছিল। ইসরাইলের সীমান্ত প্রাচীর, নিরাপত্তাব্যুহ এবং অত্যাধুনিক নজরদারি ব্যবস্থা ভেঙ্গে শত শত হামাস যোদ্ধা ইসরাইলের দক্ষিণাঞ্চলে ঢুকে দুই শতাধিক সামরিক-বেসামরিক ব্যক্তিকে আটক করে গাজায় নিয়ে যাওয়ার ঘটনা ইসরাইলের জন্য একটি অনিবার্য আতঙ্ক ও ট্রমা সৃষ্টি করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা শক্তিগুলোর সর্বাত্মক সমর্থন নিয়েও হামাসকে নির্মূল করতে না পারা, গাজা সিটিকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করা এবং নিজ বাহিনীর ধ্বংসাত্মক পরিণতি বরণের পর নেতানিয়াহু এবং ইসরাইলের শীর্ষ নেতারা বিশ্বসম্প্রদায়ের চোখে ভিলেন, গণহত্যাকারী ও যুদ্ধাপরাধী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। হেগের ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্টের বিচারের রায়ে তারা এখন গ্রেফতার আতঙ্কে ভুগতে শুরু করেছে। ইসরাইলের জায়নবাদী নেতাদের জন্য অতীতে আর কখনো এমন দুঃস্বপ্নের দুঃসময় আসেনি। তারা নিজ জনগণের উপর নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে, যাদের উপর ভর করে তারা দীর্ঘদিনে দানবীয় সামরিক পরাশক্তিতে পরিণত হয়েছিল সেই পুরনো পরীক্ষিত বন্ধুদের সাথে সম্পর্কের টানপোড়েন সৃষ্টি হয়েছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ফিলিস্তিনি সংহতির শক্তি বাঁধভাঙ্গা জোয়ারের মত অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠার বাস্তবতা জায়নবাদী ইসরাইলের অস্তিত্বকে সংকটের মুখে ঠেলে দিয়েছে। পঁচাত্তর বছর ধরে বাস্তুচ্যুত, নিপীড়িত ফিলিস্তিনীদের স্বাধীনতা ও সংহতির ডায়াসপোরা এখন সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে।
সাত মাসের যুদ্ধে লক্ষাধিক ফিলিস্তিনি হতাহত হয়েছেন। ধ্বংসস্তুপের কাছাকাছি স্থানগুলোতে যে সব নতুন নতুন গণকবর আবিষ্কৃত হচ্ছে, সেখানে একসাথে শত শত ফিলিস্তিনিকে নানাভাবে নির্যাতন করে হত্যার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। এমনকি জীবন্ত মানুষকে মাটি চাপা দেয়ার প্রামাণ্য অভিযোগও উঠে আসছে। ২০ লক্ষাধিক ফিলিস্তিনি বাস্তুচ্যুত হলেও তারা প্রাণভয়ে নিজের মাটি ত্যাগ করেনি। অন্যদিকে যুদ্ধের প্রথম দিন থেকেই লাখ লাখ ইহুদি ইসরাইল ত্যাগ করে বিভিন্ন দেশে প্রত্যাবর্তন করেছে। শুধু অক্টোবর মাস নাগাদ এ সংখ্যা ছিল ৫ লাখের বেশি। সাম্প্রতিক কয়েক মাসে লেবাননের হেজবুল্লাহ যোদ্ধাদের ধারাবাহিক আক্রমণে সীমান্তবর্তী কয়েকলাখ ইহুদি সেটেলার ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়েছে। এরা আর এসব বাসস্থানে ফিরে আসতে চায়না বলে জানা যাচ্ছে। ইসরাইলে এবং পশ্চিমা বিশ্বে বসবাসরত অর্থডক্স ইহুদিরা অবৈধভাবে গড়ে ওঠা জায়নবাদী ইসরাইলের অস্তিত্বকে মানতে নারাজ। তারা ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতা হরণ ও ভূমি দখল করে জায়নবাদী ইসরাইল প্রতিষ্ঠার বিরোধী। এদের মধ্যে অনেক বিশ্বখ্যাত সেলিব্রেটি রয়েছেন। নোবেল লোরিয়েটসহ এমন শতাধিক ব্যক্তিত্ব ২০০৮ সালে ইসরাইলের ৬০তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উৎযাপন বয়কটের ডাক দিয়েছিলেন। তারা স্বাধীন ফিলিস্তিন এবং আরব প্রতিবেশীদের সাথে ইসরাইলের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের কার্যকর উদ্যোগ ও পরিবেশ নিশ্চিত করা ছাড়া ইসরাইলের স্বাধীনতা মানতে রাজি নন। গাজায় যুদ্ধ শুরুর পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাজার হাজার ইহুদি ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা এবং গাজায় গণহত্যা বন্ধের দাবিতে ওয়াশিংটনে রাস্তায় নেমে এসেছিলেন। ক্যাপিটাল হিলে প্রতিবাদ সমাবেশ করে কয়েকশত ইহুদি গ্রেফতার বরণ করেছিলেন। একজন মার্কিন বিমান সেনা অ্যারন বুশনেল ওয়াশংটনে ইসরাইল দূতাবাসের ফটকের সামনে ফিলিস্তিনের মুক্তির দাবি উচ্চারণ করতে করতে নিজের গায়ে পেট্রোল ঢেলে আত্মাহুতি দিয়ে বিশ্বের দৃষ্টি আর্কষণ করেছিলেন। এভাবেই প্রতিবাদ-বিক্ষোভের আগুন পশ্চিমা বিশ্বে দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়েছে। গত সপ্তায় কলাম্বিয়ার আইভি ইউনিভার্সিটিতে ফিলিস্তিনের পক্ষে ব্যাপক ছাত্র বিক্ষোভ দমনে মার্কিন পুলিশ সাঁড়াশি অভিযান চালিয়ে শতাধিক বিক্ষোভকারীকে আটক করলে বিক্ষোভ আরো প্রবল আকার ধারণ করে। তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে তাবু গেঁড়ে আরো সংঘবদ্ধ বিক্ষোভের ডাক দিলে তা সারা দেশে শত শত কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ছড়িয়ে পড়ে। লেখক-কলামিস্ট ক্রিস হেজেস ফিলিস্তিনি সংহতির এই অভূতপূর্ব গণজোয়ারকে ফিলিস্তিনের পক্ষে ‘ইউনিভার্সিটি রিভ্যুলেশন’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। সাত দশক ধরে জায়নবাদী কর্পোরেট মিডিয়া এবং থিঙ্কট্যাঙ্কগুলো পশ্চিমা বিশ্বের মানুষের মধ্যে তথাকথিত এন্টি সেমিটিজম ও ইসরাইলের আত্মরক্ষার অধিকারের তকমা ঝুঁলিয়ে এক ধরনের মনোস্তাত্ত্বিক গ্যাঁড়াকলে বেধে রেখেছিল। হামাস যোদ্ধাদের প্রতিরোধ ও প্রত্যাঘাত, ফিলিস্তিনের নারী, শিশু ও সর্বস্তরের মানুষের অচিন্তনীয় আত্মত্যাগ বিশ্ববিবেকের উপর করাঘাত করেছে। শুধু মুসলমানরা নয়, বিশ্বের স্বাধীনতাকামী সব মানুষ এখন ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার পক্ষে এক মঞ্চে এসে দাঁড়িয়েছেন। কামান-বন্দুকের মুখে আরব মুসলমানদের কাছ থেকে জমি ও বসতবাড়ি ছিনিয়ে নিয়ে মুসলমানের রক্তের উপর একটি অবৈধ জায়নবাদী রাষ্ট্রের অস্তিত্ব মেনে নেয়া কঠিন হলেও বেশিরভাগ আরব মুসলমান দ্বিরাষ্ট্র কেন্দ্রীক সমাধানের ভিত্তিতে একটি স্বাধীন ফিলিস্তিনের পাশে ইসরাইলকে মেনে নিতে এখনো রাজি হওয়া মুসলমানদের ত্যাগ ও উদারতার সাক্ষ্য বহন করে। কিন্তু জায়নবাদীরা এখনো স্বাধীন ফিলিস্তিনের প্রকল্প গণহত্যার গণকবরে ধামাচাপা দিতেই সবকিছু করে যাচ্ছে। নিওকন ফ্যাসিবাদী মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিরাষ্ট্র কেন্দ্রীক সমাধানের মার্কিন মধ্যস্থতা ও প্রতিশ্রুতি অগ্রাহ্য করে জেরুজালেমের উপর ইহুদিদের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ তুলে দিতে সেখানে মার্কিন কনসুলেট ভবন স্থানান্তরের নির্দেশ বাস্তবায়ন করেছিলেন। এটি ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকে আরব-ইসরাইল সমস্যার দ্বিরাষ্ট্র কেন্দ্রিক সমাধানের কফিনে শেষ পেরেক। বৃটিশদের ফর্মুলায় ইসরাইল নামক রাষ্ট্রে ফিলিস্তিনিদের নিরাপত্তা ও আত্মনিয়ন্ত্রনাধিকার প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়নি। পঁচাত্তর বছর ধরেই ফিলিস্তিনিদের উপর নিপীড়ন, নির্যাতন, আগ্রাসন ও গণহত্যা চালিয়ে ফিলিস্তিনের ভূখণ্ডকে জনমানব শূন্য করতে চেয়েছে। পশ্চিমাদের শঠতা এবং আরব রাজাদের বিশ্বাসঘাতকতার কারণে বার বার সম্মিলিত আরব বাহিনী জায়নবাদী ইসরাইলের সাথে হেরে গেলেও জানবাজ হামাস-হেজবুল্লাহ, হুতি ও ইরানের আইআরজিসির সমন্বিত আক্রমণে এবার ইসরাইলের মরণ ঘন্টা বেজে উঠেছে। ইউরোপ থেকে উড়ে আসা ইহুদিরা ইসরাইল ত্যাগ করতে শুরু করেছে। প্রতিদিনই কমছে ইহুদির সংখ্যা। এরপরও যুদ্ধবাজ গণহত্যাকারী নেতানিয়াহু রাফায় নতুন অভিযান ও গণহত্যার প্লট তৈরী করেছে। ওরা ইসরাইলের ধ্বংসের ঝুঁকি নিতে রাজি থাকলেও একটি স্বাধীন ফিলিস্তিনের দাবি মানতে রাজি নয়। তবে ইতিহাস কখনো পরাজিতদের কথায় চলে না। ইসরাইল এবার পরাজিত শক্তিতে পরিণত হয়েছে। শান্তিপূর্ণ উপায়ে দ্বিরাষ্ট্র কেন্দ্রীক সমাধানের পথে না হাটলে একক ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রেই আবার ইহুদিদের বসবাস করতে হবে। অতীতে শত শত বছর ধরে ইহুদিরা মুসলমান শাসকদের অধীনে শান্তিপূর্ণভাবে পূর্ণ নিরাপত্তায় বসবাস করার নজির রয়েছে। আশি বছরের ইহুদি রাষ্ট্রে বাস্তুচ্যুত মুসলমানদের ন্যূনতম মানবিক অধিকার ও নিরাপত্তা নিয়ে বেঁচে থাকার সুযোগ হয়নি। এটাই ঐতিহাসিক পার্থক্য। গত দশকের মাঝামাঝিতে লেবাননের হেজবুল্লাহ নেতা হাসান নাসরাল্লাহ ইসরাইলের ইহুদিদের উদ্দেশে বলেছিলেন, ইসরাইল ধ্বংসপ্রাপ্ত হওয়ার আগেই আপনারা ইসরাইল ত্যাগ করুণ। জায়নবাদ আপনাদের এবং আমাদের কমন শত্রু। বাইবেলে ৮ দশকের মধ্যে ইহুদি রাষ্ট্রের অস্তিত্ব বিলীন হওয়ার ভবিষ্যদ্বানি করা হয়েছে। জায়নবাদিদের জন্য বর্তমান পরিস্থিতি আরো বেশি জটিল ও ভঙ্গুর। তারা ইসরাইল ত্যাগ করছে। করতেই থাকবে। পশ্চিমা বিশ্বে এবারের গণহত্যা ও জায়নবাদ বিরোধী লড়াইয়ে সামনের সারিতে অবস্থান করছে ধর্মপ্রাণ ইহুদিরা। মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ফিলিস্তিনের পক্ষে গণবিপ্লবে ইহুদি-খৃষ্টানরাও সামিল হয়েছে। জায়নবাদ-ফ্যাসিবাদ সকলের কমন শত্রু। ভারতীয় উপমহাদেশে হিন্দুত্ববাদ জায়নবাদেরই দোসর। জায়নবাদের সাথে যেমন ইহুদি ধর্মের কোনো মিল বা সমর্থন-সাজুয্য নেই। তেমনি পৌরাণিক সনাতন ধর্মের সাথে হিন্দুত্ববাদের কোনো মিল বা সমর্থন নেই। গত সপ্তাহে নিউ ইয়র্কে ফিলিস্তিনের পক্ষে সমাবেশে যোগ দিয়ে কানাডিয়ান লেখিকা-অ্যাক্টিভিস্ট নাওমি ক্লেইন ইহুদিদের জায়নবাদ ত্যাগের আহ্বান জানিয়েছেন। ১০ মিনিটের বক্তব্যে নাওমি ক্লেইন জুদাইজমের প্রতিটি মূল্যবোধের সাথে জায়নবাদের বৈপরীত্য তুলে ধরেন। ইহুদিবাদের নামে জায়নবাদের মিথ্যা প্রতিমার পূজা বন্ধ করে ফিলিস্তিনের সাথে অভিন্ন মূল্যবোধ ধারণ করে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকে বরণ করে নেয়ার আহ্বান জানান। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা রাষ্ট্রীয় শক্তির রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে জায়নবাদ বিরোধী বিডিএস আন্দোলনে যুক্ত হয়েছে। ভারত ও ইসরাইল বয়কটের প্রায় একই রকম আন্দোলনের ঢেউ ছড়িয়ে পড়ছে সারাবিশ্বে। গাজার শিশুদের রক্তবীজে এক নতুন বিশ্বের জন্ম হতে চলেছে। ১ মে ২০২৪
ওয়াশিংটন ও বাংলাদেশে নতুন অধ্যায় ?
গত গ্রীষ্মে ওয়াশিংটন ডিসিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির জন্য লাল গালিচা বিছানোর আগে মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের (এনএসসি) কৌশলগত সমন্বয়কারী এডমিরাল জন কিরবি বলেছিলেন, বাংলাদেশের বিষয়ে আমরা ভারত সরকারকে তার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের কথা বলতে দিয়েছি। কিন্তু একই সঙ্গে বাংলাদেশে একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন দেখতে আমাদের আকাঙ্খাও আমরা স্পষ্ট করেছি।
প্রেক্ষাপট না জানা থাকলে, এই বিবৃতিটিকে কিছুটা ট্র্যাকের বাইরের মনে হতে পারে। তবে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের পক্ষে সমর্থন প্রকাশ করে আসছে। প্রকৃতপক্ষে, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিতে গণতন্ত্রকে অগ্রাধিকার দিতে বাইডেন প্রশাসনের প্রচেষ্টার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছিল বাংলাদেশ।
‘ডামি নির্বাচন’ : ২০২৪ সালের ৭ই জানুয়ারি ঢাকায় যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় তা ব্যাপকভাবে ‘ডামি নির্বাচন’- নামে পরিচিত। এই নির্বাচনে শেখ হাসিনার দল আওয়ামী লীগকে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখোমুখি হতে হয়নি। এই নির্বাচন একদলীয় স্বৈরাচারী রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের ভাগ্যে সিলমোহর লাগিয়ে দেয়। নির্বাচনের এক মাস পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্দেশ্যে পাঠানো মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের একটি চিঠি পান তার শীর্ষ সরকারি কর্মকর্তা মাসুদ বিন মোমেন। ওই চিঠিতে ‘বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করার আগ্রহ’ প্রকাশ করা হয়। সিল করা ওই চিঠি দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র কি বাংলাদেশে ‘গণতন্ত্র প্রচারে’ তার নীতি থেকে ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গেছে? এর সবচেয়ে যুক্তিসঙ্গত উত্তর হলো- হ্যাঁ।
জালিয়াতিপূর্ণ নির্বাচনের পর যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকে কোনো বাস্তব পদক্ষেপের অভাব কাউকে কাউকে ভাবতে বাধ্য করছে যে, বাংলাদেশে গণতন্ত্র-প্রবর্তনের এজেন্ডা থেকে যুক্তরাষ্ট্র পিছু হটেছে। এরপর শেখ হাসিনার কাছে হোয়াইট হাউসের এই চিঠি সেই ধারণার পক্ষে বড় প্রমাণ দেয়।
মার্কিন পদক্ষেপ : নির্বাচনের আগ পর্যন্ত গত আড়াই বছর ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বেশ কয়েকটি বিবৃতি এবং উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল, যেখানে বাংলাদেশে একটি অবাধ ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দেয়া হয়েছিল। এখানে উল্লেখ্য যে, র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) এর বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিয়েই সক্রিয় পদক্ষেপ শুরু করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। র্যাব বাংলাদেশের আধাসামরিক বাহিনী, যার বিরুদ্ধে জোরপূর্বক গুম, নির্যাতন এবং হত্যা সহ ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ রয়েছে। বাংলাদেশে নির্বাচনের অনেক আগেই মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন ‘গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে ক্ষুণœ করার’ জন্য দায়ী বাংলাদেশি নাগরিকদের ওপর মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞা নীতির ঘোষণা দিয়েছিলেন। মার্কিন ভিসা নীতি স্পষ্ট করতে দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক ব্যুরোর সহকারী সেক্রেটারি ডনাল্ড লু বাংলাদেশে একটি টিভি টকশোতে হাজির হন। অন্যদিকে, স্টেট ডিপার্টমেন্ট ও এনএসসি’র মুখপাত্র বাংলাদেশে একটি বিশ্বাসযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজন করার বিষয়ে মার্কিন অবস্থানকে বারবার নিশ্চিত করেন।
এরই মধ্যে শেখ হাসিনার মন্ত্রীরা ইঙ্গিত দেন যে, গণতান্ত্রিক নির্বাচনের জন্য মার্কিন চাপ থেকে সরে যেতে তাদের সাহায্য করতে পারে ভারত। যদিও ধারণা করা হয়েছিল, ভারতের উঠোনে, বিশেষ করে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে জড়িত না হতে ওয়াশিংটনকে রাজি করাবে দিল্লি। দিল্লিতে টু প্লাস টু সংলাপের ঠিক পরেই ঢাকা ডনাল্ড লু’র কাছ থেকে একটি চিঠি পায়। ওই চিঠিতে রাজনৈতিক দলগুলোকে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য সংলাপের ব্যবস্থা করার আহ্বান জানানো হয়। এই চিঠিটি একটি যৌক্তিক ধারণা সৃষ্টি করে যে, বাংলাদেশে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের প্রক্রিয়া শুরু করার বল আসলে শেখ হাসিনার কোর্টে ছিল।
প্রথমে ভিসা বিধি নিষেধের ঘোষণা এবং এর পর ওই চিঠি আরো ইঙ্গিত দেয় যে, ঢাকা যদি অবাধ নির্বাচন আয়োজন করতে অস্বীকার করে তবে তারা মার্কিন অসন্তোষের মুখোমুখি পড়তে পারে। এত কিছুর পরো ‘ডামি নির্বাচন’ হয়েছে এবং প্রধানমন্ত্রী হয়ে শেখ হাসিনা প্রেসিডেন্ট বাইডেনের কাছ থেকে ‘একসঙ্গে কাজ করার আগ্রহের’ বিষয়ে চিঠি পেয়েছেন। ‘গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়া ক্ষুণœ করার’ জন্য হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে দৃশ্যত কোনো পদক্ষেপ নেয়নি যুক্তরাষ্ট্র। এ নির্বাচনে অবশ্যই জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটেনি। বৈদেশিক নীতি বিশেষজ্ঞ শ্রীরাধা দত্ত পর্যবেক্ষণ করেছেন যে, মোটামুটি দশ শতাংশ লোক নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল।
গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটি অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য যথেষ্ট গুঞ্জন তৈরি করার পরেও নির্বাচন শেষে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। ফলে এ নিয়ে সাধারণ পাঠক এবং অভিজ্ঞ রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মধ্যে একটি প্রশ্নের উদ্রেক করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কি ভারতের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ‘গণতন্ত্রের প্রচার’- নীতি পরিবর্তন করেছে? কারণ শেখ হাসিনা দিল্লির প্রিয়পাত্র। এই ধরনের একটি প্রশ্নের ক্ষেত্রে পরিষ্কার দৃষ্টিভঙ্গি পেতে পাঠকদের আরও কয়েক মাস অপেক্ষা করতে হতে পারে। ওয়াশিংটনের নীতি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যের ঘটনা প্রবাহের সঙ্গে ধাক্কা খেয়েছে। দ্বিতীয়ত, হাসিনা সরকারকে গণতন্ত্র এবং এই অঞ্চলে মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থকে ক্ষুণœ করার জন্য শাস্তি দিতে যুক্তরাষ্ট্র যদি কিছু করতেও চায়, তাহলে তাদেরকে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে পরিস্থিতি পুনর্মূল্যায়ন করতে হবে।
এদিকে, যুক্তরাষ্ট্র ও তার সব প্রধান মিত্র শেখ হাসিনার প্রশ্নবিদ্ধ রাজ্যাভিষেকের পর তাকে অভিনন্দন জানানো থেকে বিরত থেকেছে। স্টেট ডিপার্টমেন্ট ও হোয়াইট হাউস থেকে একই বার্তা অনুরণিত হয়েছে, যেখানে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া পুনরুদ্ধারের আহ্বান ছিল। ৫ই ফেব্রুয়ারি মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের প্রধান উপ-মুখপাত্র বেদান্ত প্যাটেল ‘থ্রি সি’ ভিসা বিধিনিষেধ সম্পর্কে এক প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, শুধুমাত্র নির্বাচন শেষ হয়েছে বলে এই নীতিগুলো শেষ হয়ে যায়নি।
ভারত, চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ঢাকায় কে জিতলো তা নিয়ে নতুন করে মূল্যায়ন প্রয়োজন। বাংলাদেশে আপাত মার্কিন নিষ্কিয়তাকে ‘লো এনার্জি এক্সটেনশন পিরিয়ড’- হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে। কারণ মধ্যপ্রাচ্য ও সেইসঙ্গে আগামী নভেম্বরের মার্কিন নির্বাচনের জন্য আসল শক্তিগুলো সঞ্চিত রাখা হয়েছে।
ভারতের সমস্যা
ওয়াশিংটন দক্ষিণ এশিয়ার প্রতি নীতিগতভাবে সময় দিতে না পারলেও, কৌশলগত অগ্রাধিকারের কারণে নজর সরিয়েও রাখতে পারবে না। ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চল রাখাইনের গুরুত্বপূর্ণ বন্দর কিয়াউকফিউ চালু হলে চীন ব্যাপক প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা পাবে। চীনের এই বন্দরে ৭০ শতাংশ শেয়ার রয়েছে, আক্ষরিক অর্থে রিয়েল এস্টেটের মালিকানা রয়েছে। এর থেকে খুব বেশি দূরে নয় চীনের পরিচালিত বিএনএস শেখ হাসিনা (একটি নতুন নৌ ঘাঁটি, যা বাংলাদেশ নৌবাহিনীর জন্য তৈরি করা হয়েছে) ‘সাবমেরিন ও যুদ্ধজাহাজের জন্য নিরাপদ জেটি সুবিধা’ প্রদান করছে।
এগুলো চীন, ভারত এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য কৌশলগতভাবে গুরুতপূর্ণ, কিন্তু ঢাকার জন্য নয়। বাংলাদেশে গণতন্ত্রের অভাব দক্ষিণ এশিয়ায় ওয়াশিংটনের সবচেয়ে বিশ্বস্ত অংশীদারের জন্য একটি অপ্রত্যাশিত অস্বস্তি নিয়ে এসেছে। বিরোধী দল পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে চিন্তাভাবনা করছে, দলটির কয়েক হাজার নেতা-কর্মী কারাগারে বন্দি। মালদ্বীপের ‘ইন্ডিয়া আউট’ প্রচারণার মতো বাংলাদেশেও সোশ্যাল মিডিয়ায় ভারতকে বয়কট করার আহ্বান জানাচ্ছে কিছু মানুষ। বয়কটের প্রভাব মূল্যায়ন করা এখনই সম্ভব না হলেও এটি এমন একটি স্তরে পৌঁছেছে যে, ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এস জয়শঙ্কর প্রশ্নের মুখোমুখি হতে পারেন যে- ভারতের প্রতিবেশী নীতিগুলো ব্যর্থ হচ্ছে কিনা। দিল্লি শেখ হাসিনার বিজয় নিশ্চিত করার জন্য ২০১৪ সালের মতো এবার তার পররাষ্ট্র সচিবকে ঢাকায় পাঠায়নি। তবুও ভারতীয় প্রভাব স্পষ্ট ছিল। বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে ভারতের প্রতি সাধারণ অনুভূতি অনুকূল নয়। বাংলাদেশে গণতন্ত্রের তাৎপর্যপূর্ণ পশ্চাদপসরণ যাই হোক না কেন, সেই পতনের সহায়ক হিসেবে অনেকেই ভারতকে দায়ী করছেন। ঢাকায় এভাবে যুক্তরাষ্ট্র বা চীনের কর্মকা- বা নিষ্ক্রিয়তার পরিণতি দিল্লিকে ভোগ করতে হবে। (লেখক মুশফিকুল ফজল আনসারী জাস্ট নিউজ বিডি এবং সাউথ এশিয়া পার্সপেক্টিভসের স্টেট ডিপার্টমেন্ট এবং হোয়াইট হাউস করেসপন্ডেন্ট হিসেবে কাজ করছেন)।
অনলাইন দ্যা ওয়ারের প্রতিবেদন, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪
বিবর্ণ রাজনীতি ও আত্মপ্রবঞ্চনা
ইবনে নূরুল হুদা : নেতিবাচক ও ক্ষমতাকেন্দ্রিকতার কারণেই আমাদের দেশের রাজনীতি বিবর্ণ হতে হতে রূপ, রস ও গন্ধহীন হয়ে পড়েছে বলে বোদ্ধামহলে অভিযোগ রয়েছে। তা এতোই প্রান্তিক পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, আমরা ক্রমেই আত্মপ্রবঞ্চিত জাতি হিসেবে পরিচিতি লাভ করতে যাচ্ছি। যা জাতি হিসেবে আমাদের গন্তব্যকেই অনিশ্চিত করে তুলেছে। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্টরা বরাবরই উদাসীন থাকছেন।
বস্তুত, গণমানুষের কল্যাণের ধারণা থেকে রাজনীতির পথচলা শুরু হয়েছে। আর রাজনীতি একটি সেবামূলক কাজ। আর্ত-মানবতার মুক্তি ও মানব সভ্যতাকে বিকশিত করার মহান উদ্দেশ্য নিয়েই রাজনীতির অভিযাত্রা। এর ইতিহাসও খুবই প্রাচীন। কিন্তু কালের বিবর্তনে ব্যক্তি ও শ্রেণিবিশেষের স্বার্থান্ধতা ও অবৈধ উচ্চাভিলাষের কারণে বৈশি^ক রাজনীতির কল্যাণকামী ও গণমুখী চরিত্রের বড় ধরনের অবনতি ঘটেছে। রাজনীতিকে পরিণত করা হয়েছে বাণিজ্যিক পণ্যে। যা এখন ক্ষেত্রবিশেষের আত্মপূজা চরিতার্থ করার অন্যতম অনুসঙ্গ। আর এই অধোগতির ধারা চলমানই আছে এবং আগামী দিনেও থাকবে বলেই মনে করা হচ্ছে। বিশেষ করে আমাদের দেশের ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বিষয়টি আরো জটিল ও ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করেছে। ফলে কক্ষচ্যুতি ঘটেছে কল্যাণমুখী রাজনীতির। রাজনীতি হয়ে ওঠেছে শ্রেণি ও গোষ্ঠীবিশেষের আত্মস্বার্থ ও উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ করার অন্যতম মাধ্যম। যে লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রচার ও রাজনীতির উদ্ভব হয়েছিল তা এখন রীতিমত ব্যর্থতার ষোলকলা পূর্ণ করেছে। ফলে প্রচলিত রাজনীতি মানুষের অধিকার রক্ষায় তেমন কোন ভূমিকা রাখতে পারছে না বরং এর বিপরীত চিত্রই এখন দৃশ্যপটে এসেছে।
আসলে ক্ষমতাকেন্দ্রিক, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যহীন রাজনীতি আমাদের দেশ ও জাতিসত্তাকেই মারাত্মক হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছে। আমাদের চলমান রাজনীতি হয়ে উঠেছে বাগাড়ম্বর ও গলাবাজি-নির্ভর। যিনি যত বাকপটু, মিথ্যুক ও প্রতারক তিনিই ততবড় রাজনীতিক ও ক্ষমতাধর হিসেবে পরিচিতি পাচ্ছেন। সবকিছুই আবর্তিত হচ্ছে কথামালার ফুলঝুড়ির মধ্যেই। বস্তুত, আমাদের দেশের রাজনীতি আটকা পড়েছে এক সংকীর্ণ বৃত্তে। সঙ্গত কারণেই আমরা রাজনীতিকে ইতিবাচক ও সততার মানদ-ে উত্তীর্ণ করতে পারিনি। রাজনীতি হয়ে উঠেছে শ্রেণিবিশেষের ক্ষমতা রক্ষা, আর ক্ষমতাহীনদের ক্ষমতা দখলের অশুভ প্রতিযোগিতার কদর্য অনুসঙ্গ। ফলে সাধারণ মানুষ রাজনীতি ও রাষ্ট্রের কল্যাণ থেকে রীতিমত বঞ্চিত হচ্ছেন। সঙ্গত কারণেই সাধারণ মানুষ রাজনীতির ওপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠছেন।
নাগরিকরা রাষ্ট্রের প্রতি অকুন্ঠ আনুগত্য প্রকাশ করলেও রাষ্ট্র তাদের অধিকারের নিশ্চয়তা প্রদান করতে পারছে না বরং ক্ষেত্রবিশেষে রাষ্ট্র কর্তৃক নাগরিকদের অধিকার ক্ষুণেœর অভিযোগটি ক্রমেই জোরালো ভিত্তি পাচ্ছে। মানুষ আইনী প্রতিকার ও সুবিচার পাচ্ছে না এ অভিযোগে কোন অভিনবত্ব নেই। কেড়ে নেয়া হয়েছে মানুষের স্বাধীনভাবে কথা বলা ও ভোটের অধিকার। রাষ্ট্র পরিচালনায় তাদের কোন অংশগ্রহণ বা ভূমিকা থাকছে না। ফলে রাজনীতি গণমানুষের জন্য ভালো বা ইতিবাচক কিছু করতে পারছে না। প্রখ্যাত মনীষী হেনরি ফোর্ডের ভাষায়, ‘রাজনীতিকে সৎ রাখতে পারে একটি মাত্র উদ্দেশ্য। আর তা হলো দেশ ও জনগণের জন্য ভালো কিছু করার উদ্দেশ্য’। কিন্তু এক্ষেত্রে আমাদের ব্যর্থতা একেবারে অমার্জনীয় বললে অত্যুক্তি হবার কথা নয়। ফলে ক্রমেই ভঙ্গুর ও দুর্বল হয়ে পড়ছে আমাদের জাতিসত্ত্বার ভিত্তিমূল।
একথা অস্বীকার করার সুযোগ নেই যে, রাজনীতিতে কৌশল থাকবে। প্রতিপক্ষকে মোকাবেলা করার পরিকল্পনা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। কিন্তু সবকিছুই আবর্তিত হতে হবে গণমানুষের অধিকার ও স্বার্থকে কেন্দ্র করে। এর বিচ্যুতি ঘটলেই সেই রাজনীতি আর রাজনীতি থাকে না বরং অপরাজনীতিতে রূপ নেয়। বস্তুত, অপরাজনীতি হলো সকল রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার প্রতি উদাসীনতা বা বিদ্বেষ। একজন ব্যক্তিকে অরাজনৈতিক হিসেবে বর্ণনা করা যেতে পারে যদি তিনি রাজনীতিতে আগ্রহী বা জড়িত না থাকেন। অরাজনৈতিক হওয়া এমন পরিস্থিতিকেও বোঝাতে পারে যেখানে মানুষ রাজনৈতিক বিষয়ে নিরপেক্ষ অবস্থান নেয়। কলিন্স ইংলিশ ডিকশনারির ভাষ্যমতে, অরাজনৈতিককে ‘রাজনৈতিকভাবে নিরপেক্ষ; রাজনৈতিক মনোভাব, বিষয়বস্তু বা পক্ষপাত ছাড়া’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করে। কিন্তু অপরাজনীতি হলো তার ভিন্নতর ও কদর্য রূপ। কারণ, অপরাজনীতি রাজনীতির নামে অরাজনৈতিক কর্মকা-ের সমষ্টিবিশেষ।
রাজনীতি পরিচালিত হবে মানুষের কল্যাণে কিন্তু অপরাজনীতিতে এসবের কোন সংশ্লিষ্টতা থাকবে না বরং থাকবে আত্মস্বার্থ, গোষ্ঠীস্বার্থ ও কদর্যতা। যেখানে আত্মস্বার্থের প্রাধান্য থাকবে। তাই রাজনীতি মানুষের জন্য কল্যাণকর হলেও অপরাজনীতি তার পুরোপুরি বিপরীত। আর আমরা এমনই এক দুর্ভাগা যে, আমরা রীতিমত আটকা পড়েছি অপরাজনীতির বৃত্তেই। একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বিশ^ যখন এগিয়ে চলছে, তখন আমাদের অপরাজনীতির কালো থাবা আমাদের দেশ ও জাতিসত্ত্বাকে অক্টোপাসের মতো চেপে ধরেছে। যা থেকে আমরা পরিত্রাণ লাভ করতে পারছি না। যারা আমাদের ভাগ্য নিয়ন্ত্রা হিসেবে দাবি করে রাজনীতি করছেন তাদের একটি শ্রেণি নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনে সব সময় তৎপর থাকছেন। আর তারা এতো প্রভাবশালী ও পরাক্রমী যে পুরো দেশ ও জাতি তাদের কাছে রীতিমত অসহায়।
একথা অস্বীকার করা যাবে না যে, একশ্রেণির অপরাজনীতিকের কারণেই আমাদের দেশের রাজনীতি আর স্বরূপে নেই বরং অনেকটাই বিবর্ণ হয়ে পড়েছে। সংবিধান অনুযায়ি আমাদের দেশ গণপ্রজাতান্ত্রিক হলেও রাষ্ট্রাচারের প্রায় ক্ষেত্রেই জনগণের মতামতের কোন প্রতিফলন নেই বললেই চলে। দেশে গণতন্ত্রের নামে জুলুমতন্ত্র ও স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। দেশে পাঁচ বছর পরপর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও তা এখন পরিণত হয়েছে রীতিমত প্রহসন ও খেলতামাশায়। নানা অজুহাত ও ছলছুতায় ২০০৬ সালে একটি সাংবিধানিক কেয়ারটেকার সরকারকে উৎখাত করে গণতন্ত্র রক্ষার নামে একটি সেনা সমর্থিত জরুরি সরকার প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছিল। আজ যারা সংবিধানের দোহায় দিয়ে নির্বাচনকে চরদখলের মহড়া বানিয়েছেন তারা এই অসাংবিধানিক সরকারকে নিজেদের আন্দোলনের সফল বলে দাবি করে তৃপ্তির ঢেকুর তুলেছিলেন।
সে সরকার অবৈধভাবে দুই বছর ক্ষমতায় থেকে একটি সমঝোতার নির্বাচনের মাধ্যমে বর্তমান ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতায় এনেছিল। ২০০৮ সালের নির্বাচন যে জরুরি সরকারের সাথে আওয়ামী লীগের সমঝোতার নির্বাচন ছিল তা কোন বিরোধী পক্ষের অভিযোগ নয় বরং খোদ আওয়ামী লীগের তদানীন্তন সাধারণ সম্পাদক আব্দুল জলিলের এ বিষয়ে আত্মস্বীকৃতি রয়েছে। তাই এটিকে কথার কথা বা বিরোধী দলের অপপ্রচার বলে দাবি করার কোন সুযোগ নেই। মূলত, আমাদের দেশের রাজনীতি বিবর্ণ হওয়ার সূচনা হয়েছিল ১/১১-এর ঘটনাপ্রবাহ ও ২০০৮ সালের সমঝোতার নির্বাচনের মাধ্যমে। আর তা এখন বিশালকায় দৈত্যে পরিণত হয়েছে। দেশ ও জাতি এই অশুভ বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না বরং দিন যতই যাচ্ছে ভোট জালিয়াতির কুশীলবরা নতুন নতুন আবিষ্কার ও উদ্ভাবনের মাধ্যমে আত্মপ্রতারণাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়ে যাচ্ছে। ফলে লঙ্ঘিত হচ্ছে সাধারণ মানুষের মৌলিক ও নাগরিক অধিকার।
এরপর আসে ২০১৪ সালের নির্বাচন। প্রধান বিরোধীদল সহ স্বীকৃত কোন বিরোধীদল এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করলেও এই নির্বাচন নিয়ে নানা বির্তকের জন্ম দেয়া হয়েছে। প্রয়াত সাবেক প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি এই নির্বাচন থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নিলেও গণতন্ত্রের তথাকথিত প্রতিভূরা তাদেরকে সে অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে। এরশাদ সাহেব নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিলেও অলৌকিকভাবে তাদের প্রার্থিতা বহাল থেকেছে এবং বায়বীয় ভোটে কিছু প্রার্থী নির্বাচিতও হয়েছিলেন। মূলত, ২০১৪ সালের নির্বাচন ছিল একদলীয় ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন। কিন্তু তারপরও বিশ^বাসী ক্ষমতাসীনদের ভোট জালিয়াতির মহড়া প্রদর্শন করেছে যা বৈশি^ক গণতন্ত্রের ইতিহাসে এক আত্মপ্রতারণা ও লজ্জাজনক অধ্যায়।
২০১৮ সালের নির্বাচন তো ‘লাইলাতুল ইলেকশন’ বা নৈশ্যভোটের নির্বাচন হিসেবে আখ্যা পেয়েছে। নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হবে বলে সরকারের শীর্ষ মহল থেকে প্রতিশ্রুতি পাওয়ার পর বিরোধী দলগুলো এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলেও সরকার তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মহলে অভিযোগ রয়েছে কথিত এই নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের অনুকূলে রাতের বেলা সিল মেরে বাক্স ভর্তি করা হয়েছে। আর এই গুতরত অভিযোগের সত্যতা মিলেছে সরকারের শরীক দলের অনেক নেতার মুখ থেকে। বিশেষ করে ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা রাশেদ খান মেনন রীতিমত হাটে হাড়ি ভেঙে দিয়েছেন। একজন নির্বাচন কমিশনার তো এই নির্বাচনকে গণতন্ত্রের অপমৃত্যু বলে মন্তব্য করেছেন।
সম্প্রতি হয়ে গেল দ্বাদশ জাতীয় সংসদের নির্বাচন। ৭ জানুয়ারির এই নির্বাচন ছিল নানাভাবেই বিতর্কিত। আমরা এই নির্বাচন নিয়ে বিরোধীদল, সুশীল সমাজ বা আন্তর্জাতিক মহলের প্রতিক্রিয়াকে বিবেচনায় নিচ্ছি না বরং দ্বাদশ সংসদের বিরোধীদলীয় নেতার বক্তব্য আলোচনা করে আজকের লেখার সমাপ্তি টানবো। কারণ, এসব কথাকে সরকার জামায়াত-বিএনপি প্রভাবিত বলে উড়িয়ে দিতে পারেন। তাই আমরা সেদিকে যাচ্ছি না বরং যারা ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ নিয়ে জাতীয় সংসদে নিজেদেরকে বিরোধী দল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন তাদের বক্তব্য পর্যালোচনা করা হবে।
জাতীয় পার্টি বর্তমান জাতীয় সংসদে বিরোধী দল হলেও বহুল বিতর্কিত নির্বাচন নিয়ে তাদেরও অভিযোগের অন্ত নেই। বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা জিএম কাদেরের বক্তব্য থেকে। তিনি জাতীয় সংসদে দাবি করেছেন, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে তিন ধরনের নির্বাচন হয়েছে। কোথাও কোথাও ইলেকশন যেভাবেই হোক ফলাফল একটা পূর্ব নির্ধারিত ছিল এবং শিট বানিয়ে দেয়া হয়েছে। অবশ্য সরকারি দলের সদস্যরা গতানুগতিরকভাবে এই বক্তব্যের প্রতিবাদ করেছেন। এই প্রতিবাদের প্রত্যুত্তরে বিরোধীদলীয় নেতা হেসে দিয়ে বলেছেন, ‘এটা নাও হতে পারে’। এমন খবরই গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।
জানা গেছে, রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর আনা ধন্যবাদ প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা এবং দ্বাদশ জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনের সমাপনী ভাষণে জিএম কাদের বিগত নির্বাচন নিয়ে বক্তব্য শুরু করতেই অধিবেশন কক্ষে হট্টগোল শুরু হয়। সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে নির্বাচন সংক্রান্ত বক্তব্যে এই হট্টগোল বাড়তে থাকে। সরকারি দলের সদস্যরা মাইক ছাড়াই নানা মন্তব্য করতে থাকেন। বিরোধী দল জাতীয় পার্টির সদস্যরাও পাল্টা মন্তব্য করতে থাকেন। এই পরিস্থিতিতে সংসদ অধিবেশনে অচলাবস্থা সৃষ্টি হলে স্পিকার সংসদ সদস্যদের শান্ত হওয়ার জন্য একাধিকবার আহ্বান জানান। পরে জিএম কাদের বক্তব্য শেষ করেন। এ সময় তিনি বলেন, ‘আমার কাছে মনে হয়েছে তিন ধরনের ইলেকশন হয়েছে। কোনো কোনো এলাকায় সবগুলো সুষ্ঠু ইলেকশন হয়েছে। সেখানে কোনো ডিস্টার্বেন্স হয়নি। সাধারণত প্রতিযোগিতাহীন ইলেকশন হয়েছে। সেখানে কোনো শক্ত প্রার্থী ছিল না। সেখানে সরকারের সদিচ্ছা ছিল। শতভাগ সুষ্ঠু হয়েছে। তবে উপস্থিতি কম ছিল। আরেকটা হয়েছে ফ্রি স্টাইল। সেখানে মাসল পাওয়ার (পেশি শক্তি) এবং মানি অবাধে ব্যবহার করা হয়েছে। সেটার মাধ্যমে ভোটকেন্দ্র দখল করা হয়েছে। বেশিরভাগ সময় এখানে সরকারি দল এবং বিদ্রোহী স্বতন্ত্র প্রার্থী বা আমাদের প্রার্থীদের বাধা দিয়েছে। আরেকটা ছিল ইলেকশন যেভাবেই হোক ফলাফল একটা পূর্ব নির্ধারিত ছিল এবং শিট বানিয়ে দেয়া হয়েছে’।
বিরোধী দলীয় নেতা বলেন, ‘সব দল নির্বাচনে আসলে এবং বাধা ছাড়াই ভোট হলে ১৫ শতাংশ ভোটও গ্রহণযোগ্য। আওয়ামী লীগ বিএনপিসহ সব বড় দল নির্বাচনে অংশ নিলে এই মুহূর্তে ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশ ভোট পড়বে। আওয়ামী লীগ বা বিএনপির মতো একটি দল না এলে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করা কঠিন। এতে মানুষ ভোট দিতে আসে না’। তিনি জাতীয় সংসদকে অবহিত করেন, যে প্রেক্ষাপট ছিল তাতে ৪২ শতাংশ ভোট দিতে গেলে সব ভোটকেন্দ্রের সামনে ৮ ঘন্টা লাইন থাকার কথা। কিন্তু তা ছিল না। এসময় সংসদ সদস্যরা হইচই শুরু করেন। এ সময় জিএম কাদের বলেন, অনেকে বলেছেন ঘণ্টায় তিন চারটার বেশি ভোট হয়নি। আমি আমার কথা বলছি না। জিএম কাদের তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সিংহভাগ মানুষ মনে করে ভাল নির্বাচন হয়নি, সঠিকভাবে জনমতের প্রতিফলন হয়েছে বলে মনে করে না। আমি মনে করি আইন কানুন ব্যাপকভাবে লঙ্ঘিত হয়েছে। যারা দেখার কথা তারা এড়িয়ে গেছেন অনেক সময় লঙ্ঘনে সহায়তা করেছেন’।
শুধু সংসদে বিরোধী দল জাতীয় পার্টি বা বিরোধী নেতা জিএম কাদের নন বরং সরকারি দল বা তাদের শরীক দল নৌকা প্রতীকে যারা হেরেছেন তারা প্রত্যেকেই দ্বাদশ জাতীয় সংসদের নির্বাচনের সুষ্ঠুতা ও গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। আওয়ামী লীগের প্রার্থী কন্ঠশিল্পী মমতাজ বেগম, জাসদের হাসানুল হক ইনু ও তরিকত ফেডারেশনের নজিবুল বশর মাইজভা-ারীর বক্তব্য থেকে তা দিবালোকের মত স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ফলে আমাদের দেশের সর্বসাম্প্রতিক নির্বাচনে যে জনমতের প্রতিফলন ঘটছে না তা নিয়ে কোন সন্দেহ-সংশয়ের অবকাশ থাকছে না। সঙ্গত কারণেই আমাদের দেশের রাজনীতি বিবর্ণ হতে হতে একেবারে বর্ণহীন হয়ে পড়েছে। আমরা ক্রমেই আত্মপ্রবঞ্চিত জাতিতে পরিণত হওয়ার দিকেই অগ্রসর হচ্ছি।
মূলত, গণতন্ত্রহীনতা, আইন ও সাংবিধানিক শাসনের বিচ্যুতি পুরো দেশ ও জাতিকে অশান্ত ও অস্থির করে তুলেছে। নাগরিকরা তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন প্রতিনিয়ত। গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ চর্চার অভাব ও সুবিচারের ভিত্তি দুর্বল হওয়ায় আমরা ক্রমেই অকার্যকর ও আত্মপ্রবঞ্চিত জাতিকে পরিণত হতে যাচ্ছি। যা আমাদেরকে অনিশ্চিত গন্তব্যের দিকেই নিয়ে যাচ্ছে। চতুর্থ খলিফা হযরত আলী (রা.)-এর ভাষায়, ‘রাজ্যের পতন হয় দেশ হতে সুবিচার উঠে গেলে, কারণ, সুবিচারে রাজ্য স্থায়ী হয়। সুবিচারকের কোন বন্ধুর দরকার হয় না’।
আমরা বোধহয় ক্রমেই সে অনিশ্চিত গন্তব্যের দিকেই অগ্রসর হচ্ছি। তাই দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থেই আমাদেরকে সেই অশুভ বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আর এজন্য প্রয়োজন বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য। বিষয়টি যথাযথভাবে উপলব্ধি করতে হবে সংশ্লিষ্টদের। ৯ মার্চ ২০২৪
পশ্চিমা দ্বিচারিতা ও ফিলিস্তিন স্বপ্ন
আশরাফুল ইসলাম আকাশ : যুদ্ধ বিধ্বস্ত অবরুদ্ধ গাজায় মানবিক বিপর্যয় চলছে। একদিকে হত্যাযজ্ঞ অন্যদিকে খাবার ও চিকিৎসা সংকট চরমে। ন্যূনতম বাঁচার অধিকার যেন নেই তাদের! গত ৭ই অক্টোবর শুরু হওয়া ইসরাইলি হত্যাযজ্ঞে ইতিমধ্যে আহত ৭২ হাজার এবং মৃত্যুর সংখ্যা ৩০ হাজার ছাড়িয়েছে। ইউক্রেনে রাশিয়ার ১৮ মাসব্যাপী অভিযানে ৫৪৫ শিশু নিহত হয়েছে। এর বিপরীতে গাজায় ইসরাইলের পাঁচ মাসের কম সময় ধরে চলা যুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছে ১২ হাজার ৫০০ শিশু। বিশ্বের এমন কোনো সংঘাতের কথা জানা নেই, যেখানে এমন অস্বাভাবিক দ্রুততায় এত শিশুর মৃত্যু ঘটেছে। এটা শুধু বিপন্ন ও বেদনার্ত অনেকগুলো অঞ্চলের মধ্যে একটি অঞ্চল নয়। ইউনিসেফ বলছে, বিশ্বের যেকোনো প্রান্তের মধ্যে গাজা এখন শিশুদের জন্য সবচেয়ে বিপজ্জনক।
সম্প্রতি অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় ত্রাণের অপেক্ষায় থাকা ফিলিস্তিনিদের ওপর হামলা করে ইসরাইলি বাহিনী। খাবারের জন্য অপেক্ষায় থাকা শতাধিক ফিলিস্তিনি নিহত এবং অন্তত ৭৬০ জন ক্ষুধার্ত ফিলিস্তিনি আহত হয়েছেন। বিশ্ব জুড়ে এ হামলার নিন্দার ঝড় উঠেছে। আর এই ঘটনা এমন সময় ঘটলো, যখন জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি সংস্থা (ডব্লিউএফপি) হুঁশিয়ারি দিয়ে আসছে-যদি অবস্থার পরিবর্তন না হয়, তবে গাজায় দুর্ভিক্ষ অত্যাসন্ন। গাজায় ক্রমশ খারাপ হতে থাকা মানবিক পরিস্থিতির ভেতর আরও কিছু করার প্রত্যয় জানিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সেখানে আকাশ পথে ত্রাণসামগ্রী ফেলার ঘোষণা দেন। গত ৩রা মার্চ বিমান থেকে প্যারাসুটের মাধ্যমে ৩৮ হাজারের বেশি খাবারের প্যাকেট ফেলে যুক্তরাষ্ট্র। এই প্রথম আকাশ থেকে গাজায় ত্রাণ সহায়তা পাঠালো যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের এই ত্রাণ সহায়তাকে প্রহসন হিসেবে দেখছে খোদ মার্কিনিরা। আমেরিকাতেই এর প্রতিবাদে বিক্ষোভ হয়েছে। বিক্ষোভকারী মার্কিনিরা বলছেন, ফিলিস্তিনিদের হত্যার জন্য বাইডেন একদিকে ইসরাইলকে অস্ত্র দিচ্ছে আবার অন্যদিকে স্থল পথ অবরুদ্ধ রেখে আকাশপথে সামান্য পরিমাণ ত্রাণ ফেলেছে। পুরো বিশ্ব থেকে যে পরিমাণ ত্রাণ সহায়তা যাচ্ছে তা প্রয়োজনের তুলনায় যৎসামান্য। অপুষ্টিতে মারা যাচ্ছে শিশুরা। ক্ষুধার্ত ফিলিস্তিনিরা পাচ্ছেন না বেঁচে থাকার মতো ন্যূনতম মানবিক সুবিধা। মার্কিনিরা একদিকে স্বাধীন ফিলিস্তিনের কথা বললেও তাদের পরম মিত্র ইসরাইলকে হত্যাযজ্ঞ চালানোর সব রসদ জোগান দিয়ে যাচ্ছে। সীমানা রুদ্ধ করে চরম মানবিক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে সেখানে। স্থায়ী সমাধানের তেমন অগ্রগতি নেই, সাময়িক যুদ্ধবিরতিতেও পৌঁছাতে বারবার ব্যর্থ হচ্ছেন বিশ্বনেতারা। পবিত্র রমজান মাসের আগেই গাজায় যুদ্ধবিরতি ঘোষণার জন্য চাপ অনেক বেড়েছে।
এদিকে, গত ৩রা মার্চ নিজেদের মধ্যে অহিনকুল সম্পর্ক ভুলে এক হওয়ার ঘোষণা দিয়েছে ফিলিস্তিনি গোষ্ঠী হামাস ও ফাতাহ। রাশিয়া আয়োজিত এক আলোচনার মধ্যদিয়ে বিরল এই ঐক্যের ঘোষণা দিলো তারা। এক হওয়ার প্রস্তাবে রাজি হয়েছে হামাস, ইসলামিক জিহাদ, ফাতাহ ও অন্য ফিলিস্তিনি গোষ্ঠীরা। চলমান যুদ্ধে কীভাবে ইসরাইলকে মোকাবিলা করা যায় এবং যুদ্ধের পরে কর্মপরিকল্পনা কী হবে, তা নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়। এর আগে গত ২৬শে ফেব্রুয়ারি ফিলিস্তিনের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ শাতায়েহ পদত্যাগ করেন এবং মন্ত্রিসভা ভেঙে দেন। এর পরপরই ফিলিস্তিনি গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে ঐক্যের ডাক দেন। ফিলিস্তিনি গোষ্ঠীগুলো মস্কো থেকে এক হয়ে বার্তা দিয়েছে যে, প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের (পিএলও) অধীনে আবারো একই ব্যানারের নিচে আসছে সবাই। সবগুলো পক্ষই এবার ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিষয়ে একমত। যদিও হামাস ও ইসলামিক জিহাদকে সন্ত্রাসী বাহিনী হিসেবে ঘোষণা করেছে পশ্চিমারা। যদিও পিএলও’র সরকারকে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি দেয় তারা। এর আগেও হামাস ও পিএলও-কে একসঙ্গে আনার নানা চেষ্টা ব্যাহত হয়েছে। তবে সর্বশেষ রাশিয়ার উদ্যোগে এই চেষ্টা সফল হলো। যুদ্ধের মাঠে বা স্বাধীন ফিলিস্তিন গঠনে কতোটা ভূমিকা রাখবে তারা তা সময়ই বলে দেবে। সামপ্রতিক বছরগুলোতে ফাতাহ ও হামাসসহ সবগুলো পক্ষের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখেছে রাশিয়া। প্রথম থেকেই ইসরাইলের বর্বর হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়ে আসছে রাশিয়া।
অপরদিকে একাধিকবার ফিলিস্তিনিদের স্বাধীন রাষ্ট্রের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে দেশটি। হামলা থামাতে জাতিসংঘে প্রস্তাবও উত্থাপন করেছিল মস্কো। এ ছাড়া ইরান সমর্থিত বিভিন্ন গোষ্ঠীও হামাসের পাশে দাঁড়িয়েছে। লেবাননের হিজবুল্লাহ এবং ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীরাও ইসরাইলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। সবারই চাওয়া ফিলিস্তিন স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হোক। তবে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বপ্ন কবে বাস্তবায়ন হবে তা অনুমান করাও দুরুহ ব্যাপার। বিধ্বস্ত গাজার শাসনভার নিয়ে ইতিমধ্যে ইসরাইলিরা বিভিন্ন পরিকল্পনা প্রকাশ করে যাচ্ছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে- স্বাধীন ফিলিস্তিন তো দূরের কথা গাজা ভূখণ্ডের নিয়ন্ত্রণও হারাতে বসেছে ফিলিস্তিনিরা।
প্রেসিডেন্ট বাইডেন নিজেই যেখানে ইসরাইলের হামলাকে বাড়াবাড়ি বলছেন, সেখানে যুক্তরাষ্ট্র তাদের অব্যাহতভাবে সুরক্ষা দিয়ে যাচ্ছে। এটা তো স্পষ্ট দ্বিচারিতা। সিনেটর বার্নি স্যানডার্স বলছিলেন, ইউক্রেনে বেসামরিক জনতার ওপর রাশিয়ার বোমা হামলার নিন্দা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। নেতানিয়াহুর যুদ্ধে হাজার হাজার মানুষ প্রাণ হারাচ্ছেন। কীভাবে যুক্তরাষ্ট্র এই যুদ্ধে অব্যাহতভাবে তহবিল জুগিয়ে যাচ্ছে? মার্কিন প্রেসিডেন্ট মুখে যাই-ই বলুন না কেন, তিনি মনেপ্রাণে একজন ইহুদিবাদী এবং তিনি ইসরাইলকে রক্ষার জন্য সম্ভাব্য সবকিছু করবেন। এ পরিস্থিতিতে ইসরাইলকে থামাবে কে- এটাই বড় প্রশ্ন। দ্বি-রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান করবে কে?
মানুষ, মনুষ্যত্ব, মানবতা, মানবাধিকার-কথাগুলো একইসূত্রে গাঁথা। দেশ, কাল, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষ সমান। মানুষে মানুষে ভেদাভেদ নেই- কথাগুলো শুনতে মধুর লাগলেও বাস্তবে তা পুরোপুরি কার্যকর নয়। মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্র-একটি ঘোষণাপত্র বা আন্তর্জাতিক দলিল। যা সমস্ত মানুষের অধিকার এবং স্বাধীনতাকে সংহত করে। প্রত্যেক মানুষের মানবাধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্য নিয়ে এই সনদ ঘোষিত হয়। সমস্ত মানুষ এবং সমস্ত জাতির জন্য অর্জনের এটি একটি সাধারণ মানদণ্ড হিসেবে গৃহীত হয়। জাতিগুলোকে জাতীয়তা, বসবাসের স্থান, লিঙ্গ, জাতীয় বা জাতিগত নির্বিশেষে সমস্ত মানুষকে স্বাধীন এবং মর্যাদা ও অধিকারে সমান হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয় এই ঘোষণা।
কিন্তু দেখা যায়, মানবাধিকারের ঘোষণা সর্বজনীন হলেও বাস্তবে তা নয়, অবস্থানভেদে মানবাধিকারের প্রয়োগে ভিন্নতা দেখা যায়। ইউক্রেন ও ফিলিস্তিন সংকটে বিষয়টি ব্যাপকভাবে আলোচনায় এসেছে। মানবাধিকার শব্দটি যেমন পশ্চিমাদের সৃষ্টি, তেমনি পশ্চিমাদের সুবিধা অনুযায়ী মানুষের সর্বজনীন অধিকারগুলোকে তারা বদলেও নেয়। মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য পশ্চিমারা পশ্চিমের কোনো দেশ, তাদের অর্থনীতির পার্টনার দেশগুলোর মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয় নিয়ে কখনো উচ্চবাচ্য করে না। অন্যদিকে তাদের প্রতিপক্ষ দেশগুলোতে সামান্য কিছু ঘটলেই মানবাধিকারের দোহাই দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন। রাশিয়া-ইউক্রেন আর ইসরাইল-ফিলিস্তিন যুদ্ধে মানবাধিকার নিয়ে পশ্চিমা দ্বৈতনীতির বিষয়টি খোলা চোখেই দেখা যায়। নেটিজেনরা সমালোচনার ঝড় তোলেন। আগেকার সময়ে সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়ে চুপ থাকলেও পশ্চিমা বিশ্বের সাধারণ জনগণ এসব নিয়ে এখন সোচ্চার হয়ে উঠেছেন।
রাশিয়ার আক্রমণে ইউক্রেনে দুই বছরে বেসামরিক মৃত্যু ১০ হাজার ছাড়িয়েছে। এর মধ্যে একটি বড় অংশ বয়স্ক মানুষ। যারা নিরাপদ আশ্রয়ে সরে যেতে অক্ষম বা অনিচ্ছুক ছিলেন। রাশিয়ার আগ্রাসনের সঙ্গে সঙ্গেই প্রতিক্রিয়ায় আমেরিকার নেতৃত্বে ইউরোপিয়ানরা আর্তচিৎকার শুরু করে যেন তাদের নিজেদেরই দেশ আক্রান্ত হয়েছে। একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের ওপর এ ন্যক্কারজনক আক্রমণ নিঃসন্দেহে অপরাধ। এর বিরোধিতা প্রতিটি সভ্য দেশ ও মানুষের অবশ্য কর্তব্য। কিন্তু পশ্চিমাদের এই মানবতা, মানবাধিকার, অন্য দেশের সার্বভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধা ইত্যাদি দেশ, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার জন্যই কি একই ধরনের? ফিলিস্তিন-ইসরাইলের যুদ্ধের দিকে নজর দিলেই স্পষ্টত উত্তর মিলবে। ইসরাইল-ফিলিস্তিন যুদ্ধের অবরুদ্ধ গাজা ভূখণ্ডে নিহতের সংখ্যা ৩০ হাজার ছাড়িয়েছে। নিহত এসব ফিলিস্তিনিদের মধ্যে ৭০ শতাংশই নারী ও শিশু। জাতিসংঘের মানবিক ত্রাণ সংস্থা জানিয়েছে, গাজায় দেড় লাখের মতো ফিলিস্তিনি বাস্তুচ্যুত হয়েছে। প্রকৃত সংখ্যা ৩ লাখেরও বেশি।
ইসরাইলি সুসজ্জিত সশস্ত্র বাহিনীর অত্যাধুনিক ট্যাংক, কামান ও ক্ষেপণাস্ত্রের বিপরীতে ফিলিস্তিনি শিশু-কিশোর ও নারী-বৃদ্ধদের ইটপাথরের ঢেলা নিক্ষেপকে মার্কিনিরা ইসরাইলের নিরাপত্তার প্রতি হুমকি মনে করেন। আর ইসরাইলিদের বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিমানবাহিনী দ্বারা ফিলিস্তিনি ঘনবসতি এলাকায় নিরস্ত্র ও ঘুমন্ত মানুষের ওপর বোমাবর্ষণকে যুক্তরাষ্ট্র মনে করে ইসরাইলিদের আত্মরক্ষার অধিকার! ইসরাইলিদের কাছে ফিলিস্তিনিদের মানবিক মর্যাদা বেওয়ারিশ কুকুর-বিড়ালের পর্যায়ে পৌঁছেছে! এই ইসরাইলি ইহুদিবাদকে অন্ধভাবে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে পশ্চিমা বিশ্ব। সিংহভাগ আন্তর্জাতিক নেতাই ইউক্রেনের আত্মরক্ষার অধিকারের প্রশংসা করেন, আর সমালোচনা করেন রাশিয়ার আক্রমণের। কিন্তু পশ্চিম তীর ও গাজায় ইসরাইলের দখলদারিত্বের ব্যাপারেও একই কথা খাটছে না। নিজ দেশ রক্ষার জন্য লড়াইরত ইউক্রেনীয়দের সমর্থন দিচ্ছে পশ্চিমা কূটনীতিবিদ ও সংবাদমাধ্যম, কিন্তু ইসরাইলিদের বিরুদ্ধে লড়াইরত ফিলিস্তিনিদের তারা আখ্যা দিয়েছে ‘সন্ত্রাসী’। গাজার স্কুল, হাসপাতাল ও শরণার্থী ক্যাম্পে নির্বিচারে ইসরাইলিদের অব্যাহত বোমা হামলা, ট্যাংক আক্রমণকে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন হিসেবে গণ্য করেনি পশ্চিমা উন্নত দেশের মানবাধিকারের প্রবক্তারা! উল্টো ইসরাইলের পক্ষে সাফায় গেয়ে সহায়তা করে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। মানবাধিকারের কথা বলে মুখে ফেনা তোলা দেশগুলোর আগ্রাসী মনোভাব, দ্বিচারিতা আর স্বার্থপরতার আরেকটি নজির হয়ে থাকবে এই সমর্থন।
ইউরোপে ভয়ঙ্কর ইহুদি নিধনযজ্ঞের পর সেখান থেকে পালিয়ে তারা নতুন এক মাতৃভূমির স্বপ্ন দেখছিল। আর সেই স্বপ্ন ফিলিস্তিনের ভূখণ্ড দখলের মধ্যদিয়ে বাস্তবে রূপ নেয়। ১৯৪৮ সালে ইহুদি নেতারা ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিলে শুরু হয় যুদ্ধ। এরপর বিভিন্ন সময়ে আরব-ইসরাইল যুদ্ধ হয়েছে এবং প্রাণ বাঁচাতে যখন ফিলিস্তিনিরা ঘরবাড়ি ছাড়ছে, সেই সুযোগে তাদের বেশির ভাগ অঞ্চল দখল করে নেয় ইসরাইল। নিজেদের আগ্রাসন টিকিয়ে রাখতে দীর্ঘ ৭৬ বছর ধরেই নিরীহ ফিলিস্তিনিদের ওপর চালিয়ে যাচ্ছে নির্যাতন। ইহুদি রাষ্ট্র গড়তে প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে নিরীহ ফিলিস্তিনিদের। সেই ইসরাইলকে নিজেদের ঘনিষ্ঠ মিত্র আখ্যা দিয়ে বারবার আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে যাচ্ছে মানবাধিকারের ঝাণ্ডা-উত্তোলক হিসেবে দাবিকারী মহাপরাক্রমশালী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। প্রায়ই শান্তি আলোচনার নাটক মঞ্চস্থ করলেও কখনই সফলতা আসেনি। কারণ সর্বদা তারা ইসরাইলের পক্ষে থেকেছে। তাদের অর্থ, অস্ত্র ও সর্বাত্মক সহায়তায় ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী জনগণের ওপর দশকের পর দশক ধরে নিপীড়ন চালিয়ে আসছে দখলদার ইসরাইল। এবারের সংঘাতেও ত্বরিত সাহায্য সহযোগিতা পাঠায়। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে যুদ্ধ বন্ধ ও মানবাধিকার রক্ষার দাবি উঠলেও পশ্চিমারা তাতে কর্ণপাত করেননি।
ইউক্রেন আক্রমণ ঠেকানোর জন্য পশ্চিমারা মরিয়া হয়ে উঠেন। রাশিয়ার বিরুদ্ধে পশ্চিমা বিশ্ব তীব্র প্রতিবাদ করেছে; তা নিঃসন্দেহে উত্তম কাজ। কিন্তু যখন তারা নিজেরাই এসব অপকর্ম করে ফিলিস্তিনে লাখো মানুষ হত্যা করে, ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে, যখন যে দেশে খুশি আক্রমণ করে, যাকে খুশি তাকে হত্যা করে, তখন তাদের এই দ্বিমুখী নীতিটাই প্রকাশিত হয়ে পড়ে। কাজেই তাদের ন্যায়পরায়ণতার বাণী, সভ্যতার বুলি, গণতন্ত্রের বার্তা ইত্যাদি সবই আজ শঠতা বলেই প্রমাণিত হচ্ছে। তবুও অর্থসম্পদ ও অস্ত্রশক্তির জোরে তারাই আজ বিশ্বের মানবতা, মানবাধিকার, গণতন্ত্র, স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব আর ন্যায়পরায়ণতার সংজ্ঞা নির্ধারণ করে দিচ্ছে, যা অন্য সব দুর্বল দেশ, রাষ্ট্র ও জনতাকে মানতে হবে। সবাই তা মেনেও নেবে। কিন্তু ঘৃণা করবে পশ্চিমাদের নগ্ন দ্বিমুখী নীতিকে। পশ্চিমা বিশ্বের বিরুদ্ধে বাকি বিশ্বের ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হতে থাকবে, যা একসময় আরও চরমপন্থি গোষ্ঠীর জন্ম দেবে এবং চূড়ান্তভাবে বৈশ্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে অস্থির করে তুলবে। বোধোদয় হোক সবার, সুরক্ষিত থাকুক প্রতিটি প্রাণ। ইউক্রেন-ফিলিস্তিন সংকটের সমাধান হোক। ফিলিস্তিনিদের স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হোক। নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষের মুক্তি হোক-এমনটায় প্রত্যাশা। ১৩ মার্চ ২০২৪
লেখক: কলাম লেখক ও সাবেক সভাপতি, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি
শয়তানের বন্দিত্বের রমজান
মোস্তফা কামাল : যথারীতি আবার শুরু হলো আরবি বর্ষপঞ্জির নবম মাস রমজান। রমজানের শেষ দশকে শবেকদরের রাতে নাজিল হয় পবিত্র আল কুরআন। এ মাসে মুমিন-মুসলমানরা গুনাহ মাফ, আল্লাহর নৈকট্য লাভের আশায় সব পাপকর্ম থেকে বিরত থাকেন। রোজা মানুষের দৈহিক-মানসিক ও আধ্যাত্মিক উন্নয়নের জন্য অতিগুরুত্বপূর্ণ প্রশিক্ষণ। ইসলামে রোজা পালনের বিধান এসেছে নামাজের পর দ্বিতীয় হিজরির ১০ শাবান মদিনায়। ইসলামের পাঁচ স্তম্ভের তৃতীয়টি সাওম বা রমজান। সাওম আরবি শব্দ, এর বহুবচন সিয়াম ফারসি প্রতিশব্দ রোজা। আর রোজার আভিধানিক অর্থ, পাপ কাজ থেকে বিরত থাকা, আত্মসংযম, কঠোর সাধনা ইত্যাদি। ইসলামী শরিয়তের পরিভাষায়, সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় নিয়তের সঙ্গে যাবতীয় পানাহার ও ইন্দ্রিয় তৃপ্তি থেকে বিরত থাকার নাম সাওম বা রোজা। অন্য অর্থে ‘রমদ, ধাতুর আভিধানিক অর্থ হচ্ছে, দহন, প্রজ্বলন, জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে-ভস্ম করে ফেলা’। রমজানে মানুষের যাবতীয় কুপ্রবৃত্তি, নফসের দাসত্ব, জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করে দেয়। রোজা লোভ-লালসা, হিংসা-বিদ্বেষ, ক্রোধ-ক্ষোভ, অত্যাচার থেকে বিরত এবং স্রষ্টার সৃষ্টির প্রতি দয়া প্রদর্শনের রিহার্সালও। প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক মুসলমান নারী-পুরুষের ওপর এর ট্রায়াল ফরজ। বয়ানে বলা হয়, আল্লাহ নিজ হাতে এর সওয়াব (প্রতিদান) দেবেন। মহানবী হজরত মুহাম্মদের (সা.) জবানিতে আছে, সাওম বা রোজা মুমিনের ‘জাহান্নাম থেকে পরিত্রাণের ঢালস্বরূপ’ (বুখারি ও মুসলিম)।
রমজান মাসে শয়তানকে বন্দি করে রাখা হয় বলে পবিত্র কুরআন, হাদিসের উদ্ধৃতিসহ নানা বয়ান আছে। কোনো কোনো বয়ানে আছে, এ মাসে শয়তানের পায়ে জিঞ্জির পরিয়ে দেয়া হয়। এর অর্থও বন্দিত্বই। বাংলা পরিভাষায় বলা যায়, অকর্মণ্য করে দেয়া হয়। ধর্মপ্রাণরা তা বিশ্বাস করেন। এর বিপরীতে প্রশ্ন, তাহলে এ মাসে শয়তানিকাণ্ড তাহলে বেশি কেন? কে করে বা করায় অপকর্মগুলো? সুরা ইব্রাহীমের-২২ নম্বর আয়াতে শয়তানের সক্ষমতা নিয়ে কিছু কথা আছে। কুরআনের আরেক জায়গায় বলা হয়েছে শয়তানের কৌশল দুর্বল! মানুষকে গুনাহ করাতে বাধ্য করার সরাসরি শক্তি নেই তার। শয়তান শুধু মানুষকে উসকানি বা ইন্ধন (ওয়াসওয়াসা) দেয়! (সুরা নিসা-৭৬)। বন্দি থাকা অবস্থায়ও তার উসকানির তীব্রতা-ব্যাপকতার প্রসঙ্গটি আসে কিছু ব্যক্তি বা মহলের মাসটিকে ঘিরে কয়েকগুণ বেশি অপকর্মের কারণে। স্বাভাবিক বোধ-বুদ্ধিতে এর জবাব মেলে না।
রোজার ধর্মীয় গুরুত্বের সঙ্গে সামাজিক ও মানবিক অনেক গুরুত্ব জড়িত। মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। এসব দেশ রমজান উপলক্ষে বড় বড় চেইনশপ থেকে শুরু করে ছোট দোকানে দেয় বিশাল বিশাল ছাড়। ক্রেতাদের কে কত বেশি মূল্য ছাড় দিতে পারে সেটা নিয়ে চলে রীতিমতো প্রতিযোগিতা। প্রতিযোগিতায় ছাড়ের মাত্রা কখনো কখনো ৫০-৭০ শতাংশ পর্যন্ত গিয়ে দাঁড়ায়। মূলত রোজাদারের অর্থকষ্ট লাঘবের পাশাপাশি অধিক সওয়াবের আশায় নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসে এমন ছাড় দেন বিক্রেতারা। ক্রয়ক্ষমতা সাধারণ মানুষের নাগালে রাখতে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম কমানোর ঘোষণা এবং সেগুলোর মূল্য তালিকা দোকানের সামনে ঝুলিয়ে রাখা হয়।
এই সংস্কৃতি কেবল মুসলিম নয়, অন্যান্য ধর্ম অধ্যুষিত দেশেও। অন্য সব ধর্মের লোকেরা রমজান মাসকে শ্রদ্ধা-সমীহ করে। নৈতিক-অনৈতিক বাছ বিচার করে। অনাহারি-অভাবী প্রতিবেশীদের খাওয়ার ব্যবস্থা করে। অতি মুনাফার মোহ সংবরণ করে। বিভিন্ন দেশ তাদের ধর্মীয় উপলক্ষ কিংবা উৎসবের সময় জিনিসপত্রের দাম কমানোর ঘোষণা দেয়। এসব উৎসব ঘিরে ইউরোপ-আমেরিকায় ছাড়ের হিড়িক পড়ে। মাসখানেক আগে থেকেই শুরু হয় উৎসব। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ না হয়েও রমজান উপলক্ষে অনেক দেশে পণ্যসামগ্রীর দাম কমানোর ঘোষণা দেয়া হয়। অমুসলিম দেশ দক্ষিণ কোরিয়ায় কোনো ধর্মীয় উৎসবের সময় দ্রব্যমূল্যের দাম বাড়ে না, রমজানে দেয়া হয় আরো বেশি ছাড়। রমজানের শুরুতে পণ্যে ছাড় দেয়া ইউরোপের দেশগুলোতে রীতিতে পরিণত হয়েছে। জার্মানিতে চলে অভাবনীয় মূল্য ছাড়। তা ফ্রান্সেও। আমাদের কাছের দেশ থাইল্যান্ডেও রমজান মাস উপলক্ষে মুসলমানসহ সবার জন্য পণ্যে বিশেষ ছাড়ের ঘোষণা দেয়া হয়েছে। রমজান উপলক্ষে ব্যবসায়ীরা তাদের আগের মুনাফা থেকে ছাড় দিয়ে ব্যবসা করেন। পণ্যের দাম না বাড়িয়ে সেখানে কমিয়ে দেন। আবার অনেক ব্যবসায়ী লাভবিহীন পণ্য বিক্রি করেন মাসজুড়ে। সম্প্রীতি-বন্ধন ও সহনশীলতা বাড়াতে তারা এমন উদ্যোগ নেন। এর ঠিক উল্টা চিত্র বাংলাদেশে। রমজান মুসলমানদের ত্যাগ ও আত্মশুদ্ধির মাস বলা হলেও মুসলিমপ্রধান এ দেশটির বাস্তবটা বড় নিষ্ঠুর। অনৈতিকভাবে প্রতি বছর রমজান মাসে বাংলাদেশে প্রায় প্রতিটি পণ্যের দাম বেড়ে যায়। তা অনেকটা স্বাভাবিক রীতিতে পরিণত হয়েছে।
শয়তানি কাণ্ডের প্রাসঙ্গিকতা এখানেই। তবে কি মাসটিতে শয়তান এখানে মুক্ত বিহঙ্গ? নাকি সে বন্দি থাকলেও তার এখানে বেশুমার সাগরেদ। এই শিষ্যদের এক্সপার্টিজম বা পারফরম্যান্স গুরু শয়তানের চেয়েও জুতসই-টেকসই? সরকারের এত চেষ্টা-ধমক-অভিযানের পরও শয়তান বা তার অনুসারীদের কারসাজি কেন বেশি টেকসই বাংলাদেশে? বছরের বাকি ১১ মাস কোপ মারলেও রমজানের এক মাসে তারা একেবারে জবাই করে ছাড়ছে। কেউ তাদের রুখতে পারে না। রোজার আগ থেকেই কোমর বেঁধে নামে তারা। পণ্যের দাম বাড়ানোর যাবতীয় ছলাকলা, কৌশল, যুক্তিসহ যাবতীয় পরিবেশ তারা নিশ্চিত করে ছেড়েছে এবারো। কিছু পণ্যের পর্যাপ্ত মজুত থাকলেও কৃত্রিম সংকট তৈরির বন্দোবস্ত তারা আগেই করে রেখেছে। বাজারে পণ্যের সংকট তৈরি করেছে দক্ষতার সঙ্গে। বড় থেকে ছোট, মহল্লার মুদি দোকানেও শয়তানি কাণ্ড চলছে হরদম। অনেকের মাথায় আবার টুপিও থাকছে। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশটিতে পবিত্র মাসে এমন শয়তানি কর্মের ফের একেবারে অবুঝের বিষয় নয়। অন্য ধর্মের চতুর লোকদেরও দায়ী করার সুযোগ নেই। দেশে ব্যবসায়ীদের ৯০ ভাগেরও বেশি মুসলমান, মুসলমান হয়েও পুণ্যের মাসে অপুণ্যের এমন কাজ তারা করছেন। করে আসছেন। এবার আরেকটু বেশি করছেন। বাকি ১১ মাসেও এই চর্চায় তারা কমতি দেবেন? অথচ রমজানের ১ মাস বাকি ১১ মাসের নৈতিকতা ও সংযম চর্চার রিহার্সাল টাইম। বাস্তবে কী রিহার্সাল শুরু হয়েছে মাসটিতে?
বহুবিধ ব্যস্ততায় রমজানে সরকারের শাসন-অভিযান, আলেম-ওলেমাদের নসিয়ত শোনার সময়ও হয় না তাদের। তারপরই না শিকলে আবদ্ধ হওয়া বা পায়ে ডান্ডাবেড়ি লাগানো। হাদিস বিশারদরা বলে থাকেন, শয়তান শিকলে আবদ্ধ থাকার অর্থ আক্ষরিক ও রূপক উভয় অর্থেই হতে পারে। রূপক অর্থে রমজানে শয়তানের ধোঁকা-প্রবঞ্চনার হার কমে যায়, অন্যায় কাজ কম হয় এবং মানুষের মধ্যে আল্লাহর বিধান পালনের প্রতি আগ্রহ প্রবল থাকে। আর আক্ষরিক অর্থ হচ্ছে, মানুষ পাপ করে দুই কারণে। একটি তার কুপ্রবৃত্তি ও বদ-অভ্যাস। আর দ্বিতীয়টি শয়তানের প্ররোচনায়। রমজানে শয়তান বন্দি থাকলেও কুপ্রবৃত্তির কারণে মানুষ পাপ করে থাকে। আমাদের সামগ্রিক বাস্তবতা কুরআন, হাদিস, বয়ান, নৈতিকতা কোনো কিছুরই ধার ধারে না। এ কারণে হয়তো ১১ মাসের চর্চা ১ মাসে থমকে না। কামাই-রোজগারের ভর মৌসুমে তা হয়তো আরো গতি পায়। শানিত হয়। শয়তানের বন্দি থাকা আর মুক্ত থাকায় তা ম্যাটার করে না। এ নিয়েও ধর্মীয় বিভিন্ন গ্রন্থে কিছু কথা আছে। কারো কারো মতে, রমজানে বন্দি থাকার কারণে শয়তানের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ বন্ধ থাকলেও পরোক্ষ হস্তক্ষেপ বন্ধ থাকে না। তাই মানুষ পাপ করে। কোনো কোনো হাদিস ব্যাখ্যাকারী বলেছেন, রমজানে সব শয়তানকে বন্দি করা হয় না, অতিরিক্ত দুষ্ট শয়তানকে বন্দি করা হয়। তাই অন্য শয়তানদের প্ররোচনায় মানুষ পাপ করে। (ফাতহুল বারি : ৪/১১৪)।
রমজান সংযম-কৃচ্ছ্রসাধনেরও রিহার্সাল আওয়ার। তা খাওয়া-দাওয়া, কেনাকাটা, ভরণ-পোষণেও প্রযোজ্য। দিনভর না খেয়ে ইফতার থেকে সেহরি পর্যন্ত মনিচ্ছা মতো খাওয়া সংযমের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এ জন্য নিজেকে উহ্য রেখে শয়তানকে দায়ী করলে তা একতরফা হয়ে যায়। দিনে টেপ খালি রেখে এক রোজা দাবি করে দুপুর থেকে কারো কারো রন্ধনশালায় যে কর্মব্যস্ততা চলে তাও সংযমের সঙ্গে যায় না। পানাহার থেকে বিরত থাকার সময় বাদেও যে খাবারের প্রতি সংযম থাকা দরকার আমরা বেশির ভাগ মানুষই তা ভুলে যাই। দীর্ঘ সময় পানাহার থেকে বিরত থাকার পর, শারীরিক ও মানসিক অবস্থা এমন হয় যে, ‘যা পাই তাই খাই’ এবং ‘যত পাই তত খাই’। বিষয়টি ধর্মীয় দিক দিয়ে তো বটেই, স্বাস্থ্যবিজ্ঞানও তা অনুমোদন করে না। দীর্ঘক্ষণ পানাহার থেকে বিরত থাকার পর টেবিলে খাবারের পসরা সাজানো সংযম নয়। এ থেকে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করাও রমজানের শিক্ষা। ইসলাম ধর্মে এ সংক্রান্ত কিছু নির্দেশনাও আছে। রাসুল (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি পেট ভর্তি করে খাবার খায় তার পেট (আল্লাহর কাছে) একটি নিকৃষ্ট পাত্র, (তিরমিজি)। সুন্নাত হলো পেটের তিন ভাগের এক ভাগ খাবার খাবে, একভাগ পানি পান করবে। বাকি এক ভাগ খালি রেখে দেবে, (তিরমিজি)। কেউ ধর্মীয় এসব নির্দেশনা মানতে চাইলে নিশ্চয়ই শয়তান তা রুখে দিতে পারবে না। রোজা-সেহরিতে যত ইচ্ছা খাওয়া আল্লাহর দরবারে কবুল হয়ে যায়- এ ধরনের কিছু মাসআলা দেয়ার লোক আছে। নিজেকে নির্দোষ রেখে সব কিছুতে শয়তানের দোহাই বা অজুহাত খোঁজাও অবশ্যই আরেক শয়তানি। মার্চ ১৩, ২০২৪
মোস্তফা কামাল : সাংবাদিক ও কলাম লেখক; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন
খেজুর ও বরই বিতর্ক
আমীন আল রশীদ : কোনও খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে গেলে সেটি না খাওয়ার ‘সহজ পরামর্শ’ দেওয়া নতুন কিছু নয়। যেমন, গরুর মাংসের দাম বেড়ে গেলে বলা হয় গরুর মাংসে কোলেস্টেরল বেশি। অতএব না খাওয়াই উত্তম। মুরগির দাম বেড়ে গেলে বলা হয় ডাল খান। ডাল হচ্ছে গরিবের আমিষ। পেঁয়াজের দাম বেড়ে গেলে বলা হয় পেঁয়াজ ছাড়াও রান্না হয়, ইত্যাদি। তারই ধারাবাহিকতায় এবার খেজুরের বদলে বরই দিয়ে ইফতারের পরামর্শ দিয়েছেন শিল্পমন্ত্রী নুরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন।
গত ৪ মার্চ রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে জেলা প্রশাসক সম্মেলনের একটি অধিবেশন শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপে মন্ত্রী বলেন, ‘বরই দিয়ে ইফতার করেন না কেন? আঙুর-খেজুর লাগবে কেন? আপেল লাগবে কেন? আর কিছু নেই আমাদের দেশে? পেয়ারা দেন না, সবকিছু দেন। প্লেটটা ওভাবে সাজান। ইফতার পার্টি তো বলেই দিয়েছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, দরকার নেই। কাজেই অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা। আপনার সংসারে যেমন আপনি দেখেন, এইভাবে দেশটারেও দেখেন আপনারাও সাংবাদিকরা। আকাশ থেকে খালি দেখেন না, নিচের থেকে এসেছেন আপনারাও। সেগুলোও দেখেন, আশপাশে দেখেন।’
তবে শিল্পমন্ত্রীর এই পরামর্শে চটেছেন সাবেক তথ্যমন্ত্রী ও জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু। বলেছেন, ‘আমি বরই দিয়ে ইফতারি করবো, আর তুমি খেজুর-আঙুর খাবা?’ ইনু বলে, ‘সাহস থাকে তো খেজুর আর আঙুরের আমদানি নিষিদ্ধ কর। খেজুর আর আঙুর আমদানি করবা, গরিব মানুষ বরই খাবে, তুমি আঙুর আর খেজুর খাবা, তা হবে না, তা হবে না।’
শুধু তাই নয়, খেজুরের বদলে বরই দিয়ে ইফতার করার পরামর্শ দেওয়ায় নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূনকে মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দেওয়ারও আহ্বান জানান ইনু।
ইফতারের আইটেমে খেজুর যে অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠলো তার প্রধানত কারণ ধর্মীয়। যেহেতু আরবের প্রধান ফল খেজুর, যেটি অন্যতম প্রধান খাদ্যপণ্যও বটে এবং মহানবী (সা.) খেজুর খুবই পছন্দ করতেন, খেজুর দিয়ে ইফতার করতেন, ফলে সারা বিশ্বে মুসলমানদের কাছে খেজুর দিয়ে ইফতার করা পুণ্যের কাজ। দ্বিতীয়ত খেজুরের পুষ্টিগুণও অনেক। পুষ্টিবিদরাও বলে থাকেন যে সারা দিন রোজা রাখার পর ইফতারিতে খেজুর সবচেয়ে উপকারী। প্রচুর পরিমাণ ক্যালরি থাকায় রোজা শেষে ইফতারিতে খেজুর খেলে দ্রুত ক্ষুধা নিবারণ করা যায়। সেই সাথে দ্রুত দুর্বলতাও কেটে যায়। যার সাথে অন্য কোনও খাবার বা ফলের তুলনা চলে না। ফল কিংবা খাদ্য হিসেবে বরই কখনও খেজুরের বিকল্প হতে পারে না।
প্রশ্ন হলো, শিল্পমন্ত্রী খেজুরের বিকল্প হিসেবে বরই খেতে বললেন কেন? এই দুটি ফল দেখতে কাছাকাছি বলে? অথবা হতে পারে তিনি খেজুরের বদলে বরই খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন প্রতীকী অর্থে।
অর্থাৎ তিনি যা বলেছেন তার আরেকটি অর্থ হলো: ‘খেজুর না খেলে কী হয়?’ অর্থাৎ পরামর্শটা গরু ও মুরগির মাংস এবং পেঁয়াজের বিকল্প কিংবা পেঁয়াজ না খাওয়ার পরামর্শের মতো। অর্থাৎ এটা না খেলে কী হয়, ওটা না খেলে কী হয় ইত্যাদি।
প্রতিটি জিনিসের দাম বেড়ে যাবে আর সেটি না খাওয়া কিংবা তার বিকল্প পরামর্শ দেওয়ার পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী কিংবা সরকারের নীতিনির্ধারকরা যদি কেন ওই জিনিসটির দাম বেড়ে গেলো তার ব্যাখ্যা দিতেন এবং সেই পণ্যটি সাধারণ মানুষের ক্রয়সীমার নাগালে নিয়ে আসতে কী কী ব্যবস্থা নিয়েছেন বা নিচ্ছেন, সেই তথ্যটি মানুষকে জানাতেন, তাহলে ভালো হতো। কেননা, তাদের মনে রাখা দরকার, কোনও কিছুর দাম বেড়ে যাওয়ার পেছনে উৎপাদন সংকটজনিত জটিলতার বাইরেও রাষ্ট্রীয় নীতিও অনেক সময় ভূমিকা রাখে— যেমন খেজুরের বেলায় হয়েছে।
সরকার খেজুরকে ‘বিলাস দ্রব্য’ হিসেবে ঘোষণা করেছে। ফলে এর আমদানি শুল্ক বেড়েছে। খেজুরের মতো একটি পণ্য কী করে বিলাস দ্রব্য হয়, সেটি বিরাট প্রশ্ন। হতে পারে এর দামের কারণে। সরকার হয়তো ভেবেছে যে ফলের কেজি ৬০০ থেকে তিন হাজার টাকা বা তারও বেশি, সেই ফল স্বল্প আয়ের মানুষ খাবে না, অতএব এটা বিলাস দ্রব্য—সেটি হয়তো একটি যুক্তি। কিন্তু এটাও মনে রাখা দরকার যে রোজার মাসে রোজাদারমাত্রই ইফতারি এমনকি সেহরিতেও খেজুর খেতে চান। হাজার বছর ধরে সেহরি ও ইফতারের মেন্যুতে খেজুর ছিল। অভিযোগ উঠেছে, খেজুরের শুল্কহার বাড়ানোর কারণ দেখিয়ে একদিকে যেমন খেজুরের দাম বাড়ানো হয়েছে, অন্যদিকে তৈরি করা হয়েছে কৃত্রিম সংকট। আমাদের দেশের ব্যবসায়ীদের যে অতি সাধারণ প্রবণতা, সেটি হলো, যেকোনও অজুহাতে তারা পণ্যের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে অতিরিক্ত মুনাফা তুলে নেন। সম্প্রতি স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও এই ধরনের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টিকারী তথা মজুতদারদের গণধোলাই দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।
বাংলাদেশে খেজুর মূলত আমদানিনির্ভর এবং নানা জাতের নানা দামের খেজুর আসে। দুইশ’ টাকা বা তারও কম দামি খেজুর যেমন আসে, তেমনি কয়েক হাজার টাকা কেজি দরের খেজুরও বাজারে পাওয়া যায়। আর্থিক সক্ষমতা অনুযায়ী মানুষ খেজুর কিনে থাকেন। রাজধানীতে খাদ্যপণ্যের অন্যতম বড় বিপণিকেন্দ্র কারওয়ান বাজারের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রোজার মাসে সাধারণত তিনশ’ থেকে ছয়শ’ টাকা কেজির খেজুরের চাহিদা থাকে সবচেয়ে বেশি। এবার সেই ছয়শ’ টাকা কেজির খেজুরই বিক্রি হচ্ছে নয়শ’ থেকে এক হাজার টাকায়।
খেজুর না খেলে কী হয় বা ইফতার ও সেহরিতে এই বিদেশি ফল রাখতেই হবে কেন— এই সরল প্রশ্ন করা যেতেই পারে, কিন্তু তাতে সংকটের সমাধান হবে না। কেননা ধর্মীয় অনুভূতির কারণে হোক আর পুষ্টিগুণের কারণে হোক, রোজার মাসে মুসলমানরা খেজুর খেতে চাইবেই। সে কারণে সরকারের উচিত ছিল অন্তত এই মাসের জন্য খেজুরে আমদানি শুল্ক আরোপ না করা এবং প্রত্যেক ব্যবসায়ীকে খেজুর আমদানির জন্য একটা কোটা নির্ধারণ করে দেওয়া যাতে বিনা শুল্কের সুযোগ নিয়ে কেউ অতিরিক্ত খেজুর আনতে না পারেন। এখানে বাজার মনিটরিং জোরদার করা। তাতে করে শিল্পমন্ত্রীকে খেজুরের বদলে বরই খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে একজন সাবেক মন্ত্রীর তোপের মুখে পড়তে হতো না। তাতে তিনি সোশ্যাল মিডিয়ায়ও ট্রলের শিকার হতেন না। তিনি খেজুরের বদলে বরই খাওয়ার পরামর্শটি হয়তো সৎ উদ্দেশ্যেই দিয়েছেন, তাতে বাজার ব্যবস্থাপনার ত্রুটিও সামনে চলে এসেছে।
কোনও কিছুর দাম বেড়ে গেলেই সেটি না খাওয়া বা সেটির বিকল্প বলতে গিয়ে অনেক সময় যে হাস্যকর পরামর্শ দেওয়া হয়— সেই ধারাবাহিকতায় খেজুরের বিকল্প বরই হতে পারে কী পারে না, তার চেয়ে বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে, বাজারে সরকারের নিয়ন্ত্রণ কতটুকু আছে?
বাংলাদেশে যেহেতু অবৈধ পথে টাকা উপার্জন করে রাতারাতি ধনী হওয়ার অবারিত সুযোগ রয়েছে, ফলে এখানে বাজারের প্রধান সংকট হলো সৎপথে সীমিত আয়ের লোকটিকেও বাজারে গিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হয় অবৈধ পথে উপার্জনকারী পয়সাওয়ালার সঙ্গে। যে মাছের দাম এক হাজার টাকাও আপনার পছন্দ হলো না, সেটি আরেকজন এসে দেড় হাজার টাকায় কিনে নিয়ে গেলেন কোনও দরদাম ছাড়াই। ফলে আপনি তার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলেন। অতএব খেজুরের বিকল্প হিসেবে বরই কতটা উপযুক্ত, এমনকি বরই না খেলেও কী হয়— সেই কথাও যদি বলা হয়, তারপরও যে প্রশ্নের মীমাংসা করা জরুরি তা হলো, মুক্তবাজার অর্থনীতির এই দুনিয়ায় সৎপথে উপার্জনকারী সীমিত আয়ের মানুষটি তার পছন্দের জিনিসটি কিনতে পারছেন কিনা এবং না পারলে তার যে দীর্ঘশ্বাস— রাষ্ট্র সেটি শুনতে পাচ্ছে কিনা বা শুনতে চাচ্ছে কিনা? ১২ মার্চ ২০২৪
লেখক: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন
ঊনিশ শতকের মুসলিম সমাজ
রানা চক্রবর্তী : ঊনবিংশ শতাব্দীতে উত্তর ভারতে স্যার সৈয়দ আহমদ খান এবং বঙ্গদেশে আবদুল লতিফ তাঁদের নিজের নিজের কর্মক্ষেত্রে প্রায় একই সময়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের পরে বৃটিশ সরকারের ধারণা হয়েছিল যে, সেই বিদ্রোহের পিছনে তৎকালীন দিল্লীর ম্রিয়মান মুঘল শক্তির পুনরুজ্জীবনের চেষ্টা ছিল, এবং সেটার জন্য বৃটিশ সরকারের পক্ষ থেকে ভারতের মুসলিম সম্প্রদায়কে সবথেকে বেশি পরিমাণে দায়ী করা হয়েছিল। সেই সময়ে কলকাতায় অবস্থানরত বৃটিশ বৃত্তিপ্রাপ্ত অযোধ্যার নবাব ওয়াজেদ আলীকে আটক, এবং ফারায়েজি আন্দোলনের নেতা দুধু মিয়াকে গ্রেফতার ও কারারুদ্ধ করা হয়েছিল। ওয়াহাবি আন্দোলনকে বৃটিশ সরকার যথেষ্ট সন্দেহের চোখে দেখেছিল। ১৮৭০-৭২ সালে হওয়া পর পর দুটি হত্যাকাণ্ড মুসলমানদের নিয়ে ইংরেজদের মনে সন্দেহ ও আশঙ্কাকে আরো বাড়িয়ে তুলেছিল। উক্ত সময়ের মধ্যে আবদুল্লাহ বিচারপতি নরম্যানকে এবং শের খান বড়লাট লর্ড মেয়োকে হত্যা করেছিলেন। এরপরে বৃটিশ সরকার কঠোর মনোভাব নিয়ে ওয়াহাবিদের ব্যাপক পরিমাণে ধর-পাকড় করতে শুরু করেছিল এবং রাণীর শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের অভিযোগ এনে অনেককে জেল-ফাঁসি-দ্বীপান্তরের সাজা দিয়ে ওয়াহাবি আন্দোলনকে কঠোর হাতে দমন করেছিল। এমন একটা সময়ে ভারতীয় মুসলমান সমাজের নেতৃত্বভার গ্রহণ করে, ভারতীয় মুসলমানদের প্রতি ইংরেজদের মনে যে সন্দেহ ছিল, সেটাকে দূর করাই স্যার সৈয়দ আহমদ ও আবদুল লতিফের প্রথম কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাঁরা উভয়েই সিপাহী বিদ্রোহের বিপক্ষে নিজেদের রায় দিয়েছিলেন এবং বিভিন্ন সভা অনুষ্ঠিত করে বৃটিশ সরকারের প্রতি মুসলমান সমাজের আনুগত্য প্রকাশ করেছিলেন। ১৮৫৯ সালে স্যার সৈয়দ আহমদ উর্দু ভাষায় ‘ভারতের বিদ্রোহের কারণ’ (আসবাব-এ বাগাওয়াত-এ হিন্দু) শিরোনামের একটি গ্রন্থ রচনা করে মুসলমানদের প্রতি বৃটিশ সরকারের সন্দেহভঞ্জন করবার চেষ্টা করেছিলেন।
অন্যদিকে আবদুল লতিফ কলকাতায় একটি সভার আয়োজন করেছিলেন। সেখানে মৌলানা কেরামত আলী ঘোষণা করেছিলেন যে, বৃটিশ শাসিত ভারতবর্ষ — ‘দারুল হরব’ — নয়, বরং — ‘দারুল ইসলাম’। তিনি আরো ঘোষণা করেছিলেন যে, ইংল্যাণ্ডের রাণীর ১৮৫৮ সালের ঘোষণাপত্র অনুযায়ী যেহেতু মুসলমানদের নিজস্ব ধর্মপালনে কোন বাধা দেওয়া হয়নি, সেহেতু শাসক বিধর্মী হলেও ধর্মীয় কারণে তাঁদের বিরুদ্ধে কোন ধরণের জেহাদ অসিদ্ধ; সুতরাং — এরপরেও যাঁরা সেই জেহাদ করবেন, তাঁরা ধর্মের চোখেও দণ্ডণীয় হবেন। (Nawab Bahadur Abdul Latif: His Writings and Related Documents, P- 87) এরপরে ১৮৭১ সালে উইলিয়ম উইলসন হান্টার — ‘দি ইন্ডিয়ান মুসলমানস’ — শিরোনামের একটি পুস্তক রচনা করে ভারতীয় মুসলমানদের অসন্তোষ সম্পর্কে বৃটিশ সরকারকে অবহিত করেছিলেন, এবং সেই অসন্তোষ দূর করবার জন্য সরকারকে যথোপযুক্ত পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। তিনি তাঁর গ্রন্থে কেরামত আলীর কথার প্রতিধ্বনি করে বলেছিলেন যে, বৃটিশ সরকার প্রজার ধর্মকর্মে হস্তক্ষেপ করে না বলে মুসলমানরা বৃটিশ শাসকের প্রতি অনুগত হলে সেটা ইসলামের নীতির বিরুদ্ধে যায় না। (The Indian musalmans, 1871)
সিপাহী বিদ্রোহের অব্যবহিত পরে রাণী ভিক্টোরিয়ার ১৮৫৮ সালের ১লা নভেম্বর তারিখের ঐতিহাসিক ‘ঘোষণাপত্রে’ বলা হয়েছিল যে, বৃটিশ সরকার যে কোন ধরণের সম্প্রসারণ নীতি পরিহার করে চলবে, ভারতীয়রা তাঁদের যোগ্যতা অনুসারে সরকারি চাকরি পাবেন, এবং কোন আইন প্রণয়ন করবার ব্যাপারে তাঁদের মতামত গ্রহণ করা হবে। রাণী তাঁর ওই ঘোষণাপত্রে ভারতীয়দের সামাজিক ও ধর্মীয় ব্যাপারে কোন ধরণের সরকারি হস্তক্ষেপ না করবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। সেই সময় থেকে ভারতবর্ষ সরাসরিভাবে রাণীর শাসনাধীনে চলে যাওয়ার ফলে ভারতীয়রা বৃটিশদের অন্যান্য উপনিবেশের প্রজার সমান মর্যাদা ও অধিকার লাভ করেছিলেন। বলাই বাহুল্য যে, সেইসব ঘটনাগুলি ইংরেজদের প্রতি ভারতীয়দের বিরূপ মনোভাব পবিবর্তনের পক্ষে সহায়ক হয়েছিল। আবদুল লতিফ ও তাঁর সহযোগীরা প্রথমে ১৮৫৫ সালে ‘মহামেডান এসোসিয়েশন’ এবং পরে ১৮৬৩ সালে ‘মহামেডান লিটারেরি সোসাইটি’ গঠন করে তৎকালীন মুসলমান সমাজের ক্ষয়িষ্ণু অভিজাত শ্রেণীকে এবং শহরের মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে সঙ্ঘবদ্ধ করে তুলেছিলেন। তিনি ইংরাজি ভাষা ও পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষার কথা প্রচার করেছিলেন। সেযুগের সরকারি ও সওদাগরি অফিসে ইংরেজি জ্ঞান ছাড়া প্রবেশ করা সম্ভব ছিল না। মুসলমান সমাজোন্নতি সম্পর্কে তাঁর মত ছিল যে, মুসলমানদের বৃটিশ সরকারে প্রতি অনুগত থেকে চাকরিতে প্রবেশ করে নিজেদের ভাগ্যোন্নয়ন করতে হবে।
মুসলমানদের সমাজোন্নতির পথ ও পদ্ধতির ব্যাপারে সৈয়দ আমীর আলীও আবদুল লতিফের সাথে একমত ছিলেন। ১৮৭৮ সালে তাঁর প্রতিষ্ঠিত ‘সেন্ট্রাল ন্যাশনাল মহামেডান এসোসিয়েশন’ একটি রাজনৈতিক সংগঠন ছিল। তিনি সেই এসোসিয়েশনের মাধ্যমে ভারতীয় মুসলমান সমাজের বিভিন্ন দাবি-দাওয়াকে সরকারের কাছে তুলে ধরেছিলেন। ১৮৮২ সালে লর্ড রিপনের কাছে তাঁর প্রদত্ত বিখ্যাত ‘স্মারকলিপি’টি তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও সমকালীন সমাজ-চিন্তার একটি প্রকৃষ্ট ঐতিহাসিক দলিল। ওই স্মারকলিপিতে তিনি দাবি করেছিলেন যে, যেহেতু মুসলমানরা তখনও পর্যন্ত শিক্ষা দীক্ষার ব্যাপারে হিন্দুদের তুলনায় পিছিয়ে ছিলেন, সেহেতু চাকরিতে নিয়োগের ব্যাপারে মুসলমান প্রার্থীদের যোগ্যতা শিথিল করতে হবে এবং মুসলমানদের জন্য নির্দিষ্ট পদ-সংখ্যা সংরক্ষিত রাখতে হবে। (Ameer Ali: His Life and Works, P: 23-40) বলাই বাহুল্য যে, সেই সময়ে অগ্রসরমান হিন্দু সম্প্রদায়ের সঙ্গে মুলমান সম্প্রদায়ের তুলনা করে আমীর আলী মুসলমানদের জন্য ওই ধরণের বাড়তি সুযোগ-সুবিধা আদায় করতে চেয়েছিলেন। তিনি কোন ধরণের সাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে সেকাজ করেননি। তাঁর সংগঠনে নব্যশিক্ষিত মুসলমানদের সংখ্যাই বেশি ছিল। সমগ্র ভারতে তাঁর প্রতিষ্ঠিত এসোসিয়েশনের শাখা ছিল, সেই কারণে তখন তাঁর মতাদর্শ ও চিন্তাধারা কলিকাতা শহর ছেড়ে মফস্বল শহরেও বিস্তারলাভ করেছিল। তবে আবদুল লতিফ শুধুমাত্র মুসলমান সমাজের উপরতলার মানুষের উন্নতির কথা বলেছিলেন, যাদের সংখ্যা তখন খুবই নগণ্য ছিল। সাধারণ শ্রেণীর মুসলমানদের স্বার্থকে তিনি তাঁর আন্দোলনের সাথে জড়াতে চাননি, সেই কারণে তিনি শহর ও মফস্বলের বিভিন্ন শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে ভিন্ন ভিন্ন ভাষা ও বিদ্যা শিক্ষার বিধান দিয়েছিলেন। এখানেই আবদুল লতিফ ও আমীর আলীর চিন্তাধারার মধ্যে গুণগত পার্থক্য ছিল।
সেযুগের ইংরেজ রাজপুরুষেরা যখন কার্যভার গ্রহণ অথবা কর্মস্থল ত্যাগ করতেন তখন তাঁরা তাঁদের সংগঠনের মাধ্যমে সেইসব রাজপুরুষদের অভিনন্দন ও বিদায় সম্বর্ধনা দিয়ে মুসলিম সমাজের অভাব-অভিযোগগুলি তাঁদের সামনে তুলে ধরতেন। সেই কারণে সমকালের পত্র-পত্রিকাগুলি তাঁদের রাজনীতিকে আবদেন-নিবেদনের রাজনীতি বলে আখ্যায়িত করেছিল। (The Moslem Chronicle, 3rd October, 1896) আমীর আলী সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়ক বিবিধ রচনা প্রকাশ করেছিলেন। তিনি তাঁর এসোসিয়েশন এবং রচনার মাধ্যমে স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলিতে মুসলমানদের জন্য স্বতন্ত্র প্রতিনিধিত্ব দাবি করেছিলেন। অন্যদিকে সমকালের হিন্দুরা সেই বিষয়ে নির্বাচন প্রথার সমর্থক ছিলেন, কারণ — তখন তাঁরা মুসলমানদের থেকে সংখ্যায় বেশি ও যোগ্যতায় উন্নত ছিলেন। সেযুগের হিন্দুরা চাকরির ক্ষেত্রেও মেধা, দক্ষতা ও প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে নিয়োগের পক্ষপাতী ছিলেন। শিক্ষার ক্ষেত্রেও সুযোগ বৃদ্ধি ও সুবিধা বণ্টনের ব্যাপারে উভয় সম্প্রদায় তখন ভিন্ন ভিন্ন মত পোষণ করেছিল। মুসলমানরা তখন শিক্ষাক্ষেত্রে পিছিয়ে ছিলেন বলে আমীর আলী ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসের মত উচ্চ সরকারি পদে মনোনয়ন প্রথার দাবি জানিয়েছিলেন। মুসলমানদের দ্বারা পরিচালিত সমকালীন বাংলা ও ইংরেজি পত্র-পত্রিকাগুলি শিক্ষা ও চাকরি ক্ষেত্রে মুসলমানদের জন্য স্বতন্ত্র সুবিধা দেওয়ার ব্যাপারে জনমত প্রচার করেছিল। তাঁদের সেই আবেদন বিফলে যায়নি। ১৮৮৫ সালের ১৫ই জুলাই তারিখের একটি সরকারি গেজেটে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছিল যে, মুসলমানরা সরকারি চাকুরতে পূর্ণ অংশ পাচ্ছেন না; তাই এরপরে সুযোগ সৃষ্টি হলেই স্থানীয় সরকার ও উচ্চ আদালতসমূহ সেই বিষয়ে বৈষম্য দূর করবার চেষ্টা চালাবে এবং উক্ত সম্প্রদায়ের প্রার্থী নিয়োগ সংক্রান্ত নির্বাচন-অনুষ্ঠানে অধস্তন কর্মচারীদের উপরে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করবে। (Gazette of India, July 1885; The Moslem Chronicle, 15th August 1895, p- 344) মূল প্রস্তাবটি এরকম ছিল —
“The Governor-General in Council desires that in those Provinces where Muhammedans do not receive their full share of State employment, the Local Governments and the High Courts will endeavour to redress this inequality as opportunity offers, and will impress upon subordinate officers the importance of attending to this in their selection of candidates.”
এরপরে ১৮৯৭ সালের ১৫ই সেপ্টেম্বর তারিখে প্রচারিত সরকারি সার্কুলারে বলা হয়েছিল — “If there are two candidates for one appointment, each of them possessing the requisite qualifications, preference should be given to the Mohammedan candidate.” (Government Circular No. 588 42 T.G. Darjeeling, 15th September, 1897; The Moslem Chronicle, 16th July 1898) এটি তৎকালীন বাংলার শিক্ষা বিভাগের চাকরির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ছিল। বলাই বাহুল্য যে, সেই সময়ে বেকার সমস্যায় জর্জরিত হিন্দুরা বৃটিশ সরকারের সেই নীতিকে মোটেও প্রীতির চোখে দেখেননি। তাঁরা সেই সার্কুলারের বিরুদ্ধে সমালোচনা ও প্রতিবাদ করেছিলেন। হিন্দুদের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছিল যে, ‘মুসলমানের পিঠ চাপড়ানো’ — নীতির পেছনে বৃটিশ সরকারের ভেদনীতি কাজ করেছে এবং বৃটিশ সরকার মুসলমানদের প্রতি অতিরিক্ত পক্ষপাতিত্ব প্রদর্শন করেছিল বলে, তাঁদের — ‘গভর্ণমেন্টের পোষ্যপুত্র’ — বলে অভিহিত করা হয়েছিল। (নবনূর, আষাঢ়, ১৩১২ বঙ্গাব্দ, পৃ- ১২৩) এতে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে বিভেদের সৃষ্টি হয়েছিল এবং পারস্পরিক তিক্ততা আরও বৃদ্ধি পেয়েছিল। (ছবিতে — স্যার সৈয়দ আহমদ খান)
কুড়িয়ে পাওয়া বই
সাগর রহমান : লন্ডনের রাস্তায় চোখ-কান খোলা রাখলে অনেক কিছুই কুড়িয়ে পাওয়া যায়। হাঁড়ি-কুড়ি, থালা-বাসন, বাচ্চাদের খেলনা, আলমিরা, দেরাজ, সোফা থেকে শুরু করে ইস্তক কম্পিউটারের যন্ত্রপাতি পর্যন্ত- নানা ধরনের দিব্যি ব্যবহার যোগ্য জিনিস মানুষ রাস্তার পাশে, কিংবা নিজেদের বাড়ির সামনে সুন্দর করে রেখে দেয়, যাতে অন্য কারো ঐ জিনিসগুলো প্রয়োজন হলে নিয়ে যেতে পারে। ঘরে অপ্রয়োজনীয় জিনিসের জঞ্জাল না বাড়ানোই এর প্রধান উদ্দেশ্য অবশ্যই।
তবে এর পেছনে আরও একটি প্র্যাকটিক্যাল কারণ আছে। এদেশে জিনিস ফেলে দেওয়া রীতিমত ঝক্কির বিষয়। আপনি চাইলেই যেখানে সেখানে ফেলে দিতে পারছেন না। রীতিমত বড় ধরনের জরিমানার সম্মুখীন হতে হবে। জিনিস ফেলে দিতে চাইলে ফেলে দেওয়া জিনিসপত্র সংগ্রহ করেন- এমন প্রাইভেট বা কাউন্সিলের (সরকারি) সার্ভিসে যোগাযোগ করে, একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ ফি দিয়ে তবে ফেলে দেওয়া জিনিসের হাত থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। এদেশে প্রচুর চ্যারিটি শপ আছে।
মূলত সেকে-হ্যান্ড (কখনো কখনো একদম নতুন জিনিসও পাওয়া যায় অবশ্য, কোনো কোনো কোম্পানি বা ব্যক্তি বিভিন্ন নতুন জিনিস চ্যারিটি হিসেবে দান করে দেয়) জিনিসপত্র বিক্রি হয় ওসব জায়গায়, যার লভ্যাংশ বিভিন্ন সেবামূলক প্রতিষ্ঠানে খরচ করা হয়। অনেকেই তাদের পুরনো জিনিস এসব দোকানগুলোতে দিয়ে দেন। বেশিরভাগই বাড়ির সামনে- অন্য কেউ নিয়ে যাবেন- এ আশায় রেখে দেন।
কারো কারো ক্ষেত্রে অবশ্য রেখে দেন বললে ভুল বলা হবে, কেউ কেউ অনেক যত্ন করে, সুন্দর করে প্যাকেটে মুড়ে একদম নতুনের মতো রেখে দেন। লোকজনও দিব্যি এসব জিনিস নিয়ে যান, ব্যবহারযোগ্য হলে ব্যবহার করার আগে দ্বিতীয়বার ভাবেন না।
লন্ডনের রাস্তায় ফেলে রাখা জিনিসগুলোর মধ্যে যে জিনিসটা আমাকে সবসময় টানে, কিংবা, যে জিনিসটা রাস্তা থেকে তুলে নিতে আমার একটুও আপত্তি হয় না, সেটি হলো বই। এখানে প্রায়ই বিভিন্ন বাড়ির সামনে বই পাওয়া যায়। বিষয়টি নিয়ে লন্ডনের চিঠির কোনো এক পর্বে লিখেছিলাম বলেই মনে পড়ছে। অতএব, সে প্রসংগে বিস্তারিত না গিয়ে গত সপ্তাহে ওরকম করে পাওয়া একটা বইয়ের কথা বলি।
বাড়ি ফিরছিলাম। আমার বাসার গলিতে ঢোকার আগের গলিতে একটি বাড়ির সামনের রোয়াকে বইটি রাখা। নাম: দ্য ক্যাচার ইন দ্য রাই। লেখক: জে. ডি. সেলিংগার। প্যাপারব্যাক বই। নিউজপ্রিন্টে ছাপা ২২০ পৃষ্ঠার ছোট্ট পুস্তিকা। দিব্যি আছে বটে, তবে সময়ের দাগ এর সর্বত্র। পাতাগুলো খানিকটা হলদেটে হয়ে গেছে। ভাগ্য ভাল যে ইতোমধ্যে বৃষ্টি নামেনি। সামান্য বৃষ্টিতেই এই বই ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ত।
এই বই কিংবা লেখকের নাম আগে কখনো শুনিনি। সাধারণত বই পেলেই সেটা কেমন ধরনের বই সে চিন্তায় বেশি সময় ব্যয় না করে, এই কিছুদিন আগ পর্যন্তও বাসায় নিয়ে যেতাম। তারপর সময় সুযোগ করে পাতা উল্টানো এবং ভালো লাগলে পড়তাম। কিন্তু ইদানীং বইয়ের অতিরিক্ত সংখ্যাধিক্যের কারণে বাসায় বই রাখার বিষয়ে কিছু গৃহস্থালী নিষেধাজ্ঞার ভেতর দিয়ে যাচ্ছি। সুতরাং, রাস্তায় দাঁড়িয়েই বইটির পৃষ্ঠা উল্টে দেখার চেষ্টা করলাম, নিয়ে যাব কি না! খুবই সাদামাটা প্রচ্ছদ।
হালকা হলুদ রঙের ওপরে কয়েকটা সাদা রঙের লাইন। লাইনের ওপরে কালো হরফে বইয়ের শিরোনাম। কোনায় পেঙ্গুইন প্রকাশনীর লোগো। পেঙ্গুইনের লোগোটি স্বভাবতই একটি ভালো বইয়ের ইংগিত দিলো বটে, তবু ভেতরে উল্টালাম। বইটির প্রকাশকাল: ১৯৫১। অত পুরনো জানার পর বইটি হাতে নেওয়ার অনুভূতি নষ্টালজিক হয়ে পড়ল।
পৃষ্ঠা উল্টাতেই অপেক্ষা করেছিল একটি হাতে লেখা নোট: টনি নামক জনৈক ব্যক্তি সারাহ নামক কাউকে উদ্দেশ্য করে ইংরেজিতে দুই লাইনের নোট লিখেছেন, Sarah, this is one of the those books that ‘everyone should read’, / Hope you like it, most chapman did! lots of love, Toby. লেখার নিচে তারিখ দেওয়া আছে, সেপ্টেম্বর ১৯৬০। এই নোটটাই আমার কাজটা সহজ করে দিল। বইটা বগলদাবা করে, রাস্তা থেকে জিনিস কুড়িয়ে নিচ্ছি এমন কোনো অনুভূতিতে বিন্দুমাত্র পীড়িত না হয়ে বাসার দিকে রওনা হলাম। টনি নামক কেউ একজন সারাহকে আজ থেকে তিষট্টি বছর আগে এই বইটি উপহার দিয়েছিল এবং সারাহ যাতে বইটি পড়ে, সেজন্য নোট হিসেবে বইটি যে কত ভাল বই- যা প্রত্যেকের পড়া উচিত, সে সার্টিফিকেট দিয়েছিলেন ছন্দের সামান্য জাদু ব্যবহার করে।
সারাহ‘র জন্য এই মন্তব্য কাজে লেগেছিল কি-না, জানার কোনো উপায় নেই, কিন্তু আমার জন্য ঠিকই কাজে লেগে গেল। পেঙ্গুইন পাবলিকেশন্সের সুনাম, আর জনৈক টনির নোট – দুয়ের উৎসাহে বইটি পড়তে শুরু করলাম, এবং শুধু প্রথম বাক্য পড়েই সিদ্ধান্ত নিলাম সত্যিই পড়ার মতো বই বটে!
টনির নোটে ব্যবহার করা চ্যাপম্যান শব্দটা ঠিক পরিচিত ছিল না। মোস্ট চ্যাপম্যান- মানে কী! মোস্ট মানে বেশির ভাগ, চ্যাপম্যান মানে? গুগল করতেই জানা গেল, মারিয়াম-ওয়েবষ্টার ডিকশানারির মতে, শব্দটার মানে হলো ব্যবসায়ী বা দোকানদার। বারো শতকের দিকে প্রচলন হওয়া এই শব্দটার আরেকটি ব্রিটিশ অপভ্রংশ ব্যবহার আছে, যা এমন ব্যাক্তিকে বোঝায় যে বেআইনি ড্রাগের বা মালের ব্যবসা করে।
আমাদের আলোচ্য নোটের একটি গ্রহণযোগ্য মানে বের করার জন্য প্রথমোক্ত অর্থটাই যদি ধরে নেই, তবে কি ধরতে পারি জনৈক টনি মোস্ট চ্যাপম্যান বলতে জ্ঞান বা কৃষ্টি নিয়ে কাজ-কারবার করেন, এমন ব্যক্তিদেরকে রূপক অর্থে ব্যবহার করেছেন এবং সারাহকে বলতে চাইছেন যে, এটি একটি ভালো ও পছন্দনীয় বই। কেননা, বেশিরভাগ জ্ঞানীরাই বইটিকে পছন্দ করেছেন।
টনি কিংবা সারাহ কে ছিলেন এবং তারা কে কার কী হন বা হতেন? বাবা- মেয়ে? প্রেমিক-প্রেমিকা? উনারা কি বেঁচে আছেন? এসব জানার কোনো দরকার তো নেই- অবশ্যই, কিন্তু বইটা যতক্ষণ পড়ি, অবচেতন মনে এই বইয়ের বর্ণাঢ্য চরিত্র ছাড়াও টনি এবং সারাহ আসা যাওয়া করতে থাকেন। আজ থেকে তেষট্টি বছর আগে, সেপ্টেম্বরের এক সন্ধ্যায় ( কিংবা বিকেলে, সকালে হতেও বা দোষ কোথায়?) সারাহ নামক এক তরুণীর (তরুণীই হবে, বয়স্ক হলে হয়তো তাকে বইটা পড়তে উৎসাহিত করার জন্য অমন ছড়া লেখার প্রয়োজন পড়ত না) হাতে এই বইটি এসে পড়েছে।
হয়তো সেদিন তার জন্মদিন। নাহ, জন্মদিন নয় বোধ হয়। তাহলে জন্মদিনের কথাটা যে কোনো ভাবে হোক নোটে এসে পড়ত। হয়তো কোনো উপলক্ষই নয়। টনির ভীষণ বইপড়ার স্বভাব। এই বইটা পড়ে তার খুব ভালো লেগে যায়। আর তাতেই তার মনে হতে লাগল সারাহর (সারাহ তার কে হন, তা জানি না) বইটি পাঠের আনন্দ পাওয়া উচিত। তৎক্ষণাৎ কলম টেনে তিনি দুই লাইনের ছড়াটি লিখলেন এবং উপহার দিলেন সারাহকে। সারাহ কি বইটি পড়েছিল? পড়ে আনন্দ পেয়েছিল? অন্য চ্যাপম্যানদের মতো পছন্দ করেছিল? জানি, এই অর্থহীন কৌতূহলের কোনো মানে নেই। তবু বইটি পড়তে পড়তে এসব মনে হচ্ছে। ঐদিনের পর থেকে ঐ বাসার সামনে দিয়ে যতবার আসা-যাওয়া করি, ততবার মনে হতে থাকে, আচ্ছা, ঐ বাড়ির দরজায় কড়া নেড়ে একদিন সারাহ এবং টনি নামক ব্যক্তিদের খোঁজ করলে কেমন হয়। মানুষ হওয়ার যন্ত্রণা হলো, যত কিছু আমরা ভাবি দৈনন্দিন, তার সিকি ভাগও প্রকাশ করা যায় না। তবে ঠিক করেছি, বইটি যদি শেষ পর্যন্ত সত্যি সত্যি ভালো লেগে যায়, তবে কে জানে, হয়তো কোনো এক বিকেলে ঐ বাড়ির দরজায় কড়া নেড়ে বসব, বলব মি. টনি (কিংবা মিসেস সারাহ) আছেন?, বাকি যা থাকে কপালে! ২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪
বই বিক্রির সন্মানী নিয়ে লেখক প্রকাশকদের দ্বন্ধ
শান্তনু চৌধুরী : সদ্য শেষ হওয়া অমর একুশে গ্রন্থমেলায় প্রায় ৬০ কোটি টাকার বই বিক্রি হয়েছে বলে জানা গেছে বাংলা একাডেমির পক্ষ থেকে। যদিও এটি কাগজে কলমে। বাস্তবে আরো বেশি। এই বিক্রি গত বছরের তুলনায় ১৩ কোটি টাকা বেশি। কিন্তু এর থেকে যারা বই লিখলেন তারাই বা কতো টাকা পেলেন? জানি সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া মুশকিল। আমাদের দেশে বই বিক্রির সন্মানী নিয়ে লেখক প্রকাশকদের দ্বন্ধ বহুকালের পুরনো। অনেকটা সৈয়দ মুজতবা আলীর বই বিক্রির সেই গল্পের মতো। পাঠক বই কিনছেন না বলে দাম কমছে না, আবার দাম কমছে না বলে পাঠক বই কিনতে পারছেন না। তেমনি বই প্রকাশ করার পর বই বিক্রি হলেও লেখকদের প্রাপ্য টাকা দিতে প্রকাশক নানা টাল বাহানা এমনকি মিথ্যার আশ্রয়ও নিয়ে থাকেন। তবে প্রকাশকদের পক্ষ থেকে যেটা বলা হয়ে থাকে, অনেক লেখকের বই গুদামে পড়ে থাকে এবং এতে করে তাদের লোকসান গুণতে হয়। এ বিষয়ে প্রথমেই কথা বলতে চেয়েছিলাম অপেক্ষাকৃত নবীন লেখকদের সঙ্গে। কিন্তু তারা এ বিষয়ে কথা বলতে চাননি এবং অনেকেই ভেবেছেন তারা এ বিষয়ে কথা বলার যোগ্য নন। কেউ কেউ মনে করেছেন তারা যদি এ বিষয়ে কথা বলেন তাহলে ভবিষ্যৎ এ প্রকাশকরা তাদের বই প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকতে পারেন।
রম্য লেখক ও কার্টুনিস্ট আহসান হাবীব বলেন, ‘’লেখককে প্রকৃতপক্ষে বই বিক্রির টাকা বা সন্মানী পাওয়ার যোগ্য হয়ে উঠতে হবে আগে। তিনি যে টাকাটা পাওয়ার মতো বই লেখেন মানে বই প্রকাশ করে প্রকাশক লাভবান হবেন সেই অবস্থানে তাকে যেতে হবে।’
অন্বেষা প্রকাশনের শাহাদাত হোসেন বলেন, ‘এই অভিযোগটা নতুন নয়, অনেক পুরনো। তবে আমাদের দেশে যেটা হয় সাধারণত আমরা চুক্তি করি না। এটা লেখকও করে না প্রকাশকও করে না। দায়টা যদিও প্রকাশকের। চুক্তি থাকলে চুক্তিতে সব বিষয়ে উল্লেখ থাকলে এ বিষয়টা সমাধান করা সম্ভব। দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে- অনেকের একটা বই ছাপানোর পর আমরা এক বছর বা দুই বছর দেখি বইটি বিক্রি হয় কি না। দুই বছর বিক্রি না হলে সেই বইটা কিন্তু পরবর্তীতে গোডাউনে চলে যায়। অনেক সময় সেটা কেজি দরে বিক্রি করে দেই। লেখকও অবগত থাকে না একটা দূরত্ব তৈরি হয়। সেক্ষেত্রে সবচেয়ে সহজ সমাধান হচ্ছে চুক্তি করা এবং চুক্তি করলে আমার মনে হয় বিষয়টি সহজে সমাধান হবে’।
কথাসাহিত্যিক স্বকৃত নোমান মনে করেন, ‘এটা সব প্রকাশক তা না। যাদের বই পাঁচশ কপি বিক্রি হয় তাদেরকে প্রকাশক রয়্যালিটি দিতে বাধ্য তাদের স্বার্থেই। কারণ একজন লেখকের যখন পাঁচশ কপি বই বিক্রি হয় তখন প্রকাশকের বিনিয়োগটা উঠে লাভও থাকে। তিনি তো একজন ব্যবসায়ী, বিনিয়োগ যদি না উঠে তাহলে লেখকের রয়্যালিটি দেওয়া সম্ভব হয় না। আমি অনেক প্রথম সারির প্রকাশকের কথা জানি, যারা ঠিকমতো টাকা দেন। কিন্তু এমন লেখককেও জানি যাদের বই একশত কপিও বিক্রি হচ্ছে না তাদের সঙ্গে প্রকাশকের একটা দ্বন্ধ তৈরি হয়। স্বাভাবিক ব্যাপার যে, আড়তদার যে পণ্যটা বেশি বিক্রি হয় সে সেটা বেশি রাখবে এবং পণ্যটা বিক্রি করে তাকে টাকাটা দিয়ে দেবে। তারপরও কিছু কিছু প্রকাশক আছেন যারা অসদুপায় অবলম্বন করে, যেমন কোনো কোনো বই ছাপে ৫০০ কপি কিন্তু বলে ২০০ কপি। আমি মনে করি যারা সত্যিকার প্রকাশক রয়েছেন তারা যদি লেখকের রয়্যালিটি ঠিকমতো দেন তাহলে যারা অসততা করে তারা বেশিদিন টিকতে পারবে না’।
লেখক পলাশ মাহবুব এর কাছে জানতে চেয়েছিলাম বিষয়টি নিয়ে। তিনি বলেন, ‘লেখক সম্মানীর ক্ষেত্রে স্বচ্ছতার বিষয়টি এখনো প্রশ্নবিদ্ধ। কিছু কিছু প্রকাশক পেশাদারিত্বের সঙ্গে কাজটি করে থাকেন আবার এ কথাও সমান সত্য অনেক প্রকাশক এক্ষেত্রে পেশাদারী আচরণ করছেন না এবং তাদের সংখ্যাটিই বড়। যেহেতু গত প্রায় দুই যুগ ধরে আমার বই প্রকাশ হচ্ছে, ফলে দুই ধরনের অভিজ্ঞতাই মধ্য দিয়েই আমাকে যেতে হয়েছে। যে কারণে অভিজ্ঞতার আলোকে গত এক দশক যাবৎ আমি তাই তুলনামূলক পেশাদার প্রকাশকদের সঙ্গে কাজ করছি। আমার কাছে মনে, স্বচ্ছতার সঙ্গে যেহেতু সততার বিষয়টি জড়িত তাই এক্ষেত্রে পরিবর্তন আনতে হলে শেষোক্ত বিষয়টির চর্চা বাড়াতে হবে’।
ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ এর প্রকাশক আদিত্য অন্তর এর মতে, ‘যারা রয়্যালটি পাওনা সত্যিকার অর্থেই হয়ে থাকেন তারা ঠিক মতোই পেয়ে থাকেন। একজন লেখক যদি মনে মনে ধরে নেন তিনি রয়্যালটি পান, কিন্তু আদতে যদি পাওনা না হয়ে থাকেন তাহলে প্রকাশকের বিরুদ্ধে তিনি নানা কথা বলতেই পারেন। সেজন্য বই প্রকাশের পূর্বেই যথাযথ চুক্তি সম্পাদন করা উচিত। তাহলে কেউ কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে পারবেন না’।
জাতীয় কবিতা পরিষদের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক কবি শরাফত হোসেন বলেন, ‘আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি, প্রকাশকরা বই বিক্রির সঠিক হিসাব দেন না। যা দেন তারও সম্মানী দিচ্ছি-দেব বলে সময়ক্ষেপণ করেন। আসলে লেখকদের সম্মানী প্রদানের ক্ষেত্রে প্রকাশকদের একরকম উদাসীনতা আছে, যা সত্যি দুঃখজনক। এখানে পেশাদারিত্বের ঘাটতি রেয়েছে, সেকারণেই আমাদের দেশে প্রকাশনা শিল্প সেই অর্থে দাড়াচ্ছে না। এর দায় লেখক-প্রকাশক উভয়েরই’।
লেখক জয়দীপ দে শাপলু মনে করেন, ‘প্রকাশকরা পেশাদারী হয়ে উঠছেন না। তারা মনে করেন, লেখককে ঠকাতে পারলে বিরাট একটা লাভ হলো। কিন্তু প্রকারান্তরে তাদেরই ক্ষতি হয়। লেখকরা লেখালেখিতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে’।
বোদ্ধা পাঠকরা মনে করেন, লেখক প্রকাশকের এই অভিযোগ পাল্টা অভিযোগ কখনো শেষ হওয়ার নয়। তবে প্রকাশকের দিকে অভিযোগের পাল্লাটা বেশি। কারণ তিনি কম্পোজিটর, কাগজ, ছাপাখানা থেকে বাঁধাই সবার টাকা পরিশোধ করতে পারলেও বইটির যিনি স্রষ্টা তার পরিশ্রমের মূল্য দিতে গড়িমসি করেন। আবার অনেকে শুধু ‘বই প্রকাশের জন্যই প্রকাশ করা’র কারণে অসৎ প্রকাশকরা সুযোগটি লুফে নেন বলে মনে করেন তারা। ৬ মার্চ ২০২৪
প্রলোভনের করুণ পরিণতি
রাজীব আহাম্মদ : ইউরোপ যেতে পারলেই উপার্জন করা যাবে কোটি কোটি টাকা। আসবে সচ্ছলতা, একদিন হবে বিত্তবৈভব। এমনই উন্নত জীবনের মোহে লাখ লাখ টাকা খরচ করে বিদেশ পাড়ি দিতে গিয়ে ভূমধ্যসাগরে ডুবে মরছেন বাংলাদেশি তরুণরা। অবৈধ পথে যাত্রা বন্ধে নানা উদ্যোগ ও প্রচার থাকলেও তা কোনো কাজে আসছে না।
দেশে বেকারত্ব, বৈধ পথে ইউরোপে যাওয়ার সুযোগ কম থাকায়, সাগর, তুষার ও বনভূমি পাড়ি দেওয়ার ঝুঁকি নিচ্ছেন তারা। গত ১৪ ফেব্রুয়ারি ইতালির পথে ভূমধ্যসাগরে প্রাণ গেছে আট বাংলাদেশির।
জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ থেকে ২০২৩ সালের জুলাই পর্যন্ত শুধু ইতালিতে অবৈধভাবে পাড়ি দিয়েছেন ২২ হাজার ৭৭৮ বাংলাদেশি, যা দেশটিতে মোট অবৈধ অভিবাসীর ১৪ শতাংশ। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) মিসিং মাইগ্রেন্টের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, আগের বছরগুলোর তুলনায় ভূমধ্যসাগরে ডুবে মৃত্যু এবং নিখোঁজের সংখ্যা বাড়ছে। ২০২১ সালে ২ হাজার ৪৮ জন, পরের বছর ২ হাজার ১১ এবং ২০২৩ সালে ৩ হাজার ৪১ জন নিখোঁজ অথবা ডুবে মারা গেছেন ভূমধ্যসাগরে। তাদের মধ্যে কয়েকশ বাংলাদেশি বলে ধারণা করা হচ্ছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের পরিসংখ্যান দপ্তর ইউরোস্ট্যাটের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৯ সাল পর্যন্ত সোয়া ১ লাখ বাংলাদেশি অবৈধভাবে জোটভুক্ত দেশগুলোতে ছিলেন। ইউএনএইচসিআরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে ইতালিতে অবৈধভাবে ১৫ হাজার ২২৮ জন এবং ২০২১ সালে ৭ হাজার ৮৩৮ জন যান, তাদের ৯৮ শতাংশই লিবিয়া হয়ে।
লিবিয়ার বাংলাদেশ দূতাবাস জানিয়েছে, গত ১৪ ফেব্রুয়ারি অভিবাসনপ্রত্যাশী একটি দল নৌকায় করে লিবিয়ার জুয়ারা উপকূল থেকে ইউরোপের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে। নৌকাটি তিউনিসিয়ার উপকূলে ডুবে যায়। এতে চালকসহ ৫৩ জন ছিলেন। আট বাংলাদেশিসহ ৯ জন ডুবে মারা গেছেন। উদ্ধার করা ৪৪ জনের ২৭ জনই বাংলাদেশি। প্রাণ হারানো আটজনের পাঁচজন মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার এবং বাকি তিনজন গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর উপজেলার।
আফগানিস্তান, সিরিয়া, লিবিয়া ও ইরাকের মতো যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের অনেক নাগরিক প্রাণ বাঁচাতে অবৈধ পথে ইউরোপ যান। বাংলাদেশিরা কেন যাচ্ছেন– এ প্রশ্নের জবাবে পাওয়া যায়, যত বাংলাদেশি লিবিয়া, ভূমধ্যসাগর হয়ে ইতালি যান, তাদের বড় অংশ বৃহত্তর ফরিদপুরের। এই পথ ধরে যাওয়া প্রবাসী বাংলাদেশিরা সমকালকে জানিয়েছেন, প্রায় দুই দশক ধরে এভাবে দেশান্তর হচ্ছেন অনেকে। আগে সরাসরি লিবিয়া যাওয়া যেত। কিন্তু ২০১১ সালে দেশটিতে গৃহযুদ্ধ এবং ভূমধ্যসাগরে ডুবে মৃত্যুর কারণে এখন আর যাওয়া যায় না।
জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৩ সালে বৈধভাবে লিবিয়ায় চাকরি নিয়ে গেছেন মাত্র ৯৪ বাংলাদেশি। ইউরোপে পাড়ি জমানো বাংলাদেশি এবং ১৪ ফেব্রুয়ারি ডুবে মারা যাওয়া তরুণদের পরিবার সূত্রে জানা গেছে, দালালের মাধ্যমে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে প্রথমে যেতে হয় দুবাই। সন্দেহ হলে ইমিগ্রেশন ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমাবন্দরে ইমিগ্রেশন আটকে দেয়। তাই সড়কপথে প্রথমে ভারতে যান অবৈধভাবে ইউরোপগামীরা। মুম্বাই থেকে আকাশপথে দুবাই যান। সেখান থেকে সরাসরি লিবিয়া, আবার কোনো ক্ষেত্রে সুদান বা মিসর থেকে লিবিয়া নেওয়া হয়।
জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সংগঠন বায়রা সভাপতি আবুল বাশার সমকালকে বলেছেন, সাগরপথে ইউরোপ পাঠানোর কাজে কোনো রিক্রুটিং এজেন্সির সংশ্লিষ্টতা নেই। পুরোটাই দালালভিত্তিক।
আদম ব্যবসায়ীদের সূত্র জানিয়েছে, বাংলাদেশের গ্রামে গ্রামে, বিশেষত মাদারীপুর, শরীয়তপুর, গোপালগঞ্জজুড়ে রয়েছে ‘রিক্রুটার’। এরা প্রথম ধাপের দালাল, যারা মূল দালালের হয়ে ইউরোপ যেতে ইচ্ছুক যুবকদের সংগ্রহ করে। মূল দালালরা গ্রাম থেকে তরুণ ও যুবকদের লিবিয়া পর্যন্ত পাঠায়। সেখানে থাকে আরেক দালাল চক্র। তারা অভিবাসনপ্রত্যাশীদের কয়েক মাস পর্যন্ত লিবিয়ায় নিজেদের জিম্মায় রাখে। তারপর সময়-সুযোগ বুঝে নৌকায় করে ইউরোপে পাঠায়। এই প্রক্রিয়াকে ‘গেম’ বলা হয়। ইতালির কোস্টগার্ড নৌকা ফিরিয়ে দিলে, কয়েকদিন পর আবার পাঠায়। লিবিয়া, তিউনিসিয়া এবং ইতালিতে যাতে নৌকা না আটকায় সেজন্যও দালাল রয়েছে।
স্থানীয় দালাল সূত্র জানিয়েছে, বর্তমানে ইতালি যেতে ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত লাগে। তবে শুরুতে অভিবাসনপ্রত্যাশীকে বলা হয় ৭-৮ লাখ টাকা লাগবে। এর পর লিবিয়ায় নিয়ে আটকে আরও ৭-৮ লাখ টাকা নেওয়া হয়। টাকা আদায়ে মারধর, খুন পর্যন্ত করা হয়। লিবিয়ায় আবার দালালদের অনেক দল-উপদল রয়েছে। এক দালাল চক্র আরেক চক্রের আনা অভিবাসনপ্রত্যাশীকে জিম্মি করে। মারধর করে মুক্তিপণ আদায় করে। ২০২০ সালের মে মাসে ২৬ বাংলাদেশি গুলিতে মারা গিয়েছিল দুই দালাল চক্রের দ্বন্দ্বে।
মাদারীপুর, শরীয়তপুর ও গোপালগঞ্জে ‘গেম’ কথাটি ঘরে ঘরে পরিচিত। ইতালির সিসিলিতে থাকা তারিকুল ইসলাম মুন্সি সমকালকে বলেন, এ দেশে মাদারীপুর, শরীয়তপুর ও গোপালগঞ্জের হাজার হাজার মানুষ থাকেন। তাদের বড় অংশ ‘গেম’ করে এসেছেন। যারা দেশে আছেন, তারাও ইউরোপে থাকা স্বজনের আয়-উন্নতি দেখে একই পদ্ধতিতে আসতে চান। এ কারণেই সাগর পাড়ি দেওয়া বন্ধ হয় না। বাবা-মা জমি বিক্রি করে, সুদে ঋণ নিয়ে ছেলেকে সাগরপথে পাঠান। বড়লোক হওয়ার মোহ না কাটা পর্যন্ত ‘গেম’ বন্ধ হবে না।
ডুবে মারা যাওয়া আটজনের স্বজন জানিয়েছেন, সবাই বাড়িতে জানিয়ে ইতালির পথে যাত্রা করেছিলেন। তাদের অভিযোগ, গোপালগঞ্জের মুকসুদপুরের গজারিয়া গ্রামে রহিম শেখ ও রাঘদি ইউনিয়নের সুন্দরদী গ্রামের বাদশা কাজীর ছেলে মোশারফ কাজী জনপ্রতি ১২ থেকে ১৫ লাখ টাকা নিয়ে এই আট যুবককে পাঠিয়েছিলেন। রাজৈরের নিহত সজীব কাজীর বাবা মিজানুর রহমান কাজী টেলিফোনে সমকালকে বলেন, দালাল রহিম শেখের সঙ্গে ১৪ লাখ টাকা চুক্তি হয়। তার ভাই কামাল নগদ ১২ লাখ টাকা নিয়ে ছেলেকে লিবিয়া পাঠায়। ছেলে বলেছিল ‘গেম’ হবে।
রাজৈরের আরেক নিহত সজল বৈরাগীর বাবা সুনীল বৈরাগী বলেন, টাকার লোভে ছেলেকে স্বপ্নের দেশ ইতালি পাঠাতে চেয়েছিলাম। জমি বিক্রি করে দালালের কাছে টাকা দিয়েছি। এখন আমার সবই শেষ হয়ে গেল। নৌকাডুবির পর থেকে দালালরা এলাকাছাড়া। তাদের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। মাদারীপুরের পুলিশ সুপার মাসুদ আলম বলেন, দালালদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে সাধারণ মানুষকেও সচতেন হতে হবে। তা না হলে এমন মৃত্যু কমবে না।
অবৈধ অভিবাসন বন্ধে ২০২১ সাল থেকে কৃষিসহ মৌসুমি শ্রমিক নিয়োগ করছে ইতালি। ২০২৩ সালে রেকর্ড ১৬ হাজার ৮৭৯ বাংলাদেশি কর্মী দেশটিতে চাকরি নিয়ে যান। আগের বছর যান ৭ হাজার ৫৯৪ জন। অবৈধ অভিবাসন বন্ধে সচেতনতা সৃষ্টিতে ২০২২ সালের জুলাইয়ে শরীয়তপুরে গিয়ে প্রচার চালান পুলিশের মহাপরিদর্শক, পররাষ্ট্র সচিব, প্রবাসীকল্যাণ সচিব এবং ঢাকায় নিযুক্ত ইতালির রাষ্ট্রদূত। কিন্তু তাতে ফল হয়নি। যারা ইতালিতে চাকরি করতে যাওয়ার দক্ষ নন কিংবা ভিসা পাচ্ছেন না, তারা সাগরপথই বেছে নিচ্ছেন।
গত বছর বাংলাদেশ থেকে রেকর্ড ১৩ লাখ কর্মী চাকরি নিয়ে বিদেশ যান। বৈধ পথ খোলা থাকলেও, কেন তরুণরা মৃত্যুপথে ইউরোপ যাচ্ছেন– এর জবাবে জনশক্তি খাত সংশ্লিষ্টরা জানান, মধ্যপ্রাচ্য, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে শ্রম দিতে যান দরিদ্র পরিবারের সন্তানরা। গ্রামের অবস্থাসম্পন্নরা সামাজিক অবস্থানের কারণে শ্রমিকের কাজ করতে চায় না। তারা দালাল ধরে ইউরোপ বা আমেরিকা যাওয়ার চেষ্টা করে।
অভিবাসী কর্মী উন্নয়ন প্রোগ্রামের (ওকাপ) নির্বাহী পরিচালক শাকিরুল ইসলাম বলেন, ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে প্রবেশে চেষ্টাকারীদের এক-তৃতীয়াংশ ধরা পড়ে বা ডুবে মারা যান। বাকি দুই-তৃতীয়াংশ কোনো না কোনোভাবে প্রবেশ করেন। যারা ব্যর্থ, তাদের কথা আসে না। যারা দেশে টাকা পাঠিয়ে দালান তোলেন, তাদের দেখে বাকিরা উৎসাহিত হয়। তাই উৎসমুখে তরুণদের থামাতে হবে। এ জন্য তাদের জন্য নিরাপদ অভিবাসন বাড়াতে দক্ষ কর্মী তৈরি করতে হবে। দক্ষতা এবং দেশে কর্মসংস্থান না থাকলে তরুণরা অবৈধ পথে পা বাড়াবেই। ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪