আর্কাইভ

Archive for এপ্রিল, 2012

প্রেম, পরিণতি ও করণীয়

বিলকিস আক্তার : ইদানিং রাস্তাঘাটে বের হলে মনে হয় চোখ বন্ধ করে রাখতে পারলে ভাল হতো। কোন অপ্রীতিকর ও অসামাজিক কর্মকান্ড তাহলে চোখে পড়ত না। কিন্তু যাদের দৃষ্টি শক্তি নাই তাদের কথা ভিন্ন আর যাদের চোখ আছে তারা কতক্ষণ চোখ বন্ধ করে চলবে? তবুও উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েরা যেভাবে চলাফেরা করে তাতে চোখ বন্ধ না করে কোন উপায় আছে? তাদের ভাবসাব দেখলে মনে হয় আমরা ভুলে ভীনগ্রহে চলে এসেছি। যে গ্রহের নিয়ম কানুন সম্পূর্ণই আমাদের থেকে আলাদা। ছেলেরা হাতে চুড়ি, ব্যাজ, কানে দুল, গলায় মোটা বড় বড় মালা আর মেয়েরা টাইট জিনস (যা টাকনুর বহু উপরে উঠানো) পরিহিতা, এ যেন উভয়েই ছেলেকে মেয়ে ও মেয়েকে ছেলে হইতে চাওয়ার আমরণ প্রচেষ্টা। মাত্র কয়েক বছরে দেশ এতটা অগ্রগতি (?) লাভ করেছে যে ভাবতে অবাক লাগে। আসলে এ সবই কি পরিবেশ ও যুগের দোষ? নাকি ছেলেমেয়েদের দোষ? নাকি পিতা-মাতাই এর জন্য দায়ী? আমাদর শিক্ষা ব্যবস্থা কি এর জন্য দায়ি নয়? সামাজিক অবক্ষয় কেন হচ্ছে এর রোধ করার কি কোন উপায় নেই? হাজারো প্রশ্ন তখন, মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে। অলিতে, গলিতে, পার্কে, স্কুল-কলেজ সর্বত্রই যেন প্রেমের ছড়াছড়ি। এ যেন লাইলি মজনুকেও হার মানিয়ে দিবে। এ যুগের ভালবাসা বলে কথা! যত্রতত্র এত ভালবাসার ছাড়াছড়ি তারপরও কি সামজে, সত্যি ভালবাসা আছে? যে ভালবাসার টানে দীর্ঘ রত্তের সম্পর্ককে অস্বীকার করে বেরিয়ে যাচ্ছে অল্প পরিচিত মানুষটির হাত ধরে সেখানেই বা কি নিজেকে সুখী করতে পারছে। মরিচীকার মতো ছুটেই চলেছে ভালবাসা নামক অলীক বস্তুটিকে আপন করে পাওয়ার জন্য। অব্যর্থভাবে চেষ্টা চালানোর পরও তারা ব্যর্থ হচ্ছে ভালবাসার প্রজাপতিটিকে ধরতে। আমাদের সমাজের ভুল পথে ভালবাসাকে পাওয়ার এই প্রচেষ্টা থেকেই আমার আজকের কলম ধরা।
প্রেম কি : নারী ও পুরুষের মধ্যকার যে সম্পর্ক তার নামই প্রেম। অথবা বিপরীত ধর্মী লিঙ্গ একজন আর একজনের জন্য নিজের জান, নিজের বিশ্বাস ও নিজস্ব অস্তিত্ব সপে দেয়ার নামই প্রেম বা ভালবাসা। আল্লাহ সোবহানাহু তায়ালা পবিত্র কুরআনে এভাবে বলেছেন, ‘‘এবং তার নিদর্শন সমূহের মধ্যে একটি নিদর্শন হচ্ছে- তিনি তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের জোড়া সৃষ্টি করেছেন। যেন তোমরা তার কাছে মানসিক শান্তি লাভ করতে পারো। আর তিনি তোমাদের মধ্যে ভালবাসা ও আন্তরিকতা সৃষ্টি করে দিয়েছেন।’’ (সূরা রুম, ২১)। প্রেমের সংজ্ঞায় আল্লাহ আরো বলেছেন, ‘‘তিনি আল্লাহ যিনি তোমাদেরকে জোড়া হিসেবে তৈরি করেছেন যেন তোমরা একে অপরের কাছ থেকে শান্তি ও আরাম পাও। ’’ (সূরা আরাফ-১৮৯)। সাথী বা জোড়কে কুরআনে ‘আযওয়াজ’ নামে অভিহিত করা হয়েছে। বহু কবি সাহিত্যিকরা রঙ তুলিতে প্রেমের বহু সংজ্ঞা দাঁড় করিয়েছেন, কিন্তু আমার আল্লাহর সংজ্ঞার চাইতে কোনটা কি উত্তম হয়েছে?
কখন হয় এই প্রেম : প্রেমের কোন বয়স নাই
নাই কোন তার রং
প্রেমে পড়ার সময় যে সব সময়।
হ্যাঁ, ঠিক তাই। সাদা, কাল, ভাল, মন্দ এই সব প্রেম নির্বাচন করতে পারেনা। যে কোন বয়সে যার তার সাথে প্রেমে পড়তে দেখা যাচ্ছে। এক দশক ধরে এই জিনিসটা বেশি দেখা যাচ্ছ অবিবাহিত ছেলেরা ২-৩ বাচ্চার মার প্রেমে পাগল হয়ে তার জন্য সব করতে পারছে, মহিলারা স্বামীকে রেখে অন্য পুরুষের হাত ধরে বেরিয়ে যাচ্ছে। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা প্রেমের সেঞ্চুরি করছে। কুরআনে এইগুলোকে আল্লাহ বলেছেন বেশি পাওয়ার লোভ তাদেরকে গাফেল করে রেখেছে।
প্রেমের সামাজিক অবক্ষয়গুলো : ‘প্রেম’ সমাজের একটি বিষাক্ত দাহ্য পদার্থ। যা একটি পরিবারে অনুপস্থিত থাকলে পরিবারটি হয় বিষাক্ত। আর ইসলামের বিপরীত প্রেমের ফলে হয়ে উঠে দেশ, জাতি ও সমাজ বিষাক্ত। এই ইসলামের বিপরীত প্রেমের সয়লাবে আমাদের সমাজ মাতোয়ারা। ফলে নৈতিক দিক থেকে আমরা হয়ে পড়েছি মেরুদন্ডহীন প্রাণী কোঁচোর মতো।
প্রেমের কারণে ভেঙে যাচ্ছে সংসার, সন্তানরা হচ্ছে দিশেহারা পারিবারিকভাবে হতে হচ্ছে হেয় প্রতিপন্ন। লজ্জায় অপমানে একটা পরিবার সামাজিকভাবে বয়কট এর পথে হাঁটছে। নিম্নে প্রেমের সামাজিক অবক্ষয়গুলো তুলে ধরা হলো :
অবাধ মেলামেলা : ছেলে মেয়েতে অবাধ মেলামেশার ফলে প্রেমের ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা এর প্রধান কারণ। এক সাথে ছেলেমেয়েতে চলাফেরা না করলে আবার তথাকথিত মুক্ত চিন্তা বিদদের (ইসলামের চিন্তা থেকে মুক্ত) ভাষায় ছেলেমেয়েরা ব্যাকডেটেড হয়ে যায়। তাই তাদের মত করে যুগটাকে সাজাতে গিয়েই প্রেমের হার আরো বেড়েছে।
অবাধ নারী স্বাধীনতা : মনে হয় নারীরা আগে পরাধীন ছিল এখন তারা বহু রঙের বিনিময়ে বহু মা, বোনের ইজ্জতের বিনিমযে নারী স্বাধীনতা অর্জন করেছে। আসলে কিন্তু তা নয়। নারী পুরুষের সমান অধিকার পাওয়ার জন্য যে চেষ্টা সৃষ্টির শুরু থেকে আজ অবধি চলে এসেছে তা কিন্তু পুরুষের কলকাঠি নাড়ানোর কারণেই। নৈপথ্যে থেকে পুরুষই নারীকে স্বাধীনতা আদায় করার জন্য ঘর থেকে বের করিয়ে এনেছে। বোকা নারীরা সেই সমস্ত পুরুষের হাতেই তাদের সতীত্ব হারাচ্ছে। সব হারিয়ে যখন নিঃস্ব, বেহায়ার মত তখনই পুরুষের মন খুশি করার জন্য বলছে আমরা নারী স্বাধীনতা চাই। আমরা এর বিরুদ্ধে কঠোর কর্মসূচির ঘোষণা দিয়েছি। এইভাবে নারী কোমলমতি হয়ে উঠেছে স্বৈরাচারীনী ও কঠোর। এই অবাধ নারী স্বাধীনতা আদায় করতে গিয়ে আজকে পত্রিকা খুললেই নারী নির্যাতন, হত্যা, খুন, ধর্ষণসহ নানা খবর আমরা প্রতিনিয়তই দেখতে পাই। অথচ আমাদের মা, চাচীদের আমলে দৃষ্টি দিলে দেখা যাবে যে, উনারা নারী স্বাধীনতা কি তা জানতেনই না, এখনো জানার চেষ্টা করেন না, অথচ উনাদের সেই সময়গুলো কত সুন্দর ছিল! ভালবাসায় ভরপুর ছিল তাদের ঘর। তখন ছিল না নারী নির্যাতন, ছিল না হত্যা, ধর্ষণ ও খুন। ফলে প্রেমের নামে কলংক লোচন করে তথাকথিথ নারীরা কোন স্বাধীনতা অর্জন করতে চায় ;তা কি তারা আদৌ বোধগম্য?
পরিবার থেকে যখন অনেক দূরে : বহু পিতামাতা আছেন যারা বিভিন্ন কারণে তাদের সন্তানদের প্রতি সঠিকভাবে যত্ন নিতে পারছেন না বা তাদের প্রতি সঠিকভাবে খেয়াল রাখতে পারছে না। ফলে সন্তানরা পিতামাতার চাইতে ভাল কম্পানি বা সঙ্গী খোঁজে। আর বিপরীত ধর্মী লিঙ্গের প্রতি স্বভাবতই আকর্ষণ বেশি তাই তারা অধিক ভাল আশ্রয়ের খোঁজে, একটু শান্তির আশায় প্রেমের এই পথকে বেছে নেয়। এই পথ যে সর্বদা বন্ধুর তা নয় এই পথই একটি সন্তানের জন্য ডেকে আনতে পারে ভয়াবহ বিপদ। এভাবে যখন তারা অগ্রসর হয় তখন প্রেমে বাধা আসাটাই স্বাভাবিক, আর তখন সন্তান হয় বখাটে, মাস্তান ও সন্ত্রাসী। হেরোইন, ড্রাগ, পেথিড্রিন এর মত বাজে নেশায় তখন তারা হয়ে উঠে মত্ত। সমস্ত নিষিদ্ধ কাজ তখন তাদের জন্য সহজ হয়ে উঠে।
যত্রতত্র যাতায়াত : বিভিন্ন সময়ে সন্তানরা বন্ধু/বান্ধুবীর বাসার নাম করে অথবা কোচিং এ, অথবা প্রাইভেট পড়তে। পড়ানোর নাম ভাঙ্গিয়ে যত্রতত্র যাওয়া আসা করার অবাধ স্বাধীনতা ছেলেমেয়েদেরকে দেয়ার ফলে বাড়ন্ত বয়সটা হয়ে পড়ছে হুমকির সম্মুখীন। তাই এই বয়ঃসন্ধিকালটাতে পিতা মাতার উচিত সন্তানের সাথে বন্ধুসুলভ আচরণ করে তার সব খবর রাখা। নৈতিক অবক্ষয় থেকে নিজের সন্তানকে রক্ষা করা।
কবি ও কবিতা, গল্প-উপন্যাসের মাধ্যমে প্রেমের যে চিত্র মনের রংতুলি দিয়ে সাজিয়ে তোলা হয়েছে তা আসলে ইসলামের ধারে কাছেও নেই। আল্লাহর প্রতি ভয় ভীতি গল্প উপন্যাস, নাটক সিনেমাগুলোতে অনুপস্থিত। যার ফলে যুব সমাজ সেই অশ্লীলতার দিকেই ঝুকে পড়ছে। আজকাল টিভি চ্যানেলগুলো খুলতেই যেই চ্যনেলই দেখার জন্য খুলে বসি সেখানেই প্রেম, ভালবাসা, পরকীয় ছাড়া কোন গল্প নাই। দেখে মনে হয়, নির্মাতাগণ ভালবাসার এই নোংরা কাহিনী ছাড়া যেন গল্পই লিখতে পারেন না, অথচ ইরানী ছবিগুলো কত সুন্দর সুস্থ  বিনোদনের কথা আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয়। অথচ আমার সাথে সবাই একমত হবেন যে, নির্মাতাগণ যে সমস্ত চলচ্চিত্র তৈরি করছেন বা পোস্টার তারা দেয়ালে লাগিয়ে থাকেন তা কি কোন ইসলামী দেশের সংস্কৃতিতে আছে? তাহলে সেই দেশের যুবসমাজ কেনই বা ক্ষতিগ্রস্ত হবে না।
০ স্কুল পালানো ও বখাটেরা : এই শ্রেণীর লোকদেরকে সমাজের দুর্বল লোকেরা ভয় পেয়ে থাকে। তারা নিজেদের কর্তৃত্ব জাহির করার জন্য নেতা নেতা ভাব নিয়ে চলাফেরা করে, ক্লাসে তাদের মন বসে না। নামেমাত্র ক্লাসে ভর্তি হয়। অবশেষে ক্লাস ফাঁকি দিয়ে বিভিন্ন পয়েন্টে দলবল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে ও মেয়েদের টিজ করে। এভাবেই তারা বখাটের খাতায় নাম লেখায়। মেয়েদের কাছ থেকে সাড়া না পেলে বিভিন্নভাবে তাদের হয়রানি করে। অবশেষে এসিড নিক্ষেপ ও ধর্ষণের মত কাজেও হাত দিতে পিছ পা হয় না।
০ পরকীয়া : ছোটছোট ছেলেমেয়েদের সাথে প্রেমের পাল্লা দিতে গিয়ে বিবাহিতা মহিলা ও পুরুষরাও অনেকেই এগিয়ে গেছেন প্রেমের স্পর্শকাতরতায়। নিজ স্বামী-সন্তানকে পর করে অন্য পুরুষের হাত ধরে বেরিয়ে যাচ্ছে আরও শান্তির আশায়, অধিক ভালবাসা পাওয়ার উদ্দেশ্যে। ২ ছেলের মা রাইমা। স্বামী বিদেশ। অবশেষে স্বামীর বন্ধুর সাথে প্রেম। তারপর পালিয়ে বিয়ে। জানাজানি হলে রাইমা তার সন্তানদেরকে এতিম করে চলে যায় নতুন স্বামীর ঘরে। খবর পেয়ে বিদেশ থেকে প্রাক্তন স্বামী আসে। ঘটনা সহ্য করতে না পেরে বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করে। অথচ হাদীসে আছে, যেই নারী বিনা কারণে এক পুরুষের ঘর ছেড়ে অন্য পুরুষের হাত ধরে চলে গেল সেই নারী জাহান্নামী। তার ইবাদাত কখনই কবুল হবে না। তওবার দরজা তার জন্য বন্ধ হয়ে গেল।
ঘটনা-২ : আনিকার স্বামী বিদেশ। ১ ছেলে ১ মেয়ে। বিশাল সম্পদের মালিক তার হাজব্যান্ড। বাড়ি ভাড়া দেয়া আছে। ভদ্রলোক আনিকার বাসায় মাঝে সাজে আসে। আনিকা একদিন ভদ্রলোককে নিজের বাসায় খাওয়ার দাওয়াত দিলেন। সেই থেকেই কাল হলো। ভদ্রলোক আনিকার রান্নার খুব প্রশংসা করল। বলল, জানেন ভাবী আমার বউ কোন গুণেরই না, অথচ আপনি কত সুন্দর। আপনার চুল কত লম্বা, আপনার রান্না কত মজা! এভাবেই ভদ্রলোক আনিকাকে মাতিয়ে রাখেন। আনিকার এখন ঐ ভদ্রলোক ছাড়া চলেই না। স্বামী, সন্তান তার কাছে তুচ্ছ। সব ভাল ঐ ভদ্রলোক। এভাবেই একটি সংসার নষ্টের শেষ পরিণতির দিকে এগোচ্ছে।
ঘটনা-৩ : সামিন ২ সন্তানের জনক। স্ত্রী ও তার মাঝে ভালবেসে বিয়ে হয়। সেই সামিন অফিসের মিটিংয়ের নাম করে সপ্তাহে ৩/৪ রাত বিভিন্ন হোটেলে নতুন নতুন গার্ল ফ্রেন্ডের সাথে কাটায়। স্ত্রীসহ আত্মীয়-স্বজন অনেকেই ঘটনা জানতে পেরেছে। মাফ চেয়ে সবার কাছ থেকে ভাল হওয়ার প্রতিশ্রুতিও দেয়। কিন্তু কয়দিন পরই আবার আগের সেই মানুষটির চরিত্রই দেখা যায়।
০ পরকীয়া প্রেমের কারণে সংসার সমাজ দারুণভাবে নৈতিক মানদন্ডের মাপকাঠি হারাচ্ছে। পরকীয়া প্রেমগুলোতে কোন পক্ষই উপযুক্ত, অনুপযুক্তর মাপকাঠি নির্বাচন করছে না। ভাল লাগছে, করে বসেছে। এভাবে সমাজ থেকে শ্রদ্ধাবোধও হারিয়ে যাচ্ছে।
কেন এই পরকীয়া : দীর্ঘদিন স্বামীরা অর্থের লোভে স্ত্রীদের কাছ থেকে দূরে থাকার ফলে তাদের প্রতি মনের টান কমে যাচ্ছে। তখন শয়তান তার সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে মহিলাদের মস্তিষ্কে কলকাঠি নাড়তে থাকে। ফলে যৌন সম্পর্ক তখন তাদের কাছে বড় হয়ে ওঠে। আর সেইদিকে নজর দিতে গিয়েই সর্বনাশটা পুরোপুরি আদায় করল।। প্রিয় সন্তান, স্বামী ও মান ইজ্জত সবটুকুকে বস্তাবন্দি করে অন্য পুরুষের হাত ধরে পালিয়ে যাচ্ছে। মুমিন হওয়ার পূর্বশর্ত হলো, পারস্পরিক ভালবাসা। একটি সংসারকে টিকিয়ে রাখতে হলে প্রয়োজন একে-অপরের প্রতি Sacrifice and compromise. আদর্শ দাম্পত্য জীবনের সুখনির্ভর করে এই জিনিসটির উপরই। যেই ঘরে এই জিনিসটি অনুপস্থিত তার ঘরে লাখ টাকার ফার্নিচার থাকলেও মনে শান্তি থাকবে না, শান্তির জন্য দরকার এই ফার্নিচারটির। তাহলে অন্য ফার্নিচার না থাকলেও ঘরে ঢুকবে বেহেশতি বাতাস। ইসলামে এই বেহেশতি বাতাসের নাম দিয়েছে ইহসান। রাসূল (সা.) বলেছেন, স্ত্রী/স্বামীর একটি ত্রুটি তোমার খারাপ-লাগলে তার অন্য একটি গুণের দিকে তাকাও। পরকীয়া প্রেম একটি জঘন্য সামাজিক অপরাধ। ইসলামে যাকে ব্যাভিচার বলে ঘোষণা করেছে।
০ সবচেয়ে আসল কথা হলো এই পরকীয়া প্রেমের কারণে তৃতীয় পক্ষ ফায়দা লুটছে বেশি। উভয়পক্ষ থেকেই তারা ফায়দা হাসিল করছে। আমাদের এই তৃতীয় পক্ষ হতে সতর্ক থেকে পরকীয়ার খাজড়ী-পাচড়ার হাত থেকে নিজের সমাজকে রক্ষা করতে হবে।
প্রেমের কুফল : প্রেমের কুফল বা ক্ষতিকর দিকগুলো কি বলে বা লিখে শেষ করা যাবে? যতই দিন যায় ততই নিত্যনতুন দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে মানুষ। আল্লাহ ১৮ হাজার মাখলুকাত তৈরি করেছেন, মানুষের মাঝেই দেখা যায় ভালবাসার দ্বনদ্ব, সংঘাত ও কুফল। প্রেমের ভয়াবহ পরিণতিগুলো এক ফাঁকে জেনে নিই :
অল্প বয়সে প্রেমে পড়ল বিনি। একদিন অতি ভালবাসার দায়ে মানিক তার গায়ে হাত দেয়। একপর্যায়ে বিনি বুঝতে পারে তার শরীরে অন্যরকম অস্তিত্ব। মাকে জানাতে না চাইলেও পরে বাধ্য হয় জানাতে। মা মানিকের সাথে, মানিকের বাবা-মার সাথে যোগাযোগ করে। এতে সামাজিক অবস্থানের কথা চিন্তা করে মানিকের পক্ষ থেকে আসে হুমকি। বাড়ি থেকে রাতের অন্ধকারে বের করে দেয়। বিনি অবশেষে এবরশন করাতে বাধ্য হয়। অকালেই ঝরে পড়ে মাতৃত্বের সাধ।
প্রেমের কারণে দেশে ঝরে পড়ছে শিক্ষিতের হার। বন্ধ হয়ে যাচ্ছে পড়ালেখা। আত্মহত্যা, বিষ খেয়ে মৃত্যুর হার বেড়ে গেছে।
প্রেমের পরিণতি ভালর চেয়ে মন্দই বেশি। তাই বহু পরিবার হারায় তাদের মানসম্মান। সামাজিকভাবে হতে হয় হেয় প্রতিপন্ন। অনেক পরিবারকে হতে হয় নিঃস্ব ও পথহারা।
০ প্রেমের ভুল পথে অগ্রসর হওয়ার কারণে বহু মেয়ে হয়েছে ধর্ষিত, হযেছে লাঞ্ছিত এবং হারিয়েছে নারী জাতির বহু মূল্যবান সম্পদ ইজ্জত।
০ স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটির ছেলে-মেয়েরা প্রেমের নামে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যে প্রেমের বালাখানা তৈরি করেছে তাতে তারা নিজেদেরকে অর্থাৎ নিজেদের চরিত্র ও সম্ভ্রমের কলংকের কালিমা থেকে হিফাজত করতে কি পারছে?
০ প্রেমের নামে বর্তমানে পাশ্চাত্য সভ্যতার অনুকরণে লাগামহীনভাবে তরুণ-তরুণী, যুবক-যুবতী মেলামেশা করছে। ঝোপ-ঝাড় আড়ালে, প্রকাশ্যে ঘনিষ্ঠভাবে বসে আপত্তিকর আচরণ করছে। প্রেমিক-প্রেমিকা একত্রে ইচ্ছামত যেখানে খুশি সেখানে চলে যাচ্ছে। ক্লাব, হোটেল বা বন্ধুর বাসায় রাত কাটাচ্ছে। বেগানা একজন নারী এবং একজন পুরুষ একত্রিত হলে শয়তানকে নিয়ে সেখানে হয় তিনজন। বলাবাহুল্য যে, শয়তানের কাজ হলো পরস্পরের মনে কুচিন্তা সৃষ্টি করা। এখন এর অনিবার্য পরিণতি হিসেবে রাস্তাঘাটে, ডাস্টবিনে নবজাতক সন্তান পাওয়া যাচ্ছে। নার্সিং হোমে গিয়ে গর্ভপাত ঘটাচ্ছে। এই অকাল গর্ভধারণ ও গর্ভপাতের ফলে অনেক মেয়েই মৃত্যুবরণ করছে এবং এইসব নির্লজ্জকর ঘটনা পত্রিকায় ছাপা হচ্ছে।
০ পশ্চিমা দেশের আদলে আমাদের দেশেও এখন ১৬ বছরের কোন মেয়ে/ছেলে যদি বলে বয়ফ্রেন্ড। গার্লফ্রেন্ড নাই। বা তাদের সাথে খোলামেলা সম্পর্ক হয়নি তাহলে তারা নাকি উপহাসের পাত্রে পরিণত হয়। এই সবই ঘটেছে নারী-পুরুষের নামে অবাধ স্বাধীনতার ফলে।
প্রেম বিয়ের আগে বা পরে উভয়টাই নিষিদ্ধ ইসলামে। এই নিষিদ্ধকে হালাল করতে গিয়ে উঠে গেছে আল্লাহ্র ভয়। হয়েছে নৈতিক স্খলন, সমাজে বেড়েছে সামাজিক উন্মাদনা।
০ এই প্রেমের কারণে বহু লোক আছে পাগলাগারদে। যৌনতার মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় বহু ঘর সংসার ভেঙে তছনছ হয়ে যাচ্ছে।
রাস্তা-ঘাটে কত ছেলে মেয়ে দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু বিয়ের জন্য পাত্র চাই! কিংবা পাত্রী চাই। তখন সবারই এক কথা, ভাল ছেলে বা ভাল মেয়ে পাওয়া যাচ্ছে না। তার একটাই কারণ এই প্রেম। বিয়ের আগে সবাই চায় একটি ভাল চরিত্রের ছেলে/মেয়ে তার ঘরে আসবে। কিন্তু এই প্রেমের কারণে সমাজ ভাল ছেলে/মেয়ে থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
বাবা-মায়ের অমতে তানিয়া বিয়ে করে মিলনকে। মিলনের বাবা-মার মন জোগানোর জন্য ঘরের সমস্ত কাজ করে তানিয়া। শরীর যখন ক্লান্ত মন যখন একটু ভালবাসা খোঁজে একটু সহানুভূতি চায় তখন সে একেবারেই একা। বহু রাতে মিলন ঘরে আসে মদ খেয়ে। কিছু বলতেই তানিয়াকে এলোপাতারি মার। বাবা মার কাছে তো বলতেই পারে না। সবই নীরবে সহ্য করে। গায়ে কত জখম! জখমে আস্তে আস্তে হাত বুলায় আর চোখের পানি ফেলে ভাবে এ যে প্রেমের দান!
প্রচার মাধ্যম : টিভি, চ্যানেল, নাটক, সিনেমা থেকে আরো বেশি প্রেমের প্রচার প্রসার হচ্ছে। নায়ক নায়িকা দু’জনে হাত ধরাধরি করে, আরো কত কি! এইসব দৃশ্য দেখে উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েরা আরো প্রেমের নানা রকম ফায়দা শিখছে। যা আদৌ কাম্য নয়।
আমাদের করণীয় : প্রেমের দুষ্ট চক্রের হাত থেকে নিজেকে পরিবারের প্রতিটি সদস্য ও সমাজকে বাঁচাতে হলে চুপচাপ যা চলছে যা ঘটছে তা হতে দেয়া যায় না। তাই মানুষ হিসেবে নৈতিক দায়িত্ব তাকে রুখে দাঁড়াবার। এই জন্য তিনটি পদক্ষেপ নেয়া জরুরি : ক. ব্যক্তিগত উদ্যোগ; খ. সামাজিক উদ্যোগ; গ. রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ।
ব্যক্তিগত উদ্যোগে যা করণীয় : প্রথমেই ‘‘আমার ঘর আমার বেহেশত’’ এই ফর্মুলা নিয়ে এগোতে হবে।
সপ্তাহে অন্তত ২ দিন পরিবারের সবাইকে নিয়ে বসা, সবার ব্যক্তিগত খোঁজ-খবর নেয়া।
যদি তা সম্ভব না হয় তাহলে খাবার টেবিলে হলেও একসাথে বসা ও টেকনিক করে ব্যক্তিগত খবরাখবর নেয়া। এতে যে কাজটা হয় সন্তানরা বুঝতে পারে তাদের বাবা-মা কত আন্তরিক তাদের সুখে দুঃখের খোঁজ খবর নিচ্ছে। ফলে পিতা-মাতার প্রতি সন্তান আন্তরিক থাকবে।
সন্তান যেন অনুগত থাকে সেজন্য পিতামাতা হিসেবে তার জন্য দোয়া করা। সূরা আল ইমরানের ৩৮নং আয়াতে আল্লাহ তা শিখিয়ে দিয়েছেন এভাবে, রাবিব হাব্লি মিল্লাদুনকা যুর্য়িইয়্যাতান ত্বায়্যিবাতান, ইন্নাকা সামী ‘উদ্ দু’আ-ই’।
সন্তান যদি বিপথে, কুপথে পরিচালিত হতে দেখা যায়, কথা শুনতে চায় না। তখনও আল্লাহ পিতামাতাকে দোয়া শিখিয়ে দিয়েছেন সূরা আহ্কাফ-এ ১৫নং আয়াতে ‘রবিব আছলিহ লী ফী-যুররিয়্যাতি, ইন্নী তুবতু ইলাইকা ওয়া ইন্নি মিনাল মুসলিমীন।
সুতরাং আল্লাহর দেয়া বিধান মোতাবেক প্রথমে নিজেকে চালাতে হবে। তারপর নিজের পরিবারকে সেই জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাতে হবে। বাঁচাতে হবে নিজের সমাজ তথা নিজের দেশকে। তাই কুরআনি রঙে নিজেকে রাঙিয়ে রাঙাতে হবে গোটা বিশ্বকে। অন্যায় যুলুম যেখানেই হতে দেখা যাবে সেখানেই বাধা দিতে হবে। আল্লাহ কুরআনে বলেছেন, ‘‘তোমাদের মধ্যে অবশ্যই একদল লোক থাকবে যারা মানুষকে সৎ কাজের আদেশ দিবে, অসৎ কাজ থেকে বিরত রাখবে। নামায কায়েম করবে যাকাত দিবে এবং আল্লাহ ও তার রাসূলের আনুগত্য করবে। ওরা এমন লোক, যাদের ওপর আল্লাহর রহমত অবশ্যই নাযিল হবে।’’ সুবহানাল্লাহ।
আমাদের সন্তানদের শিক্ষার ব্যাপারেও পিতামাতাকে যথেষ্ট নজর রাখতে হবে। রাসূল (সাঃ) বলেছেন, শিক্ষার জন্য তোমরা সূদুর চীন দেশ পর্যন্ত যাও।’’ সেই শিক্ষা যেন হয় আল্লাহকে জানার শিক্ষা। আল্লাহকে বাদ দিয়ে কোন শিক্ষাই আজ পর্যন্ত সফল হতে পারেনি পারবেও না। আমাদের শিক্ষা যেন হয় পরস্পরকে বন্ধু বানানোর, সাথী ও সহযোগী বানানোর। দুনিয়ায় শান্তি ও আখিরাতে মুক্তি তখনই আসবে। আমরা বর্তমান সমাজে শিক্ষার যে চিত্র দেখতে পাই তাতে মনে হয় এই যে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বিএসসি ক্যাডার, বড় বড় শিল্প-প্রতিষ্ঠানের মালিক হওয়া বড় চাকরিজীবী হওয়া। এইসব বড় বড় ‘হওয়া’ওয়ালারা কি মৃত্যুর পর আল্লাহকে চাকরি করে খাওয়াবে, নাকি ডাক্তার আল্লাহকে ডাক্তারি করবে? নাউযুবিল্লাহ।
আল্লাহ এই সকলকিছুর ঊর্ধ্বে। আল্লাহর খাওয়া পরার প্রয়োজন হয় না। প্রয়োজন শুধু আমাদের তা ও এই দুনিয়ায় বেঁচে থাকার জন্য। মৃত্যুর পরে আর কোন প্রয়োজন নেই। তাহলে এই অল্প সময়ের প্রয়োজনটুকু আমাদের কাছে এত বেশি কেন? আমরা কি ঈমানদার হতে পেরেছি? নফসের তাড়নায় কেন আমরা বিমুখ হয়ে রয়েছি। মৃত্যুর পরও যেন কবরে আমল পৌঁছায় সেই ব্যবস্থা কি দুনিয়াতেই করে যেতে চাই না? অবশ্যই হ্যাঁ তাহলে আসুন আগে নেক সন্তান বানানোর সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাতে শুরু করি এখন থেকেই। তাহলে আর আমাদের সন্তানকে গুন্ডা, বদমাইশ, ইতর, সন্ত্রাসী ডাক শুনতে হবে না।
সৎসঙ্গে সন্তানকে উৎসাহ দেই। সৎ শিক্ষায় সন্তানকে শিক্ষিত করি। সন্তানের সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে তুলি।
আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি, ‘‘রববানা আতিনা ফিদ্দুনিয়া হাসানাতাও ওয়া ফিল আখিরাতি হাসানাতাও ওয়াকিনা আযাবান নার।’’ সূরা বাকারাহ-২০১নং আয়াত।
সামাজিকভাবে করণীয় : প্রেমের অসভ্যতাকে বন্ধ করার জন্য সামাজিকভাবে প্রতিটি মানুষের কিছু করণীয় আছে। মানুষ সামাজিক জীব। সমাজবদ্ধভাবে বসবাস করাটাই মানুষের নিয়ম। আমাদের সমাজকে সুন্দর করার দায়িত্ব আমাদের। ইসলাম বিয়ের পূর্বে প্রেমকে নিষিদ্ধ করেছে। প্রেমের নামে এই সব যথেচ্ছাচার হতে যেখানেই দেখা যাবে সেখানেই এর বিরুদ্ধে জনগণকে সচেতন থাকতে হবে, শক্ত হাতে তা প্রতিরোধ করতে হবে। সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফলে সমাজ থেকে অন্যায় রোধ করা যায়। সেজন্য প্রয়োজন দৃঢ় মনোবল ও পদক্ষেপ গ্রহণ করা। সামাজিকভাবে প্রেমের অত্যাচারকে রুখে দাঁড়াবার কিছু পদক্ষেপ :
আমাদের দেশে বিজাতীয় সংস্কৃতির আদলে পহেলা বৈশাখ, ভালবাসা দিবস পালন করা হয়। এতে প্রেমিক-প্রেমিকারা, উঠতি বয়সের ছেলে-মেয়েরা বেহায়া ও বেলাল্লাপনার উন্মাদনায় মত্ত থাকে। যা আমাদের ধর্মীয় সংস্কৃতিতে আঘাত করে। কুরআন-হাদীসের বিরুদ্ধের আচরণ হয়। তাই আমাদের উচিত ইসলামী অনুশাসন টিকিয়ে রাখতে হলে এইসব বিজাতীয় সংস্কৃতির বিরুদ্ধে আইন করা, কঠোর নীতির মাধ্যমে তা সমাজ থেকে দূর করা। যারা এর পক্ষে কথা বলবে তাদেরকেও শাস্তির আওতায় আনা। কুরআনের আইন বাস্তবায়ন করা।
বিজাতীয় সংস্কৃতির আবর্জনায় ঢাকা পড়ে গেছে ইসলামের সৌন্দর্য্য। মিথ্যার আবর্জনায় চাপা পড়েছে শাশ্বত কুরআনের সত্য। সত্যি বলতে কি সত্যের সূর্য রক্তিম আভা নিয়ে উদিত হবেই। ইসলামের নূরকে, কুরআনের নূরকে যারা মুখের ফুৎকারে নিভিয়ে দিতে চায় তাদের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা। ইসলামী সংস্কৃতি জানালাকে সকলের সামনে খুলে ধরা।

কুরআনের আয়াত সংখ্যা নিয়ে তারতম্যের কারণ ও তার নিরসন

Uthmans-noble_quran-1

কায়রো ইসলামী জাদুঘরে রক্ষিত উসমানী হরফে লিখিত একটি প্রাচীন কুরআন

কুরআনের আয়াত সংখ্যাঃ

হযরত আয়েশা (রাঃ)-এর মতে ,৬৬৬

হযরত ওসমান (রাঃ)-এর মতে ,২৫০

হযরত আলী (রাঃ)-এর মতে ,২৩৬

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ)-এর মতে ,২১৮

মক্কার গণনা মতে ,২১২

বসরার গণনা মতে ,২২৬

ইরাকের গণনা মতে ,২১৪

ঐতিহাসিকদের মতে হযরত আয়েশার গণনাই বেশী প্রসিদ্ধি লাভ করেছে যদিও আমাদের এখানে প্রচলিত কোরআনের নোসফাসমূহ থেকে আয়াতের সংখ্যা শুনলে এ মতের সমর্থন পাওয়া যায় না । বর্তমানকালের প্রায় সমস্ত কুরআন শরীফে হযরত আলী (রাঃ)-এর গণনা(,২৩৬) পরীলক্ষিত হয় যা নিম্নরূপঃ

ayah

আয়াতের সংখ্যার মধ্যে কিছুটা তারতম্য রয়েছে । এর কারণ, কিছু কিছু আয়াতের শেষে রসূল (সাঃ) মাঝে মাঝে ওয়াকফ করেছেন, আবার কখনও ওয়াকফ না করে পরবর্তী আয়াতের সাথে মিলিয়ে তা তেলাওয়াত করেছেন । এমতাবস্থায় কেউ কেউ প্রথম অবস্থার দিকে লক্ষ্য রেখে এক ধরণের গণনা করেছেন। আবার কেউ কেউ পরবর্তী অবস্থার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করে আয়াতের সংখ্যা নির্ণয় করেছেন। এতে করে কোরআনের আয়াতের সংখ্যা নিয়ে কিছুটা মত পার্থক্য দেখা দিয়েছে । হযরত আয়েশার গণনাকে এ ব্যাপারে কেনো বেশী নির্ভরযোগ্য মনে করা হয় তা সঠিকভাবে জানা যায় না।

তথ্যসুত্রঃ কোরআন শরীফ সহজ সরল বাংলা অনুবাদ হাফেজ মুনির উদ্দীন আহমদ (আল কোরআন একাডেমী, লন্ডন), পৃষ্ঠা নং ১১, ১৪

বিভাগ:ইসলাম, ধর্মীয় ট্যাগসমূহ:

কুরআন-সুন্নাহ থাকতে মাযহাব কেন?

আসলেও কি মাযহাব কোর’আন ও সুন্নাহ্‌ বিরুধী? যারা মাযহাব মানে তারা সহ্‌হী হাদিস মানে না” এই ধারনা কি ঠিক? যারা মাযহাব কে বিতর্কিত করে কোর’আন ও সুন্নাহর মুখোমুখি দাড় করিয়েছে তাদের কথা কতটুকু ঠিক?

আসুন উপরুক্ত প্রশ্নের জবাব দেখি এই পোস্ট টিতে। জাজাকাল্লাহ্‌ খায়ের।

আজ এই মুহূর্তে আপনি ইসলাম গ্রহণ করলেন কিংবা আপনি জন্মগতভাবেই মুসলিম, এ মুহূর্তে আপনি ইসলামের কোনো বিধান পালন করতে চান, তো আপনাকে আলেমউলামা বা ইসলাম সম্পর্কে জানেনএমন ব্যক্তির শরণাপন্ন হতে হবে। আমাদের এই ভূখন্ডে প্রথম দিকে যারা ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন তারা ঈমান শিখেছিলেন ইসলামপ্রচারকদের কাছে। এরপর তাদের কাছেই নামায আদায় করতে শিখেছিলেন। আজ এবং অনাগত দিনেও পৃথিবীব্যাপী প্রতিটি নওমুসলিমই ঈমান, অযুগোসল, হালালহারাম, সালাতযাকাত, সিয়ামহজ্ব ইত্যাদির প্রথম ধারণা লাভ করবেন তার ইসলাম গ্রহণের প্রথম মাধ্যম ব্যক্তিটির কাছ থেকে এবং বহু কিছু তিনি শিখে নিবেন মুসলিমসমাজের ধর্মীয় কার্যক্রম ও কালচার থেকে। এ বিষয়টি আমরা খুব সহজেই বুঝতে পারব যদি কল্পনা করি সে সময়টির কথা, যখন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এত উন্নত হয়নি। শিক্ষাদীক্ষার হার ছিল প্রায় শূন্যের কোঠায়। তথ্য ও যোগাযোগ মাধ্যম বলতে তেমন কিছুই ছিল না। ছিল না এত বইপুস্তক, পত্রিকা ও প্রকাশনা। তখন ভাবের আদানপ্রদান ও যোগাযোগের একটিই উপায় ছিল। তা হল মৌখিক জ্ঞান বিনিময়ের পাশাপাশি বাস্তব অনুশীলন। অর্থাৎ হাতেকলমে শিক্ষা দেওয়া।

আজকের এই সময়টা নিয়েই ভাবুন। দেখবেন, বাংলাদেশের মুসলমানরা ইসলামী বিশ্বাস, চিন্তাচেতনা, ইবাদতবন্দেগী, সুন্নতবিদআত, জায়েযনাজায়েয, হালালহারাম প্রভৃতি যা কিছুই জানেন এর সিংহভাগই সমাজ, পরিবেশ, গৃহশিক্ষক, মসজিদের ইমাম, ওয়ায়েজ, মক্তবের উস্তাদ, মাবাবা, দাদাদাদী ইত্যাদি মানুষ থেকে শেখা। কেবল নিজের পড়াশোনা, প্রচারমাধ্যম বা অন্যান্য ব্যক্তিগত অনুসন্ধান থেকে ধর্মীয় জ্ঞান লাভ করেছেন এমন মানুষের সংখ্যা এ দেশে এখনও অনেক কম।
আমাদের সমাজের প্রকট বাস্তবতার আলোকেই বাঙ্গালী মুসলমানের প্রথম ইসলামী জ্ঞান অর্জনের এ ব্যবস্থাকে অবলম্বন করেই প্রবচন চালু হয়েছে-‘শুইন্যা মুসলমান।’ অর্থাৎ মূল উৎস ঘেঁটে, দেখে বা পড়ে নয়, শুনে শুনে যারা একটি বিশ্বাস ও সংস্কৃতিকে ধারণ করেছে এমন ব্যক্তির ক্ষেত্রেই এ প্রবচনটি প্রয়োগ করে থাকেন গ্রামবাংলার মানুষ।

কেবল বইপুস্তক পড়ে একটা কাজ শেখা আর একজন শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে হাতেকলমে শিক্ষালাভ করার মধ্যে আকাশপাতাল তফাৎ আছে। কোনো খেলা, ব্যায়াম, সাইকেল বা গাড়ি চালনা কোনোটাই শুধু বইপুস্তক পড়ে, মিডিয়ায় ছবি দেখে পূর্ণরূপে শিখে নেওয়া সহজ নয়। একজন উস্তাদের সাথে থেকে তার ইনস্ট্রাকশন মেনে বিষয়টি শিখলে এবং হাতেকলমে অনুশীলন করলে পুঁথিগত জ্ঞান বা তাত্ত্বিক ব্যাকরণ ততটা না জানলেও কাঙ্খিত কার্যক্রমটুকু শিখে নেওয়া সম্ভব। পড়াশোনার বিষয়টি ব্যবহারিক পর্যায়ে থাকলেও কাজ বাধাগ্রস্ত হবে না। গভীর তত্ত্ব আলোচনা ও সামগ্রিক জ্ঞান অনুসন্ধান বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিবর্গের জন্য জরুরি হলেও বিশ্বাস, দর্শন ও জীবনব্যবস্থার সাধারণ অনুসারীর প্রাথমিক শিক্ষার জন্য ওই প্রশিক্ষক, গুরু, পীর, উস্তাদ, মুর্শিদ, আলেম, ইমাম বা প্রচারকের সান্নিধ্যই যথেষ্ট।

বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্ম ও আল্লাহর মনোনীত একমাত্র দ্বীন ইসলামের প্রচার তত্ত্বের চেয়ে ব্যবহারিক পর্যায়েই বেশি অগ্রসর হয়েছে। কেননা, পৃথিবীর সকল অঞ্চলের সকল যোগ্যতার মানুষকে তাওহীদ, রিসালত ও আখেরাতের ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত জীবনব্যবস্থার দিকে দাওয়াত দিতে চাইলে কোনো কঠিন ও জটিল পন্থা অবলম্বন করা চলবে না। হযরত নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরাম রা.-এর সরল ও সনাতন পন্থায়ই তা করতে হবে।

হযরত নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবায়ে কেরামকে জীবনের প্রতিটি বিষয় হাতেকলমে শিক্ষা দিয়েছেন, কোনো বইপুস্তক ধরিয়ে দিয়ে গবেষণা করে বুঝে নিতে বলেই দায়িত্ব শেষ করেননি। পৃথিবীর অপরাপর এলাকায় বসবাসরত সমকালীন মানুষ এবং পরবর্তী সকল যুগের অনাগত বিশ্বমানবমন্ডলীর কাছে নিজের দাওয়াত পৌঁছে দিতেও হযরত বইপুস্তক, পত্রপত্রিকা, পান্ডুলিপি ইত্যাদির আশ্রয় নেননি। তিনি তাঁর সাহাবীগণকে দায়িত্ব দিয়েছেন বিশ্বময় ছড়িয়ে পড় এবং আমার আদর্শের একটি বাণী হলেও পূর্বপশ্চিমে বসবাসরত প্রতিটি মানুষের কাছে পৌঁছে দাও।

হযরত নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেমন বলতেন, তোমরা আমাকে যেভাবে নামায পড়তে দেখ সেভাবে নামায পড়, সাহাবীরা যেমন নতুন কোনো মানুষকে অযু শেখানোর সময় তাদের সামনে বসে অযু করতেন এবং বলতেন, এই ছিল নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামএর অযু। ইসলামের প্রতিটি বিধানই প্রাথমিকভাবে এর ধারকবাহকদের মাধ্যমে ব্যবহারিক তথা প্রায়োগিকভাবেই বিস্তৃত ও প্রচলিত হয়েছে। আর ইসলামের সৌন্দর্য ও শ্রেষ্ঠত্ব বা এর অন্তর্নিহিত শক্তিও এখানেই যে, এটি ধারণ বা পালন না করে বহন করা যায় না। আর একে ভালো না বেসে ধারণও করা যায় না। যারা একে ভালবাসেন ও নিজেরা ধারণ করেন, তারাই কেবল একে অন্যদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে পারেন। এর আনুষ্ঠানিক প্রচারের তুলনায় এর ধারক ও সেবকদের আন্তরিকতা ও কল্যাণকামিতার মাধ্যমেই ইসলাম অধিক, ব্যাপক, গভীর আর টেকসই পর্যায়ে বিস্তৃত হয়েছে। দেড় হাজার বছরের ইতিহাসই এর সপক্ষে প্রমাণ হিসেবে যথেষ্ট।

এখন ইসলামের একজন অনুসারী হিসেবে আমি নিজেকে নিয়েই চিন্তা করি। ইসলামের একজন প্রচারক যখন আমার কাছে ইসলামের আদর্শ তুলে ধরবেন, সে সময়টা যদি হয় আরও ২, , , ৭ শ বছর আগের, তখন কি তার পক্ষে সম্ভব আমার হাতে এক কপি কুরআন বা সহীহ হাদীসের একটি পূর্ণাঙ্গ সংকলন তুলে দেওয়া? বাংলাভাষী হওয়ায় আমার পক্ষে কী আরবী ভাষায় তা পাঠ করাও সম্ভব? শুধু আরবী ভাষা বলেই কথা নয়, আমার পক্ষে কি তাত্ত্বিক এ দুটো উৎসবিদ্যার বিষয়গত ভাব উদ্ধার করাও সম্ভব? এখানে আমার জ্ঞানগরিমার পাশাপাশি আর্থসামাজিক অবস্থা, বোধবিবেকের পরিমাণও একটি প্রশ্ন। এরপর বহু সাধনা করে কুরআনসুন্নাহর ভান্ডার হাতে পেয়ে গবেষণা করে এর সারনির্যাস হাসিল করে নিজে ঈমান, আমল ও আখলাক চর্চা শুরু করতে আমার কত মাস, বছর বা যুগ লাগবে সেটাও কি কম বড় প্রশ্ন ? এতটা পরিশ্রম করে যদি ইসলাম পালন আমি শুরু করি, তাহলেও তো ভালো। কিন্তু এ কাজটুকু ক’জন মানুষের পক্ষে সহজ বা সম্ভব? তদুপরি প্রশ্ন দেখা দেবে যে, কুরআনসুন্নাহ গবেষণা করে ঈমানআমল, নামাযরোযা, হজ্বযাকাত, বিয়েশাদি, ব্যবসাবাণিজ্য, ঋণউৎপাদন, দানখয়রাত, জীবনমৃত্যু, জানাযাউত্তরাধিকার ইত্যাদি শুরু করার আগ পর্যন্ত আমার মুসলমানিত্বের এ দীর্ঘ সময়ের নামাযবন্দেগী ও কাজকর্মের কী হবে?
আমার তো মনে হয়, কোনো ব্যক্তি বা জনগোষ্ঠীর ঈমান ও আমলের জন্য, ইসলামী জীবনবোধ ও সংস্কৃতি চর্চার জন্য প্রথম দিনই কুরআন ও সুন্নাহ গবেষণা শুরু করার পদ্বতি ইসলামের স্বাভাবিক রীতি নয়। যদি এই না হবে তাহলে আমার সন্তানকে আমি ঈমান শেখাব কী করে? তাকে নামায, যিকর, সবর, শোকর, তাওয়াক্কুল ও আদবআখলাক আমি কোন অধিকারে শিক্ষা দেব? যদি সে প্রশ্ন তোলে, আববু! তুমি আমাকে কুরআন ও সুন্নাহ শেখাও কেন? কুরআনসুন্নাহ থেকে আমিই আমার জীবনবিধান খুঁজে নেব। তুমি এর মধ্যে এসো না। তুমি তোমার প্রায়োগিক আচরণ ও পর্যবেক্ষণ আমার ওপর চাপাতে চেষ্টা করো না। আমি তোমার বা তোমাদের মাযহাব মানি না। আমার দায়িত্ব তো কুরআনসুন্নাহর ওপর আমল করা। অতএব কুরআনসুন্নাহর ওপর দখল স্থাপন করার সময় আমাকে দাও। এরপরই আমি শরীয়তের ওপর আমল শুরু করব। পুত্রের এসব যুক্তির পর আমার বলার কি কিছু থাকবে?

পুত্রের এ বক্তব্য যে ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত সে ভিত্তিই আমাকে কথা বলার সুযোগ দেবে। কারণ মহান আল্লাহ তাঁর দ্বীনের প্রচার ও শিক্ষাকে যে সনাতন ও স্বাভাবিক পদ্ধতিতে প্রচলিত ও বিস্তৃত করেছেন, এর সম্পূর্ণ অনুরূপ হচ্ছে আমার এ উদ্যোগ।
আমার পুত্রকে ইসলামী জীবনবিধান শিক্ষা দেওয়া আমার ওপর শরীয়তের নির্দেশ। আমি তাকে আল্লাহর পরিচয়, আল্লাহর শক্তি, প্রীতি, ভীতি ও ভালবাসা শেখাব। তাকে হযরত রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামএর মহত্ত্ব, অবস্থান ও অপরিহার্যতা সম্পর্কে ধারণা দেব। তাকে নামায শেখাব। খাওয়াপরা, ঘুমবিশ্রাম, প্রস্রাবপায়খানা, প্রবেশপ্রস্থান, মসজিদে যাতায়াত, আযানের জবাব, হাঁটাচলা, সালাম, মোসাফাহা ইত্যাদির ইসলামী নিয়ম শিক্ষা দেব। আমি নিজেও অযুগোসল, রোযানামায, দাম্পত্য জীবন, পারিবারিক ও সামাজিক জীবন, হজ্বকুরবানী প্রভৃতি যথাযথ নিয়মে পালন করব। অথচ আমি কুরআন বা হাদীস পড়ার বা বুঝার মতো যোগ্যতা রাখি না। জ্ঞানের এ দুই মহাসমুদ্র পাড়ি দিয়ে আমার দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনীয় বিধিবিধান হস্তগত করে আমল করার মতো শিক্ষা, মেধা, মানসিক যোগ্যতা বা সামগ্রিক অবস্থা আমার নেই, এমতাবস্থায় আমার কী করণীয়?

আমার তো মনে হয়, এখানে আমার ও আমার পুত্রের একই ধরনের করণীয়, যা ইসলামের ১৫০ কোটি সমসাময়িক অনুসারীর প্রত্যেকেরই করণীয়। আর তা হল, কুরআনসুন্নাহ ও ইজমাকিয়াস থেকে গৃহীত ইসলামী বিধিবিধানের প্রায়োগিক রূপ ফিকহের অনুসরণ। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেমন বলেছেন, একজন ফকীহ শয়তানের মোকাবেলায় এক হাজার আবেদেরও চেয়েও শক্তিশালী। এর কারণ সম্ভবত এটিও যে, এক হাজার সাধারণ মুসলিমকে ধর্মীয় বিষয়াদি নিয়ে সংশয় উদ্বেগ ও বিভ্রান্তিতে ফেলে দেওয়া শয়তানের জন্য যত না কঠিন একজনমাত্র শরীয়তবিশেষজ্ঞ ফকীহ আলেমকে বিভ্রান্ত করা এরচেয়ে বেশি কঠিন। কেননা, এই ব্যক্তির কাছে কুরআন ও সুন্নাহর শক্তিশালী সম্পদ রয়েছে। রয়েছে ইলমে দ্বীনের আরও বিস্তারিত ভান্ডার।
কুরআন মজীদেও আল্লাহ তাআলা এ মর্মে বলেছেন, প্রত্যেক জনগোষ্ঠীর মধ্য হতে একদল মানুষ যেন দ্বীনী ইলমের উপর ব্যুৎপত্তি অর্জন করে কারণ জনগোষ্ঠীর বাকি অংশটিকে তাদের শরীয়তের উপর পরিচালনা করতে হবে। এখানেও আমরা ফকীহ বা শরীয়তের আলেমের বিধিগত অস্তিত্ব এবং তাঁর কুরআনী দায়িত্ব উপলব্ধি করতে পারি।

আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও মহামান্য সাহাবীগণের পৃথিবী থেকে চলে যাওয়ার পর ইসলাম যখন আরবউপদ্বীপ ছেড়ে একদিকে সাহারা গোবি ছুঁয়ে দূর অতলান্তিক স্পর্শ করছিল, অপরদিকে আসমুদ্র সাইবেরিয়া আর মহাচীনের প্রাচীর পর্যন্ত পৌঁছে যাচ্ছিল তখনও কিন্তু পবিত্র কুরআন ব্যাপকভাবে হস্তলিখিত হয়ে এত বিপুল পরিমাণ অনুলিপি তৈরি হয়নি, যা প্রতিটি শিক্ষিত নওমুসলিমের হাতে তুলে দেওয়া যায়। আর হাদীস শরীফ তো তখনও যাচাই বাছাইয়ের পর সংকলিত ও গ্রন্থবদ্ধ হয়েও শেষ হয়নি। তো ইসলামের এ অগ্রযাত্রা, ইসলামী শরীয়তের আলোয় প্লাবিত এ নতুন পৃথিবীর বুকে কাদের মাধ্যমে কুরআনসুন্নাহর আলো প্রতিবিম্বিত হয়েছিল? এর ছোট এক টুকরো জবাবই ইসলামের ইতিহাসে সুরক্ষিত আছে, যা আমি এ লেখার শুরুতে নিবেদন করেছি। হাদীস শরীফে তো বলা হয়েছে, তোমাদের মাঝে দুটি বিষয় আমি রেখে গেলাম। যতদিন তোমরা এ দুটো আঁকড়ে রাখবে ততদিন পথচ্যুত হবে না। এক আল্লাহর কিতাব। দুই. আমার আদর্শ। এ মহা দিকনির্দেশনার আরও সুসংহত রূপ হচ্ছে হযরতের অপর বাণী, যেখানে মুসলিম জাতিকে সত্যপথের দিশা দিতে গিয়ে বলেছেন, ‘যে আদর্শের উপর আমি রয়েছি আর আমার সাহাবীগণ রয়েছেন।’ অন্যত্র বলেছেন, ‘তোমাদের জন্য অবধারিত করছি আমার এবং খোলাফায়ে রাশেদীনের আদর্শের অনুসরণ।’

এখানে আমরা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি যে, ইসলামী অগ্রযাত্রা ও ইসলামী জীবনসাধনার সঠিক দিকনির্দেশের জন্য কুরআন ও সুন্নাহকে মূল উৎস সাব্যস্ত করা হয়েছে। ইসলামী জীবনব্যবস্থার আদর্শ ও মাপকাঠিরূপে অভিহিত করা হয়েছে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সহচরবৃন্দের অনুসৃত পথ, যা প্রধানতই ব্যবহারিক ও সান্নিধ্যগত আদর্শ। বইপুস্তক ও তত্ত্ব প্রধান নয়। যে জন্য সাহাবায়ে কেরামের মূল সময়কালের শেষ পর্যায়ে আমরা পবিত্র মদীনা মুনাওয়ারায় হযরত মালেক ইবনে আনাসকে রাহ. দেখতে পাই গোটা মুসলিমসমাজের লোকশিক্ষক ও দিকনির্দেশক হিসেবে। ইসলামের উপর আমল করার জন্য মদীনাবাসী তখন থেকেই কুরআন ও সুন্নাহ নিয়ে ব্যক্তিগতভাবে গবেষণা বা অনুসন্ধান শুরু না করে ফকীহ ও আলেম ইমাম মালেকের ফিকাহ বা মাযহাবের উপর, তার নির্বাচন ও পর্যবেক্ষণের উপর নিশ্চিন্তে নির্ভর করেছেন। এরও বহু আগে থেকে মক্কাবাসীরা নির্ভর করেছেন হযরত ইবনে আববাস রা.-এর উপর। এর কিছুদিন পর থেকে বৃহত্তর ইরাকবাসী ইমামে আজমের ফিকহের উপর। আর এটিই কুরআন ও সুন্নাহর বিধান। আল্লাহ তাআলা যেমন বলেছেন, তোমরা অনুসরণ কর আল্লাহর ও তাঁর রাসূলের। আর অনুসরণ কর তোমাদের উলুল আমর বা শরীয়তী অথরিটির। হাদীস শরীফে বলা হয়েছে, পিতার সন্তুষ্টিতেই রয়েছে আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি। তো আমার পুত্রকে দৈনন্দিন জীবনের যে শরীয়ত সম্পর্কিত শিক্ষাদীক্ষা আমি দেব তা তৎক্ষণাৎ গ্রহণ করা ও তার উপর আমল করাও পুত্রের উপর শরীয়তেরই নির্দেশ। এখানে আমাদের মধ্যকার এ আদানপ্রদান কিছুতেই কুরআনসুন্নাহ বিবর্জিত বা বিরোধী নয়।

মুসলিমজাতির হাতে তাদের শরীয়তের ব্যবহারিক রূপরেখা সমন্বিত ও সংকলিত আকারে তুলে দেওয়ার জন্য মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামএর নির্দেশে যেসব সাহাবী, তাবেয়ী ও পরবর্তী যুগের ফকীহগণ কঠোর জ্ঞানগবেষণা ও সাধনা করেছেন তাদের মর্যাদা বা গুরুত্ব নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা এখানে সম্ভব নয়, একখানা উদ্ধৃতি উল্লেখ করাই বিষয়টির মাহাত্ম্য উপলব্ধি করার জন্য যথেষ্ট মনে হয়। হযরত নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামএর একজন বিখ্যাত সাহাবী আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রা. বলেন, রাতের কিছু সময় ইলম চর্চা করা রাতভর নফল ইবাদতের চেয়েও উত্তম।

কুরআনসুন্নাহর ভেতর মানবজীবনের উদ্ভূত যে কোনো সমস্যার সমাধান পেয়ে গেলে এ থেকেই আমাদের তা গ্রহণ করতে হবে। অন্যথায় কুরআনসুন্নাহর আলোকে সমাধানে পৌঁছার জন্য নিজের জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও বিবেচনার আশ্রয় নিতে হবে। এটি হযরত নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামেরই আদর্শ। হযরত মুআয ইবনে জাবাল রা.কে ইয়েমেনে পাঠানোর সময় তার মুখ থেকে এ কথা শুনতে পেয়ে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খুশি হয়ে আল্লাহর শোকর গোযারি করেছিলেন।
ইসলাম পৃথিবীর সর্বকালের সকল মানুষের জন্য চিরস্থায়ী জীবনব্যবস্থারূপে কুরআন, সুন্নাহ, ইজমা ও কিয়াস প্রভৃতির মূলনীতির ভিত্তিতে ফকীহ ও মুজতাহিদ সাহাবীগণের মাধ্যমে ব্যবহারিক বিধানরূপে, সমস্যার সমাধানরূপে, বিচারালয়ে ফয়সালারূপে জীবনের প্রতিটি অঙ্গনে অতুলনীয় ব্যবস্থারূপে তার ব্যাপক আকার পরিগ্রহ করতে থাকে। ব্যবহারিক জীবনে ইসলামের নানা বিধানে কিছু বৈচিত্র ইসলামের বিশালত্ব ব্যাপ্তি ও কালজয়ী গুণেরই বহিঃপ্রকাশ। অসংখ্য বিষয়ে সাহাবায়ে কেরামের পর্যবেক্ষণে ছিল অনেক মতবৈচিত্র! এ ইসলামের এক স্বীকৃত রীতি। প্রায়োগিক বিধানের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ তথা বিস্তারিত ফিকহ রচনার সময়ও মুজতাহিদ আলেমগণের পর্যবেক্ষণ, উপলব্ধি ও নির্বাচনে এ ধরনের বৈচিত্র ফুটে ওঠে। শরীয়তে চিন্তার এ বৈচিত্রকে উৎসাহিত করা হয়েছে। তবে এ ক্ষেত্রে মূল কথা হচ্ছে কুরআন মজীদ, সুন্নাহ, প্রথম যুগের প্রচলন, সাহাবীদের ঐকমত্য আর পূর্ববর্তী নজির অনুসরণ। এসব মূলনীতি বিশ্লেষণ করেই আপেক্ষিক বিষয়ের মধ্যে একটিকে প্রাধান্য দেওয়া হবে। আর এ ইজতিহাদী তত্ত্বের ভিত্তিতেই গড়ে ওঠেছে ইসলামের বহুমাযহাব সম্বলিত ব্যবহারিক ফিকহ।

কুরআনসুন্নাহ ও এর প্রাসঙ্গিক সকল বিষয় যে সুযোগ্য ব্যক্তির নখদর্পণে, মুসলিম জাতির প্রয়োজনে তিনিই পারেন ইজতিহাদ করতে। কেননা, সাহাবায়ে কেরামের মতবৈচিত্রপূর্ণ কোনো বিষয় কিংবা সাহাবীদের যুগের পরবর্তী কোনো নতুন সমস্যার সমাধান নির্বাচন ও পর্যবেক্ষণ ছাড়া কার্যকর করা সম্ভব ছিল না। ফলে অসংখ্য মত ও মাযহাবের বৈচিত্র ছিল খুবই স্বাভাবিক, যার মধ্যে অপেক্ষাকৃত প্রসিদ্ধ চারটি মাযহাবের সাথে মুসলিম জনসাধারণ সমধিক পরিচিত। এসব মাযহাবের কোনোটিই কুরআনসুন্নাহ বহির্ভূত নয় এবং কোনোটিই এমন নয়, যার অনুসরণ করলে আমরা কুরআনসুন্নাহর অনুসারী বলে গণ্য হব না। এমনকি একটি মাযহাবের ইমাম অপর মাযহাবের ইমামের এলাকায় বেড়াতে গিয়ে তার ফিকহ অনুসারেই আমল করেছেন এমন উদাহরণও ইমামদের জীবনে দেখা যায়। যেন আমরা বুঝতে সক্ষম হই যে, মাযহাব কেবলই নির্বাচন ও পর্যবেক্ষণের বিষয়।
কুরআনসুন্নাহ, ইজমা ও কিয়াসের সমন্বয়ে প্রাপ্ত সিদ্ধান্তের বহুমাত্রিকতা থেকে একটি অবস্থাকে প্রাধান্য দেওয়ার নাম তারজীহ। আর এ প্রাধান্যপ্রাপ্ত সমাধানগুলোই হচ্ছে মাযহাবের বৈচিত্রপূর্ণ অংশ। অতএব মাযহাব মানা আর কুরআনসুন্নাহ মানার মধ্যে কোনোই ফারাক থাকার কথা নয়। তাছাড়া সাধারণ মুসলমানের পক্ষে কোনো আংশিক বা সামগ্রিক, প্রসিদ্ধ কিংবা অখ্যাত মাযহাব অনুসরণ ছাড়া শরীয়তের উপর আমল করাও প্রায় অসম্ভব।

কেননা, ইসলামের বিশালত্ব, চিরস্থায়িত্ব ও সর্বকালের সকল অঞ্চলের মানুষের উপযোগী ধর্ম ও জীবনব্যবস্থা হিসেবে এর ভেতরকার সবকিছুই পরম উদার ও বৈজ্ঞানিক। এতে অনেক সুযোগ, উদারতা ও বিস্তৃতি রয়েছে। জীবন ও জগতকে গতিশীল উপায়ে এগিয়ে নেওয়া ইসলামের প্রেরণা। সুতরাং এখানে প্রায় সব বিষয়েই অনেক এখতিয়ার, অনেক সহজতা। ইসলামের মূল ইবাদত নামাযের ভেতর যত বৈচিত্র ও সহজতা মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামএর জীবন থেকে হাদীসের মারফত আমরা পাই, এর সবগুলোর উপরই আমাদের আমল করার বৈধতা ও যুক্তি রয়েছে। এতে একজন বিজ্ঞ মুজতাহিদ যখন একটি নামায পদ্ধতি আমাদের জন্য কুরআনসুন্নাহ, ইজমা, কিয়াসএর আলোকে নির্বাচন করবেন, তখন সেটাই এক এলাকার, এক সংস্কৃতির মানুষকে ধারণ করতে হবে। এ পদ্ধতির চর্চাই পরস্পরগতভাবে প্রজন্মান্তরে চলতে থাকবে। শুধু নামায নয়, যাকাত, হজ্ব, কুরবানী, পাকনাপাক, হালালহারাম, জায়েযনাজায়েযের প্রতি ক্ষেত্রেই এভাবে মাযহাবের প্রয়োজনীয়তা মুসলিমজাতি উপলব্ধি করবে। সর্বোপরি সকল মাযহাবের ইমামদের অভিন্ন একটি কৈফিয়ত ইসলামে রয়েছে যে, আমার নির্বাচিত মাসআলার বিপরীতে যদি আরও শক্তিশালী প্রমাণ খুঁজে পাও তাহলে আমার মাসআলা ত্যাগ কর। বিশুদ্ধ হাদীস যদি আমার সিলেকশনকে চ্যালেঞ্জ করে তাহলে আমার কথাকে ছুঁড়ে ফেলে দাও। এখানে অবশ্য একজন মুজতাহিদের নির্বাচনকে যাচাই করার জন্যও ন্যূনতম কিছু যোগ্যতার প্রয়োজন। সাধারণ একজন দর্শক, শ্রোতা বা পাঠকের পক্ষে এক্ষেত্রে নাক গলানো খুবই ঝুঁকিপূর্ণ ও অসঙ্গত।
যদি কোনো ব্যক্তি নিজেই শরীয়তের সকল শর্ত পূরণ করা একজন মুজতাহিদ হন তাহলে তিনি কোনো ইমামের মাযহাব অনুসরণ না করে নিজেই কুরআনসুন্নাহর আলোকে জীবনযাপন করতে পারেন। তবে কুরআনহাদীসের অনেক শাস্ত্রবিদ মনীষীও এ ধরনের ঝুঁকি নিতে চাননি। কেননা, বিষয়টি শরীয়তের এক বা দুই শাস্ত্রের মাঝে সীমাবদ্ধ নয়, কুরআন ও হাদীস সংক্রান্ত সকল মৌলিক শাস্ত্রে গভীর বুৎপত্তির অধিকারী হয়ে নিজেকে নতুন পথের পন্থী দাবি করা চাট্টিখানি কথা নয়।

অতএব নির্দ্ধিধায় আমরা স্বীকৃত মাযহাবগুলোর উপর আমল করতে পারি। কর্মসূচিগত ও সামাজিক শৃঙ্খলার জন্য যে কোনো একটি মাযহাবকে বেছে নেওয়া জরুরি। যেমন, একটি বহুতল ভবনে ওঠার জন্য যদি সিঁড়ি, এসকেলেটর, লিফট, ক্রেন, রশি প্রভৃতি উপায় থাকে তাহলে একই সঙ্গে একাধিক উপায় অবলম্বন করা শৃঙ্খলাবিরোধী কাজ বলে বিবেচিত। একটি পন্থাই বেছে নিতে হবে আমাকে। তাছাড়া ধর্মীয় কার্যক্রমের ক্ষেত্রে একটি পন্থা অনুসারে আমল করা এজন্যও কর্তব্য যে, ইবাদত বা আচরণে অস্থিরতা এর আবেদনকে বহুলাংশে ক্ষুণ্ণ করে থাকে।

অতএব স্বাভাবিকভাবেই আমরা এ সিদ্ধান্তে আসতে পারি যে, মাযহাব অনুসরণ করলে প্রকৃতপক্ষে আমি কুরআনসুন্নাহই অনুসরণ করলাম। আমি তখন আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত। আমি তখন আহলে কুরআন, আহলে হাদীস। আমিই তখন সালাফী বা পূর্ববর্তী মুরববীদের অনুসারী। কেননা, এসব পথের মূল প্রেরণা আর মাযহাব সংকলনের প্রেরণায় কোনোই বিরোধ নেই। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে দ্বীনের সঠিক বোধ ও উপলব্ধি দান করুন, আমীন।

http://www.islamforuniverse.com/archives/1314

বিভাগ:ইসলাম ট্যাগসমূহ:, ,

সেদিন সংসদে সদ্যপ্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াকে নিয়ে রাজনীতিবিদরা যা বলেছিলেন…

লোকে যারে বড় বলে
শাকিল ওয়াহেদ

যে কোন মানুষের মৃত্যুর পর সদ্যপ্রয়াত ব্যক্তিটি কেমন মানুষ ছিলেন তা সমাজে কমবেশী আলোচিত হয়েই থাকে। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের অস্বাভাবিক মৃত্যুর পরও সারাদেশে শোকের ছায়া নেমে এসেছিল এবং সর্বস্তরের মানুষের মুখে মুখে তার সাদাসিধা জীবনাচরণ, তার সাফল্য-ব্যর্থতা, সাহসিকতা, দেশপ্রেম, মোহময় নেতৃত্বের গুণাবলী প্রভৃতি দিকগুলো ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়েছিল। একজন রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে কেমন ছিলেন তিনি? একজন মুক্তিযোদ্ধা ও রাজনীতিক হিসেবেই বা কেমন ছিলেন? ব্যক্তি জীবনে কেমন জীবন যাপন করতেন? সাধারণ মানুষের মুখে মুখে তার জীবনের বিভিন্ন দিক যেমন আলোচিত হচ্ছিল তেমনি আলোচিত হয়েছিল তত্কালীন জাতীয় সংসদের অধিবেশনেও। সরকারী দলের নেতৃবৃন্দ যেমন আলোচনা করেছিলেন তেমনি প্রধান বিরোধী দলসহ অন্য সব জাতীয় নেতৃবৃন্দও তার জীবনচরিত পুঙ্খানুপুঙ্খ মূল্যায়ন করেছিলেন। সেই সব সারগর্ভ আলোচনা ইতিহাসেরই অংশ এবং বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের মহাফেজখানায় সংরক্ষিত রয়েছে। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ৩২ তম শাহাদাত বার্ষিকী উপলক্ষে প্রকাশিত ক্রোড়পত্রে সেই ইতিহাসের খানিক পর্যালোচনা করা যাক।

চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে ১৯৮১ সালের ৩০ মে কিছু বিপথগামী সেনা কর্মকর্তার হাতে শাহাদাত বরণ করেন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। ১৯৮১ সালের ৩ জুন তারিখে দ্বিতীয় জাতীয় সংসদের সপ্তম অধিবেশনের অষ্টম বৈঠকে তত্কালীন স্পিকার মির্জা গোলাম হাফিজ একটি শোক প্রস্তাব উত্থাপন করেন। ওইদিনের সব কার্যসূচি স্থগিত রেখে শোক প্রস্তাবটির ওপর আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। সংসদের সরকারী দল, প্রধান বিরোধী দলসহ অন্যান্য দলের নেতৃবৃন্দের আলোচনার পর উত্থাপিত শোক প্রস্তাবটি stamp-ziaসর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়েছিল। আলোচকদের সকলেই সদ্য প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের অকাল মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করে তার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বক্তব্য রেখেছিলেন।

তত্কালীন স্পিকার জনাব মির্জা গোলাম হাফিজ সংসদে শোক প্রস্তাব উত্থাপন করে বলেছিলেন, ‘আমি অত্যন্ত দু:খ ভারাক্রান্ত ও বেদনাহত হৃদয়ে আপনাদের জানাচ্ছি যে, বাংলাদেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতি জনাব জিয়াউর রহমান, বীর উত্তম আর আমাদের মধ্যে নেই। তিনি গত ১৯৮১ সালের ৩০শে মে ভোরে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে কতিপয় দুষ্কৃতিকারীর হাতে নির্মমভাবে নিহত হয়েছেন (ইন্নালিল্লাহে…রাজেউন)। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল প্রায় ৪৫ বছর। …মরহুম জিয়াউর রহমান ছিলেন বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে গণতান্ত্রিক চেতনাবোধ জাগিয়ে তোলার একজন অক্লান্ত কর্মী ও নিবেদিতপ্রাণ। …স্বাধীনতা যুদ্ধের বীর মুক্তিযোদ্ধা, স্বাধীনতার অতন্দ্রপ্রহরী, গণতন্ত্রের সাধক, অকৃত্রিম দেশপ্রেমিক মরহুম জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ে বিশিষ্ট আসন লাভ করে আছেন।…’

তত্কালীন সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী জনাব শাহ আজিজুর রহমান বলেছিলেন, ‘…তিনি ইতিহাসের পৃষ্ঠায় চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষক হিসাবে। …তার জীবনের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব সবচাইতে উল্লেখযোগ্য অবদান যা আমি মনে করি সেটা হচ্ছে, শান্তিপূর্ণ প্রক্রিয়ায় মার্শাল ল থেকে গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তন। … যে কর্মচাঞ্চল্য এবং কর্মপ্রেরণা দেশবাসীর মধ্যে তিনি রেখে গিয়েছেন এটা হচ্ছে তার দুই নম্বর উল্লেখযোগ্য অবদান। তিন নম্বর অবদান হচ্ছে, তিনি বাংলাদেশের জন্য একটি multi party system বহুদলীয় গণতন্ত্র কায়েম করে গেছেন।…’

জাতীয় সংসদে তত্কালীন বিরোধীদলীয় নেতা ও আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য জনাব আছাদুজ্জামান খান বলেছিলেন, ‘জনাব স্পীকার, আজকে অত্যন্ত দুঃখভারাক্রান্ত মন নিয়েই এখানে বক্তব্য রাখতে হচ্ছে। …আজকে মরহুম জিয়াউর রহমান সাহেব আমাদের মধ্যে নেই। তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, জনাব স্পীকার। …তিনি ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন। জাতি সেটা স্মরণ করবে।…’

বাংলাদেশ জাতীয় লীগের প্রধান ও সংসদ সদস্য জনাব আতাউর রহমান খান বলেছিলেন, ‘…তিনি সরল-সহজ নিরলস জীবনযাপন করেছেন, অনাড়ম্বর জীবনযাপন করেছেন। মানুষকে ভালবেসেছেন এবং বাংলার জনগণের সঙ্গে তিনি একাত্মতা ঘোষণা করে তাদেরই একজন হয়েছিলেন। সাধারণ মানুষ মনে করত, জিয়াউর রহমান আমাদেরই মতো একজন সাধারণ মানুষ। তাকে তারা নিজেদের করে নিয়েছিল। এই গুণ সাধারণত অনেক নেতার মধ্যে পাওয়া যায় না। যার মধ্যে পাওয়া যায়, তিনি সত্যিকার অর্থে দেশের নেতা হতে পারেন। …’

গণতন্ত্রী পার্টির নেতা ও সংসদ সদস্য বাবু সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত সংসদে আনা শোক প্রস্তাবে সমর্থন দিয়ে বলেন, ‘…৩০ মে থেকে ৩ জুন যে লক্ষ লক্ষ জনতা শুধু ঢাকা নগরীতেই নয়, গোটা বাংলাদেশে তাদের অনুভূতি প্রকাশ করেছে, তার মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে যে, আমাদের সাবেক রাষ্ট্রপতি বাংলাদেশের মানুষের কত কাছাকাছি এবং প্রাণপ্রিয় ছিলেন। এটা বলতে যদি কেউ কুণ্ঠাবোধ করেন, এটা তার মানসিক দৈন্য এবং তার রাজনৈতিক বিচক্ষণতার অভাব বলে আমি মনে করি। …এই যে লক্ষ লক্ষ জনতার স্রোত, কেন এসেছিল এই লাশটির পাশে, কেন এসেছিল জানাজায় ও গায়েবি জানাজায়? এসেছিল একটি মাত্র কারণে—সাবেক রাষ্ট্রপতির সততার প্রতি অভিনন্দন ও শ্রদ্ধা জানাতে। …আমি কীভাবে এ পার্লামেন্টে এলাম, কীভাবে আমি এখানে কথা বলছি? এটা সেই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার অংশ এবং বাংলাদেশে সেই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া এভাবে চলছে। …রাষ্ট্রপতিকে কখন হত্যা করা হলো? ১৯৮০-তে নয়, ১৯৮১ সালের মে মাসে যখন রাষ্ট্রপতি দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলেন, যখন রাষ্ট্রপতি দৃঢ় প্রত্যয়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম ঘোষণা করলেন, যখন শোষণহীন সমাজব্যবস্থার কথা বলতে চাইলেন, দক্ষিণ এশিয়া, পৃথিবীর বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে গেলেন, সিরিয়ায় গেলেন, যখন নর্থ সাউথ ডায়ালগ ওপেন করতে গেলেন, আর সেই মুহূর্তে তার ওপর আঘাত এলো।…’

সংসদ সদস্য জনাব রাশেদ খান মেনন বলেছিলেন, ‘মাননীয় স্পীকার, মরহুম রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সাহেবের ওপর আপনি যে শোক প্রস্তাব এনেছেন, তার প্রতি আমি আমার ব্যক্তিগত এবং দলের তরফ থেকে একাত্মতা ঘোষণা করছি। …মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে জিয়াউর রহমানের সঙ্গে আমার পরিচয়। তাকে সেভাবেই আমি দেখেছি, তাকে সেভাবেই আমি সম্মান করেছি। তার সঙ্গে তার যে কীর্তি, সেই কীর্তি অমর এবং অক্ষুণ্ন থাকুক—এটা কামনা করি।…’

সাম্যবাদী দলের সংসদ সদস্য মোহাম্মদ তোয়াহা বলেছিলেন, ‘…আজকে আমাদের মরহুম রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সাহেবের প্রশংসার কথাই আমাকে বলতে হবে। সফলতা এবং ব্যর্থতা নিয়েই মানুষের জীবন। মানুষকে বিচার করতে হবে—তার সফলতার দিক প্রধান, না ব্যর্থতার দিক প্রধান সেদিক থেকে। আমি নিঃসন্দেহে বলতে চাই, মরহুম জিয়াউর রহমান তার সফলতা নিয়েই আমাদের মধ্য থেকে বিদায় নিয়েছেন। …লিডারশিপ সম্পর্কে একটা কথা আছে, Some people are born leaders, leadership is thurst upon somebody, some acquire leadership বোধহয় শেষোক্ত দুটি কারণেই আমরা তাকে Leader হিসেবে দেখেছি। জাতির জীবনের এক সঙ্কটপূর্ণ মুহূর্তে তার ওপর এই গুরুদায়িত্ব অর্পিত হয়েছিল। তিনি নেতা হয়ে জন্মাননি। একটা বিশেষ ঘটনাপরম্পরায় তার ওপর দায়িত্ব এসেছিল এবং তার পরবর্তী বছরগুলোতে তিনি সে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে He has acquired all the art of leadership. তাই আজ বলব, বিশ্বপরিসরে যাদের আমরা সাধারণত এত্বধঃ খবধফবত্ বলি, জেনারেল জিয়া সাহেবকে সেইরূপ Great Leader-এর পর্যায়ভুক্ত আমি বলতে চাই। …গোটা বিশ্বে তিনি বাংলাদেশকে তুলে ধরতে পেরেছেন সফলতার সঙ্গে। তিনি মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশের একাত্মতা প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তৃতীয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের জাতীয় স্বার্থের পক্ষে তিনি দাঁড়িয়েছিলেন।…’

ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ) প্রধান অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ বলেছিলেন, ‘…তিনি একজন সাধারণ মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন না, তিনি একজন সক্রিয় মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তিনি নিজ জীবনকে বাজি রেখে যুদ্ধ করেছেন এবং রেডিও মারফত স্বাধীনতার বাণী ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়েছেন। আমি যখন ঢাকা শহরেই আত্মগোপন অবস্থায় ছিলাম, তখন রেডিও মারফতই তার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। পরবর্তী পরিচয়ের কথা বলে আমি দীর্ঘায়িত করতে চাই না। তিনি একজন determined লোক ছিলেন, তিনি একজন সত্ লোক ছিলেন এবং জনতার মধ্যে তার জন্য যেটা আপনারা লক্ষ করেছেন, সেটায় আমি দ্বিমত পোষণ করছি না। তিনি জনতাকে কিছু দিয়ে যেতে পেরেছিলেন, সেটার কারণেই নয়; জনতা বুঝতে পেরেছিল, তিনি কিছু দিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তারা বুঝতে পেরেছিল, তিনি একজন সত্ ও দেশপ্রেমিক লোক।…’

জাসদ নেতা ও সংসদ সদস্য জনাব শাজাহান সিরাজ বলেছিলেন, ‘…৩০শে মে মাননীয় রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মর্মান্তিক পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডে সারা জাতি মর্মাহত স্তম্ভিত। এই হত্যাকাণ্ডের নিন্দা করার কোন ভাষা আমার নাই। মরহুম রাষ্ট্রপতির বিদেহী আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা ও মাগফেরাত কামনা করছি এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারকে সহানুভূতি জানাচ্ছি।…’

আওয়ামী লীগ (মিজান) প্রধান জনাব মিজানুর রহমান চৌধুরী বলেন, ‘মাননীয় স্পীকার, মরহুম জিয়াউর রহমানের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় হয়েছিল পাকিস্তানে, যখন ১৯৫৮ সালে মার্শাল ল’ দেয়া হয়। তারপরে তার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল খেমকারান রণাঙ্গনে। আমরা পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের তরফ থেকে সেখানে গিয়েছিলাম। তারপর তার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের সময়ে। বড় দুঃখের দিনের পরিচয়। চোখের জলের বিনিময়ে সেই পরিচয় আমাদের হয়েছিল। আজকে তিনি জীবিত নেই। মৃত্যু এ জীবনেরই পরিণতি। ধর্মীয় দিক থেকে বলুন, দার্শনিক দিক থেকে বলুন, কবির দিক থেকে বলুন, এসব মুখোমুখি এসব দেখাশোনা ক্ষণিকের মেলা। মানুষ আসে যাওয়ার জন্যই। তিনি গিয়েছেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো এই যে, এই মৃত্যু তো স্বাভাবিকভাবে হতে পারত।…’

আইডিএল প্রধান ও সংসদীয় দলের নেতা মাওলানা মুহাম্মদ আবদুর রহীম বলেছিলেন, ‘…মরহুম জিয়াউর রহমান সাহেবকে এদেশের জনগণ কখনই ভুলতে পারে না বলে আমি মনে করি। তিনি এই জাতি, সাধারণভাবে সমস্ত মানুষের জন্য, এদেশের কল্যাণের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে গিয়েছেন। মূহুর্তকাল তিনি বিশ্রাম নিয়েছেন বলে আমি মনে করি না। সব সময় তিনি দেশের উন্নতি, জনগণের সার্বিক কল্যাণ, এগুলি নিয়েই চিন্তা ভাবনা করে গিয়েছেন।…’

মুসলিম লীগ সংসদীয় দলের নেতা জনাব খান এ সবুর বলেছিলেন, ‘…জিয়াউর রহমান সাহেব সাদাসিধা জীবনযাপন করতেন। তার অপ্রাপ্ত বয়স্ক সন্তানদের জন্য এবং বিধবা পত্নীর জন্য তিনি একখানি বাড়ি রেখে যেতে পারেননি। তার ব্যাংক ব্যালান্সও নেই। এই ছেলেপিলেদের সাবালক হওয়া পর্যন্ত শিক্ষার কোনো ব্যবস্থাই তিনি করে যেতে পারেননি। কেননা কোনোদিন টাকা পয়সার লোভ-লালসা তার ছিল—একথা তার শত্রুরাও বলতে পারবে না।…’

জাতীয় সংসদের উপরোক্ত অধিবেশনে উত্থাপিত শোক প্রস্তাবের ওপর আলোচনা অনুষ্ঠানের আগের দিন অর্থ্যাত্ ১৯৮১ সালের ২ জুন তারিখে জাতীয় সংসদের সামনে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের জানাজা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেই জানাজায় সেদিন লক্ষ লক্ষ মানুষ অংশ নিয়েছিল এবং জানাজা পরিণত হয়েছিল এক জনসমুদ্রে। সারাদেশের কোটি মানুষের কান্না, চোখের জল আর দোয়া নিয়ে সেদিন শেষ বিদায় নিয়েছিলেন বাংলাদেশের জনগণের প্রাণপ্রিয় নেতা ও রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। চিরনিদ্রায় শায়িত হয়েছিলেন জাতীয় সংসদেরই পাশে ক্রিসেন্ট লেকের পাড়ে। জৈবিকভাবে অনুপস্থিত থাকলেও তিনি আজো সগৌরবে বিরাজ করেন বাংলাদেশের হাটে-মাঠে-ঘাটে এবং তার প্রিয় জনগণের হৃদয়ের মণিকোঠায়।

লেখক : সহ-তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক,
বিএনপি; সহ-সভাপতি, জাতীয়তাবাদী তাঁতীদল;
মহাসচিব, এমবিএ এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ম্যাব)

তথ্যসূত্রঃ দৈনিক আমার দেশ, ৩০ মে, ২০১৩

বুখারী শরীফের হাদীস সংখ্যা গণনায় তারতম্যের কারণ ও তার নিরসন

এপ্রিল 6, 2012 ১টি মন্তব্য

bukhari_hadith_count

আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ বিন ইসমাঈল বিন ইবরাহীম বিন মুগীরাহ ইবনে বারদিযবাহ আল বুখারী আল জুফী সংক্ষেপে ইমাম বুখারী (রঃ) তাঁর সুবিখ্যাত “আলজামিউল সাহীহুল মুসনাদুল মুখতাসিরু মিন উমুরি রাসুলিল্লাহি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামা ওয়া সুন্নাতিহী ওয়া আইয়্যামিহী” (বাংলা অর্থঃ “রাসুলে করীমের কার্যাবলী ও তাঁর সমসাময়িক যুগের সমস্ত অবস্থা ও ব্যাপারসমূহের বিশুদ্ধ সনদযুক্ত বিবরণের ব্যাপক সংকলন”) – সংক্ষেপে বুখারী শরীফএ ঠিক কতগুলো সহীহ হাদীস সন্নিবেশিত করেছিলেন তার সঠিক সংখ্যা নির্ভরযোগ্যভাবে জানা যায় না এবং জানা সম্ভবও না । বিভিন্ন সংকলকের দ্বারা প্রস্তুত বুখারী শরীফে বিভিন্ন সংখ্যক হাদীসের সংখ্যা দৃষ্টিগোচর হয় । যেমনঃ

ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ সর্বমোট হাদীস সংখ্যার ব্যাপারে (হাফিয ইবনে হাজার (রঃ)-এর গণনার ভিত্তিতে) বলেছে ৭,৩৯৭, তাকরার বাদে ২,৫১৩ আর মুআল্লাক ও মুতাবাআত যোগে ৯,০৮২ ।

আধুনিক প্রকাশনী থেকে ছাপানো বুখারী শরীফ হাতের কাছে নাই । তবে আমার ধারণা, তারাও হাফিয ইবনে হাজার (রঃ)-এর গণনাই ব্যবহার করেছে ।

রশিদিয়া লাইব্রেরী কর্তৃক ২০০২ সালে প্রকাশিত মাওলানা আজিজুল হক অনুদিত বোখারী শরীফ (বাংলা তরজমা ও বিস্তারিত ব্যাখ্যা) গ্রন্থের ১ম খন্ডের চল্লিশ পৃষ্ঠায় ইমাম বুখারীর সংকলনে হাদীসের সংখ্যা ২,৬০২ বা ২,৫১৩টি বলে উল্লেখ করা হয়েছে ।

সোলেমানিয়া বুক হাউস থেকে প্রকাশিত “সহীহ বোখারী শরীফ” গ্রন্থের ভূমিকায় বলা হয়েছে, “ইমাম নববী তাঁর তাহযীবনামক কিতাবে এবং হাফেজ ইবনে হাজার (রঃ) তাঁর রচিত ফাতহুল বারীকিতাবের ভূমিকায় বর্ণনা করেছেন, বোখারী শরীফে উল্লিখিত হাদীসের সংখ্যা ৭,২৭৫ খানা। আর পুনরুক্ত ছাড়া প্রায় চার হাজার মতান্তরে ৭,৩৯৭, ,০৮২ ইত্যাদি ।”

তাওহীদ পাবলিকেশন্স থেকে ২০১২ সালে প্রকাশিত সহীহুল বুখারী শরীফ গ্রন্থের ১ম খন্ডের ৬৩৯ নং পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, আলমুজামুল মুফাহরাসের হিসাব অনুযায়ী সর্বমোট ৭,৫৬৩ টি এবং তাকরার বাদে ৪,০০০ টি হাদীস আছে ।

আল্লামা জলিল আহসান নদভী রচিত ও হাফেয আকরাম ফারুক অনুদিত “রাহে আমল” গ্রন্থের ১ম খন্ডের ২৬নং পৃষ্ঠায় বুখারী শরীফের হাদীসের সর্বমোট সংখ্যার ব্যাপারে উপরোক্ত বইএর ঐ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে ৯,৬৮৪। সেখানে আরো বলা হয়েছে, “পুনরুক্তি ও তালীকাত (সনদবিহীন রিওয়ায়াত), শাওয়াহিদ (সাহাবাদের বাণী) ও মুরসাল হাদীস বাদ দিলে শুধু মারফু হাদীসের সংখ্যা দাঁড়ায় ৬,২৩০এ।”

মোহাম্মদ আবদুল করিম খান সংকলিত বাংলায় বোখারী শরীফ হাদীসসমূহ“, প্রকাশনায় বাংলাদেশ লাইব্রেরী, ১০নং পৃষ্ঠায় বলেছেন, “মুফতী আমিনুল এহসান সাহেবের মতে বোখারী শরীফে সংকলিত হাদীসের সংখ্যা ৭,৩৯৭ । তাকরার বা পুনরাবৃত্তি বাদ দিলে এই সংখ্যা দাঁড়ায় ২,৪৬০টি । মতান্তরে বোখারী শরীফে সংকলিত মওকুপ রেওয়াতের ছাড়া মোট হাদীস ৯,০৮২টি এবং তাকরার বাদ দিলে এই সংখ্যা দাঁড়ায় ২,৫১৩টি ।”

ঝিনুক পুস্তিকা থেকে পাকিস্তান আমলে (বর্তমানে দুষ্প্রাপ্য) প্রকাশিত অধ্যক্ষ আলী হায়দার চৌধুরী অনুদিত ও সংকলিত হাদীসে রসূল” গ্রন্থের ৩৯নং পৃষ্ঠায় বোখারীতে হাদীসের সংখ্যা তাকরার সহ ৭,৩৯৭ এবং তাকরার বাদে ২,৭৬১ বলে উল্লেখ করেছেন ।

উপরোক্ত বইটিকে পরিমার্জন ও সম্পাদনা করে একই নামে বিউটি বুক হাউস থেকে মাওলানা মোঃ তারিকুল ইসলাম প্রকাশিত বইএ ঐ সংখ্যা দুটো ৯,০৮২ এবং ২,৬০৭ বলে উল্লেখ করা হয়েছে ।

মদীনা ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. মুহাম্মাদ মুহসিন খান কর্তৃক দারুস সালাম প্রকাশনী থেকে ১৯৯৪ সালে প্রকাশিত ও ইংরেজীতে অনুদিত Summarized Sahih Bukhari বই(আযযুবাইদী রচিত আততাযরীদ আসশরীহমূল গ্রন্থ থেকে) তাকরারসহ ৭,২৭৫ (আনুমানিক) এবং তাকরার বাদে ২,২৩০ (আনুমানিক) বলে উল্লেখ করেছেন । [পৃষ্ঠা নং ১০ ও ১৯]

এর কারণ হিসেবে ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত বুখারী শরীফে বলা হয়েছে, “বিভিন্ন বর্ণনাকারী ও গণনাকারীদের গণনায় এ সংখ্যার তারতম্য পরিলক্ষিত হয় ।” কিন্তু কেনো এই তারতম্য তার কোনো ব্যাখ্যা নেই সেখানে ।

অবশেষে অত্যন্ত মনোগ্রাহী ও একমাত্র কারণ খুঁজে পেলাম আমাদের বাংলাদেশেরই এক বোদ্ধা ইসলামী পন্ডিত মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুর রহীম সাহেবের গবেষণালদ্ধ বই “হাদীস সংকলনের ইতিহাস”এর পাতায় । সেখানে তিনি বলেছেন, “সংখ্যা গণনায় এই পার্থক্যের মূলে একটি প্রধান কারণ রহিয়াছেঃ ইমাম বুখারীর এই মহামূল্য গ্রন্থের প্রণয়নকার্য যদিও ষোল বৎসরের মধ্যে সমাপ্ত হইয়াছিল, তথাপি ইহাতে পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও সংযোজন, পরিবর্জনের কাজ ইহার পরও দীর্ঘদিন পর্যন্ত চলিতে থাকে । এই কারণে ইমাম বুখারীর নিকট হইতে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ছাত্র ইহা শ্রবণ করিয়াছেন বলিয়া তাঁহাদের নিকট রক্ষিত গ্রন্থের হাদীসের সংখ্যায় পার্থক্য সূচিত হইয়াছে ।” [পৃষ্ঠা নং ৩৮৩]

এছাড়া, মাওলানা আজিজুল হকও একটি সুন্দর ব্যাখ্যা দিয়েছেন যা এখানে প্রণিধানযোগ্য– “একটি হাদীছের বিভিন্ন সনদ থাকে, এমনকি এক একজন সাক্ষ্যদাতার বিভিন্নতায় একটি মূল হাদীছের এক একশত সনদও হইয়া থাকে । হাদীছ শাস্ত্রের পরিভাষায় মূল হাদীছ ও সনদের সমষ্টিকে হাদীছ বলা হয় । এই সূত্রে একটি মূল হাদীছ একশত বা ততোধিক হাদীছ {হিসেবে} পরিগণিত হইতে পারে । মোহাদ্দেছগণের সংগৃহীত হাদীছের যে সংখ্যা বর্ণিত হইয়া থাকে তাহা এই পরিভাষার ভিত্তিতেই । বোখারী শরীফে মূল হাদীছের সংখ্যা ২৬০২ কাহারও গণনায় ২৫১৩ । উক্ত সংখ্যক মূল হাদীছই পারিভাষিক সংজ্ঞা মতে প্রায় ৪০০০ সংখ্যায় পরিণত হইয়াছে । তন্মধ্যে বহু সংখ্যক হাদীছ একাধিক স্থানে উল্লেখ হইয়াছে । প্রত্যেক স্থানের হাদীছকে ভিন্ন ভিন্ন গণনা করিলে বোখারী শরীফের হাদীছ সংখ্যা হইবে ৭২৭৫ ।

এটি ছিলো আমার মনের মধ্যে লালিত দীর্ঘ দিনের একটি প্রশ্ন যার উত্তর খুঁজে পেলাম গত রাতে ।

আল্লাহপাকের শুকরিয়া আদায় করছি এবং সেই সাথে মাওলানা আবদুর রহীম ও শায়খুল হাদীস আজিজুল হক সাহেবের জন্য দুয়া করছি । আমীন ।

বিঃদ্রঃ আরবীতে বুখারী শরীফের পুরো নাম ও তার বাংলা রূপান্তর মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুর রহীম প্রণীত হাদীস সংকলনের ইতিহাস” গ্রন্থ (পৃষ্ঠা নং ৩৩) থেকে নেয়া হয়েছে যা তিনি মাওলানা আহমদ আলী সাহারানপুরী রচিত মুকাদ্দামা সহীহুল বুখারী (আরবীতে লিখিত, আবদুর রহীমের বইএর গ্রন্থপঞ্জীর রেফারেন্স বই নং ৯) গ্রন্থের ১৫০ পৃষ্ঠা থেকে নিয়েছেন। বিভিন্ন গ্রন্থে বুখারী শরীফের এই পুরো নামের কিছুটা হেরফের দেখা যায় । আবদুর রহীম সাহেবের বইএ নামটি নোকতা সহকারে উদ্ধৃত বলে আমি তারটি গ্রহণ করেছি ।

বিভাগ:ইসলাম ট্যাগসমূহ:,

সিরিয়া নিয়ে আমার পর্যালোচনা

map-syria

শুরুতেই বলে নিচ্ছি এ লেখাটি একপেশে অর্থাৎ বাশার আসাদকে এখানে তুলোধুনা করা হয়নি। আবার বাশার বা তার বাবা কর্তৃক নির্মমভাবে নির্যাতিত বিরাট সংখ্যক সিরিয়ার মুসলিম জনগোষ্ঠীর (যারা আজ বিদ্রোহী নামে অভিহিত) মুক্তিকামী সশস্ত্র প্রচেষ্টাকেও এখানে সপ্রশংস দৃষ্টিতে তুলে ধরা হয়নি। সাধুবাদ দেয়া হয়নি বিদ্রোহীদের অর্থঅস্ত্র যোগানদাতা মধ্যপ্রাচ্যের কতিপয় রাজন্যবর্গকে বা বিদ্রোহীদের পাশে লড়তে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা জানবাজ মুসলিমদেরকে। পশ্চিমা বিশ্বের গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের বুলি কপচানো ভন্ড দেশগুলোরও স্তুতি গাওয়া হয়নি এই লেখায়। এটি সিরিয়ার সার্বিক পরিস্থিতির মূল্যায়ন বিষয়ক কোন পোষ্টও নয়। ষ্টিকি হবে, বেশুমার লাইক দেয়া হবে, প্রিয়তে রাখা হবে, অনেকবার পঠিত হবে বা ভালো লাগলোধরণের মন্তব্য পাওয়া যাবে এমন চিন্তা করেও এই লেখা তৈরী করা হয়নি। ব্লগে এ সংক্রান্ত যে লেখাগুলো আমার ভালো (চোখে পড়ার কারণে ব্লগে আমার আনাগোনা অনিয়মিত গোছের) লেগেছে, আগ্রহী পাঠকরা সেগুলোর উপর চোখ বুলিয়ে নিতে পারেন। আমি শুধু ঐ পয়েন্টগুলোর উপর আলোকপাত করবো যা নীচের লেখাগুলোতে আসেনি বা আসলেও জোরালোভাবে ফুটে উঠেনি।

সিরিয়া ইস্যুতে সরবরা ফিলিস্তিন প্রসঙ্গে নীরব কেন

ষড়যন্ত্রের বেড়াজালে সিরিয়া

তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ কি আসন্ন ? না কি এক মহাযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে এই বিশ্ব ?

সিরিয়াসহ মুসলিম বিশ্বে মার্কিন মহাষড়যন্ত্র ও সেবাদাসদের ভণ্ডামি (অত্যন্ত বিস্তারিত গবেষণাধর্মী লেখা)

রাজনৈতিক বিশ্লেষণঃ সিরিয়াতে মার্কিন হামলার উদ্দেশ্য কি ???

ক্রুসেডারদের জাহান্নামের টিকেট ধরিয়ে দেয়া দরকার

সিরিয়ার যুদ্ধে কানা দাজ্জালের আবির্ভাব

“Humanity”-এর দোহায় দিয়ে “Human”, হত্যা এ কেমন কথা!!

কারো পৌষ মাস আর কারো সর্বনাশ

সিরিয়া নিয়ে তাবৎ বিশ্বে এখন এক চাপা উত্তেজনা উৎকন্ঠা বিরাজ করছে এই বুঝি অতর্কিতে মিসাইল হামলা শুরু হয়ে গেলো।কারো পৌষ মাস আর কারো সর্বনাশবলে বাংলায় এক প্রবাদ বাক্য প্রচলিত আছে সিরিয়ার ব্যাপারটা অনেকটা সে রকম সিরিয়ার বিদ্রোহী এবং তাদের সমর্থনকারী এক শ্রেণীর সাধারণ মুসলমান, আগ্রাসী স্বার্থান্বিত পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী দেশসমূহ (বিশেষত যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ফ্রান্স) তাদের পদলেহী নপুংশক আরব রাষ্ট্রসমূহের (বিশেষত সৌদী আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, কুয়েত, বাহরাইন, তুরষ্ক, জর্ডান) কাছে এটা অবশ্য নিদারুণ আনন্দজনক সংবাদ। অন্যদিকে আরেক শ্রেণীর সাধারণ মুসলমান, বাশারের সমর্থনকারী সিরিয়াবাসী, শিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম দেশ বা গোষ্ঠীসমূহ (যেমন, ইরান, ইরাক, বাহরাইনের শিয়া সম্প্রদায়, হিজবুল্লাহ সমর্থিত লেবাননের শিয়া জনগোষ্ঠী) এবং স্বার্থান্বিত বিদেশী রাষ্ট্র (যেমন, রাশিয়া, চীন, ভেনিজুয়েলা) এদের কাছে সিরিয়ায় সশস্ত্র হামলা হবে নিতান্ত পীড়াদায়ক ব্যাপক প্রাণহানী ছাড়া রয়েছে রাষ্ট্রের অবকাঠামো (সামরিক স্থাপনা ধ্বংসের পাশাপাশি বেসামরিক স্থাপনা যেমন, সড়কতথ্যআকাশ যোগাযোগ ব্যবস্থা, পানিবিদ্যুৎচিকিৎসাবসবাস ইত্যাদি) ধ্বংস। তাই তো কথায় আছে, “রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয়, উলু খগড়ার প্রাণ যায়।

এর বাইরে অবশ্য মূলত বাণিজ্যিক কারণে বা যুক্তরাষ্ট্রের নেকনজরে (বিশ্বমোড়ল আমেরিকার রক্তচক্ষুর ভয় তো আছে) থাকার জন্য অনেক মুসলিমঅমুসলিম রাষ্ট্র নীরবে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে অদ্যাবদি নীরব ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে (তবে সময়মত সমর্থন দানে এরা পিছপা হবে না) – যেমন, মিশরের মুসলিম ব্রাদারহুড ও নূর (সালাফিষ্ট) ব্যতীত সমগ্র আফ্রিকা মহাদেশ, সমগ্র দক্ষিণ আমেরিকা, যুক্তরাষ্ট্র ব্যতীত উত্তর আমেরিকার সমস্ত দেশগুলো, সমগ্র ওশানিয়া, ভারতীয় উপমহাদেশ, দূরপ্রাচ্য এবং দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দেশগুলো এবং ইউরোপের সাবেক কমিউনিষ্ট ব্লকের দেশগুলো।

ঝিকে মেরে বউকে শেখানো

আমার এই লেখা পড়ে কেউ তার বউকে পেটালে আমি কিন্তু দায়ভার গ্রহণ করবো না সেটা আগেই বলে রাখলাম ! খ্যাতনামা সাংবাদিক রবার্ট ফিস্কের লেখায় যে কথাটি ফুটে উঠেছে তা হচ্ছে, The Road to Damascus is through Syria. এক লক্ষাধিক মানুষ নিহত হলে সেটা মানবাধিকারের তথাকথিত ধ্বজাধারীদের বিবেকে তেমন কোন আলোড়ন সৃষ্টি করলো না অথচ রাসায়নিক গ্যাসে ,৩০০ মানুষের প্রাণহানীতে মায়াকান্না তুলে রণহুংকার তোলা হলো ফিস্ক এতে বড় আশ্চার্যান্বিত হয়েছেন ! হবার কথা। ফিস্কের ধারণা, বাশারের বাহিনী কর্তৃক সম্প্রতিকালে বিদ্রোহীদের সাফল্যজনকভাবে দমন করতে পারায় (অত্যাধুনিক অস্ত্র সরবরাহ প্রশিক্ষণ প্রদান করার পর) পশ্চিমা শক্তি ধৈর্য হারিয়ে ফেলেছে। ব্লগার এম আর মিলন যর্থার্থ বলেছেন, “এটা হলো ইরান আক্রমনের পুর্ব প্রস্তুতি। কারণ ইরান আক্রমন করতে হলে ইরানের অন্যতম প্রতিরোধ শক্তি হিজবুল্লাহ সিরিয়াকে ধ্বংস করতে হবে। এটাই হল যুদ্ধ শুরুর মূল কথা এই যুদ্ধে সবচেয়ে লাভবান হবে ইসরায়েল কারণ এতে হিজবুল্লাহ, ইরান, সিরিয়ার শক্তি অনেকাংশে বিনাশ হবে আর এটাই ইসরায়েলের পরম চাওয়া পাওয়া।

রাসায়নিক অস্ত্র নিয়ে বিশ্ব মোড়লদের বাগাড়াম্বর

বিশ্ব মোড়লরা আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুল প্রদর্শন করে নিজেরা প্রতি বৎসর বিশাল অংকের অর্থ অধিকতর কার্যকর নিত্যনতুন রাসায়নিক অস্ত্র উদ্ভাবনে গবেষণা উৎপাদনে ব্যয় করে চলেছে এমনকি জায়গা বুঝে চুপিসারে প্রয়োগ করে চলেছে বা স্বৈরশাসকদের সরবরাহ করে চলেছে। (বাংলাদেশে কয়েক মাস আগে বিরোধী রাজনৈতিক দল, এমনকি প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতনভাতার শান্তিপূর্ণ আন্দোলনসমাবেশ, দমন করতে আমরা বিষাক্ত পেপারস্প্রে ব্যবহার দেখলাম একজন শিক্ষক মৃত্যুবরণ করলেন বাকীদের অনেককে হয়তো ভবিষ্যতে কান্সারাক্রান্ত পাওয়া যাবে ?) আবার এই ভন্ডবদমাসের দল অন্যরা এই অস্ত্রের প্রয়োগ করলে তাদের উপর হামলে পড়ছে। ইরাকে বিষাক্ত সাদা ফসফরাস ডিপ্লিটেড (depleted) ইউরেনিয়ামসমৃদ্ধ যুদ্ধাস্ত্র প্রয়োগের ফলে সেখানে হৃৎপিন্ড মস্তিষ্কে রোগ নিয়ে কিম্ভুতকিমাকার শিশুদের জন্ম হচ্ছে 

disfigured_child_headমানবাধিকারের ধ্বজাধারীদের সেদিকে কোন ভ্রূক্ষেপ নাই। টঙ্কিন সাগরের মিথ্যা প্রপাগান্ডা দিয়ে ভিয়েতনাম যুদ্ধে জড়িয়ে ভিয়েতনাম, লাওস কম্বোডিয়ায় আমেরিকানরা ফেলেছিলো ২০ মিলিয়ন গ্যালন এজেন্ট অরেঞ্জ। সেখানে দীর্ঘদিন ইরাকের মতো অবস্থা বিদ্যমান ছিলো লক্ষ মানুষ মৃত্যুবরণ করেছিলো আর লক্ষ শিশু বিভিন্ন জন্মগত দোষ নিয়ে জন্মেছিলো আর হিরোশিমা নাগাসাকির কথা কে না জানে? পরমাণু অস্ত্র তো এক প্রকার রাসায়নিক অস্ত্র ! ইরানের বিরুদ্ধে এক যুগব্যাপী যুদ্ধে আমেরিকানরা সাদ্দামকে মাস্টার্ড গ্যাস সরবরাহ করেছিলো ! তাছাড়া সাদ্দাম ১৯৮৮ সালে হাল্লাবজা এলাকায় ইরাকী কুর্দীদের উপর গ্যাস প্রয়োগ করায় হাজার হাজার লোক মারা গেলে তখন কিন্তু আমেরিকা মুখে কুলুপ এঁটে বসে ছিলো। ভন্ডামী আর কাকে বলে !

শত শত ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হানবে সিরিয়ায়

tomahawk

ইরাক আফগানিস্তানে যা করেছে এবার যুক্তরাষ্ট্র তা করতে পারে অর্থাৎ সিরিয়ার বাহিনী কিছু বুঝে উঠার আগে pre-emptive-ভাবে শুরুতে যুদ্ধজাহাজ বা সাবমেরিন থেকে এক সাথে ঝাঁকে ঝাঁকে টোমাহক মিসাইল (যা রাডার ফাকি দিয়ে অত্যন্ত নীচু দিয়ে উড়ে গিয়ে আঘাত হানতে সক্ষম) নিক্ষেপ করে তাদের কিংকর্তব্যবিমূঢ় করে দেয়া। আফগানিস্তানে শুরুতে ৫০০ মিসাইল নিক্ষেপ করলে ইরাকে সে সংখ্যা ছিলো ,০০০ এটাকে তারা নাম দিয়েছে Shock & Awe treatment. Naomi Klein রচিত The Shock Doctrine বইটি পড়ে নেয়া যেতে পারে যেখানে জাতিসংঘকে ব্যবহার করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শকদেয়ার অর্থনৈতিক (এর প্রবক্তা শিকাগোবয় খ্যাত মিল্টন ফ্রীডম্যান) দিকটি নিয়ে বিশদভাবে আলোকপাত করা হয়েছে।

There ain’t any such thing as a free lunch বলে একটা কথা আছে যা জন কেরির মুখ থেকে নিৎসারিত হচ্ছেঃ

সিরিয়া হামলার খরচ সৌদি’র নেতৃত্বাধীন আরব দেশগুলোর: কেরি

আমার অনুমান, বাশার হয়তো বিদ্রোহীদের সাথে গেরিলা ষ্টাইল যুদ্ধে এটে উঠতে না পেরে রাসায়নিক অস্ত্র প্রয়োগ করে থাকতে পারে । বাশার যখন সম্প্রতি রাশিয়ার প্রস্তাবানুযায়ী তার রাসায়নিক অস্ত্র আন্তর্জাতিক তত্ত্বাবধানে রাজী হয় তখন স্পষ্ট হয়ে যায় যে, আসাদের কাছে রাসায়নিক অস্ত্র মজুদ আছে। তবে এটা আগে থেকেই জানা থাকার সুবাদে সুযোগ নিয়ে ইসরাঈল বা সিরীয় বিদ্রোহীরা আমেরিকার দ্বারা হামলাকে ত্বরান্বিত করার পন্থা হিসেবে রাসায়নিক অস্ত্র প্রয়োগ করে থাকতে পারে। তবে এ ধরণের কুটচাল অনেক সময় ঈশপের গল্পের মিথ্যাবাদী রাখালের তৃতীয় বারের বাঘ বাঘ চিৎকারে পর্যবসিত হতে পারে। জাতিসংঘের তদন্তকারী দলকে রাসায়নিক অস্ত্র প্রয়োগের ঘটনাস্থল পরিদর্শনে বাধা প্রদান ঐ সন্দেহকে বাড়িয়ে দেয় বৈকি।

অত্যন্ত নৃশংস হত্যাকান্ডে অভ্যস্ত এই সিরীয় বিদ্রোহী দল (দেখুন, নৃশংসতায় পিছিয়ে নেই সিরিয়ার বিদ্রোহীরাও, http://www.mzamin.com/ সেপ্টেম্বর ২০১৩) মৃত সিরীয় সৈন্যদের কলিজা চিবিয়ে খাওয়া, সাহাবীর মৃতদেহ কবর থেকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া, ঠান্ডা মাথায় নিরস্ত্র ট্রাক চালকদের হত্যা করা (শুধুমাত্র শিয়া হবার কারণে সালাফী সৌদী ওহাবীরা শিয়াদের কাফির মনে করে যেমনটি বেনামাযীদের কাফির বলে ফতোয়া দেয়) বা যুদ্ধবন্দীদের আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে তড়িঘড়ি কোমলমতি শিশুদের সামনে ছুরি দিয়ে শিরোচ্ছেদ করা, ভিডিও এখানে ইত্যাদি।

মিশর ও সিরিয়ার সাম্প্রতিক ঘটনাবলী বিশুদ্ধ ওয়াহাবী ইসলামের দাবীদার মধ্যপ্রাচ্যের রাজন্যবর্গের মুখোশ খুলে ফেলতে আবারো সাহায্য করেছে। ডোরা দাগ দেখে বাঘ চেনা যায় বটে কিন্তু মুনাফিকদের চিনতে হয় কথা ও কাজের মাঝে অসামঞ্জস্যতা দেখে। সাম্রাজ্যবাদীদের দ্বারা সিরিয়ায় সম্ভাব্য হামলাকে ব্যাপকভিত্তিক করার জন্য সৌদী পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রকাশ্যে উদাত্ত আহ্বান জানাচ্ছে আর মুসলিম দেশগুলো মৌনতা অবলম্বন করছে। অন্যদিকে অমুসলিমরা যুদ্ধের দামামা বন্ধ করার জন্য তাদের দেশে শান্তিপূর্ণ মিছিলসমাবেশ করছে !!! সত্যি সেলুকাস ! বিচিত্র এই মুসলিম জাত।

যুদ্ধবিরোধী প্রতিবাদ সভা মিছিল হয়েছে লন্ডনে , খোদ আমেরিকাতে এবং পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানেহয়নি শুধু মুসলিম দেশগুলোতে।

syria-protest-worldwide

অস্ত্র ব্যবসায়ীদের জন্য যে কোন যুদ্ধ হচ্ছে লুফে নেয়ার মতো সুসংবাদ। পুরনো অস্ত্রের ভান্ডার ফুরালেই তো নতুন অস্ত্র সরবরাহের অর্ডার পাওয়া যায়। যুদ্ধের উপকারিতার মধ্যে আছে, ধ্বংস সাধনের পর অবকাঠামো পুনর্গঠনের জন্য টেন্ডারবিহীন কন্ট্রাক্ট লাভ, যুদ্ধের ময়দানে অস্ত্রের প্রকৃত কার্যকারিতার প্রমাণ লাভ করা, পুরানো অস্ত্রের ভান্ডার নবতর সংষ্করণ দিয়ে পুনরায় সমৃদ্ধ করা, বিভিন্ন দেশের কাছ থেকেও মারণাস্ত্র সরবরাহের বিশাল বিশাল অর্ডার লাভ করা ইত্যাদি।

সিরিয়ার উপর নতুন বিশ্ব ব্যবস্থার প্রবর্তকরা ক্ষিপ্ত হওয়ার ৮টি কারণ (বিস্তারিত জানতে এখানে দেখুন) আছেঃ

() সিরিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরকারী মালিকাধীন নিয়ন্ত্রণাধীন।

() আইএমফএর কাছে সিরিয়া কোন দেনা নেই।

() ক্যান্সারের ঝুঁকি থাকায় সিরিয়া আমেরিকার বহুজাতিক কোম্পানী মন্সান্টোর পেটেন্টকরা জেনেটিক্যালী পরিবর্তিত বীজ দিয়ে শস্য উৎপাদন নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে।

() সিরিয়ার জনগণ নতুন বিশ্ব ব্যবস্থার (New World Order) ভয়াবহতা সম্পর্কে সম্যক ওয়াকিবহাল।

() সিরিয়ার আছে বিশাল তেল গ্যাসের রিজার্ভ যাতে ইতোমধ্যেই শকুনীদের শ্যেনদৃষ্টি পতিত হয়েছে। পশ্চিমা বহুজাতিক কোম্পানীদের বাদ দিয়ে ইরানের সাথে গাঁটছড়া বেধে দীর্ঘ পাইপ লাইন বসানো শুরু করায় তাদের চক্ষুশূল হয়ে পড়েছে।

() ইসরাঈল যায়নবাদ বিরোধী (ইরানের মতো) হওয়ায় ইসরাঈলীদের উস্কানীতে আমেরিকার হামলার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে।

() নানা ধর্ম জাতির সমন্বয়ে গড়ে ওঠা সিরিয়ায় দীর্ঘ দিন ধরে বহাল আছে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি। মুসলিম বিশ্বে এটা থাকা পশ্চিমা বা ইসরাঈলী যায়নবাদীদের কাছে অসহনীয়।

() নতুন বিশ্ব ব্যবস্থার হর্তাকর্তাদের বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে সগর্বে সিরিয়ার স্বকীয় রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক পরিচয়ের বহিপ্রকাশ বিশ্ব মোড়লদের এজেন্ডা বাস্তবায়নের পথে বাধা

আল্লাহ বিশ্বের মুসলিমদের এই ভয়াবহ ফিৎনা থেকে রক্ষা করুন। আমীন।

বিভাগ:ইসলাম ট্যাগসমূহ:

সৌদী ফতোয়ায় তিউনিশিয়ান মেয়েদের দিয়ে সিরিয়ায় যৌন জিহাদ

women-trafickingবরাবরের মতো আমার এই ব্লগটি বিনোদনমূলক কোন চটুল রচনা নয় – মূলত সিরিয়াস টাইপের ব্লগাররা এ ধরণের নিরামিষী পরিবেশনা গ্রহণে হয়তো আগ্রহী হলে-ও হতে পারেন ।

সিরিয়ার ‘যৌন জিহাদ’ থেকে গর্ভবতী হয়ে ফিরছে তিউনিশিয়ার মেয়েরা

সিরিয়ায় কথিত ‘যৌন জিহাদ’ করতে গিয়ে এখন গর্ভবতী হয়ে দেশে ফিরছে তিউনিশিয়ার মেয়েরা। তিউনিশিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লোতফি বিন জেদ্দো দেশটির জাতীয় সংসদে গতকাল (বৃহস্পতিবার) এ কথা জানিয়েছেন। তিনি বলেন, “তিউনিশিয়ার এসব মেয়ে ২০, ৩০ কিংবা ১০০ বিদ্রোহীর মাঝে ভাগবাটোয়ারা হয়েছে এবং তারা এখন কথিত যৌন জিহাদের ফল বয়ে আনছে দেশে। আর আমরা এ নিয়ে এখনো নীরব রয়েছি কিছুই করছি না।”

বিন জেদ্দো জানান, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গত মার্চ থেকে এ পর্যন্ত সিরিয়া সফরে ৬,০০০ তরুণতরুণীকে বাধা দিয়েছে এবং সিরিয়ায় কথিত জিহাদি নেট ওয়ার্ক গড়ে তোলার সন্দেহে ৮৬ জনকে আটক করা হয়েছে। এ সময় তিনি কয়েকটি মানবাধিকার সংস্থারও সমালোচনা করেন। সিরিয়ায় যেতে বাধা দেয়ায় এসব মানবাধিকার সংস্থা তিউনিশিয়া সরকারের সমালোচনা করেছে। যেসব ব্যক্তিকে সিরিয়ায় যেতে বাধা দেয়া হয়েছে তাদের বেশির ভাগেরই বয়স ৩৫ বছরের কম।

তিউনিশিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, “আমাদের তরুণদেরকে সিরিয়ার বিদেশি মদদপুষ্ট বিদ্রোহীরা যুদ্ধক্ষেত্রে সামনের ভাগে রাখছে এবং তাদেরকে চুরি করা ও গ্রামে গ্রামে অভিযান চালানো শেখাচ্ছে।”

গত ১৩ এপ্রিল তিউনিশিয়ার সাবেক মুফতি শেখ ওসমান বাত্তিক জানিয়েছিলেন, প্রতারণার শিকার হয়ে ১৩টি মেয়ে সিরিয়ায় বিদেশি মদদপুষ্ট বিদ্রোহীদেরকে ‘যৌন সেবা’ দিতে গেছে। তিনি সে সময় কথিত এ যৌন জিহাদকে পরিষ্কার ভাষায় পতিতাবৃত্তি বলে উল্লেখ করেছিলেন। মুফতি বাত্তিক আরো বলেছিলেন, “সিরিয়ায় যুদ্ধের জন্য এখন তারা মেয়েদের ঠেলে দিচ্ছে। এরই মধ্যে তিউনিশিয়ার ১৩টি মেয়েকে সিরিয়ায় যৌন সেবা দেয়ার জন্য পাঠানো হয়েছে। এসব কি? একে বলে পতিতাবৃত্তি। এটি নৈতিক শিক্ষা বিষয়ক দুর্নীতি।”

গত আগস্ট মাসে তিউনিশিয়ার জননিরাপত্তা বিভাগের মহাপরিচালক মোস্তাফা বিন ওমর জানিয়েছিলেন, দেশের পশ্চিমাঞ্চলে আলকায়েদা অধ্যুষিত এলাকায় কথিত একটি ‘যৌন জিহাদ সেল’ ভেঙে দেয়া হয়েছে। তিনি জানান, আলকায়েদার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত আনসার শারিয়াহ গোষ্ঠী ছোট ছোট মেয়েদেরকে সিরিয়ার পুরুষ বিদ্রোহীদের যৌন সেবা দেয়ার জন্য পাঠাচ্ছে।

সূত্রঃ রেডিও তেহরান, দৈনিক দিনকাল তৃতীয় পৃষ্ঠা , আলআরাবিয়া, ইত্যাদি।

তিউনিশিয়ার মেয়েরা যেমন বানোয়াট ও ভুল ফতোয়া (সেটা যেখান থেকে-ই এসে থাকুক না কেন) দ্বারা প্রতারিত হয়েছিলো সিরীয় মেয়েরা যারা মগজধোলাই হয়ে যুদ্ধের মাঠে নেমেছিলো তারা-ও একইভাবে বিভ্রান্ত ছিলো – আমার দৃষ্টিকোণ থেকে তারা তো মুজাহিদ নয়-ই — বরং পুরোদস্তুর সন্ত্রাসী — কথায় যেমন বলে – One man’s freedom fighter is another man’s terrorist.

cartoon-sex-jihad

ফতোয়ার অনুসন্ধানঃ

তিউনিশিয়ায় প্রায় সব পত্রিকা আরবী ফরাসী ভাষায় প্রাকাশিত হয়। সে কারণে খুব বেশী রেফারেন্স সংগ্রহ করা একটু কষ্টসাধ্য ব্যাপার অবশ্য যারা আমার কথা মানতে চাইবে না তাদের সামনে শত শত রেফারেন্স আনলে কোন লাভ হবে না। যাহোক, যাহা রটে তাহা কিছু না কিছু বটেবলে বাংলায় একটা কথা প্রচলিত আছে। আমাদের এই কথাটি স্মরণ রাখলে ঘটনা প্রবাহ বুঝতে সুবিধা হবে।

সৌদী সালাফীদের ভাবধারায় প্রভাবিত কিছু ইসলামী সংগঠন দাতব্য সংস্থার আড়ালে কাজ করে এইসব প্রাপ্ত এবং অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদেরযৌন সেবা প্রদানের মাধ্যমে জিহাদকরার জন্য সিরিয়া যেতে রিক্রুট করা হয়। প্রত্যাগত এইসব কিছু মেয়েদের দ্বারা ইতোমধ্যেই প্রসব করা সন্তানদের পিতা অসনাক্ত অবস্থায় থেকে যাচ্ছে যা তাদের ভবিষ্যত জীবন দুর্বিসহ করে তুলতে পারে [http://www.tunisiadaily.com/ থেকে সারাংশের ভাবানুবাদ ।] গত বৃহস্পতিবার তিউনিশিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লোতফি বেন জেদ্দো কর্তৃক সংসদে প্রদান করা ভাষণটি এখানে

তিউনিশিয়ার মেয়েদেরকে সিরিয়ায় যেয়ে বিদ্রোহীদের সাথে মুত বিবাহে উদ্বুদ্ধ করার জন্য যে ফতোয়া (সেটা সৌদী ফতোয়া কিনা তা তিনি নির্দিষ্ট করে বলেননি) ব্যবহার করা হচ্ছিলো তা তিউনিশিয়ার সদ্যবিদায়ী মুফতি শায়খ ওসমান বাতিখএর মুখ থেকে কথা আমলে আনলে পরিষ্কার হয়ে যায় – He added bitterly “I also want to say that those who make Fatwas and foreign practices to our traditions today, unfortunately, influence families to send their children to jihad. »

Sheikh Othman Batikh also told the media that “the so-called jihad of Nikah (marriage), is nothing but a form of prostitution”. He also voiced his concerns about the sexually transmitted diseases that these Jihadist women will bring as soon as they come back to Tunisia. He was referring to the Tunisian sent to Syria to offer their bodies to “Jihadist brothers” in a jihad , they believe, is in Allah’s name. The name of Allah is greater than that.

Batikh’s declarations appear to embarrass the interim government, which is heavily indebted and which is putting all its weight betting with Qatar’s petrodollar Emirs on the overthrow of Bashar Al Assad and the collapse of Syria. [http://www.thetunistimes.com/2013/07/the-mufti-bade-farewell-to-the-tunisian-people-48577/]

এই পোষ্ট পড়ার পর আমি সৌদী ফতোয়ার সন্ধানের ইন্টারনেট সাধ্যানুযায়ী চষে বেড়িয়েছি যার জন্য উত্তরটা দিতে দেরী হলো। মূল ফতোয়া কোথাও পাওয়া যায়নি তবে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন মিডিয়া (জর্ডানভিত্তিক আলবাওয়াবা, তিউনিশিয়া ডেইলীর ভিডিওএক, দুই, তিন, চার, ইউটিউব ধরণের কিছু আপত্তিকর ফতোয়া (একটি হচ্ছে, প্রয়োজনে সিরিয়ান মেয়েদের গণধর্ষণ করা যাবে, আরেকটি হচ্ছে, ১৪ বৎসর তদোর্ধ্ব বয়সের মেয়েরা দুবৎসর যাবৎ সিরিয়ায় জিহাদরত বিদ্রোহীদের সাথে মুত বিবাহে আবদ্ধ হয়ে তাদের যৌন বাসনা পূরণ করে যুদ্ধের জন্য তাদের চাঙ্গা করে তুলতে পারবে) প্রদানের জন্য সিরিয়াজিহাদএর ব্যাপারে উচ্চকন্ঠ সৌদী সালাফী শায়খ ডঃ আবদুর রহমান মুহাম্মদ আলআরিফি নাম বার বার উচ্চারণ করেছে। কিন্তু ডঃ আরিফি ধরণের কোন ফতোয়া দেবার ব্যাপারে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেছেন তার ফেসবুক টুইটার একাউন্টের মাধ্যমে। তিনি দাবী করেছেন যে, তারা বিরুদ্ধবাদীরা তার নামে কুৎসা রটাচ্ছে। এটা হতেই পারে। আমি ব্যক্তিগতভাবে আলআরিফির কথায় সায় দিবো। তার এক গুণমুগ্ধ স্বীকার করেছেন যে, সরকারী অনুমতি ছাড়া সিরীয় বিদ্রোহীদের জন্য অর্থ সংগ্রহের জন্য তাকে নাকি গ্রেফতার করা হয়েছিলো। উইকিপিডিয়ায় তার সম্বন্ধে আপত্তিকর ফতোয়া প্রদানের অভিযোগের প্রেক্ষাপটে যুক্তরাজ্যের ভিসা প্রদানে অস্বীকৃতি জানানো হয়।

ফতোয়ার উৎপত্তির ব্যাপারে পাকিস্তান ডিফেন্স জার্নালে প্রকাশিত একটি সুদীর্ঘ মন্তব্য প্রতিবেদন আমার কাছে অনেক ভারসাম্যপূর্ণ মনে হয়েছে যেখানে গুজবের সম্ভাব্য উৎসের সন্ধানের চেষ্টা করেছেন, গুজব ছড়ানোর ভয়াবহ দিকটির ওপর আলোকপার করেছেন এবং বলেছেন যে, সিরিয়ার যুদ্ধের পক্ষ ও বিপক্ষ পরস্পরের বিরুদ্ধে প্রপাগান্ডা চালিয়ে যাচ্ছে, মূল বিষয়গুলো ধামাচাপা পড়ে থাকছে এবং মাঝখান দিয়ে বরাবরের মতো মেয়েরা নির্যাতনের ষ্টীমরোলারে নিষ্পেষিত হয়ে যাচ্ছে।

সুতরাং শায়খ আলআরিফি ঐ ধরণের কোন ফতোয়া ইস্যু করেছিলেন কিনা সেটা বড় কথা না। আমার কথা হচ্ছে, তার নামে ফতোয়া ব্যবহার না করেও যদি তিউনিশিয়ান মেয়েদের সিরিয়া নিয়ে যাওয়া হয়ে থাকে (নিয়ে যে যাওয়া হয়েছিলো তা তো সুনিশ্চিত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সংসদে দেয়া বক্তব্য থেকে) গিয়েছিলো তাতেই মারাত্মক গর্হিত কাজ করা হয়েছে এ ব্যাপারে আমাদের সোচ্চার থাকা উচিৎ । সোজাসাপ্টা কথা। এই অপকর্ম কারা করে থাকতে পারে? শিয়ারা? আসাদের লোকজন? মুসলিম বিশ্বে কি ছেলে জিহাদীর অভাব হয়েছে? পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে কি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক পুরুষ জিহাদী যায়নি বা এখনো যাচ্ছে না সিরিয়াতে? সুতরাং মেয়েদের সেখানে নিয়ে যাবার পিছনে মতলবটা কি? মেয়েরা কিভাবে সেখান থেকে কাদের দ্বারা গর্ভবতী হয়ে ফেরত আসছে? সেটা বুঝতে নিশ্চয়ই আমাদের রকেট বিজ্ঞানী হবার দরকার নেই।

এই খবরটা এখন ফাঁস করা হলেও তা কিন্তু মোটামুটি গত বছরের ডিসেম্বর (এমনকি তসলিমা নাসরিনের ব্লগে) ব্যাপারটি এসেছে গত বৎসরের শেষ দিনে থেকেই চাউর হয়ে আছে। তাহলে তিউনিশিয়ান ইসলামিষ্ট পার্টি [সিরিয়ান জিহাদের সমর্থক] কি এতদিন মুখে কুলুট এঁটে ছিলো জনগণের মধ্যে বিরুপ প্রতিক্রিয়া হবে এই ভয়ে ? এই তাদের ইসলাম ভালবাসার নমুনা ? ছি !

[ প্রসঙ্গত এখানে বলে রাখি যে, তিউনিশিয়ার এননাহদা পার্টির সিরিয়ার বিদ্রোহীদের সমর্থন (এবং মেয়েদের পতিতাদের মতো ব্যবহৃত হতে দেয়া) অদূর ভবিষ্যতে তাদের প্রতিকুলে চলে যেতে পারে এখনই ব্যাপারস্যাপার কিছুটা টলটলায়মান মনে হচ্ছে। মুরসীর বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলতে গিয়ে মিশরের মেয়েদের বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতন বন্ধে মুরসীর পর্বতপ্রমাণ ব্যর্থতাকে কিন্তু ইস্যু হিসেবে সাফল্যজনকভাবে কাজে লাগানো হয়েছিলো। নোবেল বিজয়ী তাওয়াক্কুল কারমানও কিন্তু মুরসীর বিরুদ্ধে আন্দোলনকারীদের পক্ষ নিয়েছিলেন কিন্তু মুরসীর পতনের পর আবার পক্ষ পরিবর্তন করেছিলেন ! ]

তাকে আমি বেনিফিট এফ ডাউট দিচ্ছি।

যে সব অপকর্ম ঘটেছে তার প্রেক্ষাপটে বলতে হয়, ফতোয়া দিয়েছিলেন কিনা সেটা গৌণ ব্যাপার (তার মানহানির কথা বাদ দিলে) — মুখ্য ব্যাপার হচ্ছে নারীরা জুলুমের শিকার হয়েছে ।

ব্যাপারটা যেহেতু আমিই এই ব্লগে শুরু করেছিলাম এবং এটা নিয়ে কেউ কেউ কথা তুলেছেন তাই এটা নিয়ে ভালো করে খবরাখবর সংগ্রহ করে ব্লগারদের জানিয়ে দেয়াটা একটা নৈতিক দায়িত্ব হিসেবে গ্রহণ করলাম।

মাঝেমধ্যেই তাদের উল্টাপাল্টা ফতোয়া দেয়ার প্রবণতাকে কেউ কেউ এক্সপ্লয়েট করতেই পারে যদিও এটা একটা মারাত্মক অন্যায় কাজ । কিন্তু ক্রোধআক্রোশজিঘাংসা যখন প্রবলতর হয়ে ওঠে তখন মানুষ শয়তান দ্বারা প্রভাবিত হয়ে কোরআনহাদীস নিজের মতো করে ব্যাখ্যা করে পাপে মজে যেতেও দ্বিধা করে না কোরআন থেকে তাওরিয়ার মাসায়েল বের করে আবার হাদীস থেকে মিথ্যা বলার লাইসেন্স বের করে নেয়। ফলে পাপবোধও জাগে না।

বিভাগ:ইসলাম ট্যাগসমূহ:,

প্রতীকি বস্তু বা মূর্তির সামনে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা বা পূজা নিবেদন করে ঈমানহারা হওয়া

আমি আমার দেশকে, বাংলা ভাষাকে অনেক ভালবাসি এবং শ্রদ্ধা জানাই সকল ভাষা শহীদদের প্রতি।ভাষা দিবস মানে এই নয়, যে সকালে প্রতিক মূর্তি অর্থাৎ শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে পূজা করতে হবে। যখনই এই কথা বলব অনেকেই আমাকে রাজাকার বলবে হয়ত। কিন্তু একজন মুসলমান হিসেবে কখনই আমি পূজা করতে পারিনা। আল্লাহ্‌ তাদের জান্নাতুল ফেরদৌস নসিব করুন।

খলীফা ওমর (রাঃ)-এর সময় তাকে সংবাদ দেয়া হল যে, কতিপয় মানুষ ঐ বৃক্ষের উদ্দেশ্যে যাতায়াত করে যে বৃক্ষের নীচে ছাহাবীগণ নবী করীম (ছাঃ)-এর হাতে বায়‘আত করেছিলেন। অতঃপর তিনি [ওমর (রাঃ)] ঐ বৃক্ষকে কেটে ফেলার নির্দেশ দিলেন (ফাৎহুল বারী ৭/৪৪৮)।

কিন্তু বর্তমানে আমরা সংস্কৃতির নামে, আধুনিকতার নামে অহরহ শিরক করে চলেছি। স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস ও শহীদ দিবস আসলে আমরা শহীদ মিনারে ও স্মৃতিসৌধে গিয়ে ফুলের স্তবক দেই, নীরবে দাঁড়িয়ে থাকি, শ্রদ্ধা ও সম্মান জানাই। প্রতিটি স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে শহীদ মিনার তৈরী করে দেশে ভবিষ্যৎ কর্ণধার কোমলমতি ছাত্র-ছাত্রীদেরকে শিরক শিক্ষা দেয়া হচ্ছে।

অথচ সবচেয়ে বড় গুনাহ ও শিরক থেকে বেঁচে থাকার যথার্থ শিক্ষা দেয়াই উচিৎ ছিল এ দেশের তরুণ প্রজন্মকে। আবার অতি আধুনিকতার দোহাই পেড়ে খোদ ইসলাম প্রতিষ্ঠায় সংগ্রামকারী ব্যক্তিবর্গও ইট-পাথর-বালু-সিমেন্টের তৈরী খাম্বা বা পিলারকে সামনে রেখে মাথা নত করে সম্মান প্রদর্শন করে, এক মিনিট নীরবতা পালন করে, পুষ্পস্তবক অর্পণ করে, নানা কায়দায় সম্মান প্রদর্শন করে। এসব কিছুর মধ্যে মূলতঃ মৌলিক কোন পার্থক্য নেই। বরং পর্যায়ক্রমে শেষেরটা বেশী হাস্যকর। শীতকালে প্রচন্ড শৈত্যপ্রবাহ কুয়াশাচ্ছন্ন দিনে সকাল, দুপুর, বিকাল তথা সারাদিনই একই রকম থাকে। সারাদিনই সূর্যের আলোর মুখ দেখা যায় না। ঠিক মূর্তিপূজা, কবর বা মাজার পূজা ও শহীদ মিনার পূজা একই সূত্রে গাঁথা। স্রেফ কিছু নিয়ম-নীতির পার্থক্য মাত্র।

ভাস্কর্যের নামে শিক্ষাঙ্গন ও রাস্তার মোড়ে মোড়ে মূর্তি স্থাপন করা ও তাকে সম্মান দেখানো, শিখা অনির্বাণ ও শিখা চিরন্তন বানিয়ে নীরবে সম্মান প্রদর্শন করা মূর্তিপূজার শামিল যা শিরক।

যেভাবে বদলে যাচ্ছে ধর্মীয় অনুশাসন – তারিক রামাদান

tariq_ramadan-3সময় থেমে থাকে না, সাথে বদলে যাচ্ছে মানুষের জীবন ধারাও। এই বদলে যাওয়ার পেছনে সবচেয়ে বড় অনুঘটক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি। তাই পরিবর্তিত এই জীবন ধারার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পরির্তন আসছে ধর্মীয় অনুশাসনেও। বিবিসি’র সাংবাদিক উইলিয়াম ক্রেমারের এমন এক নিবন্ধের অনুবাদ করেছেন মাহবুবুল আলম তারেক।

একটা সময় পশু বলি দেয়া হিন্দু ধর্মীয় অনুশাসনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল, ক্যাথলিক পাদ্রীরা কুমার থাকতেন না এবং নবী মুহাম্মদের (সা.) ছবি আঁকাটা ইসলামি শিল্পকলারই অংশ ছিল। খুব শিগগিরই হয়তো যুক্তরাজ্যের কিছু গীর্জা সমকামীদের বিয়ে পড়ানো শুরু করবে। কিন্তু প্রশ্ন হল, কীভাবে ধর্মগুলো তাদের ধ্যানধারণায় এমন আমুল পরিবর্তন সাধন করে?

উইলফোর্ড উডরাফ মরমোন চার্চের চতুর্থ সভাপতি হন ১৮৮৯ সালে। সভাপতি থাকা অবস্থায় তাকে একজন নবী হিসেবে দেখা হত যে কিনা সরাসরি যিশু খ্রিস্টের কাছ থেকে প্রজ্ঞা ও উপদেশ গ্রহণ করতে পারতেন এবং সত্যিই তার উপদেশের দরকার ছিল কারণ তার গীর্জা সংকটে ছিল।

প্রায় ৪০ বছর ধরে মরমোন বহুগামীতার বিষয়টি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের সাথে ঝগড়াবিবাদে লিপ্ত থাকে। আর এ ব্যাপারে পুরুষ বিশ্বাসীরা খুবই উৎসাহিত ছিল। সরকার বলে যে এটা বেআইনি এবং এ ক্ষেত্রে ধর্মীয় বিশ্বাসের কিছুই করার নেই।

একাধিক স্ত্রী রাখার দায়ে সামরিক কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করার পরিকল্পনায় লিপ্ত থেকে উডরাফ এবং তার মতো অন্যান্যরা একটি অনিশ্চিত জীবন যাপন করতেন। ১৮৯০ সালে সরকার চার্চের সব সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে এসবের একটি সমাপ্তি টানার উদ্যোগ নেয়।

এসময়ই উডরাফ বলেন, যিশু খ্রিস্ট স্বপ্নযোগে তাকে বহুগামিতার চর্চা বন্ধ করা না হলে মরমোন চার্চের ভবিষ্যৎ পরিণতি কী হতে পারে তা দেখিয়ে দিয়েছেন, এবং এতে তিনি ভালো কিছু দেখেননি। যদিও তিনি বহুবিবাহের বিষয়টিকে একেবারেই অস্বীকার করেননি, তবে তা নিষিদ্ধ করে একটি ইশতেহার প্রকাশ করেন তিনি।

ভ্যান্ডারবিল্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের আমেরিকান ধর্মের ইতিহাসের অধ্যাপক ক্যাথলিন ফ্লেক, যিনি নিজেও একজন মরমোন তার মতে, যদি মনে হয় যে সমস্যাটির খুব সহজেই সমাধান হয়েছিল তবে তা ঠিক নয়।

তিনি বলেন, সামাজিক, ব্যক্তিগত এবং ধর্মতাত্ত্বিক দিক থেকে এটা খুবই জটিল একটা বিষয় ছিল। এ পরিবর্তন সমগ্র গীর্জার সংগঠনকেই অস্থিতিশীল করে তোলে এবং এর মধ্য দিয়েই মরমোনবাদের মৌলিক নীতিমালার একটি গভীর প্রতিফলন ঘটে।

ইতিহাসে দেখা গেছে, যে ধর্ম পরিবর্তিত হতে চায়নি সে মরে গেছে’, যোগ করেন ফ্লেক। কিন্তু যেসব ধর্মের কোনো জীবন্ত নবী নেই তাদের কী অবস্থা; তারা কীভাবে পরিবর্তিত হয়?

যেমন মুসলমানদের কথাই ধরা যাক, তাদের শেষ নবী মুহাম্মদ (সা.), যিনি প্রায় ১৪০০ বছর আগে মারা গেছেন। এরপর আইন বিশেষজ্ঞ উলামারাই ইসলামি শরীয়া আইনের ব্যাপারে সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ হিসেবে স্বীকৃত হয় যা এ ধর্মের দুটি মৌলিক দলিল কোরআন ও সুন্নাহর ওপর ভিত্তি করে গঠিত।

এখন আরব সমাজের বিশেষ পরিপ্রেক্ষিতে উদ্ভুত আইনকানুন যা সপ্তম শতকের আরবদের জীবন যাপনের ক্ষেত্রেই শুধু প্রয়োগযোগ্য ছিল বর্তমান একুশ শতকের দুনিয়ায় তার প্রয়োগের সম্ভাব্যতা একটি কঠিন সমস্যাই হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে এটাও কোনো আশ্চর্যের বিষয় নয় যে, একই বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন দেশের উলামারা ভিন্ন ভিন্ন রায় দেন এবং তারা প্রায়ই তাদের মত পরিবর্তন করেন।

এক শতক আগেও একটি রেডিও বা লাউডস্পিকার ব্যবহার হারাম বা নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু আজ অনেক ধর্মপরায়ণ মুসলিমেরই নিজস্ব রেডিও, টিভি এবং এমনকি ইউটিউব চ্যানেলও আছে।

তেমনিভাবে, ১৯৭৯ সালে ইরানের ইসলামি বিপ্লবের সময় উলামারা জন্মনিয়ন্ত্রণকে হারাম ঘোষণা করলেও বর্তমান ইরানে কনডম ব্যাবহারে উৎসাহিত করা হচ্ছে; এমনকি রাষ্ট্রীয় সহায়তায় কনডম উৎপাদনে কারখানা স্থাপন করা হয়েছে। ইরানের বিদ্যালয়গুলোতে বিয়ের আগেই ছেলেমেয়েদেরকে পরিবার পরিকল্পনার পাঠ দেয়া হচ্ছে।

ডেলাওয়্যার বিশ্ব বিদ্যালয়ের মুকতেদার খান বলেন, ‘আগে ধারণা করা হত যে, পশ্চিম থেকে আসা যে কোনো কিছুই ইসলামের জন্য অবমাননাকর।’

দৈনন্দিন জীবন যাপনের পশ্চিমা রীতিনীতির সাথে মুসলমানদের শিক্ষাদীক্ষার প্রায়ই একটা টানাপোড়েন চলতো। এ ক্ষেত্রে মুসলিম পুরুষদের জন্য একটা বড় সমস্যার বিষয় হচ্ছে পেশাব করার নিয়ম নিয়ে।

মুসলমানদের নিয়ম হচ্ছে বসে বসে পেশাব করা। খান ব্যাখ্যা করে বলেন, এটাই মুসলমানদের নামাজের জন্য পোশাক পবিত্র রাখার সবচেয়ে ভালো উপায়। তবে পশ্চিমে এটা সব সময় সম্ভব নাও হতে পারে।

আরেকটি সমস্যা হচ্ছেপশ্চিমা বাড়িঘরের কাঠামো। খান বলেন, পশ্চিমা বাড়িঘরের কাঠামোয় মেয়েদের জন্য আলাদা কোনো ব্যাবস্থা নেই। এ ক্ষেত্রে যদি শুধু মুসলিমদের উপস্থিতিতে একটি পার্টির আয়োজন করা হয় তখন যদি কোনো নারী আলাদা ব্যাবস্থা দাবি করে তাহলে পরিস্থিতি খুবই জটিল আকার ধারণ করে। এর ফলে তিনি তার সন্তানদের তিনচারটি জন্মদিন করতে পারেননি বলে জানান খান।

বহুমুখী সাংস্কৃতিক সমাজের মুসলমানরা প্রায়ই তাদের পবিত্র ধর্ম গ্রন্থের পুনর্ব্যাখ্যার আর্জি জানায়, বলেন খান। ধর্মতত্ত্বিকরাও এ আর্জির প্রেক্ষিতে কোরআনের আক্ষরিক ব্যাখ্যা অথবা এর গভীর মর্মার্থ উদ্ধারের যে কোনো একটিকে বেছে নেন।

তবে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের তারিক রামাদানের মতে, এ ক্ষেত্রে প্রধান নীতি হওয়া উচিৎ প্রথমেই ‘মূলনীতি’ যা অপরিবর্তনীয় এবং পরে বিশেষ দেশকালপাত্র ভেদে যে ‘মডেল’ বা ‘আদর্শ এ নমুনা’ দাঁড়ায় তার মধ্যে একটা ভেদ রেখা টেনে নেয়া। এ দৃষ্টিভঙ্গী থেকে বিশেষ দেশকালপাত্রের প্রেক্ষিতে কোরআন থেকে আমাদের টানা সিদ্ধান্তগুলোর পরিবর্তন করা কোনো ঐচ্ছিক বিষয় নয়, বরং এটা এটা বাধ্যতামূলক।

তিনি বলেন, ‘আমাদের বোঝাপড়ার মধ্যে বিবর্তন ছাড়া ইসলামের বাণীগুলোর পূর্ণ অনুশীলন সব সময় সম্ভব নাও হতে পারে।’

সুতরাং যখন স্ত্রীদের প্রহার করা জায়েয বলে কোরআনের কোনো আয়াত হাজির করা হবে, তখন এর জবাব দেয়ার জন্য ‘সর্বোত্তম উদাহরণ হতে পারে যে ইসলামের রাসুল (সা.) নিজে কোনোদিন তার কোনো স্ত্রীকে প্রহার করেননি’, যোগ করেন রামাদান।

ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব’র অধ্যাপক অরভিন্দ শার্মা একটি ঘটনার উদাহরণ দিয়ে দেখান যে কীভাবে কোন বিষয়ে একটি ধর্মের মৌলনীতি ঠিক রেখেও দেশকালপাত্র ভেদে গড়ে ওঠা নীতি বা আদর্শের পরিবর্তন সাধন করা সম্ভব হয়। তার ঘটনাটি মহাত্মা গান্ধীর হিন্দু ধর্মের একটি মূলনীতি ‘কর্ম’র ধারণার ব্যাখ্যার মুহূর্তটির ওপর কেন্দ্র করে গঠিত। ‘কর্ম’ ধারণা মতে, প্রত্যেকেই পরকালে তার মন্দ কাজের জন্য শাস্তি পাবে আর ভালো কাজের জন্য পুরস্কৃত হবে।

শার্মা বলেন, ‘কর্ম’র ধারণা সনাতন হিন্দু ধর্মে জাতপাত ভেদের ন্যায্যতা উৎপাদনের জন্য ব্যবহৃত হত। যেমন বলা হতোকেউ যদি নিচু শ্রেণীতে জন্মায় তাহলে বুঝতে হবে যে পূর্ব জন্মে সে কোনো অপরাধ করেছিল। যার ফলে এ জন্মে সে নিচু জাতে জন্মেছে। সুতরাং তার কর্মের ফল হিসেবেই তাকে তার এ নিচু সামজিক মর্যাদা মেনে নিতে হবে।’

শার্মা বলেন, গান্ধী দেখান যে, হিন্দুদের সব বর্ণই ব্রিটিশরা অস্পৃশ্য মনে করে। কারণ তারা তাদের বাড়ি ঘর এবং ক্লাবের দরজায় লিখে রাখে যে, ‘কুকুর এবং ভারতীয়দের প্রবেশ নিষেধ।’

গান্ধীর দাবি এ ক্ষেত্রে তো কর্ম’র ধারণা কাজ করছে না। ভারতীয়রা যেমন জন্ম পরিচয়ের ভিত্তিতে মানুষের মধ্যে উঁচুনিচু ভেদ করে তেমনি করে ব্রিটিশরাও জন্ম পরিচয়ের ভিত্তিতেই ইউরোপীয় এবং ভারতীয়দের মধ্যে উঁচুনিচু ভেদ করছে।’

তবে তাই বলে গান্ধী কর্ম’র ধারণাকে পরিহার করার কথা বলেননি। তিনি বরং এর নতুন ব্যাখ্যা দিয়ে এর ওপর ভিত্তি করে মানুষকে মন্দ কাজ থেকে বিরত থাকতে এবং ভালো কাজে উৎসাহিত করার কথা বলেন।

ইহুদীদের একটি ধর্মগ্রন্থ তালমুদের একটি বিখ্যাত গল্পে দেখা যায়, ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যে তাদের নিজেদের মতো করেই ধর্মীয় আইনকানুনের ব্যাখ্যা করবে তার ইঙ্গিত ওই গল্পে রয়েছে।

ওই গল্পে, মুসা একদিন সিনাই পর্বতে যান আল্লার কাছ থেকে ইহুদীদের আরেকটি ধর্মগ্রন্থ তৌরাতের বাণী লাভ করতে। এ সময় মুসা দেখতে পান যে আল্লাহ্ এর হরফগুলো ছোট ছোট মুকুট দিয়ে অলঙ্কৃত করে দিয়েছেন।

নিউইয়র্কের ইহুদী ধর্মতাত্ত্বিক বিদ্যালয়ের এক রাবাই বার্ট ভিজোটজস্কি বলেন, ‘মুসা ছিল খুবই বিনয়ী লোক এবং সে বললো যে, ঠিক আছে হে খোদা, তুমি জানআমি সত্যি সত্যিই এ বাণী যেভাবে আছে ঠিক সেভাবেই লোকের কাছে নিয়ে যাবো।’

তখন আল্লাহ বললেন, না, এটা করা যাবে না। কারণ ভবিষ্যতে আকিভা নামে এমন এক রাবাই আসবে যে এই পবিত্র বাণীগুলোর হরফ থেকে নয় বরং এর অলঙ্কার সজ্জা থেকেই নতুন আইন বানাবে।’

এরপর আল্লাহ যখন মুসাকে ভবিষ্যতে আকিভার দীক্ষা দানের একটি চিত্র দেখান তখন মুসা হতভম্ব হয়ে যান। কারণ আকিভা তার শ্রোতাদের উদ্দেশে কি বলছিল মুসা কিছুই বুঝতে পারছিলেন না।

তালমুদের গণ্ডির ভেতরেই গড়ে ওঠা রাবাইদের আইনকানুন এবং জ্ঞানের ভাণ্ডার দেখে এটাই প্রমাণিত হয় যে জ্ঞানের জগতে অনেক কিছুই পরিবর্তিত হয় তার মানে এই নয় যে তা আল্লাহর বাণী থেকে আলাদা কিছু হয়ে যায় এবং এতে আল্লাহর বাণীরও ক্ষতি হয়ে যায়’ যোগ করেন তিনি।

পরিবর্তিত হওয়ার জন্য ধর্মের ওপর চাপ সৃষ্টি করা মানুষের জ্ঞানের একটি শাখা হচ্ছে বিজ্ঞান। এ ক্ষেত্রে কোপার্নিকাস বিপ্লবের একটা উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। কোপার্নিকাস যখন চার্চের বিপরীতে দেখান যে, সূর্য পৃথীবির চারদিকে নয় বরং পৃথীবিই সূর্যের চারদিকে ঘুরছে তখন চার্চের সাথে একটা সংঘাত বেধে যায়।

চার্চ এর আগে গ্যালিলিওকে এ ধরণের মত পোষণ করায় ধর্মদ্রোহিতার অভিযোগে তার জীবনের শেষ দশটি বছর তাকে গৃহবন্দী করে রাখে। গ্যালিলিও তার পদার্থ বিজ্ঞান এবং জোতির্বিজ্ঞান সংক্রান্ত গবেষণায় এ সংক্রান্ত ধর্মীয় বাণীর ব্যাখ্যায় একটি ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গীও প্রদান করেন।

তিনি ধর্মীয় বাণীর বিরোধিতা না করে বরং একে ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করেন। জর্জ কোয়েন নামে একজন জেসুইট পাদ্রী, যিনি নিজে ভ্যাটিকানের মান মন্দির ২৮ বছর ধরে পরিচালনা করেন তিনি বলেন, ‘গ্যলিলিও মূলত বলেনএ সংক্রান্ত ধর্মগ্রন্থের বাণীতে স্বর্গ কীভাবে চলে তার নির্দেশনা নয়, বরং আমাদেরকে কীভাবে স্বর্গে আরোহন করতে হবে তার নির্দেশনা দেয়া আছে।’

ক্যাথলিক গির্জা এখন স্বীকার করে নিয়েছে যে, গ্যালিলিওই ঠিক ছিল এবং ১৯৯২ সালে পোপ জন পল গ্যালিলিওর বিরুদ্ধে আনা ধর্মদ্রোহিতার অভিযোগ আনুষ্ঠানিকভাবে প্রত্যাহার করে নেন। কিন্তু বিজ্ঞান গির্জার সামনে এখনও কঠিন সব প্রশ্ন তুলেই যাচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে কোয়েন বলেন, ‘জেনেটিক্স’র পুরো গন্ডি, আণবিক জীব বিজ্ঞান এবং বিবর্তন প্রভৃতি চার্চের সামনে কঠিন সব চ্যালেঞ্জই বটে।’

গ্যালিলিওর ভুত কি বারবারই কথা বলার জন্য ফিরে আসছে? হ্যাঁ, আসছে। আমার প্রিয় চার্চ! গ্যালিলিওর সময় তুমি যা করেছ তা হল তুমি বিজ্ঞানের কথা শোননি এবং এখনও তুমি একই কাজ করছে।’

কোয়েনের মতে, বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে প্রশিক্ষিত বিশ্বাসীদেরকে চার্চের মোকাবেলায় নামতে হবে এবং চার্চের শিক্ষাদীক্ষার সাথে বিজ্ঞানের আবিষ্কার এবং মানবজাতির জন্য তাদের প্রস্তাবনার একটি সমন্বয়ও সাধন করতে হবে।

কী বিশ্বাস করতে হবে এবং কাকে বিশ্বাস করতে হবে তা চূড়ান্ত বিচারে কোনো ধর্মগুরুর ওপর নয়, বরং যে বিশ্বাস করে তার উপরই নির্ভর করে।

এ হিস্টোরি অফ গড এবং ধর্মীয় বিষয়ে আরো ২০ টিরও বেশি গ্রন্থের লেখক ক্যারেন আর্মস্ট্রং বলেন, ‘চূড়ান্ত বিচারে নিজেরাই চিন্তা করার জন্য আমাদেরকে সৃষ্টিশীল প্রচেষ্টাটি করতে হবে এবং নিজেদের জন্যই হতবুদ্ধিকর প্রশ্নগুলির উত্তর খুঁজে বের করতে হবে।’

কীভাবে জীবন যাপন করতে হবে তার উত্তর কখনই শুধু কিতাবের মধ্যেই পাওয়া যাবে না। যেমনি করে গাড়ি চালানোর যোগ্যতা গাড়ির নির্দেশিকার মধ্যে পাওয়া সম্ভব নয়, তেমনি করে শুধু কিতাবের মধ্যেই জীবন পরিচালনার দিক নির্দেশনা পাওয়া সম্ভব নয়, যোগ করেন আর্মস্ট্রং।

তবে তিনি এটাও স্বীকার করেছেন যে, এটা মেনে নেয়াটা তাদের জন্য খুবই কঠিন হবে যারা নিয়ত পরিবর্তনশীল এ দুনিয়ায় তাদের ধর্মের কাছে অনড় কিছু প্রত্যাশা করে এবং সব প্রশ্নের রেডিমেড উত্তর পাওয়া যায় এমন কোনো পাত্রের খোঁজ করেন।

আর্মস্ট্রং বলেন, ‘লোকে প্রায়ই মনে করে যে, ধর্ম বুঝি খুবই সহজ ব্যাপার। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে এর জন্যও এক কঠোর বুদ্ধিবৃত্তিক, আত্মিক এবং কল্পনাশ্রয়ী শ্রম ও প্রচেষ্টার দরকার হয়।’

রওজা শরীফে কবরগুলোর অবস্থান নিয়ে বিভ্রান্তি

rawdahআমরা সবাই জানি যে, রওজা শরীফের অভ্যন্তরে তিন ব্যক্তির কবর আছে – – মহানবী মুহাম্মদ (সাঃ), হযরত আবু বকর (রাঃ) এবং হযরত উমর (রাঃ) । হজ্ব করতে গিয়ে অধিকাংশ হাজ্বী রওজা মুবারক যিরারত করার মানসে এবং জামাতসহকারে ৪০ ওয়াক্ত নামাজ মসজিদে নাবাউয়িতে পড়ে অসংখ্য সওয়াব হাসিলের জন্য মদীনায় গমন করে থাকেন যদিও তা হজ্বের কোন অংশ নয়। রওজা শরীফে তিনটি দরজা বিদ্যমান থাকায় অনেক হাজ্বী বিভ্রান্ত হয়ে যান এই ভেবে যে, কোন দরজা বরাবর (হুজরার দক্ষিণ পার্শ্বে দাড়িয়ে উত্তরমুখী হয়ে) কাকে সালাম দেবেন যদিও ব্যাপারটা মামুলী।

আমার ধারণা, বেশীর ভাগ হাজ্বীই হয় তাদের নিজস্ব অনুমানের উপর ভিত্তি করে বা মুয়াল্লিমদের প্রদত্ত তথ্যের ভিত্তিতে সালামকালামের ব্যাপারটি সেরে নেন। কিন্তু তারপরও কারো কারো মনের মধ্যে ব্যাপারটি নিয়ে একটা খুঁত খুঁত ভাব থেকে যায়। এ বিষয়টি নিয়ে একটু আলোকপাত করার উদ্দেশ্যেই এই লেখাটির অবতারণা।

মহানবীর (সাঃ) মৃত্যুর পর হযরত আইশার (রাঃ) হুজরার দক্ষিণাংশে মাথা পশ্চিম দিকে, পা পূর্ব দিকে এবং চেহারা মুবারক দক্ষিণ দিকে কিবলামুখী করে তাঁর লাশ কবরস্থ করা হয়। হযরত আবু বকরের (রাঃ) মাথা রাসুলুল্লাহ (রাঃ)-এর কাঁধ বরাবর রেখে তাঁর দেহ পেছনে (অর্থাৎ উত্তর দিকে) দাফন করা হয়। কিন্তু হযরত উমর (রাঃ)-এর কবরের অবস্থান নিয়ে দুধরণের বর্ণনা পাওয়া যায়। নিম্নে চিত্রগুলোর সাহায্যে সেটা তুলে ধরা হলোঃ

pict-1

pict-2

pict-3

নাফে বিন আবী নাঈমের বর্ণনাকে অধিকাংশ ঐতিহাসিক সর্মথন করলেও ঐতিহাসিক ও ভূমিজরীপী বাস্তবতার বিচারে [উমাইয়া খলীফা ওয়ালিদ ইবন আব্দুল মালিকের শাসনামলে হুজরার পূর্ব দিকের দেয়াল ভেঙ্গে উমরের (রাঃ) একটি পা বেরিয়ে আসার ঘটনায়] তা ধোপে টেকে না। তদস্থলে কাসেম বিন আবু বাকরের বর্ণনা (এবং আব্দুল্লাহ বিন উবায়দুল্লাহর একটি সহায়ক বর্ণনা) বেশী গ্রহণযোগ্য হয় ওঠে। কাসেমের বর্ণনা গ্রহণ করলে হুজরায় চতুর্থ আরেকটি কবরের স্থান খালি থাকা সম্ভব যেখানে কিয়ামতের আগে হযরত ঈশাকে (আঃ) কবরস্থ করা হতে পারে বলে বিভিন্ন বর্ণনা পাওয়া যায়। এর মধ্যে একটি বর্ণনা নিম্নরূপঃ

উমর বিন আব্দুল আযীযকে মদীনা সফরের আমন্ত্রণ জানিয়ে বলা হলো, আপনি মদীনায় বাস করুন। তাহলে আপনার ইন্তিকালের পর আপনাকে ৪র্থ খালি কবরে দাফন করা যাবে। তিনি ঐ প্রস্তাব প্রত্যাখান করে বলেনঃ আমি নিজেকে ঐ কবরের উপযুক্ত মনে করার অপরাধে আল্লাহ আমাকে কঠিন শাস্তি দান ক রবেন। কিয়ামতের আগে এতে হযরত ঈশা (আঃ)-এর কবর হবে। (মিরকাত, শরহে মিশকাত, ৪র্থ খন্ড)

মুহাদ্দিসরা উপরোক্ত বর্ণনাকে ()গ্রহণযোগ্যতার কোন পর্যায়ে ফেলেছেন তা আমি জানতে আগ্রহী।

ভাবতে আর্শ্চয লাগে যে, রাসুলূল্লাহ (রাঃ) ও প্রথম চার খলীফার (রাঃ) মৃত্যুর অল্প কিছু বৎসর পরই উমরের (রাঃ) কবরের সঠিক অবস্থান নিয়ে মতানৈক্য ছিলো এবং আছে।

কথিত আছে যে, বর্তমানে প্রত্যেক সোম ও শুক্রবার রাতে ঈশার নামাজের পর হুজরা মুবারক পরিষ্কার করা হয়। ক্লিনাররা কেউ এসে কখনো বর্ণনা করে না কেন তারা ভেতরে কি দেখেছে? কবরগুলোর অবস্থান সম্পর্কে মসজিদে নাবাউয়ি কর্তৃপক্ষ সুষ্পষ্ট কোন ধারণা কি কখনো দিয়েছে বা ছবি প্রকাশ করেছে? জানতে আগ্রহী।

এদিকে মহানবীর (সাঃ) কবরের ছবি দাবী করে ইন্টারনেটে অনেক ছবি চালাচালি হচ্ছে। কয়েক দিন আগেও এমন একটি ইমেইল পেয়েছিলাম। তাঁর সন্দেহ নিরসনের জন্য এই লিংকটি পাঠিয়েছিলাম। ইচ্ছে করলে চোখ বুলিয়ে নিতে পারেন।

তথ্য সহায়িকাঃ মদীনা শরীফের ইতিকথা এ এন এম সিরাজুল ইসলাম (পৃষ্ঠা ৮৮৯৭)

বিভাগ:ইসলাম ট্যাগসমূহ: