বাঙালি ও ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদের দ্বন্দ্ব
মাসুদা ভাট্টি : মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে দণ্ডিত মীর কাসেম আলীর ফাঁসির চূড়ান্ত রায় ঘোষিত হওয়ার পরদিন পূর্ব লন্ডনের আলতাব আলী পার্কের শহীদ মিনারের সামনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে একটি সমাবেশ করে। একই সময় একই স্থানে এই রায়ের বিরোধিতাকারীরাও একটি সমাবেশ করে। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত সচিত্র প্রতিবেদনে দেখা যায়, উভয় পক্ষের সঙ্গে পুলিশ কথা বলছে এবং সব পক্ষকে শান্ত করার চেষ্টা করছে। এর মধ্যে এক ব্যক্তির কণ্ঠস্বর শোনা যায়, যেখানে তিনি বলছেন, ‘খেয়াল রাখবেন যেন ওরা শহীদ মিনার দখল করতে না পারে, তাহলে আর আমাদের কিছু থাকলো না।’ বাক্যটি খুব নিরীহ কিন্তু গভীর তাৎপর্যময়। এই বাক্যের সূত্র ধরেই আমরা ব্রিটেনের বাংলাদেশি কমিউনিটির বাঙালি জাতীয়তাবাদী অতীত ও আজকে সেই অতীতকে অগ্রাহ্য করে নতুন প্রজন্মের রাজনৈতিক ইসলামের শিকার হওয়া ‘নব্য–মুসলিম’ বর্তমানকে ব্যাখ্যা করতে পারি।
কেউ যদি গভীরভাবে আলতাব আলী পার্কে উপস্থিত দুই পক্ষের মারমুখী অবস্থানের ভিডিওচিত্র পর্যবেক্ষণ করেন, তাহলে দেখতে পাবেন, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মানবতাবিরোদী অপরাধের বিচার চাওয়া পক্ষটি বয়সে প্রবীণ এবং তাদের বেশিরভাগই রয়েছে দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবন ও অভিজ্ঞতা। তাদের সঙ্গে তরুণ প্রজন্মের কেউ নেই, সে কথা বলছি না কিন্তু তারাও মূলত বাংলাদেশ থেকে আসা, এখানে তাদের জন্ম নয়। অন্যদিকে যারা মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের বিপক্ষে দাঁড়িয়েছে, তারা অপেক্ষাকৃত তরুণ এবং মূলত এখানে জন্ম নেওয়া ও বড় হওয়া প্রজন্ম। তবে তাদের নেতৃত্বে কিংবা সঙ্গে যে বাংলাদেশ থেকে আসা কেউ নেই, সেটাও সত্য নয়। দু’পক্ষের এই ছবিটি আমাদের সামনে উন্মুক্ত করে একটি বিশাল তাৎপর্যময় অধ্যায়। আর তা হলো, ব্রিটেনের প্রজন্মের ব্যবধানে ব্রিটেনের বাংলাদেশি কমিউনিটির অবস্থান, নৈতিকতা, রাজনীতি এবং ধর্মীয় অবস্থানের পরিবর্তন। সেটা কী রকম সে ব্যাখ্যাতেই যাচ্ছি।
আমরা সত্তরের দশকের বাংলাদেশি কমিউনিটির দিকে যদি দৃষ্টিপাত করি, তাহলে দেখতে পাই, এদেশে বাঙালি জাতীয়তবাদী রাজনীতির জয়জয়কার, যার ভিত্তিতে মুক্তিযুদ্ধে এদেশের বাঙালি কমিউনিটি ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। মূলত তহবিল সংগ্রহ, জনমত তৈরি এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কাছে বাংলাদেশের পক্ষে স্বীকৃতি আদায়ের লক্ষ্যে। তাদের কাছে তখন এদেশে টিকে থাকার চেয়ে বাংলাদেশে স্বাধীনতা অর্জন অনেক বেশি জরুরি ছিল। অনেক বাঙালি গৃহবধূ তখন নিজের গহনা বিক্রি করে মুক্তিযুদ্ধের তহবিলে অর্থ দিয়েছেন, ট্রাফলগার স্কোয়ারে যে বিশাল জমায়েত হয়েছিল তাতে বাঙালির অংশগ্রহণ ছিল অভূতপূর্ব। ব্রিটেনে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য ও শ্বেতাঙ্গ সমাজের কাছ থেকে নিজেদের অধিকার আদায়ের যে সংগ্রাম বাংলাদেশি কমিউনিটিকে করতে হয়েছিল সে সময় তার মূল ও মৌলিক স্পৃহা আসলে এসেছিল এই স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামের ভেতর দিয়ে। বিশেষ করে বর্ণবাদের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন গড়ে উঠেছিল তার নেতৃত্বেও কিন্তু একই সঙ্গে এদেশের বাঙালি মুক্তিযোদ্ধারাই ছিলেন। মজার ব্যাপার হলো, সে সময় যে ক’জন মুষ্টিমেয় বাঙালি মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিলেন, তাদের কাউকেই বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনেও দেখা যায়নি, এমনকি মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে যে ব্যক্তি লন্ডনে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে গড়ে ওঠা অফিসটিতে আগুন লাগিয়ে মূল্যবান দলিলদস্তাবেজ পুড়িয়ে দিয়েছিলেন, সেই ব্যক্তিটিই পরে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। এটি একটি মাত্র উদাহরণ, এ রকম আরও উদাহরণ প্রমাণসহ দেওয়া সম্ভব।
বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ ও তাকে কেন্দ্র করে দেশে–বিদেশে যে আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, তা ছিল সম্পূর্ণ সেক্যুলার এবং ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ হওয়া পাকিস্তানের নিগড় থেকে বেরিয়ে আসার লক্ষ্যে। এক্ষেত্রে যদি বলা হয়, বাঙালি মুসলমান আসলে পাকিস্তানের কট্টর ও সাম্প্রদায়িক ধর্মবাদী–শেকল থেকে মুক্ত হতে চেয়েছিল, তাহলে বোধ করি অত্যুক্তি হবে না। যে কারণে বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পর আশির দশকে এদেশের দ্বিতীয় প্রজন্মের বাঙালির অনেকেই সেক্যুলার লেবার পার্টির রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে, কিন্তু তাতে তাদের বাঙালি জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে কোনও ধরনের চিড় ধরে না এবং বাঙালির সাংস্কৃতিক পরিচয়ে পরিচিত হতেও তাদের কোনও সমস্যা হয়নি। বরং ব্রিটেনে তাদের বাঙালি বা বাংলাদেশি পরিচয় একটা গর্বের জায়গা হয়ে দাঁড়ায়। কেননা একটি সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে তারা একটি জাতি ও দেশ প্রতিষ্ঠা করেছে, একথা ব্রিটেনের মূলধারা ও সাধারণ মানুষ জানে ও স্বীকার করে। ফলে দ্বিতীয় প্রজন্মের বাঙালির জন্য ব্রিটেনে নিজেকে বাঙালি বা বাংলাদেশি পরিচয় দেওয়াটা কোনোভাবেই অসম্মানজনক ছিল না।
কিন্তু গোল বাধে পূর্ব লন্ডনের একটি মসজিদকে কেন্দ্র করে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি শুরু হওয়ার পর থেকে। লন্ডনের সেক্যুলার রাজনীতিবিদদের সঙ্গে ব্রিক লেইন মসজিদ ওতপ্রোতভাবে জড়িত, এমনকি জেনারেল এরশাদের শাসনামলে এই মসজিদের জন্য বাংলাদেশ থেকে অনুদান সংগ্রহের ব্যবস্থা করা হয়, যা দিয়ে মসজিদের ভেতরকার সৌন্দর্য বাড়ানো হয়। অন্যদিকে চিহ্নিত মানবতাবিরোধী অপরাধী চৌধুরী মঈনুদ্দিনের নেতৃত্বে পূর্ব লন্ডন মসজিদকে ঘিরে তৈরি হয় নতুন রাজনীতি, যার ভিত্তি মূলত ধর্ম। এই মসজিদ থেকে বাঙালি কমিউনিটিকে ধর্মীয় উগ্রবাদী চিন্তাধারার বইপুস্তক সরবরাহ ছাড়াও একটা স্টাডি গ্রুপ তৈরি করা হয়। যা মূলত বাঙালি জাতীয়তাবাদী রাজনীতির বিপক্ষে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির প্রচারণা চালায়। পূর্ব লন্ডনের সোমালি কমিউনিটিকেও তারা তাদের পাশে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়। মোটকথা এই মসজিদকে কেন্দ্র করে কিছু রাজনৈতিক সংগঠনের যাত্রা শুরু হয়, যার মধ্যে ইয়ং মুসলিম অর্গানাইজেশন, ইসলামিক ফোরাম ইউরোপ, হিজবুত তাহ্রীর অন্যতম। যেগুলোর প্রত্যেকটিই আসলে উগ্র ধর্মীয় প্রচারণার জন্য ব্রিটেনে পরবর্তী সময়ে মূলধারার গণমাধ্যমের নজর কাড়ে এবং তারা ঢালাওভাবে বাংলাদেশি কমিউনিটির ওপরই এই ধর্মান্ধ রাজনীতির দায় চাপাতে শুরু করে। স্পষ্টতই নব্বইয়ের দশক জুড়ে ব্রিটেনের বাংলাদেশিশী কমিউনিটি ব্রিক লেইন মসজিদ ও পূর্ব লন্ডন মসজিদের ভেতরকার দ্বন্দ্ব দেখতে পায়। যে দ্বন্দ্ব আর কিছুই নয়, বাঙালি জাতীয়তাবাদ আর ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদের দ্বন্দ্ব। পূর্ব লন্ডন মসজিদ মধ্যপ্রাচ্য এবং পাকিস্তান থেকে সরাসরি সাহায্য পায় এবং তারা একটি বিশাল মুসলিম ‘উম্মাহ’র পক্ষে জোর প্রচারণা চালাতে শুরু করে, যেখানে বাঙালি পরিচয়কে তারা সম্পূর্ণভাবে অগ্রাহ্য করে তরুণদের কেবল মুসলিম পরিচয়ে পরিচিত করাতে শুরু করে। অচিরেই ইস্ট লন্ডন মসজিদের এই প্রচারণা ছড়িয়ে পড়ে ব্রিটেনের সর্বত্র, তারা তাদের নিজেদের আদর্শে একের পর এক মসজিদ ও ইসলামিক সেন্টার গড়ে তোলে, কিন্তু অর্থ ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে ব্রিক লেইন মসজিদের পক্ষে বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও উদার ইসলামের পক্ষে প্রচারণা চালানো কিংবা এই মতাদর্শের কোনও প্রতিষ্ঠান তৈরি সম্ভব হয়নি।
ফলে তৃতীয় ও অপেক্ষাকৃত তরুণদের সামনে প্রথম ও দ্বিতীয় প্রজন্মের বাঙালিকে অনেক প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়, ঘরে–বাইরে সর্বত্রই। বিশেষ করে, বাঙালি জাতীয়তাবাদ নিয়ে প্রথম ও দ্বিতীয় প্রজন্মের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণে তৃতীয় ও তরুণরা তাদের এই দেশপ্রেম, স্বাধীনতা ইত্যাদিকে নিয়ে কটাক্ষ শুরু করে। কিন্তু সবচেয়ে বড় আঘাতটি আসে ধর্মকে নিয়ে যখন প্রশ্ন করা হয় তখন, কারণ পুরনোদের ইসলাম–পালনকে নতুনরা ‘বাংলাদেশি ইসলাম’ বলে অবহেলা করে এবং নিজেদের ‘নতুন ও খাঁটি মুসলমান’ হিসেবে দাবি করে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় যে, পুরনোরা শব–ই–বরাত পালনে উৎসাহী এবং একে একটি উৎসব হিসেবে মনে করে। অন্যদিকে তরুণদের বোঝানো হয়েছে, এটা বেদায়াত, ইসলামে এর কোনও জায়গা নেই। পুরনোরা ব্রিক লেইনকে কেন্দ্র করে ইউরোপের বাঙালিদের একটি বিশাল মিলনমেলা সৃষ্টির লক্ষ্যে বৈশাখী মেলার আয়োজন করে, যা আসলে লোকায়ত বাঙালি সংস্কৃতির অংশ, কিন্তু নতুনরা তাকে কেবল অস্বীকারই করেনি, তারা শক্তি প্রয়োগে এই মেলা বন্ধের চেষ্টা করেছে, কারণ তাদের কাছে বৈশাখী মেলা বেদায়াতি। মূলত পুরনো ও নতুনদের এই দ্বন্দ্বে টাওয়ার হ্যামলেটস (সবচেয়ে বড় বাঙালি অধ্যুষিত এলাকা)-এ দু’টি বিবদমান পক্ষ দাঁড়িয়ে যায়। যারা নিজেদের পক্ষে সরকারি ফান্ড ও সমর্থন আদায়ে উঠেপড়ে লাগে এবং দেখা যায় যে, নতুন–মুসলিম পক্ষটি এতে কিছুটা জয়ীও হয়। কারণ তাদের পক্ষে ধর্মকে ব্যবহার করে এমপি হিসেবে বিজয় লাভ করা জর্জ গ্যালওয়ে এবং পরবর্তী সময়ে বাঙালি একজন মেয়র সর্বশক্তি নিয়োগ করেন। কিন্তু এক্ষেত্রে তারা আপাত বিজয় লাভ করলেও সেক্যুলার ও বাঙালি জাতীয়বাদী শক্তিটি কিন্তু তাদের অবস্থান ত্যাগ করে না। তারা আবার একত্রিত হয় মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারকে কেন্দ্র করে টাওয়ার হ্যামলেটসে তাদের অস্তিত্বের লড়াই চলতে থাকে। তাদের হাত দিয়ে ব্রিক লেইন সংলগ্ন এলাকা ‘বাংলা টাউন’ নামে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। চায়না টাউনের মতো এখানেও অসংখ্য পর্যটক আসে, বাংলাদেশি খাবার খেতে কিংবা ঘুরতে। সুতরাং, তাদের অর্জনতো কোনোভাবেই কম নয়। অন্যদিকে, তাদের বিরোধিতাকারী পক্ষটি যারা ধর্মভিত্তিক উন্মাদনা ছড়িয়ে তরুণদের আকৃষ্ট করছে, তাদের অর্জন কমিউনিটিতে হিংসা ছড়ানো, মূলধারার বিরুদ্ধে বিদ্বেষ তৈরি, ধর্ম দিয়ে মূলধারা থেকে কমিউনিটিকে আলাদা করা, মানবতাবিরোধী অপরাধের পক্ষে বিপুল অঙ্কের অর্থ ছড়ানো। এমনকি তাদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী সংগঠন আইসিস–এর প্রতি পক্ষপাতের অভিযোগও রয়েছে।
এদিকে দেখুন, সেকুল্যার বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী পক্ষটি বর্ণবাদের সঙ্গে সংগ্রামের পাশাপাশি এখনও মূলধারার সঙ্গে সহাবস্থানের পক্ষে কথা বলে এবং কাজও করে যাচ্ছে। স্মরণ করতে পারি যখন মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি দেলোয়ার হোসেন সাঈদী ব্রিটেনে এসে ওয়াজ করার সময় এখানকার সংখ্যাগরিষ্ঠ সিলেটি কমিউনিটিকে হেয় করে বক্তব্য রেখেছিলেন এবং কমিউনিটি যখন তার বিরুদ্ধে ফেটে পড়েছিল ক্ষোভে, তখন একদিকে বয়স্ক প্রথম ও দ্বিতীয় প্রজন্মের বাঙালিরা তার বিরুদ্ধে স্লোগান দিচ্ছিলেন, অন্যদিকে তাদেরই সন্তানরা সাঈদীর পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন। কেন তারা সাঈদীর পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন, সে প্রশ্নের উত্তর দীর্ঘ। তবে এখন এটুকু বলেই শেষ করছি যে, এই তরুণরা সুফিবাদ সম্পর্কে জানেনি, জানেনি উদার বাঙালির ইসলাম সম্পর্কেও। তারা কেবল জেনেছে ইসলাম ধর্মের রাজনৈতিক রূপ সম্পর্কে এবং ৯/১১–র পরে পশ্চিমে ইসলাম সম্পর্কে ঘৃণা সম্পর্কে, যা তাদের ভেতরে আরও গভীরভাবে বসিয়ে দিয়েছে চৌধুরী মঈনুদ্দিনের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধী ও তার তৈরি ইস্ট লন্ডন মসজিদের মতো কিছু প্রতিষ্ঠান। ফলে তারা একটি কাল্পনিক কমিউনিটি (ইমাজিনড কমিউনিটি)-র প্রতি আকৃষ্ট ও ধাবিত হয়েছে, যার মূল ভিত্তি রাজনৈতিক ইসলাম। আজকাল এ বিষয়টি নিয়ে চারদিকে কথাবার্তা চলছে, চলছে গবেষণা।
এত কথা বলে আমি যে কথাটি বলতে চেয়েছি, তা হলো, ব্রিটেনেই নয়, বাংলাদেশেও যারা আসলে বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ও রাজনীতির সঙ্গে থেকেছেন, তাদের পক্ষে ধর্মীয় উগ্রবাদের প্রতি সমর্থন দেওয়া কখনোই সম্ভব নয়। আজকে ব্রিটেনে যারা আলতাব আলী পার্কে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন, তারাই একাত্তরে যুদ্ধ করেছেন, তারাই আশির দশকে এদেশে বর্ণবাদের বিরুদ্ধে লড়েছেন, তারাই এদেশে হাউজিং বা শিক্ষার জন্য আন্দোলন করেছেন এবং তারাই এদেশে মূলধারার পাশাপাশি থেকে একটি শক্তিশালী বাঙালি–সংস্কৃতিকে লালন করেছেন বা করছেন। যার একটি প্রপঞ্চ হলো ধর্ম বা ইসলাম, যার সঙ্গে মানবতার কোনও বিরোধ নেই, নেই উন্নয়ন এবং আধুনিকতারও।
সূত্রঃ বাংলা ট্রিবিউন, ৫ সেপ্টেম্বর ২০১৬
অভিসংশনের শিকার হয়েছেন যেসব বিশ্ব নেতারা
মধ্য এশিয়ায় পরাশক্তি দেশগুলোর খেলা !
হাঙ্গেরীতে সুলতান সুলায়মানের সমাধির সন্ধান লাভ
টুইটারে সৌদি নারীদের স্বাধীনভাবে চলার আন্দোলন
একজন প্রাপ্তবয়স্ক পেশাদার নারীকে ভ্রমণ বা কাজের জন্য বাড়ির বাইরে যেতে হলে অনুমতি নিতে হয় স্বামী, ভাই বা ছেলের কাছ থেকে। আদৌ তিনি বাড়ির বাইরে গিয়ে কাজ করতে পারবেন কিনা সে ব্যাপারেই অনুমতি নিতে হয়। সৌদি নারীদের দৈনন্দিন জীবনের বাস্তবতার পরিস্থিতি এই। নারীরা যেখানে তাদের জীবনের কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না কোনো পুরুষ অভিভাবকের অনুমোদন ছাড়া।
সে পুরুষটি হয়তো ওই নারীরই গর্ভে জন্ম নিয়েছেন এবং তার নিজ বাড়িতে রেখেই তাকে লালন–পালন করা হয়েছে।
আবার অনেক সময় ওই পুরুষ অভিভাবকটি হন একজন অত্যাচারি অভিভাবক। যিনি তার পুরুষালি ক্ষমতার অপব্যবহার করে তার নিয়ন্ত্রণে থাকা নারীর কাছ থেকে অর্থ আদায় করেন। অথবা চালান আরো গুরুতর কোনো অত্যাচার।
শুধু কাজ, ভ্রমণ বা বিয়ের জন্যই পুরষ অভিভাবকের অনুমোদন দরকার হয় না। বরং কোনো নারীকে জেল থেকে ছাড়া পেতে হলেও তার পুরুষ অভিভাবকের অনুমোদন লাগে! আরো অদ্ভুত হলো, পুলিশে অভিযোগ দায়ের, স্বাস্থ্য সেবা বা জরুরি কোনো সেবা পেতে গেলেও কোনো নারীকে তার পুরুষ অভিভাবকের লিখিত অনুমোদন নিতে হয়।
হাজার হাজার নারী এই অমানবিক দশা থেকে মুক্তি পেতে এখন সামাজিক গণমাধ্যম টুইটারে একটি আন্দোলন শুরু করেছেন। ওই আন্দোলনের লক্ষ্য হলো পুরুষ অভিভাবকদের অধীনে নারীদেরকে কার্যত দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে বা শিশু বানিয়ে রাখা থেকে মুক্ত করতে সৌদি সরকারকে চাপ প্রয়োগ করা।
আন্দোলনটি প্রাথমিকভাবে শুরু করে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)। ‘#টুগেদারটুএন্ডমেলগার্ডিয়ানশীপ’ এই হ্যাশট্যাগে আন্দোলনটির সুচনা করে এইচআরডব্লিউ। ওই আন্দোলনের একটি আরবী সংস্করণও শিগগিরই শুরু হয়। যা ১ লাখ ৪০ হাজার টুইটার ব্যবহারকারীকে যুক্ত করতে সক্ষম হয়েছে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই। এর পাশাপাশি ‘#স্টপএনস্লেভিংসৌদিওমেন’ হ্যাশট্যাগেও চলছে আরেকটি আন্দোলন।
সম্প্রতি সৌদি সরকার দেশটির নারীদের মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতির লক্ষ্যে কিছু ছোট ছোট পদক্ষেপ গ্রহণ করার পরিপ্রেক্ষিতে এই আন্দোলনের সুচনা হয়। গত বছরের ডিসেম্বরে সৌদি নারীদেরকে অবশেষে পৌরসভা নির্বাচনে ভোটের অধিকার দেওয়া হয়। নারীরা প্রার্থী হিসেবেও অংশগ্রহণ করার সুযোগ পায় ওই নির্বাচনে। বেশ কয়েকজন নারী কয়েকটি আসনে জয়লাভও করেন বেশ কয়েকজন নারী। তবে পুরুষদের তুলনায় তা ছিলো খুবই নগন্য।
কিন্তু পৌরসভা নির্বাচনে জয়ী হওয়া নারীদেরকে পুরুষ কাউন্সিল সদস্যদের কাছ থেকে আলাদা থাকার আদেশ দিয়ে সরকার তাদের ওপর একটি পাল্টা আঘাত হানে। শুধু ভিডিওর মাধ্যমে বৈঠকে অংশগ্রহণের আদেশ দেওয়া হয় তাদেরকে।
গাড়ি চালানো এখনো নিষিদ্ধ সৌদি আরবের নারীদের জন্য। নিজেদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টও খুলতে পারেন না তারা। তাদেরকে বাধ্যতামূলকভাবে সঙ্গে একজন পুরুষ অভিভাবক রাখতে হয় বাজারে যাওয়ার সময়ও।
চলতি বছরের এপ্রিলে সৌদি আরব “ভিশন” ২০৩০ নামের একটি উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ঘোষণা করেছে। এতে নারীদের উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ানো, নিজেদের ভবিষ্যত শক্তিশালি করা এবং সৌদি আরবের আর্থ–সামাজিক উন্নয়নে অবদান রাখার জন্য তাদেরকে সক্ষম করে গড়ে তোলার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ সহ যারা সৌদি আরবের নারীদের পরিস্থিতির উন্নয়নে সরব হয়েছে তাদের মতে, প্রধানত পুরুষদের অভিভাবকত্বের শৃঙ্খলসহ অন্যান্য বৈষম্যমূলক নীতি দেশটির নারীদের পিছিয়ে পড়ার প্রধান কারণ।
সূত্র: দ্য সিডনি মর্নিং হেরাল্ড
কলম্বো ভ্রমণ অভিজ্ঞতা
ড. সা’দত হুসাইন : দক্ষিণ এশিয়ার ব্যবস্থাপনা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধানদের আঞ্চলিক সম্মেলন চলতি বছরের ২৫ ও ২৬ জুলাই শ্রীলঙ্কার রাজধানী কলম্বোয় অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশ প্রশিক্ষণ ও উন্নয়ন সমিতির (বিএসটিডি) প্রতিনিধি হিসেবে আমি ও আমার বন্ধু বিএসটিডির সহসভাপতি মোশাররফ হোসেন এ সম্মেলনে যোগ দিই। সম্মেলনের আগের দিন, ২৪ জুলাই আমরা ঢাকা থেকে কলম্বো রওনা হয়েছিলাম এবং সম্মেলনের এক দিন পরই ঢাকা প্রত্যাবর্তন করেছি। এ কারণে কলম্বোর বাইরে কোথাও যেতে পারিনি। যা কিছু ঘোরাফেরা কলম্বোয়ই করতে হয়েছে।
আমি অবশ্য এর আগে একাধিকবার শ্রীলঙ্কা গিয়েছি। তবে তা নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি। তখন শ্রীলঙ্কার অবস্থা ভালো ছিল না। গৃহযুদ্ধে বিপর্যস্ত ছিল দেশটি। তামিল বিচ্ছিন্নতাবাদীরা আজ এখানে, কাল সেখানে আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছিল। দেশের অনেক প্রখ্যাত ব্যক্তি, এমনকি পদাসীন প্রেসিডেন্ট প্রেমাদাসাও তাদের আক্রমণে নিহত হয়েছেন। শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি বিরাট চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছিল। তার পর্যটন শিল্প মুখ থুবড়ে পড়েছিল। আতঙ্ক ও নিরাপত্তাহীনতা রাজধানীসহ পুরো দেশে জেঁকে বসেছিল। কলম্বোর বাইরে সফরে যেতে আমাদের নিরাপত্তা বাহিনীর সমর্থন নিতে হয়। কলম্বোর মধ্যেও আমাদের চলাফেরা সীমিত ছিল। নানা ধরনের বাধানিষেধের আওতায় আমাদের চলাফেরা করতে হতো। কোনো এক উঁচুমানের হোটেলের লনে সন্ধ্যাকালীন সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে কয়েকজন মন্ত্রী এসেছিলেন। তাঁদের আশপাশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একঝাঁক লোক ছিল। আতঙ্কের পরিমাণ আরো বেড়ে গিয়েছিল।
দেশে থেকেই আমরা বুঝতে পেরেছিলাম যে এবার সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিবেশে সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। তামিল টাইগাররা সম্পূর্ণরূপে পরাজিত হওয়ার পর কলম্বো শহরে ভীতিকর অবস্থার অবসান হয়েছে। দেশের অন্যান্য জায়গায়ও এখন চোরাগোপ্তা আক্রমণ নেই। যদিও শোনা যায় তামিলদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ এখনো পুরোপুরি শেষ হয়নি। এ ছাড়া যুদ্ধকালে ও যুদ্ধের অব্যবহিত পরে তামিলদের প্রতি রাজাপাকসে সরকারের নিষ্ঠুর আচরণের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ উঠেছে সে ব্যাপারে আন্তর্জাতিক তদন্ত ইত্যাদি এখনো চলছে। পূর্ববর্তী সরকার এ তদন্তের বিরোধিতা করে নানা ধরনের জটিলতা সৃষ্টি করলেও বর্তমান সরকার এ ব্যাপারে তেমন কোনো বিরোধিতা করছে না। শ্রীলঙ্কার অবস্থা স্বাভাবিক ও শান্তিপূূর্ণ জেনেই আমরা কলম্বোর উদ্দেশে রওনা হই।
বর্তমানে শুধু মিহিন লঙ্কা নামে একটি বেসরকারি বিমান সংস্থা ঢাকা ও কলম্বোর মধ্যে সরাসরি চলাচল করে। প্রতিদিন তাদের দুটি ফ্লাইট রয়েছে। একসময় বাংলাদেশ বিমানেরও সরাসরি ফ্লাইট ছিল, পরে তা বন্ধ হয়ে গেছে। শোনা যাচ্ছে, বিমান এ বছরের মধ্যে আবার সরাসরি ফ্লাইট চালু করবে। ব্যাংকক অথবা ভারতের চেন্নাই কিংবা মুম্বাই হয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। তার ভাড়া অনেক বেশি এবং সময়ও অনেক বেশি লাগে। এ কারণে মিহিন লঙ্কার সরাসরি ফ্লাইটে ভ্রমণ করার বাস্তব বিকল্প নেই বললেই চলে। মিহিন লঙ্কা বোধ হয় এই মনোপলি সুযোগ ব্যবহার করে টিকিটের দাম মাত্রাতিরিক্ত বেশি ধার্য করেছে। রিটার্ন টিকিটের দাম ইকোনমি ক্লাসে ৫৫ হাজার টাকা এবং বিজনেস ক্লাসে ৮১ হাজার টাকা। এ ভাড়া গুনেই আমাদের ভ্রমণ করতে হয়েছে।
ঢাকা–কলম্বো ফ্লাইটে যাত্রীর সংখ্যা অত্যধিক নয়। টিকিট পেতেও খুব কষ্ট হয় না, প্লেন খালি যায় এমনটিও বলা যাবে না। যাত্রীদের একাংশ মালদ্বীপের পর্যটক। এক টিকিটে দুই দেশ ভ্রমণ করার সুযোগ পাওয়া যায় বলে কলম্বো–মালে ভ্রমণে পর্যটকরা উৎসাহিত বোধ করেন। আমরা দুপুর ১২টার ফ্লাইটে রওনা দিলাম। বিমানে ভ্রমণ সময় পৌনে তিন ঘণ্টা। শ্রীলঙ্কার সময় বাংলাদেশ থেকে আধঘণ্টা পিছিয়ে। অপরাহ্ন আড়াইটার কাছাকাছি আমরা বন্দরনায়েক আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, কলম্বোয় অবতরণ করলাম। বিমানবন্দরটি বৃহৎ আকারের নয়। যাত্রীসংখ্যা সীমিত। ইমিগ্রেশন, কাস্টমসে ঝক্কি–ঝামেলা নেই। খুব সহজে এসব পার হয়ে বাইরে এলাম। এমডি সার নির্বাহী পর্ষদের সদস্যকে নেওয়ার জন্য ভাড়া গাড়ি কম্পানির এক প্রতিনিধি অপেক্ষা করছিলেন। আমাদের পরিচয় দেওয়ার পর তিনি টেলিফোন করে একটি গাড়ি আনালেন। গাড়িটি বেশ ভালো। গাড়ির ড্রাইভার ও ভদ্রলোক—দুজনেই জানালেন যে রবিবার ছুটির দিন হওয়ায় এক্সপ্রেস ওয়েতে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। সাধারণ পথে গেলেই চলবে, তাতে ৬০০ শ্রীলঙ্কার রুপি কম খরচ হবে। ইচ্ছা করলে তাঁরা এক্সপ্রেস ওয়ের নাম করে আমাদের কাছ থেকে ৬০০ রুপি বেশি নিতে পারতেন। কিন্তু সে রকম কিছু তাঁরা করেননি। আমরা নিরাপদে হোটেলে চলে এলাম।
ম্যারিন ড্রাইভে অবস্থিত গ্লোবাল টাওয়ার হোটেলে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এটি সাগর পারে নবনির্মিত একটি উঁচুমানের হোটেল। রুম ভাড়া যৌক্তিক মনে হয়েছে, দৈনিক মাত্র ৮০ ইউএস ডলার। হোটেলের রুম থেকে সাগর দেখা যায়। একটু হেঁটে গিয়ে সাগর পাড়ে বসা যায়। তবে মূল ‘বিচ’ গলফ ফেস নামক স্থানে, যা আমাদের হোটেল থেকে ছয়–সাত কিলোমিটার দূরে। সেটি শহরের পুরনো অংশে পড়ে, যদিও রাষ্ট্রপতির অফিস, পুরনো পার্লামেন্ট শহরের এ অংশে অবস্থিত। আমরা রবিবারে কলম্বো পৌঁছি। সাপ্তাহিক ছুটির দিন বিধায় দোকানপাট বন্ধ, রাস্তাঘাটে লোকজন কম। গাড়ির সংখ্যাও সীমিত। বিকেলে হেঁটেই আমরা আশপাশের পথঘাট দেখলাম।
কলম্বোর রাস্তাঘাট, ফুটপাত পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন। কোথাও দখলদারির লেশ নেই। ফুটপাতে পসরা সাজিয়ে কোনো হকার বসেনি। মেরামতের জন্য আনা গাড়ি রাস্তার ওপর রাখা হয়নি। রাস্তার পাশে গাড়ি মেরামতের যে গ্যারেজ রয়েছে, সব গাড়ি তার ভেতরে রাখা আছে। আমাদের শহরে মেরামতের গাড়ি হয় রাস্তার ওপরে, না হয় ফুটপাতে রেখে রাস্তা ও ফুটপাত দুটিই বেদখল করা হয়। রাস্তা ও ফুটপাতে চলাচলে কার কী অসুবিধা হচ্ছে তা নিয়ে কারো মাথাব্যথা নেই। কলম্বোয় রাস্তা–ফুটপাত দখল–বেদখলের বালাই নেই।
কলম্বোয় আমি কোনো ভাঙা রাস্তা দেখিনি। অলিগলির কথা নিশ্চিত করে বলতে পারি না। আমরা মাত্র দু–একটি গলিপথ দেখেছি। সেগুলো খুব চওড়া নয়, দুটি গাড়ি চলতে পারে। সেসব গলিপথও ভাঙা নয়। রাস্তায় দিনের বেলায় ট্রাক খুব একটা চলে না। বাস, পিকআপ, কার, জিপ, বেবিট্যাক্সি, মোটরসাইকেল ও বাইসাইকেল চলে। কলম্বোর লোকজন ধীরস্থির প্রকৃতির। তারা হুড়মুড় করে, কনুই মেরে, ল্যাং মেরে কিংবা গুঁতোগুঁতি করে রাস্তায় চলাফেরা করে না। ধীরে–সুস্থে প্রতিবন্ধকহীন ফুটপাত দিয়ে হেঁটে যায়। দেখেশুনে জেব্রাক্রসিং দিয়ে রাস্তা পারাপার হয়। গাড়িগুলো সোজা লাইন ধরে রাস্তায় চলে, বারবার লেন পরিবর্তন করে না। আমাদের দেশের বাসগুলোর মতো যাত্রী তোলার জন্য থেমে থাকে না। আবার যাত্রী ওঠানোর পর কোনা কেটে অন্য গাড়িগুলোকে আটকে রাস্তার অন্য পাশে যায় না। ফলে কলম্বোর রাস্তার দুর্বিষহ ট্রাফিক জ্যাম নেই। সিগন্যাল বাতির ইশারায় সবুজ বাতিতে গাড়ি চলে, লাল বাতিতে থেমে থাকে, যা ঢাকায় সচরাচর ঘটে না। ঢাকায় ট্রাফিক পুলিশের মর্জিমতো লাল বাতিতেও গাড়ি চলে, আবার সবুজ বাতিতে গাড়ি থেমেও থাকে। কলম্বোর রাস্তায় পর্যাপ্তসংখ্যক ভাড়ার ক্যাব দেখা যায়। মজার ব্যাপার, এ শহরে ‘ন্যানো’ মডেলের গাড়ি ভাড়ার ক্যাব হিসেবে ব্যবহৃত হয়। আমরা এ ধরনের গাড়িতে চড়িনি। ধারণা করছি, ন্যানো ক্যাবে ভাড়া কম হবে, এতে এক লিটার তেলে প্রায় ১৫ কিলোমিটার চলে। নবনির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় এসে সাধারণ জনগণের সুবিধার্থে তেলের দাম উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়েছে। আগে যেখানে প্রতি লিটার তেল ছিল ১৬২ শ্রীলঙ্কান রুপি, বর্তমানে তা নামিয়ে আনা হয়েছে ১১৭ শ্রীলঙ্কান রুপিতে (বাংলাদেশি ৬৪ টাকা)। গাড়ির মালিক ও যাত্রী সাধারণ উভয়ের জন্য এটি বড় রকমের স্বস্তিদায়ক হয়েছে।
উদ্যোক্তাদের গাড়ি আমাদের হোটেল থেকে সেমিনার ভেন্যুতে নিয়ে যায়। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে কোনো বাড়তি আড়ম্বর ছিল না। পরিপাটি আয়োজন। ভিআইপি হিসেবে কাউকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করা হয়নি। ভিআইপিদের কোনো সিট সংরক্ষিত ছিল না। সবাই সম্মানিত ব্যক্তি, সে হিসেবে সবাই ভিআইপি। যাঁরা অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেবেন, শুধুই তাঁরাই মঞ্চে বসা। প্রত্যেকেই প্রাঞ্জল ভাষায় যথাপরিসরে লক্ষ্যবিদ্ধ বিষয়ের ওপর তাঁদের বক্তব্য দিয়েছেন। স্তুতি, বন্দনা, নিজের গুণগান কিংবা চাটুকারিতার লেশ মাত্র ছিল না। তথ্যসমৃদ্ধ যৌক্তিক বক্তব্য সবার মন কেড়েছে বলে আমার ধারণা। আমার বন্ধু মোশাররফের মূল্যায়নও একই। অনাড়ম্বর পরিবেশে সুন্দরভাবে অনুষ্ঠানটির সমাপ্তি হয়েছিল।
পরদিন ছিল ‘বিজনেস সেশন’। বিভিন্ন দেশের আমন্ত্রিত অতিথিরাই এতে উপস্থিত ছিলেন। পূর্বনির্ধারিত ব্যক্তিবৃন্দ তাঁদের নিবন্ধ উপস্থাপন করেছিলেন। এখানে একটি দুর্বলতা লক্ষণীয় ছিল। প্রতিনিধিদের সামনে কোনো ফোল্ডার, নোট বই কিংবা কলম রাখা ছিল না। এমনকি সাদা কাগজও রাখা ছিল না। প্রয়োজন বোধে চেয়ে নিতে হয়েছে। তবে কর্মসূচি ছিল নিটোল। উপস্থাপক ও বক্তারা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তাঁদের বক্তব্য গুছিয়ে উপস্থাপন করেছেন। উন্মুক্ত আলোচনায় প্রত্যাশী অংশগ্রহণকারীদের বক্তব্য রাখার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। কাউকে মাঝপথে থামিয়ে দেওয়া হয়নি। অধিবেশন শেষ হওয়ার ঠিক আগে র্যাপোটিয়ার সংক্ষেপে অধিবেশনের মূল ভাবনা ও গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্যগুলোর সারসংক্ষেপ তুলে ধরে তাত্ক্ষণিক প্রতিবেদন পেশ করেছেন। সৌহার্দ্যমূলক পরিবেশে সবার সন্তুষ্টির মধ্য দিয়ে বিজনেস সেশন শেষ হয়েছে। আমরা প্রীতিভোজে যোগ দিয়েছি।
শ্রীলঙ্কান ভোজে দক্ষিণ ভারতীয় প্রভাব চোখে পড়ার ও জিভে লাগার মতো। এখানে মাছ–মাংসের উপস্থিতি লক্ষণীয় নয়। তার বদলে সবজি, পনির, নারকেল, ইদলি, দোসা চাটনির ছড়াছড়ি। বৌদ্ধপ্রধান দেশে মাংসের স্বল্পতা মেনে নেওয়া গেলেও সাগরবেষ্টিত শ্রীলঙ্কায় মাছের আইটেম পর্যাপ্ত না থাকাকে স্বাভাবিক বলে মেনে নিতে মন চায় না। হোটেলের মাছ–মাংস–সংবলিত প্রাতরাশে অসুবিধা না হলেও মধ্যাহ্ন ও নৈশ ভোজে মাছ–মাংসের অনুপস্থিতি অনুভূত হতো। অতৃপ্তির অবসান ঘটাতে ম্যাকডোনাল্ড, কেএফসি কিংবা ভারতীয় হোটেলে যেতে হয়েছে। উদ্যোক্তাদের আন্তরিকতার অভাব ছিল না। তবে আমাদের খাদ্যাভ্যাস সম্পর্কে তাঁদের সুস্পষ্ট ধারণা ছিল না।
সম্মেলন শেষ হওয়ার পর মাত্র এক দিন সময় পেয়েছিলাম দোকানপাটে যাওয়ার। পুরনো শহর ‘পেটায়’, যাকে ওল্ড মুরস স্ট্রিটও বলা হয়, গিয়েছি ‘চা’ কেনার জন্য। এ জায়গাটা আমাদের পুরান ঢাকার বাজার বা দিল্লির করলবাগের মতো। অবশ্য পুরান ঢাকার মতো অত ঘিঞ্জি ও অপরিষ্কার নয়। এটি কলম্বোর মসলা ও চায়ের বাজার। মালামালের পরিমাণ ও বৈচিত্র্যের অভাব নেই। দোকানদারদের ব্যবহার চমৎকার। কোনো পণ্য কারো দোকানে না পাওয়া গেলে দোকানদার আপনাকে অকপটে বলে দেবে তা কোন দোকানে পাওয়া যাবে। ঢাকা ও কলকাতার দোকানদাররা বলবে এ ব্র্যান্ডের পণ্য এখন বাজারে পাওয়া যায় না, অতএব তার দোকানের জিনিসটি কেনাই সমীচীন হবে। আসলে হয়তো জিনিসটি বাজারে ঠিকই পাওয়া যাবে, তবু সামান্য লাভ ও লোভের জন্য আমাদের দোকানদার জেনেশুনে ক্রেতাকে বিভ্রান্ত করে। কলম্বোর বড় বড় দোকানেও সেলসম্যানদের অকপট ও আন্তরিক ব্যবহার আমাদের মুগ্ধ করেছে। তাদের কারো মধ্যেই চালবাজির প্রবণতা দেখিনি। আমরা যে গাড়িটি ভাড়া করে নিয়ে গিয়েছিলাম, তার চালকও ফন্দিফিকির করে আমাদের কাছ থেকে বাড়তি টাকা হাতিয়ে নিতে চেষ্টা করেনি।
ফিরে আসার পথে আমার বন্ধু মোশাররফ আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘এই কদিনে কলম্বোর কোনো লোকের আচার–আচরণ, ব্যবহার তোর কাছে বিরক্তিকর মনে হয়েছে কি না, কোনো লোককে চালবাজ–ধাপ্পাবাজ মনে হয়েছে কি না?’ আমার উত্তর ছিল, ‘না’। এটি ছিল আমাদের জন্য কলম্বো সফরের সবচেয়ে বড় শিক্ষা।
লেখক : সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও পিএসসির সাবেক চেয়ারম্যান
সূত্রঃ দৈনিক কালের কন্ঠ, ৩ সেপ্টেম্বর ২০১৬