প্রথম পাতা > ইতিহাস, ইসলাম, জীবনী, ধর্মীয় > হাদীস শাস্ত্রে ইমাম আবু হানীফার (রহ.) শ্রেষ্ঠত্ব

হাদীস শাস্ত্রে ইমাম আবু হানীফার (রহ.) শ্রেষ্ঠত্ব

abu-hanifa-mazarমুহাম্মাদুল্লাহ আরমান : ইমাম আবু হানীফা (রহ.)-এর ব্যক্তিত্ব, কৃতিত্ব এবং শ্রেষ্ঠত্ব তাঁর সমকালীন যুগ থেকে নিয়ে সর্বযুগে স্বীকৃত। মুসলিম উম্মাহর বড় বড় মনীষীগণ তাঁর অনন্য অসাধারণ এসব কৃতিত্ব ও অবদানের কথা এবং ইলমের ময়দানে তাঁর দান ও অনুদানের কথা অবলীলায় স্বীকার করে গেছেন। ইলম ও আখলাকে, জ্ঞানে ও গুণে এবং বোধ ও বুদ্ধিতে এমন বিরল প্রতিভার অধিকারী সব্যসাচী মানুষ মানব ইতিহাসে খুব কমই জন্মেছে। ইমাম আবু হানীফা (রহ.) ফিকহের ময়দানের শাহেনশাহ, হাদীসের ময়দানের শাহসাওয়ার এবং অন্ধকার রাতের একজন বিনিদ্র সাধক। মুুসলিম উম্মাহ এই কিংবদন্তির কাছে চিরঋণী হয়ে থাকবে।

যে মানুষটির মেধা ও প্রজ্ঞায় মুসলিম উম্মাহ আলোকিত হয়েছে, যার অসাধারণ চিন্তাশক্তিতে হাজারো জটিল সমস্যার সমাধানের পথ খুলেছে, যে মানুষটি তাঁর অনন্য দক্ষতায় পবিত্র কোরআন এবং হাদীস থেকে মাসআলা বের করার পন্থা শিখিয়েছেন, যিনি হাজার হাজার হাদীস থেকে বাছাই করে নির্ভরযোগ্য হাদীসের কিতাব লিখেছেন; সেই মানুষটির ব্যাপারে যখন বলা হয় তিনি হাদীস জানেন না এবং বুঝেন না তখন বিবেকের দংশন এবং আত্মার দহন নিজেকে কুরে কুরে খায়। আজ এত বছর পরে সমালোচকদের অভিযোগের কারণে যখন আমাদেরকে এই কথা লিখতে হয় যে, ইমাম আবু হানিফা (রহ.)ও হাদীস জানতেন তখন লজ্জায় নিজেকে ছোট মনে হয়। এটা কীসের সাথে কীসের তুলনা! যে মানুষটি হাদীস অন্বেষণ করার জন্য দেশ থেকে দেশান্তরে সফর করেছেন, যিনি যুগ যুগ ধরে বিনিদ্র রজনী কাটিয়ে হাদীস থেকে মাসআলা ইস্তিম্বাত করেছেন; তার ব্যাপারে হাদীস না জানার অভিযোগ তোলা চরম আপত্তিকর এবং হাস্যকর। এটা একেবারেই নিচু মানসিকতার পরিচায়ক। হিংসা, বিদ্বেষ এবং পক্ষপাতদুষ্ট উদ্দেশ্য প্রণোদিত হীন মানসিকতা ছাড়া কোনোভাবেই এ ধরনের অসত্য ও অবাস্তব অভিযোগ তোলা সম্ভব নয়। আর এটাই সত্য, যারা অভিযোগ তোলেন এই কারণেই তোলেন। যদিও তাদের এই অভিযোগ অবাস্তব বিষয় নিয়ে অরণ্যে রোদন ছাড়া কিছুই নয় এবং তাদের এই অভিযোগের কারণে হানাফী মাযহাব এবং ইমাম আবু হানীফা (রহ.)-এর মতো মহীরুহের কিছুই আসে যায় না, তারপরও যেন হানাফী মাযহাব অনুসারীরা ভ্রান্তির শিকার না হন এবং হীনমন্যতায় না ভোগেন সে জন্য এখানে ইমাম আবু হানীফা (রহ.)-এর হাদীসি অবস্থান তুলে ধরার প্রয়াস চালানো হয়েছে। মহান আল্লাহই তাওফীক দাতা।

হাদীস অন্বেষণে ইমাম আবু হানীফা (রহ.)

ইমাম আবু হানীফা (রহ.) ওইসব মুহাদ্দিসীনে কেরামের একজন যারা হাদীস অন্বেষণ করার জন্য দূরদূরান্তে সফর করেছেন। ইমাম আবু হানীফা (রহ.)-এর বয়স যখন ২০ বছর তখন থেকে তিনি ব্যাপকহারে হাদীস খুঁজতে শুরু করেন। আবু হানীফা (রহ.) জন্মগ্রহণ করেন ৮০ হিজরীতে। তখন পযন্ত সুবিন্যস্তভাবে হাদীসের কোনো কিতাব লেখা হয়নি। সবাই হাদীস সংগ্রহের জন্য দেশদেশান্তর সফর করতেন। সাহাবায়ে কেরাম এবং তাঁদের ছাত্রদের কাছ থেকে হাদীস সংগ্রহে ব্যস্ত থাকতেন। তারই ধারাবাহিকতায় ইমাম আবু হানীফা (রহ.) হাদীস সংগ্রহে বের হয়ে পড়েন। আবু হানীফা (রহ.)-এর হাদীস সংগ্রহের এই বিষয়টিকে বড় বড় মুহাদ্দিস এবং হাদীস বর্ণণাকারীদের জীবনী নিয়ে গ্রন্থপ্রণেতাগণও স্বীকৃতি দিয়েছেন। তাদেরই একজন আল্লামা হাফেয শামসুদ্দীন যাহাবী (রহ.) (৭৪৮হি.) ‘সিয়ারু আলামিন নুবালা’তে লিখেন, ‘ইরাকের আলেম ফকীহুল মিল্লাত ইমাম আবু হানীফা (রহ.)..। যিনি হাদীস ও আছার সংগ্রহের প্রতি মনোনিবেশ করেছেন এবং এর জন্য সফর করেছেন। আর ফিকহের সূক্ষ্মতা এবং চিন্তাশক্তির তীক্ষ্মতার ক্ষেত্রে আবু হানীফাই হলেন প্রথম সংকলক ও প্রবর্তক। ফিকহের জগতে মানুষ ইমাম আবু হানীফা (রহ.)-এরই পরিবারভুক্ত।’ (সিয়ারু আলামিন নুবালা, শামসুদ্দীন আযযাহাবী খ: ৫ পৃ: ২২২, মাকতবাতুস সফা, কায়রো, মিশর, প্রথম সংস্করণ ১৪২৪ হি.) অন্যত্র হাফেয যাহাবী (রহ.) বলেন, ‘ইমাম আবু হানীফা (রহ.) হাদীস অন্বেষণ করেছেন। একশ’ হিজরী ও তার পরবর্তী সময়ে তিনি হাদীস সংগ্রহের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছেন।’ (সিয়ারু আলামিন নুবালা, : ০৫ পৃ: ২২৫)

ইমাম আবু হানীফা (রহ.) হাদীস সংগ্রহের জন্য ইরাক থেকে সুদূর মক্কায় সফর করে আতা বিন আবী রাবাহ (রহ.) (১১৪হি.)-এর কাছ থেকে হাদীস শুনেছেন। সে ব্যাপারে যাহাবী (রহ.) ‘মানাকেবে আবী হানীফা’ নামক গ্রন্থে লিখেন, ‘ইমাম আবু হানীফা (রহ.) মক্কায় আতা বিন আবু রাবাহর কাছে হাদীস শুনেছেন। আবু হানীফা (রহ.) বলেন, হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে আমি আতা থেকে উত্তম কাউকে দেখিনি।’ (মানাকেবুল ইমাম আবী হানীফা ওয়া সাহেবাইহি, আযযাহাবী পৃ:১১, মিশর থেকে প্রকাশিত; মাকানাতুল ইমাম আবী হানীফা ফিল হাদীস, মাওলানা আবদুর রশীদ নোমানী (রহ.), পৃ: ১৭, দারুল বাশাইরিল ইসলামিয়া, বৈরুত, লেবানন; তারীখে বাগদাদ, খতীব আলবাগদাদী খ: ১৩ পৃ:৩৩৯)

ইমাম আবু হানীফা (রহ.) হাদীস অন্বেষণের ক্ষেত্রে অন্যদের চেয়ে কতটা অগ্রগামী ও আগ্রহী ছিলেন তার প্রমাণ মেলে তারই সমকালীন সহপাঠী ইমাম মিসআর বিন কেদাম (রহ.) (১৫৫হি.)-এর কথা থেকে। তিনি বলেন, ‘আমি আবু হানীফা (রহ.)-এর সাথে হাদীস অন্বেষণ করেছি, তিনি আমার থেকে আগে বেড়ে গেছেন। তাঁর সাথে যুহদে (আল্লাহর ইবাদত) লিপ্ত হয়েছি, সেখানেও তিনি অগ্রগামী হয়ে গেছেন। অতঃপর তাঁর সাথে ইলমে ফিকহ অন্বেষণ করেছি, এক্ষেত্রে তিনি আমার চেয়ে কত উঁচুতে উন্নীত হয়েছেন তা আপনারাই প্রত্যক্ষ করছেন।’ (মাকানাতুল ইমাম আবী হানীফা ফিল হাদীস, পৃ: ২০; মানাকেবে আবী হানীফা, পৃ: ২৭)

এখানে একটা বিষয় লক্ষণীয়, মিসআর বিন কেদাম (রহ.) (১৫৫হি.) এমন একজন হাদীস বিশারদ যার ব্যাপারে হাফেয আবু মুহাম্মাদ রামাহুরমুযী (রহ.) বলেন, কোনো হাদীস নিয়ে যখন ইমাম শো’বা (১৬০হি.) ও সুফয়ান সাওরী (রহ.)(১৬১হি.)-এর মাঝে মতানৈক্য হতো তখন তারা সে হাদীসের ব্যাপারে মিসআর বিন কেদামের সিদ্ধান্তানুযায়ী সমাধানে উপনীত হতেন। ইমাম শো’বা ও সুফয়ান সাওরী (রহ.)-কে বলা হয় ‘আমীরুল মু’মিনীন ফিল হাদীস’। তাদের মতো হাদীস বিশেষজ্ঞ যে মিসআর বিন কেদামকে সমাধানের মাধ্যম ও পাল্লা বানান, সেই মিসআর বিন কেদাম ইমাম আবু হানীফা (রহ.)-এর ব্যাপারে মন্তব্য করেছেন যে, তিনি আমার থেকে হাদীস সংগ্রহে আগে বেড়ে গেছেন!! তাহলে হাদীসের জগতে ইমাম আবু হানীফা (রহ.)-এর মর্যাদা কত ওপরে সেটা সহজেই অনুমান করা যায়। (আল মুহাদ্দিসুল ফাসিল বাইনার রাবী ওয়াল ওয়াঈ, মাখতুত, হায়দারাবাদ দাক্কান; সূত্রইমাম ইবনে মাজাহ আওর ইলমে হাদীস, মাওলানা আবদুর রশীদ নোমানী, পৃ: ১৬৬, মীর মুহাম্মাদ কুতুবখানা করাচী)

সংগৃহীত হাদীসের সংখ্যা এবং ‘কিতাবুল আছার’

ইমাম আবু হানীফা (রহ.) দেশদেশান্তরে সফর করে যে পরিমাণ হাদীস সংগ্রহ করেছেন তার সংখ্যাই হলো ৪০ হাজার। এই ৪০ হাজার থেকে সহীহ ও আমলযোগ্য আহকামের হাদীসগুলো বাছাই করে তিনি একটি হাদীসের কিতাব লিখেন, যার নাম কিতাবুল আছার। এ বিষয়ে সদরুল আইম্মা মুয়াফফাক বিন আহমদ (রহ.) ‘মানাকিবুল ইমামিল আযম’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘ইমাম আবু হানীফা (রহ.) ৪০ হাজার হাদীস থেকে বাছাই করে কিতাবুল আছার লিখেছেন।’ (ইমাম ইবনে মাজাহ আওর ইলমে হাদীস, পৃ: ১৬৪)

এ ব্যাপারে অন্যত্র আবু ইয়াহইয়া যাকারিয়া বিন ইয়াহইয়া নিশাপুরী (রহ.) (২৯৮হি.) সনদসহ ইমাম আবু হানীফা (রহ.)-এর একটি মন্তব্য উল্লেখ করেন। আবু হানীফা (রহ.) বলেন, ‘আমার কাছে হাদীসের বিশাল এক ভান্ডার আছে, আমি সেখান থেকে শুধু এমন হাদীসগুলোই বের করেছি যার দ্বারা মানুষের উপকার হবে। (অর্থাৎআমি সহীহ ও আমলযোগ্য হাদীসই বর্ণনা করেছি)। প্রাগুক্ত।

এখানে প্রাসঙ্গিক একটি কথা উল্লেখ না করলেই নয়, তা হলো ইমাম আবু হানীফা (রহ.) যে ৪০ হাজার হাদীস সংগ্রহ করেছেন সেখানে সাহাবায়ে কেরাম এবং তাবেঈনদের বাণী এবং ফতোয়াও আছে। মুহাদ্দিসীনের পরিভাষায় এগুলোও হাদীস হিসেবে গণ্য। আবু হানীফা (রহ.)-এর যুগে হাদীসের সনদ বা বর্ণনাসূত্র ৪০ হাজারের বেশি ছিল না। এই ৪০ হাজার হাদীসই পরবর্তীতে ইমাম বুখারী ও মুসলিমের যুগে এসে বর্ণনাসূত্রের আধিক্যের কারণে লক্ষ লক্ষ হাদীসে রূপান্তরিত হয়েছে। কারণ মুহাদ্দিসীনে কেরাম সনদের ভিন্নতাকেও আলাদা হাদীস হিসেবে গণনা করেন। এ কারণেই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামএর একটি হাদীসই সনদের ভিন্নতার কারণে ১০১৫টি হাদীস হয়ে গেছে। সে হিসেবে ইমাম আবু হানীফা (রহ.) কিতাবুল আছারে যে হাদীসগুলো উল্লেখ করেছেন, সেগুলো যদি পরবর্তীতে লিখিত হাদীসের কিতাবসমূহ থেকে তাখরীজ করা হয় তাহলে সেটা ১০১৫ গুণ হয়ে যাবে। তাই আবু হানীফা (রহ.) হাদীস কম জানতেন এ জাতীয় আপত্তি তোলার কোনো সুযোগই নেই। (টিকা, ইমাম ইবনে মাজাহ আওর ইলমে হাদীস, পৃ: ১৬৪)

কিতাবুল আছারের মান

ইমাম আবু হানীফা (রহ.) ১২৫ হিজরীর পরে কিতাবুল আছার লিপিবদ্ধ করেন। এখানে তিনি আহকামের হাদীস থেকে সহীহ ও আমলযোগ্য হাদীস একত্রিত করেছেন। ইমাম আবু হানীফা (রহ.)-ই প্রথম ব্যক্তি যিনি শাস্ত্রীয় আন্দাযে সুবিন্যস্তভাবে সর্বপ্রথম হাদীসের কিতাব লিখেছেন। ফিকহী অধ্যায় ও পরিচ্ছেদ আকারে ইমাম আবু হানীফা (রহ.)-এর পূর্বে কেউ কিতাব লিখেননি। যারা টুকটাক লিখেছেন তারা শুধু হাদীস একত্রিত করেছেন, সেটাকে সুবিন্যস্ত রূপ দেননি। আল্লামা জালালুদ্দীন সুয়ূতী (রহ.) বলেন, ‘ইমাম আবু হানীফা (রহ.)-এর স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের একটি হলো, তিনিই সর্বপ্রথম ব্যক্তি যিনি ইলমে শরীয়তকে অধ্যায় আকারে সর্বপ্রথম সংকলন করেছেন। পরবর্তীতে তাঁর অনুসরণ করে ইমাম মালেক (রহ.) (১৭৯হি.) মুআত্তা মালেক লিখেছেন। ইমাম আবু হানীফা (রহ.)-এর আগে এই তরতীবে অন্য কেউ কাজ করেননি।’ (তাবঈযুয সাহীফাহ, সুয়ূতী, পৃ: ৩৬, ইবনে মাজাহ আওর ইলমে হাদীস: ১৬১)

সহীহ বুখারীর আগে সর্বপ্রথম সহীহ হাদীসের কিতাব বলা হয় মুআত্তায়ে মালেককে। হাফেয মুগলতাই এবং আল্লামা সুয়ূতী (রহ.) এই স্বীকৃতি দিয়েছেন। আর এটাও সত্য, ইমাম আবু হানীফা (রহ.)-এর কিতাবুল আছার লেখা হয় মুআত্তায়ে মালেকের পূর্বে। এখন জানার বিষয় হলো কিতাবুল আছারের হাদীসগুলোর মান কোন্ পর্যায়ের! সে ব্যাপারে আল্লামা আবদুর রশীদ নোমানী (রহ.) (১৪২০হি.) বলেন, ‘আমি কিতাবুল আছারের প্রত্যেকটি রাবী এবং প্রত্যেকটি হাদীস তাহকীক ও যাছাইবাছাই করেছি। তাহকীকের পর আমি যে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি তা হলো, কিতাবুল আছারের হাদীসগুলো শুদ্ধতা ও শক্তিশালী হওয়ার দিক থেকে কোনো অংশেই মুআত্তায়ে মালেকের রেওয়ায়াত থেকে কম না। মুআত্তার মুরসাল রেওয়ায়াতের স্বপক্ষে যেমন শক্তিশালী বর্ণনা আছ, ঠিক তেমনি কিতাবুল আছারের মুরসাল হাদীসের স্বপক্ষেও আছে। সুতরাং যে কারণে হাফেয মুগলতাই এবং সুয়ূতী (রহ.)-এর নিকট মুআত্তা সহীহ কিতাব হিসেবে পরিগণিত, ঠিক একই কারণে কিতাবুল আছারও সহীহ পরিগণিত হবে। মুআত্তা ও কিতাবুল আসারের মাঝে ব্যবধান ওটুকুই যেটুকু সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমের মাঝে। (সুতরাং একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, সর্বপ্রথম হাদীসের সহীহ কিতাব হলো ইমাম আবু হানীফা (রহ.)-এর কিতাবুল আছার।) ইবনে মাজাহ আওর ইলমে হাদীস, পৃ: ১৬২১৬৩; আলইমামু ইবনু মাজাহ ওয়া কিতাবুহুস সুনান, মাওলানা আবদুর রশীদ নোমানী (রহ.) পৃ: ৫৮, মাকতাবুল মাতবুআতিল ইসলামিয়া, হলব)

হাদীস বর্ণনায় ইমাম আযমের সতর্কতা

ইমাম আবু হানীফা (রহ.) হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করতেন। যেকোনো হাদীস যেভাবে সেভাবে বর্ণনা করতেন না। হাফেয আবু মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ হারেসী (রহ.) ইমাম ওয়াকী ইবনুল জাররাহ (১৯৭হি.) থেকে মুত্তাসিল সনদে বর্ণনা করেন, ‘হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে ইমাম আবু হানীফা (রহ.) যে পরিমাণ সতর্কতা অবলম্বন করতেন তা আর কারও মধ্যে পাওয়া যায়নি। (মানাকেবে ইমাম আযম, সদরুল আইম্মা ১/১৯৭; ইমাম ইবনে মাজাহ আওর ইলমে হাদীস: ১৬৭)

হাফেযে হাদীস ইয়াহইয়া বিন মাঈন (রহ.) (২৩৩হি.) বলেন, ‘ইমাম আবু হানীফা একজন ছেকা (নির্ভরযোগ্য) বর্ণনাকারী ছিলেন। যে হাদীস তাঁর মুখস্ত থাকতো কেবল সে হাদীসই তিনি বর্ণনা করতেন। আর যেটি মুখস্ত ছিল না সেটি বর্ণনা করতেন না।’ (সিয়ারু আলামিন নুবালা. : ৫ পৃ: ২২৪; তারীখে বাগদাদ, :১৩ পৃ:৪১৯; আলইমামু ইবনে মাজাহ ওয়া কিতাবুহুস সুনান, পৃ: ৫৮)

উল্লেখ্য, ইমাম ইয়াহইয়া বিন মাঈন এমন একজন হাফেযে হাদীস যার ব্যাপারে ইমাম আহমদ বিন হাম্বল (রহ.) (২৪০হি.) বলতেন, ‘ইয়াহইয়া বিন মাঈন যে হাদীস জানেন না, সে হাদীস হাদীসই নয়।’ তাহলে ইয়াহইয়া বিন মাঈনের মতো ব্যক্তিত্ব যখন ইমাম আবু হানীফা (রহ.)-কে ছেকা বলে এমন ভূয়সী প্রশংসা করেন তখন ইমাম আবু হানীফা (রহ.)-এর মর্যাদা হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে কত ওপরে সেটা সহজেই অনুমেয়।

ইমাম আবু হানীফা (রহ.) হাফেযে হাদীস ছিলেন

একজন রাবী বা বর্ণনাকারী হিসেবে ইমাম আবু হানীফা (রহ.)-এর অবস্থান কোন্ পর্যায়ে ছিল, সে বিষয়ে আসমাউররিজালের কিতাবে সবিস্তার আলোচনা আছে। হাফেযে হাদীস আল্লামা শামসুদ্দীন যাহাবী (রহ.) ইমাম আবু হানীফা (রহ.)-কে হাফেযে হাদীসদের মধ্যেই অন্তর্ভুক্ত করেছেন। যাহাবী (রহ.) হাফেযে হাদীসদের জীবনী নিয়ে ‘তাযকিরাতুল হুফফায’ নামে একটি কিতাব লিখেছেন। সেই কিতাবে তিনি ‘আলইমামুল আযম আবু হানীফা’ শিরোনাম দিয়ে আমাদের ইমামের জীবন বৃত্তান্ত আলোচনা করেছেন। (তাযকেরাতুল হুফফায, :০১ পৃ:১৬৮)

পাশাপাশি ইমাম আবু হানীফা (রহ.) আইম্মায়ে জারহ ওয়া তাদীলের একজন ছিলেন। অর্থাৎ তিনি এমন একজন হাদীস বিশারদ ছিলেন যিনি অন্য হাদীস বর্ণনাকারীর ব্যাপারে বলতে পারতেন যে, তিনি রাবী হিসেবে সহীহ নাকি যঈফ, তার বর্ণনা গ্রহণ করা যাবে কি যাবে না ইত্যাদি। আর আবু হানীফা (রহ.) এ কাজটি করেছেনও। আল্লামা যাহাবী (রহ.) বর্ণনা করেন, ‘হিজরী দেড়শ’ শতাব্দীর দিকে যখন তাবেঈগণ দুনিয়া থেকে বিদায় নিচ্ছিলেন তখন কিছু বিচক্ষণ উলামায়ে কেরাম হাদীস বর্ণনাকারীদের নির্ভরযোগ্যতা ও দুর্বলতা নিয়ে কথা বলেন। যেমন আবু হানীফা (রহ.) বলেন, আমি জাবের জু’ফী থেকে মিথ্যাবাদী আর কাউকে দেখিনি। (মাকানাতুল ইমাম আবী হানীফা ফিল হাদীস, পৃ: ৭০; আলইমামু ইবনু মাজাহ ওয় কিতাবুহুস সুনান, পৃ: ৬২)

সুতরাং ইমাম আবু হানীফা (রহ.) যে একজন হাফেযে হাদীস ছিলেন এবং জারহ ও তাদীলের ইমাম ছিলেন সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই্। আইম্মায়ে হাদীস এবং আইম্মায়ে জারহ ও তাদীলের মধ্যে যারা ইমাম আবু হানীফা (রহ.)-এর ছেকা বা নির্ভরযোগ্য হওয়ার পক্ষে সাক্ষী দিয়েছেন, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন ইমাম ইয়াহইয়া বিন মাঈন (২৩৩হি.), কাসেম বিন মাআন (১৭৫হি.), মালেক বিন আনাস (১৭৯হি.), ইবনে জুরাইজ (১৫০হি.), ইয়াযিদ বিন হারুন (২০৬হি.), আবদুল্লাহ বিন মুবারক (১৮১হি.), সুফয়ান সাওরী (১৬১হি.), শাদ্দাদ বিন হাকীম, ইয়হইয়া বিন সাঈদ আল কাত্তান (১৯৮হি.), শামসুদ্দীন যাহাবী (৭৪৮হি.), হাফেয মিযযি (৭৪২হি.), ইবনে হাজার আসকালানী (৮৫২হি.) প্রমুখ (রাহিমাহুমুল্লাহ)। এ সকল হাফেযে হাদীস এবং মহামনীষীদের পক্ষ থেকে ইমাম আবু হানীফা (রহ.)-কে নির্ভরতা ও তাওছীকের সাক্ষ্য দেয়াই তাঁর জন্য যথেষ্ট।

সূত্রঃ দৈনিক ইনকিলাব, ৯ অক্টোবর ২০১৬

  1. কোন মন্তব্য নেই এখনও
  1. No trackbacks yet.

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান