সাদা (হোয়াইট) হাউসে ঘটা কালো কাণ্ড !
কা দা ছোড়াছুড়ির নির্বাচনে তা হলে হিলারি ক্লিন্টন ওভারট্রাম্প হয়েই গেলেন। ব্যবসা কিংবা নারীঘটিত জবরদস্ত সব কেচ্ছাকে কাঁচকলা দেখিয়ে ড্যাং ড্যাং করে হোয়াইট হাউসের দিকে হাঁটা লাগাচ্ছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। আসলে মার্কিন প্রেসিডেন্টদের ইতিহাস অনেক সময়েই গন্ডগোলের আর কেলেংকারির ইতিহাস। তাঁদের পথ যতই ফুলে–ফেঁপে ফুলে ঢেকে থাকুক না কেন, দু–চারটে তীক্ষ্ণ কাঁটা সেখানে উঁকি মারবেই। আমেরিকার অতীত জুড়ে ‘আনপ্রিসিডেন্টেড’ সে–সব কাঁটা প্রেসিডেন্টদের রথের চাকা বার বার ছ্যাঁদা করে দিয়েছে। এ কাঁটার নাম ‘স্ক্যান্ডাল’। কখনও তা আর্থিক, কখনও কূটনৈতিক বা যুদ্ধনীতি সংক্রান্ত, কখনও আবার মাখো–মাখো যৌন কেচ্ছা। জন এফ কেনেডি আর অভিনেত্রী মেরিলিন মনরো–র সম্পর্ক তো প্রবাদ হয়ে গিয়েছে। মেরিলিন ‘হ্যাপি বার্থডে মিস্টার প্রেসিডেন্ট’ গেয়েছিলেন যে পোশাক পরে, তা পর্যন্ত প্রবাদ। এত আঁটো পোশাক উনি আদৌ কী করে পরেছিলেন, তা নিয়েও গবেষণা কম নেই। তেমনই মনিকা লিউইনস্কি–র সঙ্গে বিল ক্লিন্টনের কীর্তি আজও চর্চিত। কিংবা রিচার্ড নিক্সনের সেই গোপন টেপ কাণ্ড— ‘ওয়াটারগেট’। যা জন্ম দিয়েছিল যাবতীয় কেচ্ছা–কেলেংকারির সমার্থক এক নতুন অনুসর্গের— ‘–গেট’।
প্রথম প্রেসিডেন্ট, স্বাধীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম স্থপতি জর্জ ওয়াশিংটন বিদ্ধ হয়েছিলেন শিক্ষাদীক্ষার প্রশ্নে। হয়তো এর নেপথ্যে তাঁর ঈর্ষাপরায়ণ সঙ্গীদেরই অপপ্রচার ছিল, তবু অনেকেই সে সময় বিশ্বাস করতেন, স্বয়ং প্রেসিডেন্ট কার্যত অশিক্ষিত। এমনকী কেনাকাটা করলে খুচরোটুকুও নাকি হিসেব করে মেলাতে পারেন না! অথচ অন্য দিকে জ্ঞান ছিল টনটনে! বয়স তখন বিশের কোঠায়। প্রেম শুরু হয় বন্ধুর স্ত্রী স্যালি ফেয়ারফ্যাক্স–এর সঙ্গে। স্যালি ছিলেন শিক্ষিতা, ঝকঝকে বুদ্ধিমতী। তাঁর সাহচর্যে থেকেই নাকি সমাজের উচ্চকোঠায় পা রাখতে চেয়েছিলেন ওয়াশিংটন। কিন্তু অচিরেই সংস্পর্শে আসেন চূড়ান্ত বিত্তশালী এক বিধবা, মার্থা ড্যান্ডরিজ–এর। বিপুল সম্পত্তি আর সামাজিক প্রতিষ্ঠা লাভের সিঁড়ি তখন হাতের মুঠোয়! স্যালি–কে ভুলে মার্থার সঙ্গেই বিবাহ বন্ধনে বাঁধা পড়েন ওয়াশিংটন। পরবর্তীতেও আপাত নিষ্কলুষ মানুষটির অন্তরের এই লোভ নানা মহলে নিন্দিত হয়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৃতীয় প্রেসিডেন্ট টমাস জেফারসন পরিচিত ছিলেন দয়ালু ও অনেকটাই দাসপ্রথা বিরোধী হিসেবে। অথচ মুখে নীতির কথা বললেও তাঁর ব্যক্তিগত দাসদাসীর সংখ্যা নেহাত কম ছিল না। তাঁকে নিয়ে সবচেয়ে বেশি ছিছিক্কার পড়ে গেল, যখন জানা গেল, তাঁদের মধ্যেই এক দাসী, স্যালি হেমিংস–কে তিনি রক্ষিতা করে রেখেছেন এবং স্যালির গর্ভে ছ–ছ’টি সন্তানের জন্ম দিয়েছেন। আরও মারাত্মক হল, ওই সন্তানদেরও তিনি দাস বানিয়েই রেখেছিলেন! দীর্ঘ দিন ধরে এ সব অভিযোগকে নিছক রটনা বলে উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হলেও তা সম্ভব হয়নি। আধুনিক গবেষণা, ১৯৯৮ সালে হেমিংসের বংশধরদের ডিএনএ টেস্ট প্রমাণ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের এই ‘ফাউন্ডিং ফাদার’ তাঁদেরও প্রকৃত ফাদার!
সপ্তম মার্কিন প্রেসিডেন্ট ও আজকের ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রতিষ্ঠাতা অ্যান্ড্রু জ্যাকসনের জীবনে কেচ্ছার অভিঘাত ছিল অত্যন্ত বেদনাদায়ক। তাঁর স্ত্রী র্যাচেল ছিলেন ডিভোর্সি। ১৮২৮ সালে নির্বাচনী প্রচারে বিরোধীরা কাদা ছুড়লেন— প্রথম পক্ষের থেকে আইনি বিচ্ছেদের আগেই র্যাচেলকে বিয়ে করেন অ্যান্ড্রু। সে অভিযোগ যে সর্বৈব মিথ্যে ছিল, এমনটা নয়। কিন্তু সে সব ত্রিশ–পঁয়ত্রিশ বছরের পুরনো কাসুন্দি! কাজেই বিরোধীদের এই অভিযোগে অ্যান্ড্রুর প্রেসিডেন্ট হওয়া আটকালো না। কিন্তু র্যাচেল এই আঘাত সহ্য করতে পারলেন না। নির্বাচনের ঠিক পরেই হার্ট–অ্যাটাকে মৃত্যু হয় তাঁর।
অ্যান্ড্রু জ্যাকসনের পরই প্রেসিডেন্টের গদিতে বসেন মার্টিন ভ্যান বুরেন। তাঁর গায়ে ‘এলিটিস্ট’ তকমা লাগিয়ে দেওয়া হয় এবং বিরোধীদের কুৎসার কেন্দ্রে উঠে আসে তাঁর টয়লেট! জনতার টাকায় হোয়াইট হাউসে গরম জলের ট্যাংক বসিয়ে চরম নিন্দিত হন বুরেন। এ–ও বলা হতে থাকে, প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি একেবারেই অযোগ্য, কারণ তাঁর আচরণ আগাগোড়া ‘মেয়েলি’, ‘লেস্ড আপ ইন করসেটস…’! গালভরা অমন জুলপি না থাকলে নাকি তাঁকে দেখে বোঝাই যেত না তিনি পুরুষ না মহিলা! আবার জেমস বুকানন কিংবা আব্রাহাম লিংকনের ক্ষেত্রে কেচ্ছাটা গড়িয়েছিল সমকামিতা পর্যন্ত। একাধিক পুরুষের সঙ্গে নাকি লিংকনের সম্পর্ক ছিল। এমনকী নিজের দেহরক্ষীর সঙ্গেও তাঁর সম্পর্ক নিয়ে অনেক রটনা আছে। একটি কবিতাংশের উল্লেখ করা যাক— ‘ফর রুবেন অ্যান্ড চার্লস হ্যাভ ম্যারেড টু গার্লস,/ বাট বিলি হ্যাজ ম্যারেড আ বয়’! উল্লেখ্য, কবির নাম— আব্রাহাম লিংকন!
কবিতা শুধু নয়, মার্কিন প্রেসিডেন্টদের কেচ্ছায় ছড়াও ছিল। ১৮৮৪ সালে নির্বাচনের প্রচারকালে একটি ছড়ার প্রথম লাইনটি বিখ্যাত হয়ে ওঠে—‘মা, মা, হোয়্যার ইজ মাই পা?’ লক্ষ্য এখানে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী গ্রোভার ক্লিভল্যান্ড। ক্লিভল্যান্ডই হলেন অদ্যাবধি মার্কিন মুলুকে একমাত্র উদাহরণ, যিনি গদিচ্যুত হয়ে ফের প্রেসিডেন্টের গদিতে ফিরে এসেছেন। এটি ছিল তাঁর প্রথমবারের ঘটনা। এর কিছু আগেই এক তরুণী, মারিয়া হ্যালপিন–এর সঙ্গে অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন ক্লিভল্যান্ড। তাঁর গর্ভে এক সন্তানেরও জন্ম দেন। মার্কিন মুলুকে তখন এ সব তেমন কোনও ব্যাপার ছিল না। কিন্তু ক্লিভল্যান্ড হ্যালপিনকে পাগলা–গারদে ও তাঁর সন্তানকে অনাথ–আশ্রমে চালান করে দেন। স্বভাবতই কেচ্ছাটি অন্য মাত্রা পায়। কিন্তু ক্লিভল্যান্ড বাজিমাত করেন অদ্ভুত এক স্ট্র্যাটেজিতে— তিনি সব অভিযোগ আগাগোড়া স্বীকার করে নেন! প্রেসিডেন্টের গদিতে বসার পর তাঁর সমর্থকরা বিরোধীদের উদ্দেশে ছড়ার শেষ লাইনটি আওড়াতেন— ‘হি’জ গন টু দ্য হোয়াইট হাউস, হা, হা, হা!’
একইভাবে পরকীয়ায় জড়িয়ে কেচ্ছার শিকার হয়েছেন ফ্র্যাংকলিন ডি রুজভেল্ট কিংবা জিমি কার্টার। আবার মানসিক রোগীদের নিয়ে রোনাল্ড রেগান–এর নীতির বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, কিংবা বারাক ওবামার বিরুদ্ধে অন্যের বক্তৃতা টুকে একের পর এক বক্তৃতা করার অভিযোগও উঠেছে। এমনকী হলিউডের সিনেমা, কমিক স্ট্রিপ, মায় পর্নোগ্রাফিতেও মার্কিন প্রেসিডেন্টরা যেভাবে উঠে এসেছেন, তা চমকে দেয়। ‘ট্রান্সমেট্রোপলিটান’ কমিক্সে দেখি কাল্পনিক মার্কিন প্রেসিডেন্ট গ্যারি ক্যালাহান ভয়াবহ খুনি! ‘দ্য সিম্পসন্স’–এ প্রেসিডেন্ট ক্যাং নরখাদক! একটি নীল ছবি তো নির্মিত হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিশতবার্ষিকী উপলক্ষে, ঠিক চল্লিশ বছর আগে, গত সেভেন্টি সিক্সে— ‘স্পিরিট অব সেভেন্টি সেক্স’। তাতে অন্যতম চরিত্রের নাম ছিল ‘জর্জ’। জর্জ ওয়াশিংটন?
সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৩ নভেম্বর ২০১৬