প্রথম পাতা > জীবনী, বাংলাদেশ, সাহিত্য > আবু ইসহাকের অভিধানচর্চা ও সাহিত্যখ্যাতি

আবু ইসহাকের অভিধানচর্চা ও সাহিত্যখ্যাতি

abu ishaq 7মৌরী তানিয়া : প্রথম দিকে খুব বেশিদূর যেতে চাননি তিনি। লিখতে বসেছিলেন বিশেষিত শব্দের ছোটখাটো একটা অভিধান। লিখতে লিখতে তিরিশ বছর কেটে গেল। কখন কেটে গেল টেরই পেলেন না। নিজের বিশাল কাজ দেখে পরে নিজেই অবাক হয়ে গেলেন। শেষ দিকে এসে এ কাজে পুরো পরিবার নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন।

কাজটাও বেশ অদ্ভুত। নানা ধরনের বইপুস্তক ও পত্রপত্রিকা চষে শব্দ বের করতেন। শব্দগুলো ছোট ছোট কার্ডে লিখে নিতেন। কার্ডগুলো রাখতেন গুঁড়ো দুধের খালি কৌটায়। পরে সেগুলো বাছাই করে সুতোয় মালা গেঁথে সাজাতেন। এই মালা গাঁথার কাজ ও বিশেষিত শব্দের কার্ড গুছিয়ে দিতেন স্ত্রী, কন্যা, পুত্র ও নাতি-নাতনিরা। এভাবে দুই লাখেরও বেশি বিশেষিত শব্দ নিয়ে মালা গাঁথলেন তিনি। শব্দের এই মালাগুলো পুস্তক আকারে রূপ নিয়ে হলো বাংলা ভাষার মূল্যবান সম্পদ ‘সমকালীন বাংলা ভাষার অভিধান’। শুধু এই অভিধানই নয়, আরো অনেক কিছু রচনা করেছেন আবু ইসহাক। বাংলাদেশের কথাসাহিত্যের উজ্জ্বলতম নক্ষত্রগুলোর একটির নাম আবু ইসহাক।

বাংলা সাহিত্যে যাঁরা লিখেছেন কম, কিন্তু যা লিখেছেন তা অসাধারণ, তাঁদেরই একজন তিনি। সব মিলিয়ে তিনটি উপন্যাস, ছোটগল্পের দুটি সংকলন, একটি নাটক, একটি স্মৃতিকথা ও একটি অভিধান রচনা করেছেন আবু ইসহাক। এর বাইরে অগ্রন্থিত আরও কিছু রচনা আছে। মাত্র ২০ বছর বয়সে লেখা প্রথম উপন্যাস ‘সূর্যদীঘল বাড়ী’ দিয়ে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যসমাজে সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন আবু ইসহাক।

১৯২৬ সালের ১ নভেম্বর (১৫ কার্তিক ১৩৩৩ বাংলা) শরীয়তপুর জেলার নড়িয়া থানাধীন শিরঙ্গল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন আবু ইসহাক। তাঁর বাবা মৌলভী মোহাম্মদ এবাদুল্লাহ কাঠের ব্যবসা করতেন। এছাড়া গ্রামের কিছু কৃষি জমির মালিকও ছিলেন মোহাম্মদ এবাদুল্লাহ। আবু ইসাহাকের মা আতহারুন্নিসা ছিলেন সাধারণ একজন গৃহবধূ। ছয় ভাইবোনের মধ্যে আবু ইসহাক ছিলেন পঞ্চম। আবু ইসহাকের বাবা কাঠের ব্যবসায়ী হলেও শিক্ষা-সংস্কৃতির প্রতি তাঁর বিশেষ আগ্রহ ছিল। ছেলেমেয়েদের মানসিক বিকাশের কথা চিন্তা করে তিনি ওই সময়ের বিখ্যাত দুটি বাংলা সাময়িকপত্রের গ্রাহক হয়েছিলেন। নিয়মিত গ্রাহক হওয়ায় ‘সওগাত’ ও ‘দেশ’ পত্রিকা নিয়মিত পেতেন আবু ইসহাক ও তাঁর ভাইবোনেরা।

বিশ শতকের গোড়ার দিকে বাংলাদেশের গ্রামগুলোর অধিকাংশই ছিল অনগ্রসর। এক্ষেত্রে খানিকটা ব্যতিক্রম ছিল নড়িয়া গ্রাম। নড়িয়ায় তখন বেশকিছু সম্পন্ন ও সংস্কৃতিমনা পরিবার ছিল। এসব পরিবারের সাথে আবু ইসহাকদের পরিবারের সুসম্পর্ক ছিল। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সমাজকর্ম কর্মসূচির অন্যতম সহযোগী সুধীরচন্দ্র কর ছিলেন নড়িয়া গ্রামের সন্তান। আবু ইসহাকের সহপাঠী ছিলেন সুধীরচন্দ্র করের ছোটভাই সুভাষচন্দ্র কর। সহপাঠী সুভাষের মাধ্যমে তাঁদের পারিবারিক সংগ্রহ থেকে অনেক বইপত্র পড়ার সুযোগ পেয়েছেন তিনি। আবু ইসহাকের বড়ভাইয়ের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক ছিল প্রতিবেশী জমিদার বাড়ির ছেলে ফুটবলার গোষ্ঠ পালের। গোষ্ঠ পালদের বিশাল পারিবারিক লাইব্রেরি থেকে বইপত্র ধার নেওয়ার সুযোগ পেতেন আবু ইসহাক। এছাড়া আবু ইসহাকদের স্কুলের (উপসী বিজারি তারাপ্রসন্ন উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়) লাইব্রেরিতে সমকালীন পত্রপত্রিকা ও বইপুস্তক ছিল। এখান থেকেও বইপত্র পড়ার সুযোগ পেতেন তিনি। শৈশব ও কৈশোরে পত্রপত্রিকা ও পুস্তক পাঠের এসব সুযোগ সাহিত্যিক আবু ইসহাকের মানস গঠনে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে। ছোটবেলা থেকেই কবিতা ও গল্প লেখার প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন তিনি। ১৯৪০ সালে আবু ইসহাক যখন নবম শ্রেণির ছাত্র তখনই ‘অভিশাপ’ নামের একটি গল্প তিনি পাঠিয়েছিলেন কলকাতা থেকে কবি কাজী নজরুল ইসলামের সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘নবযুগ’ পত্রিকায়। ওই পত্রিকায় ওই বছরের কোনো এক রবিবারে তাঁর গল্পটি ছাপা হয়। এটিই আবু ইসহাকের প্রথম প্রকাশিত লেখা।

abu ishaq books 1

১৯৪২ সালে শরীয়তপুর জেলার উপসী বিজারী তারাপ্রসন্ন উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয় থেকে বৃত্তি নিয়ে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন আবু ইসহাক। ১৯৪৪ সালে ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। সময়টি ছিল বাংলাদেশ তথা সারা বিশ্বের জন্যই গভীরতর সংকটের। একদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আর অন্যদিকে বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষ ও সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধির রাজনীতি। পারিবারিক আর্থিক সংকট ও রাজনীতিবিদদের উত্সাহে পড়াশোনা অসমাপ্ত রেখেই আবু ইসহাক চাকরিতে যোগ দেন। বাংলা সরকারের বেসরকারি সরবরাহ বিভাগের পরিদর্শকের চাকরি নিয়ে তিনি চলে আসেন নারায়ণগঞ্জে। নারায়ণগঞ্জ থেকে কলকাতা এবং পরে পাবনা। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের সময় আবু ইসহাকের কর্মস্থল ছিল পাবনা। ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত তিনি সেখানেই ছিলেন। দেশভাগের মাধ্যমে পূর্ববঙ্গ পাকিস্তানের অংশ হয়ে যায়। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর বেসরকারি সরবরাহ বিভাগ বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়। আবু ইসহাককে আত্মীকরণ করা হয় পুলিশ ও নিরাপত্তা বিভাগে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর সরকারি চাকুরেদের অনেকের পদোন্নতি ঘটলেও আবু ইসহাকের ক্ষেত্রে ঘটে পদাবনতি। আগে ছিলেন পরিদর্শক, পুলিশ বিভাগে আত্মীকরণের পর হন সহকারী পরিদর্শক। একই পদে থেকে যেতে হয় দীর্ঘ আট বছর। এই চাকরিতে ১৯৪৯ থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত আবু ইসহাকের কর্মস্থল ছিল তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকা। ১৯৫৬ সালে তাঁর ভাগ্যে পদোন্নতি জোটে। পুলিশ ও নিরাপত্তা বিভাগের পরিদর্শক করে তাঁকে করাচিতে বদলি করা হয়। ১৯৬০ সালে চাকরিরত অবস্থায় করাচি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক পাস করেন তিনি। এরপর আবু ইসহাকের বেশ কয়েক দফা দ্রুত পদোন্নতি ঘটে। ১৯৬৬ সালে তাঁকে রাওয়ালপিন্ডিতে বদলি করা হয়। ১৯৬৯ সালে সহকারী কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা কর্মকর্তা হিসেবে পদোন্নতি দিয়ে তাঁকে করাচি থেকে বদলি করা হয় ইসলামাবাদে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত তিনি ইসলামাবাদেই ছিলেন।

মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশে না থাকলেও বাঙালি হওয়ার কারণে আবু ইসহাককে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ সহ্য করতে হয়েছে। ১৯৭১ থেকে ১৯৭৩ পর্যন্ত প্রতিনিয়ত জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাঁচার চেষ্টায় লড়তে হয়েছে তাঁকে। পাকিস্তানে আটকে পড়া অবস্থা থেকে আবু ইসহাক বহু কষ্টে পালিয়ে যান আফগানিস্তানে। ভারত ও আফগানিস্তান সরকারের সহায়তায় ১৯৭৩ সালে কাবুল ও নয়াদিল্লি হয়ে দেশে ফিরে আসতে সক্ষম হন। দেশে ফেরার পর বাংলাদেশের নবগঠিত নিরাপত্তা বিভাগ তাঁকে যথার্থ সম্মানের সাথে বরণ করে নেয়। তাঁকে জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার (এনএসআই) উপপরিচালক করা হয়। এর পরে ১৯৭৪ সালে তিনি মিয়ানমারের (বার্মা) আকিয়াব শহরে বাংলাদেশ কনসুলেটে ভাইস কনসাল হিসেবে নিয়োগ পান। ১৯৭৬ সালে আবু ইসহাক কলকাতায় বাংলাদেশ ডেপুটি হাইকমিশনে ফার্স্ট সেক্রেটারি হিসেবে যোগ দেন। ১৯৮৯ সালে তাঁকে আবার বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনা হয় এবং এনএসআই’র খুলনা বিভাগের প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। চাকরিজীবনের শেষ পর্যায়ে খুলনার খালিশপুর এলাকায় ‘সূর্যদীঘল বাড়ী’ নামে একটি বাড়ি নির্মাণ করেছিলেন আবু ইসহাক। সে বাড়িতে অবশ্য তিনি বেশিদিন থাকেননি। ১৯৮৪ সালের ১ নভেম্বর চাকরি থেকে অবসর নেন তিনি। অবসর নেওয়ার পর থেকে মৃত্যুর পূর্বপর্যন্ত ঢাকার বড় মগবাজার এলাকার ‘তাহমিনা মঞ্জিল’ নামের একটি ভাড়া বাসায় অবস্থান করেছেন। আবু ইসহাক ২০০৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি রবিবার রাত ৯টা ১৫ মিনিটে ঢাকার হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা শহীদ দিবসে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে দেশের এই কৃতী সন্তানকে শেষ শ্রদ্ধা জানায় সর্বস্তরের মানুষ। ঢাকার মিরপুরে বুদ্ধিজীবী গোরস্তানে চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন আবু ইসহাক।

আবু ইসহাক দাম্পত্যজীবন শুরু করেন ১৯৫০ সালে। পাকিস্তানে থাকার সময় স্ত্রী সালেহা ইসহাক ছিলেন ইসলামাবাদ সেন্ট্রাল গভর্নমেন্ট হাইস্কুলের শিক্ষিকা। দেশে ফেরার পর শিক্ষকতা করেছেন মতিঝিল বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে। এই স্কুল থেকে তিনি অবসর গ্রহণ করেন। আবু ইসহাক ও সালেহা ইসহাক দম্পতির তিন সন্তান। তাঁরা সবাই নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত।

আবু ইসহাক তাঁর ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার ব্যাপারে খুব যত্নবান ছিলেন। ছেলেমেয়েদেরকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত কোনো প্রাইভেট টিউটর না দিয়ে নিজেই তাঁদেরকে পড়াশোনায় সহযোগিতা করেছেন। বাবার স্মৃতিচারণ করে মুশতাক কামিল বলেন, “আমাদের একটা কথা তিনি প্রায়ই বলতেন, ‘জন্মগত প্রতিভাবান বলে তেমন কিছু নেই। কালেভদ্রে দুয়েকজন তেমন হয়। বাকি সবাইকে পরিশ্রম করতে হয়। সফলতা পেতে চাইলে সবাইকে পরিশ্রম করতে হবে।’”

শুধু নিজের পরিবারের প্রতি নয়, অন্যান্য মানুষের প্রতিও আবু ইসহাক সব সময় সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর ১৯৭২ সালে পাকিস্তানে আটকে পড়া বাঙালিদের দেশে ফেরত পাঠানোর ক্ষেত্রে তিনি সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন। পাকিস্তানে ‘বাঙালি রিপ্যাট্রিয়েশন কমিটি’র কর্মকর্তা ছিলেন তিনি। পাকিস্তানের জেলে আটকে পড়া বাঙালিদের ছাড়িয়ে আনার জন্য আইনি সহযোগিতা থেকে শুরু করে বিভিন্নভাবে সাহায্য করার সাধ্যমতো চেষ্টা করেছেন আবু ইসহাক।

আবু ইসহাকের শখ ছিল মাছ ধরা, শিকার করা এবং মৌমাছি পালন। এছাড়া আড্ডাপ্রিয় মানুষ ছিলেন তিনি। করাচিতে থাকাকালীন সমমনা পড়ুয়া বাঙালিদের নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন প্রবাসী পাঠচক্র। পাঠচক্রের সদস্যদের বাসায় প্রতি মাসে চক্রাকারে আড্ডা বসত।

বাংলা সাহিত্যে অসামান্য অবদানের জন্য আবু ইসহাক ১৯৬৩ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৮১ সালে আবু ইসহাককে সুন্দরবন সাহিত্য পদক দেওয়া হয়। ১৯৯০ সালে বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ সাহিত্য পদক লাভ করেন। ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে একুশে পদকে ভূষিত করে। পরবর্তী সময়ে ২০০৪ সালে স্বাধীনতা পদক লাভ করেন তিনি। ২০০৬ সালে আবু ইসহাক নাটক বিভাগে শিশু একাডেমী পদক পান। এছাড়া অলক্ত সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন তিনি।

আবু ইসহাকের উপন্যাস ও গল্পের অনুবাদ এবং সেগুলো অবলম্বনে নির্মিত চলচ্চিত্র দেশের বাইরে থেকে দেশের জন্য সম্মান বয়ে এনেছে। তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘সূর্যদীঘল বাড়ী’ উর্দু ও চেক ভাষায় অনূদিত হয়েছে। উপন্যাসটির উর্দু অনুবাদ ‘আসেবি ঘর’ ১৯৬৯ সালে হাবিব ব্যাংক সাহিত্য পদক লাভ করে।

‘সূর্যদীঘল বাড়ী’ অবলম্বনে ১৯৭৯ সালে চলচ্চিত্রকার মসিহউদ্দিন শাকের একই নামে যে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন সেটি জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রের পুরস্কারসহ সাতটি এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পাঁচটি পুরস্কার লাভ করে। আবু ইসহাকের লেখা ‘মহাপতঙ্গ’ গল্প অবলম্বনে ইংরেজি ভাষায় নির্মিত কার্টুন ছবি “হু ফ্লিউ ওভার দ্য স্প্যারো’স নেস্ট” সুইজারল্যান্ডে অনুষ্ঠিত ১৯৮১ সালের চলচ্চিত্র উত্সবে মানবিক আবেদন সৃষ্টির জন্য শ্রেষ্ঠ স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র হিসেবে নির্বাচিত হয়।

পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র থাকা অবস্থায়ই আবু ইসহাক গল্প ও কবিতা লেখা শুরু করেন। তাঁর এসব লেখার বেশকিছু স্কুলের দেয়াল পত্রিকা ‘প্রভাতী’-তে ছাপা হয়েছে। স্কুলের গণ্ডির বাইরে তাঁর প্রথম লেখা প্রকাশিত হয় নবম শ্রেণিতে পড়ার সময়। মাত্র ১৪ বছর বয়সে কলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘নবযুগ’ পত্রিকায় ছাপা ‘অভিশাপ’ নামের সেই গল্পটিই তাঁকে সাহিত্যিক হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে। ফরিদপুরের রাজেন্দ্র কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক পড়ার সময় ‘সওগাত’ ও ‘আজাদ’ পত্রিকায় তাঁর লেখা বেশ কয়েকটি গল্প ছাপা হয়। ওই সময় কলেজ বার্ষিকীতে তাঁর অনুবাদ করা একটি কবিতাও ছাপা হয়েছিল।

উচ্চ মাধ্যমিক পাসের পর বেসরকারি সরবরাহ বিভাগের পরিদর্শকের চাকরি নিয়ে আবু ইসহাক প্রথম কাজ শুরু করেন নারায়ণগঞ্জে। নারায়ণগঞ্জ তখন দুর্ভিক্ষ কবলিত। নারায়ণগঞ্জে তাঁর বন্ধু কবি আনিসুল হক চৌধুরী দেশের দুর্ভিক্ষের চিত্র একটি উপন্যাসের মাধ্যমে তুলে ধরার ব্যাপারে তাঁকে উত্সাহিত করেন। আবু ইসহাকের সংবেদশীল মনেও বাংলাদেশের মানুষের দুর্যোগ, দুর্ভোগ, কুসংস্কার ও বেঁচে থাকার সংগ্রাম গভীরভাবে নাড়া দিয়েছিল। বিশ্বযুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ ও সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধির খপ্পরে পড়ে দেশের অধিকাংশ মানুষই তখন বাঁচার আশায় দিশেহারা। নারায়ণগঞ্জে থাকার সময় ঢাকা-নারায়ণগঞ্জের ট্রেনের একশ্রেণির যাত্রীর মধ্যে এই দিশেহারাদের দেখছিলেন আবু ইসহাক। যারা নিঃস্ব হয়ে পেটের ভাত জোগাড়ের আশায় শহরে গিয়েছিল, কিন্তু শহরে কোনো ভরসা না পেয়ে তারা গ্রামে ফিরে আসে। গ্রামে ফিরেও তারা বাঁচার আশ্বাস পায় না। এইসব দিশেহারা, নিঃস্ব, অসহায় মানুষদের নিয়ে আবু ইসহাক নারায়ণগঞ্জে থাকাকালেই ১৯৪৪ সালে তাঁর প্রথম ও অন্যতম উপন্যাস ‘সূর্যদীঘল বাড়ী’ রচনার কাজ শুরু করেন। দীর্ঘ চার বছর পর ১৯৪৮ সালে এটি লেখার কাজ শেষ হয়। ১৯৫০ সাল থেকে ১৯৫১ সাল পর্যন্ত এটি ধারাবাহিকভাবে ছাপা হয় ‘নওবাহার’ নামক মাসিক পত্রিকায়। উপন্যাসটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় রচনার সাত বছর পর ১৯৫৫ সালে। প্রথম গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় কলকাতা থেকে এবং পরে বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত হয় ১৯৬২ সালে। ‘সূর্যদীঘল বাড়ী’-তে এমন অনেক কিছুই আছে যা দেশে ও বিদেশে অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।

আবু ইসহাকের দ্বিতীয় উপন্যাস ‘পদ্মার পলিদ্বীপ’। ‘পদ্মার পলিদ্বীপ’ লেখা শুরু করেছিলেন ১৯৬০ সালে এবং শেষ করেন ১৯৮৫ সালে। এটি প্রথমে বাংলা একাডেমির পত্রিকা ‘উত্তরাধিকার’-এ প্রকাশিত হয় ‘মুখরমাটি’ নামে। পরে গ্রন্থাকারে প্রকাশের সময় এটির নাম রাখা হয় ‘পদ্মার পলিদ্বীপ’।

ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষ অর্থাত্ দেশভাগের আগের সময়কে এ উপন্যাসে ধারণ করা হয়েছে। পদ্মার বুকে জেগে ওঠা নতুন চরের দখল নিয়ে এ উপন্যাসের কাহিনি আবর্তিত হয়েছে।

আবু ইসহাকের তৃতীয় ও সর্বশেষ উপন্যাস ‘জাল’। ১৯৮৮ সালে ‘আনন্দপত্র’ নামের একটি পত্রিকার ঈদসংখ্যায় এটি প্রথম ছাপা হয়। গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় এর পরের বছর। প্রকাশের দিক থেকে তৃতীয় উপন্যাস হলেও এটি লেখা হয় ১৯৫০-এর দশকে। এটি লেখার সময় পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে আবু ইসহাক কয়েকটি জাল নোটের মামলার তদন্ত করছিলেন। শোনা যায়, ‘সূর্যদীঘল বাড়ী’ প্রকাশের জন্য প্রকাশকদের মনোযোগ আকর্ষণ করতেই তিনি গোয়েন্দা কাহিনির আদলে লিখেছিলেন ‘জাল’। পরে ‘সূর্যদীঘল বাড়ী’ এতটাই আলোড়ন তোলে যে তিনি নিজের নামের প্রতি অবিচার হতে পারে ভেবে ‘জাল’কে প্রকাশ না করে বাক্সবন্দি করে রাখেন দীর্ঘ ৩৪ বছর।

আবু ইসহাকের সঙ্গে সাহিত্যের পাঠকের পরিচয় তাঁর গল্পের মাধ্যমে। তবে দীর্ঘ সাহিত্যজীবনের তুলনায় তাঁর গল্পের সংখ্যা খুব বেশি নয়। প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ মাত্র দুটি ‘হারেম’ (১৯৬২) ও ‘মহাপতঙ্গ’ (১৯৬৩)। ২০০১ সালে প্রকাশিত গ্রন্থ ‘স্মৃতিবিচিত্রা’কে অনেকেই গল্প সংকলন হিসেবে বিবেচনায় আনেন। ‘স্মৃতিবিচিত্রা’য় আসলে তিনি নিজের জীবনের স্মৃতিই তুলে ধরেছেন নকশাধর্মী রচনার আদলে।

আবু ইসহাক রচিত একমাত্র নাটক ‘জয়ধ্বনি’। ১৯৯৬ থেকে ১৯৯৭ সালের মধ্যে তিনি এটি রচনা করেন। বাংলা একাডেমির কিশোর পত্রিকা ‘ধানশালিকের দেশ’-এ এটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৯৭ সালে। নাতি-নাতনিদের আবদারে তিনি এটি রচনা করেন। মীজানুর রহমানের ‘ত্রৈমাসিক পত্রিকা’র পক্ষী সংখ্যায় ১৯৮৮-৮৯ সালে প্রকাশিত ‘একটি ময়নার আত্মকাহিনী’ নামে তাঁর লেখা গল্প এবং মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পাকিস্তানে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ার অভিজ্ঞতার ছাপ পড়েছে এ নাটকে।

আবু ইসহাকের অপ্রকাশিত রচনার সংখ্যাও খুব বেশি নয়। পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর কিছু গল্প, একটি ইংরেজি অভিধানের পাণ্ডুলিপি, কিছু প্রবন্ধ এবং ‘সমকালীন বাংলা ভাষার অভিধান’-এর অপ্রকাশিত অংশ, এসব মিলিয়ে অপ্রকাশিত রচনাগুলো নিয়ে মাত্র দু-এক খণ্ডেই রচনাসমগ্র প্রকাশ করা সম্ভব।

আবু ইসহাকের অভিধানচর্চার একটা দীর্ঘ ইতিহাস আছে। বিশ শতকের ষাটের দশকের শুরুর দিকে (১৯৬২ সালে) চাকরিসূত্রে তিনি পাকিস্তানের করাচিতে ছিলেন। ওই সময়ে করাচিতে বাঙালিদের সাহিত্য সংগঠন প্রবাসী পাঠচক্রের একটি মাসিক সাহিত্যসভার আয়োজন ছিল আবু ইসহাকের বাসায়। ওই সভায় উপস্থিত হয়েছিলেন ভাষাবিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ (১৮৫৮-১৯৭৯)। তিনি তখন পাকিস্তান সরকারের উর্দু ডেভেলপমেন্ট বোর্ডের পরিকল্পনাধীন উর্দু ভাষার অভিধান প্রণয়নের জন্য উর্দু শব্দের ব্যুত্পত্তি নির্ণয়ে নিয়োজিত। তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানের বাংলা একাডেমির পরিকল্পনাধীন আঞ্চলিক ভাষার অভিধান নিয়ে তখন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর সঙ্গে আবু ইসহাকের আলোচনা হয়। ড. এনামুল হকের নেতৃত্বে বাংলা একাডেমি তখন ব্যবহারিক বাংলা অভিধানের কাজ করছে। ওই দিন আবু ইসহাক কথায় কথায় ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে বাংলা ভাষায় বিশেষণে বিশেষিত একটি অভিধানের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন। ওই আলোচনায় ড. শহীদুল্লাহ বলেন, ‘করতে পারলে তো ভালোই হয়। তবে আমার বয়সে তা সম্ভব নয়।…যদি কেউ করতে পারে তবে ভালো কাজ হবে বলে মনে করি। তবে অভিধানের নামে যেন ওয়ার্ডবুক না হয়।’

ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর এসব কথাই আবু ইসহাকের মনে নাড়া দিয়ে যায়। ওইদিনই তিনি বিশেষণে বিশেষিত বাংলা শব্দের একটি অভিধান প্রণয়নের ব্যাপারে মনে মনে সংকল্প করেন। ‘সমকালীন বাংলা ভাষার অভিধান’-এর ব্যঞ্জনবর্ণ অংশের ‘কৃতজ্ঞতা স্বীকার’ করতে গিয়ে আবু ইসহাক লিখেছেন, ‘১৯৬২ সাল থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত চাকরিজীবনের বিক্ষিপ্ত অবসরে এবং ১৯৮৬ সাল থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত অবসরজীবনে সার্বক্ষণিকভাবে শুধু বিশেষিত শব্দ ও বিশিষ্ট কবি-সাহিত্যিকদের রচনা থেকে প্রয়োগ উদাহরণ সংগ্রহ করেছিলাম। অভিধান সংকলনের কাজ শুরু করি ১৯৯১ সালে।’ ১৯৯৩ সালের জুনে বাংলা একাডেমি থেকে অভিধানটির প্রথম অংশ (স্বরবর্ণ) প্রকাশিত হয়। ১৯৯৮ সালে বাংলা একাডেমি ‘সমকালীন বাংলা ভাষার অভিধান’-এর ব্যঞ্জনবর্ণ অংশ (ক থেকে ঞ) প্রকাশ করে। বিশাল এই অভিধানের বাকি অংশ প্রকাশে উদ্যোগী ছিল বাংলা একাডেমি। আবু ইসহাকের আকস্মিক মৃত্যুতে অভিধানের কাজ মাঝপথে থেমে যায় এবং বাকি অংশগুলো প্রকাশে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। আবু ইসহাক তাঁর এই বিশাল কর্মযজ্ঞ সমাপ্ত করে যেতে পারেননি। পুরো অভিধানের পৃষ্ঠাসংখ্যা ২৫ হাজারের বেশি হতো বলে ধারণা করেছিলেন আবু ইসহাক। তাঁর আকস্মিক মৃত্যু আমাদের এ রকম একটি বিশাল প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত করেছে।

  1. কোন মন্তব্য নেই এখনও
  1. No trackbacks yet.

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান