কার হাসি কে হাসে : ডোনাল্ড ট্রাম্পেরিকা!
যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প
এত জল্পনা–কল্পনা, এত জরিপ, এত হিসাব–নিকাশ সব কিছু পাল্টে দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হলেন রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প। ইতিহাস গড়লেন ডোনাল্ড জে ট্রাম্প। বিভিন্ন জরিপের ফল ও বিশ্লেষকদের আভাস পাল্টে দিয়ে হোয়াইট হাউসের উত্তরাধিকারী নির্বাচিত হলেন রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প। ৪৫তম মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে আগামী চার বছরের জন্য ট্রাম্পকেই বেছে নিল বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ।
নারী কেলেঙ্কারি, বিতর্কিত কর্মকাণ্ড–মন্তব্য, বদমেজাজী, ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক জ্ঞানের অভাবসহ কোনো অভিযোগই তাকে আটকে রাখতে পারল না। ‘প্রমিথিউস আনবাউন্ড’ এর মতো ট্রাম্প ‘আনবাউন্ড’ হয়ে ছিনিয়ে নিলেন বিজয়। মঙ্গলবার যুক্তরাষ্ট্রের ৫৮তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে যা হলো তাকে এককথায় বলা যেতে পারে ‘ট্রাম্প–কোয়েক’ বা ‘ট্রাম্পকম্প’। সত্যিই তো ‘কাঁপিয়ে দিলেন’ ট্রাম্প। নির্বাচনের আগের দিনও কেউ কল্পনা করেননি ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হচ্ছেন। অথচ হলেন তাই।
নির্বাচনপূর্ব বিভিন্ন জরিপে প্রেসিডেন্ট হওয়ার দৌড়ে ট্রাম্পের চেয়ে ৩ থেকে ৪ শতাংশ এগিয়ে ছিলেন হিলারি। জরিপ অনুযায়ী, ফ্লোরিডা, টেক্সাস, নর্থ ক্যারোলিনায় জয় পাবার কথা ছিল হিলারি ক্লিনটনের। অথচ তাকে হটিয়ে সেখানে স্পষ্ট ব্যবধানে জয় পেলেন ট্রাম্প। জর্জিয়া, ওহাইও, মিশিগান, নিউ হ্যাম্পশায়ার, অ্যারিজোনা, উইসকনসিল এমনকি পেনসিলভানিয়ায়ও পাত্তা পেলেন না হিলারি।
শুধুই কি এ কয়টি রাজ্যে। পুরো যুক্তরাষ্ট্রের কোথায় নয়! ৫০টি রাজ্য ও রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসির মধ্যে ৩০টিতে জয় পেয়েছেন ট্রাম্প। আর মাত্র ২১টিতে জয় পেয়েছেন হিলারি। ক্যালিফোর্নিয়া, নিউ ইয়র্ক ও ইলিনয় বাদে বলার মতো তেমন কোনো রাজ্যই জয় করতে পারেননি হিলারি।
নির্বাচনে ট্রাম্প জয় পেয়েছেন– উটাহ (ইলেক্টোরাল ভোট–৬), ইডাহো (৪), মন্টনা (৩), ওয়াইওমিং (৩), টেক্সাস (৩৮), ওকলাহোমা (৭), কানসাস (৬), নেব্রাস্কা (৫), সাউথ ডাকোটা (৩), নর্থ ডাকোটা (৩), লুইজিয়ানা (৮), আরকানসাস (৬), মিসৌরি (১০), লোয়া (৬), মিসিসিপি (৬), আলাবামা (৯), ফ্লোরিডা (২৯), জর্জিয়া (১৬), সাউথ ক্যারোলিনা (৯), নর্থ ক্যারোলিনা (১৫), টেনেসি (১১), কেনটাকি (৮), ইন্ডিয়ানা (১১), ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া (৫), ওহাইও (১৮), পেনসিলভানিয়া (২০), মিশিগান (১৬), উইসকনসিল (১০), অ্যারিজোনা (১১) ও আলাস্কা (৩) রাজ্যে।
অপরদিকে, হিলারি জয় পেয়েছেন ক্যালিফোর্নিয়া (৫৫), নেভাডা (৬), অরেগান (৭), ওয়াশিংটন (১২), নিউ মেক্সিকো (৫), ওয়াশিংটন ডিসি (৩) কলোরাডো (৯), ইলিনয় (২০), মিনেসোটা (১০), ভার্জিনিয়া (১৩), ম্যারিল্যান্ড (১০), ডেলাওয়ার (৩) নিউ জার্সি (১৪), নিউ ইয়র্ক (২৯), কানেক্টিকাট (৭), ম্যাসাচুসেটস (১১), ভারমন্ট (৩), নিউ হ্যাম্পশায়ার (৪), মেইন (৪), রোড আইল্যান্ড (৪) ও হাওয়াই (৪) রাজ্যে।
এছাড়া সিনেট ও প্রতিনিধি পরিষদ নির্বাচনেও সাফল্য পেয়েছে ট্রাম্পের দল রিপাবলিকান পার্টি। বিভিন্ন সংস্থার জরিপে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের ৫৮তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোট পড়েছে প্রায় ৫৪ শতাংশ।
বাংলাদেশ সময় বুধবার ভোরে শেষ হয় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোটগ্রহণ। সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, ৫৩৮ ইলেকটোরাল কলেজ ভোটের মধ্যে ২৯০টি নিজ ঝুলিতে পুরেছেন ট্রাম্প। প্রতিদ্বন্দ্বী ডেমোক্রাট প্রার্থী হিলারি ক্লিনটন পেয়েছেন ২১৮ ভোট। সর্বমোট ৫৩৮টি ইলেকটোরাল কলেজ ভোটের মধ্যে প্রেসিডেন্ট হওয়ার জন্য প্রয়োজন ২৭০ ভোট।
প্রেসিডেন্ট ছাড়াও মঙ্গলবার মার্কিন কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদের ৪৩৫ আসনের সবকটিতে ও উচ্চকক্ষ সিনেটের ১০০ আসনের মধ্যে ৩৪ আসনের প্রার্থীও নির্বাচন করেন যুক্তরাষ্ট্রের ভোটররা। প্রাপ্ত ফলাফলে দেখা যায়, রিপাবলিকানদের নিয়ন্ত্রণে থাকা প্রতিনিধি পরিষদ তাদের হাতেই রইল। নিউইয়র্ক টাইমসের তথ্যানুযায়ী, শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত প্রতিনিধি পরিষদে রিপাবলিকানরা ২৩৫ আসন পেয়েছে। আর ডেমোক্র্যাটরা পেয়েছে ১৭৬ আসন। আর সিনেটে রিপাবলিকানরা ৫১ ও ডেমোক্র্যাটরা পেয়েছে ৪৭ আসন।
হাসার কথা ছিল কার কিন্তু শেষ পর্যন্ত হাসল কে? সব হিসাব পাল্টে দিয়ে শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে বিজয়ীর হাসি হাসলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।
পৃথিবীর অনেক দেশের মুসলমানদের কাছে আমেরিকার এই নির্বাচন ছিল ব্যাড বনাম ম্যাডের লড়াই। যে হিলারির জন্য এদেশের অনেক মানুষ প্রার্থনা পর্যন্ত করেছিল, সেই হিলারি ছিলেন অনেকের কাছে ব্যাড। কারণ উইকিলিকসের তথ্য অনুযায়ী মধ্যপ্রাচ্যসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মৌলবাদী মুসলমানদের বিতর্কিত সংগঠন আইএসের অন্যতম জন্মদাতা বারাক ওবামা এবং হিলারি ক্লিনটন। যারা মিলিয়ন মিলিয়ন ডলারের সহায়তা দিয়েছিলেন আইএসকে। পৃথিবীব্যাপী মুসলমানদের অনেকেই আগে বিশ্বাস করত, আইএস ইহুদি ইসরাইল ও আমেরিকার তৈরি এবং তাদের ফান্ড ফুলে–ফেঁপে উঠেছে। উইকিলিকসের তথ্য এই বিশ্বাসটাকে আরও উস্কে দেয়।
যে কারণে জয়ী ট্রাম্প
সব জরিপ ও ধারণা মিথ্যা প্রমাণ করে যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫ তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন রিপাবলিকান দলের মনোনীত প্রার্থী ডোনাল্ট ট্রাম্প। অথচ প্রেসিডেন্ট হওয়া তো দূরের কথা, ট্রাম্প যোগ্য প্রার্থী কিনা সে বিষয়ে শুরু থেকে বির্তক ছিল। এমনকী প্রার্থী হওয়ার পর অনেকে ধারণা করেছিলেন শেষ পর্যন্ত হয়ত প্রেসিডেন্ট দৌড়ে থাকতে পারবেন না ধনকুবের ট্রাম্প। কিন্তু এত কিছু সত্ত্বেও কী কৌশলে শেষ হাসি হাসলেন ট্রাম্প।
বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নির্বাচনে জিততে তিনি বেশ কয়েকটা কৌশলের অবলম্বন করেছিলেন। যা তার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী হিলারি ক্লিনটনের হয়ত কল্পনায়ও ছিল না।
‘আমেরিকাকে আবার মহান করুন‘ এই শ্লোগান দিয়ে প্রচারে নামেন রিপাবলিকান দলের প্রার্থী ডোনাল্ট ট্রাম্প। প্রচারণার সময় আমেরিকার অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। বলেছেন, মেক্সিকো আর যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে দেয়াল তুলে দেওয়া এবং মুসলমানদের অভিবাসন সাময়িকভাবে বন্ধ রাখার কথা। এতে তিনি ব্যাপক সাড়া পান শ্বেতাঙ্গ আমেরিকানদের কাছে। তাই অনেকে কাছে ট্রাম্প ছিল ‘খাঁটি‘ আমেরিকানদের প্রার্থী।
যেসব জায়গায় দরকার ছিল, সেগুলোতে জোরালো আঘাত হেনেছে ট্রাম্প। যুক্তরাষ্ট্রের মধ্য পশ্চিমাঞ্চলের রাজ্য গুলোতে ছিল ডেমোক্রেটদের ঘাঁটি। সেখানে মূলত কালো ও শ্রমিক শ্রেণির সাদা ভোটারদের উপর ভিত্তি করে ওই রাজ্যগুলোতে কয়েক দশক ধরে গেঁড়ে বসেছিল ডেমোক্র্যাটরা। কিন্তু ওই সব সাদা শ্রমিকরা এবার দল বেঁধে ট্রাম্পকে ভোট দিয়েছেন।
গ্রামীণ মানুষেরও ভোট পেয়েছেন ট্রাম্প। তারা ওই সব আমেরিকান যারা কায়েমি শক্তির কাছে উপেক্ষিত বোধ করেছে এবং উপকূলীয় অভিজাতদের পেছনে পড়েছিলেন। তারা নিজের পক্ষে আওয়াজ শুনেছেন। যেখানে ভার্জিনিয়া ও কলোরাডোর মতো জায়গায় ঘাঁটি শক্ত থাকলেও উইসকনসিনের পতন হয়েছে; সঙ্গে মিসেস ক্লিনটনের প্রেসিডেন্ট হওয়ার স্বপ্নও।
ট্রাম্প জয়ী হওয়ার পর এখন অনেকে ধারণা অনেকটা পরিকল্পিতভাবে ট্রাম্প নির্বাচনী প্রচারণার সময় বির্তকের জন্ম দিয়েছেন। এর ফলে সব সময় আলোচনার কেন্দ্র বিন্দুতে ছিলেন ট্রাম্প। সম্ভবত এসব বিভিন্ন বিতর্ক এতো শক্ত ও দ্রুত এসেছে যে সেগুলো রক্তক্ষরণের সুযোগ পায়নি।
দুই সপ্তাহ আগেও ট্রাম্পের এই বিজয়ের পথ ততোটা স্পষ্ট ছিল না। হিলারির ব্যক্তিগত ইমেইল সার্ভারের বিষয়ে এফবিআই পরিচালক জেমস কোমি নতুন করে তদন্তের কথা ঘোষণা করার পর পরিস্থতি পাল্টো যায়।
জরিপে জোরালো প্রতিযোগিতার আভাস থাকলে কমির ওই চিঠি এবং পরে তদন্ত শেষ হলে দেওয়া চিঠির এই সময়ের মধ্যেই ট্রাম্প শক্ত অবস্থান তৈরি করেছে। অন্যদিকে হিলারির প্রেসিডেন্ট হওয়ার আশা মলিন হয়েছে।
এ যাবতকালের সবচেয়ে ব্যতিক্রমী রাজনৈতিক প্রচারণা চালিয়েছেন ট্রাম্প, কিন্তু প্রমাণিত হলো তিনি সব অভিজ্ঞদের চেয়ে ভাল জানেন। ট্রাম্প উইসকনসিন ও মিশিগানের মতো রাজ্যগুলো সফর করেছেন, যেগুলোকে অনেকে দুর্গম বলেছিল। মানুষের দ্বারে দ্বারে না গিয়ে তিনি বড় বড় সমাবেশ করে তিনি ভোটারদের ঘর থেকে বের করে এনেছেন।
‘সব আমেরিকানের প্রেসিডেন্ট হব‘, যুদ্ধ নয়, আমি শান্তির পক্ষে: ট্রাম্প
দু‘দিন আগেও বিশ্বের রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা তাকে সেরার আসনে রাখেননি। মার্কিন প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা সেই হিলারিকেই এগিয়ে রাখার পক্ষে ছিলেন অনেকে। কিন্তু গণতন্ত্রের রায় সব সময় বিশেষজ্ঞদের বক্তব্যের উপর নির্ভর করে না। বিশ্বের বহু দেশে বহু নির্বাচনেই তা প্রমাণিত হয়েছে। জয় ঘোষিত হওয়ার পরেই দেশবাসীকে ধন্যবাদ জানালেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫তম প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
জয়সূচক বক্তৃতায় সেই আগ্রাসী ট্রাম্পকে দেখালো অনেকটাই সংযত। মা–বাবা, স্ত্রীসহ পরিবারকে ধন্যবাদ জানিয়ে ট্রাম্প বললেন, ‘মানুষ বলছে, এটা ঐতিহাসিক জয়।‘
হাততালি আর উল্লাসে ফেটে পড়ল গোটা হল। প্রথমেই প্রতিদ্বন্দ্বী হিলারি ক্লিনটনের প্রসঙ্গ তুললেন। জানালেন, ‘এই মাত্র হিলারি ক্লিন্টনের ফোন পেলাম। জয়ের শুভেচ্ছা জানালেন। উনি খুব শক্ত লড়াই লড়েছেন।‘
ট্রাম্পকে যারা ‘যুদ্ধবাজ‘ বলে সমালোচনা করেছিলেন, তাদের প্রতি ট্রাম্পের বার্তা, ‘যুদ্ধ নয়, আমি শান্তির পক্ষে। বিশ্বের সব দেশকে নিয়ে এগোব।‘
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার শপথ করে ট্রাম্প বললেন, ‘আমেরিকাকে নতুন দিশা দেওয়ার সময় এসেছে। আমাদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে। প্রত্যেক মার্কিন নাগরিকের স্বপ্ন পূরণ হবে।‘ মার্কিন নাগরিকদের প্রতি প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘গোটা দেশকে এক সুতোয় গাঁথতে হবে। আপনাদের সহযোগিতা চাই। বিশ্বের সেরা রাষ্ট্রের খেতাব পুনরুদ্ধার করবই। আসুন বৃহৎ ও সাহসী স্বপ্ন দেখি। যারা আমায় ভোট দেননি, তাদেরও বলছি, আসুন নতুন রাষ্ট্র গড়ি।‘
নির্বাচনী প্রচারের শুরু থেকেই ট্রাম্প নানা বিতর্কে জড়ান। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনকে ওবামার চেয়ে অধিক যোগ্য বলে উল্লেখ করেছিলেন তিনি। এতে সব মহলেই সমালোচিত হন ট্রাম্প। আয়কর দাখিল না করা নিয়েও তার বিরুদ্ধে সমালোচনা হয়েছে। নানা রকম বিরুদ্ধ প্রচারণা সত্ত্বেও দমে যাননি তিনি।
বিজয় ভাষণে ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার পরিকল্পনার কথা তুলে ধরে বলেন, ‘আমি সব কিছুর কাঠামোগত উন্নয়ন করবো, কোটি মানুষকে কাজ দেবো। আমাদের একটা অর্থনৈতিক পরিকল্পনা আছে, সে অনুযায়ী কাজ হবে।’ তিনি যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিকে দ্বিগুণ করার প্রতিশ্রুতি দেন। অন্য দেশগুলোর সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করারও অঙ্গীকার করেন তিনি। ট্রাম্প বলেন, ‘আমি বিশ্ব সম্প্রদায়কে বলতে চাই, আমরা যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থকে প্রাধান্য দিলেও সবার সঙ্গে ভালোভাবে থাকব।’
তিনি আরো বলেন, ‘বিশ্বের উন্নয়নে নেতৃত্ব দেবে আমেরিকা। এটাই এখন আমাদের চ্যালেঞ্জ। দেশের উন্নয়ন ছাড়া এখন আমাদের কোনো চিন্তা নেই।’
ধনকুবের থেকে প্রেসিডেন্ট হওয়া ট্রাম্প বলেন, ‘আমি একজন ব্যবসায়ী হিসেবে বিশ্বে সুনাম অর্জন করেছি। এখন দেশ ও দেশের মানুষের জন্য কিছু করতে চাই। আমি উপলব্ধি করছি, এটা করা উচিৎ।’
অনেকেই ট্রাম্পকে উগ্র, উম্মাদ, যৌনকাতর ও স্ট্যান্ড আপ কমেডিয়ান বলেছেন। তবে ভারতীয় বংশোদ্ভূত আমেরিকান নাগরিকরা ট্রাম্পকেই সমর্থন করেছেন। তাদের যুক্তি নরেন্দ্র মোদি যতই উগ্র এবং সাম্প্রদায়িক কথা বলুন না কেন, ভারতের জন্য তাকেই বেশি প্রয়োজন! সুতরাং প্রেসিডেন্ট হলে ট্রাম্পও উগ্রতা থেকে সরে আসবেন এবং অ্যামেরিকার অর্থনীতিকে শক্তিশালী করে তুলবেন। যদি তেমনই হয়, তাহলে অপেক্ষা করা ছাড়া কোনও উপায় নেই। দেখা যাক হয়তো ক্ষমতাই ট্রাম্পকে উগ্রবাদ ও পাগলামি থেকে শান্তির পথে নিয়ে আসবে!
রাম্পও ছক্কা মেরেছেন। প্রায় সব মিডিয়া তাকে উম্মাদ আর ক্লাউন বানাতে ব্যস্ত ছিল। কেউ বলেনি যে ট্রাম্পই নির্বাচনে জিতে যাচ্ছে। বর্ণবাদী ও উগ্র আমেরিকানরা ভয় পাচ্ছিল যে ক্রমশ তাদের ক্ষমতা অশ্বেতাঙ্গ মানুষের হাতে চলে যায় কিনা। এই ভয় আর নারী প্রেসিডন্ট দেখার চেয়ে তারা একজন ক্লাউনকেই বেছে নিয়েছে। এখন বলা হচ্ছে নিম্ন ও মধ্য আয়ের আমেরিকানরাও নাকি ট্রাম্পকে পছন্দ করা শুরু করেছে। এ কারণেই ইলেক্টোরাল ভোটের এতা পপুলার ভোটেও ট্রাম্প এগিয়ে ছিলেন। এত মিডিয়া আমেরিকার, আর তারা সাধারণ মানুষের পালস বুঝতে পারল না?
ট্রাম্পের জয়ে বিশ্বনেতাদের প্রতিক্রিয়া
অনেক হিসাব–নিকাশই পাল্টে দিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে রিপাবলিক পার্টির প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের জয়। হোয়াইট হাউসের পরবর্তী এই উত্তরাধিকারীকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন বিশ্ব নেতারা।
টুইটার, টেলিগ্রাম কিংবা অভিনন্দন বার্তায় শুভেচ্ছা জানানোর পাশাপাশি অনেকে আবার আশঙ্কাও প্রকাশ করেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ায় ডোনাল্ড ট্রাম্পকে অভিনন্দন জানিয়েছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। অভিনন্দন বার্তায় পুতিন দুই দেশের সংকটপূর্ণ অবস্থা কাটিয়ে উঠতে একসঙ্গে কাজ করার প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন।
যুক্তরাষ্ট্রের নতুন নেতৃত্বকে অভিনন্দন জানিয়ে তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী বিনালি ইদিরিম বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রে স্বেচ্ছা নির্বাসনে থাকা তুরস্কের ধর্মীয় নেতা ফেতুল্লাহ গুলেনকে ফেরত দিলে দু‘দেশের সম্পর্কে এক নতুন মাত্রা যুক্ত হবে। সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে তুরেস্কের অবস্থানের বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্র বিবেচেনায় রাখবে বলেও প্রত্যাশা করেন তিনি।
টুইটার বার্তায় নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে অভিনন্দন জানিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। দ্বিপক্ষীয় কাজের মাধ্যমে ভারত–আমেরিকার সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় পৌঁছাবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
ট্রাম্পকে অভিনন্দন জানিয়ে পাঠানো বার্তায় ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট রদ্রিগো দুতেরতে বলেছেন, দুই দেশের সম্পর্ক উন্নয়নে আমেরিকার নতুন নেতা এক সঙ্গে কাজ করবেন বলে তিনি আশা করেন।
জার্মানির চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মার্কেল নতুন মার্কিন প্রেসিডেন্টকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে যতটা সম্ভব একসঙ্গে কাজ করবে জার্মানি।
যুক্তরাষ্ট্রের নতুন নেতৃত্বের মাধ্যমে ফিলিস্তিনের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের ‘পক্ষপাত নীতি‘ পরিবর্তন হবে বলে মনে করে না হামাস। সংগঠনটির মুখপাত্র সামি আবু জুহরি বলেছেন, ‘ফিলিস্তিনিরা মার্কিন প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে কোনো ধরনের পরিবর্তনের আশা করেন না। ফিলিস্তিন ইস্যুতে মার্কিন নীতি সব সময়ই পক্ষপাতমূলক।‘
টুইটার বার্তায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক প্রধান ফেদেরিকা মোগেরিনি বলেছেন, ট্রাম্পের জয়ের পরও ইইউ–যুক্তরাষ্ট্র একসঙ্গে কাজ করে যাবে।
নতুন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে অভিনন্দন জানিয়েছেন জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে। তিনি আশা প্রকাশ করেন, এর মধ্য দিয়ে দুই দেশের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আরও দৃঢ় হবে।
শপথের আগে যে কাজগুলো বাকি
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তবে এখনই তিনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পাচ্ছেন না। সব কিছু ঠিক থাকলে আগামী ২০ জানুয়ারি শপথ নিতে পারবেন তিনি। এর আগে আরো কিছু কাজ করতে হবে ইলেকটর ও মার্কিন কংগ্রেসকে। এ কর্মযজ্ঞ শুরু হবে মধ্য নভেম্বরে শেষ হবে জানুয়ারির প্রথমার্ধে।
মধ্য নভেম্বর থেকে ১৯ ডিসেম্বর
প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর রাজ্যগুলোর সরকার সাতটি ‘ স্পষ্টীকরণ সনদ’ তৈরি করে। নির্বাচনের ফল ঘোষণার পর একে সত্যায়িতের পর গভর্নর একটি সনদ মোহাফেজখানায় পাঠিয়ে দেন। ডিসেম্বরে ইলেকটরদের বৈঠকের আগেই এ সনদ মোহাফেজখানায় পাঠাতে হয়। বাকী ছয়টি সনদ ডিসেম্বরে ইলেকটরদের বৈঠকে উপস্থাপনের জন্য রেখে দেওয়া হয়।
১৩ ডিসেম্বর
রাজ্যগুলোতে তাদের নিয়োগ করা ইলেকটরদের নিয়ে কোনো বিতর্ক আছে কিনা তা স্পষ্ট করতে হয়। আর থাকলে তা নিরসনে বৈঠকের ছয়দিন আগে তা নিস্পত্তি করতে হয়। কংগ্রেসে যাতে ইলেকটরদের ভোট গ্রহণযোগ্য হয় সেজন্য এ কাজটি করতে হয়।
১৯ ডিসেম্বর
ইলেকটররা তাদের রাজ্যে বৈঠকে বসেন এবং প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্ট পদের জন্য পৃথক ব্যালট পেপারে ভোট দেন। তারাএই ভোটের পর ছয়টি ‘ স্পষ্টীকরণ সনদ’ এর বিপরীতে ছয়টি ‘ভোট সনদ’ তৈরি করেন। একটি স্পষ্টীকরণ সনদ’ ও একটি ‘ভোট সনদ’ দিয়ে জোড়া সনদের একটি প্যাকেজ করা হয়। এর একটি প্যাকেজ পাঠানো হয় সিনেটের প্রেসিডেন্টের (ভাইস প্রেসিডেন্ট) কার্যালয়ে, একজোড়া প্যাকেজ পাঠানো হয় যে রাজ্যে ইলেকটররা বৈঠকে বসেন সে রাজ্যের প্রধান নির্বাচকের কার্যালয়ে। বাকী তিনটির মধ্যে দুটি পাঠানো হয় মোহফেজখানায় এবং একটি পাঠানো হয় যে রাজ্যে বৈঠক হয়, সেখানকার জেলা জজের কাছে।
২৮ ডিসেম্বর
ইলেকটরদের বৈঠকের নয়দিনের মধ্যে সিনেটের প্রেসিডেন্ট ও মোহাফেজখানায় ‘ভোট সনদ’ পাঠাতে হয়।
৩ জানুয়ারি বা তার আগে
মোহাফেজখানার সংরক্ষক এবং কেন্দ্রীয় রেজিস্ট্রার বা তার প্রতিনিধি সিনেটের সেক্রেটারি ও করণিকের সঙ্গে ডিসেম্বরের শেষ কিংবা জানুয়ারির প্রথমে দেখা করেন।
৬ জানুয়ারি
ইলেকটরাল ভোট গণনার জন্য যৌথ অধিবেষনে বসে কংগ্রেস। কংগ্রেস চাইলে এই তারিখ পরিবর্তনে আইনও করতে পারে। সিনেটের প্রেসিডেন্ট যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্টের নাম ঘোষণা করেন।
যদি কোনো রাজ্য ইলেকটরাল ভোট নিয়ে কোনো পরস্পরবিরোধী তথ্য জানায়, তাহলে হাউজ অব রিপ্রেজেনটেটিভ ও সিনেট চাইলে এই ভোট গ্রহণ করতে পারে অথবা প্রত্যাখান করতে পারে। যদি প্রেসিডেন্ট পদে কোনো প্রার্থী ২৭০ ইলেকটরাল ভোট বা তার বেশি না পায় তাহলে সংবিধানের ১২ তম সংশোধনী অনুযায়ী, সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটের ভিত্তিতে তিনজনের মধ্যে একজনকে হাউজ অব রিপ্রেজেনটেটিভ প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করতে পারে। আর এই ভোট প্রদান করবে রাজ্যগুলো। একটি রাজ্য একটি ভোট প্রদান করতে পারবে।
২০ জানুয়ারি
প্রেসিডেন্ট শপথ গ্রহণ করেন এবং আনুষ্ঠানিকভাবে চার বছরের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সর্বময় কর্তৃত্বের অধিকারী হন।
শপথ অনুষ্ঠান
সাধারণত ২০ জানুয়ারি প্রেসিডেন্ট ও ভাই প্রেসিডেন্টের শপথ অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। তবে ২০ জানুয়ারি যদি সাপ্তাহিক ছুটির দিন হয় অর্থাৎ রবিবার হয় তবে ২১ জানুয়ারি শপথ গ্রহণ হয়। ওয়াশিংটন ডি.সি–এর ক্যাপিটল ভবনে আয়োজিত হয় অনুষ্ঠান।
প্রথমে ভাইস প্রেসিডেন্ট তার শপথ নেন। ১৮৮৪ সাল থেকে সিনেটর, রিপ্রেজেন্টেটিভ ও ফেডারেল কর্মীরা যে শপথ বাক্য পাঠ করে থাকের সে একই শপথবাক্য এখানে পাঠ করা হয়।
ভাইস প্রেসিডেন্ট তার শপথবাক্যে বলবেন, ‘আমি শপথ নিচ্ছি যে আমি দেশি–বিদেশি সকল শত্রুর হাত থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের সুরক্ষা দেব। একইরকম করে আমিও সংবিধানের প্রতি পুরোপুরি আস্থা ও আনুগত্য বজায় রাখব। কোনও ধরনের অনিচ্ছা ও ছল ছাড়াই স্বাচ্ছন্দ্যে আমি এ বাধ্যবাধকতা মেনে নিচ্ছি। যে অফিসে আমি প্রবেশ করতে যাচ্ছি সেখানকার দায়িত্বগুলো ভালোভাবে ও বিশ্বস্তার সাথে পালন করব। ঈশ্বর আমার সহায় হোন।’
এরপর ওইদিন দুপুরে যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের ধারা ১–এর ২ নাম্বার অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট তার শপথ নেবেন। প্রেসিডেন্ট তার শপথবাক্যে বলবেন, ‘আমি শপথ নিচ্ছি যে, আমি বিশ্বাস বজায় রেখে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট কার্যালয় নির্বাহের কাজ করব এবং সাধ্যমত সর্বোচ্চ কাজ করব, যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের সংরক্ষণ করব, সুরক্ষা দিব ও পালন করব।’
শপথ গ্রহণের পর উদ্বোধনী ভাষণ দেবেন নতুন প্রেসিডেন্ট। নতুন প্রেসিডেন্টের শপথ অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন বিদায়ী প্রেসিডেন্ট। আনুষ্ঠানিকতা শেষে বিদায়ী প্রেসিডেন্ট হোয়াইট হাউজ ছেড়ে দেবেন এবং তার পরিবারসমেত অন্য বাসস্থানে চলে যাবেন।