মধ্যপ্রাচ্যে অন্তহীন সঙ্ঘাতের কুশীলবরা
আলফাজ আনাম : পৃথিবীর ইতিহাসের সাথে জড়িয়ে আছে সঙ্ঘাতের ইতিহাস। মনে করা হয়, সঙ্ঘাতের শুরু হয়েছিল হাবিল ও কাবিলের লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে। এ লড়াইয়ের স্থানটিও ছিল মধ্যপ্রাচ্যে। কথিত আছে, আজকের রক্তাক্ত সিরিয়ায় ক্যাসিওন পার্বত্য এলাকায় হাবিলকে হত্যা করেছিল কাবিল। হজরত ইব্রাহীম আ:-এর বিশ্বাস থেকে উৎসারিত তিনটি ধর্ম খ্রিষ্টান, ইহুদি আর মুসলমানদের পবিত্র স্থান জেরুসালেমসহ ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলো এ অঞ্চলেই।
অন্তহীন এ সঙ্ঘাতে গত এক শতাব্দীতে মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্রের পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু স্থিতিশীলতা আসেনি। কবে এ যুদ্ধের শেষ, কেউ জানে না। এর মধ্যে ইসরাইল নামেমাত্র আশি লাখ লোকের জন্য যে সীমানাহীন এক রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছে, তার পরিধি কোথায় ঠেকবে সে সম্পর্কে কোনো আগাম ধারণা কেউ দিতে পারছে না। এ অঞ্চলে এমন দেশ নেই বললেই চলে, যেখানে বিগত কয়েক দশকে যুদ্ধ হয়নি কিংবা অভ্যন্তরীণ সঙ্কটের মুখোমুখি হয়নি। নিকট ভবিষ্যতেও সহিংসতার কবল থেকে তারা যে মুক্ত হতে পারবেন, তেমন সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না। ২০১১ সালে ‘আরব বসন্ত’ নামে পরিচিতি পেয়েছে যে আন্দোলন সেটাও পাল্টা বিদ্রোহের চোরাবালিতে হারিয়ে গেছে।
সময়টা ১৯১৪ সালের গ্রীষ্মকাল। ওসমানীয় সাম্রাজ্যের রাজধানী ইস্তাম্বুল তখন ইশলের ইম্পেরিয়াল ভিলা থেকে প্রায় অর্ধ–পৃথিবী দূরে যেখানে সম্রাট ফ্রাঞ্চ জোসেফ প্রথম তার ‘টু মাই পিপল’ ম্যানিফেস্টোতে স্বাক্ষর করলেন। সাইবেরিয়ার বিরুদ্ধে তার যুদ্ধ ঘোষণার মাধ্যমে সূচনা হলো প্রথম বিশ্বযুদ্ধের। সঙ্ঘাত শুরুর কিছু পরই বার্লিন আর ভিয়েনার পক্ষে যোগ দিলো ইস্তাম্বুল। ২ আগস্ট জার্মান আর ওসমানীয় সুলতান সই করলেন গোপন চুক্তিতে। আঘাত আসতে শুরু করল ওসমানীয় সাম্রাজ্যের ওপর। বহু শতাব্দী ওসমানীয়রা রাজত্ব করেছেন দক্ষিণ ও পূর্ব ভূমধ্যসাগরে আলেক্সান্দ্রিয়া থেকে আরিশ, আর মাগরেব থেকে সুয়েজ পর্যন্ত। কিন্তু ১৯১১ সালে ফ্রান্সের অধীনস্থ হলো আলজেরিয়া আর তিউনিসিয়া, ব্রিটিশরা দখল করল মিসর। অন্যদিকে লিবিয়ায় ঘাঁটি গেড়ে বসল ইতালি। সঙ্কুচিত হয়ে এলো ওসমানীয় সাম্রাজ্য। তুরস্ক ছাড়া সাম্রাজ্যের মধ্যে তখন মধ্যপ্রাচ্যের ইরাক থেকে ইয়েমেন পর্যন্ত বিস্তৃত আরব উপদ্বীপ।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে বর্তমান তুরস্কের দক্ষিণের এ অঞ্চলটাই মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধক্ষেত্রের মূল কেন্দ্র ছিল। ৪০০ বছর ধরে ইতিহাসেই মগ্ন ছিল এ অঞ্চল। ইব্রাহীম আ:-এর ধর্মের ভিত্তির ঐতিহাসিক স্থানগুলোও এ অঞ্চলে। কিন্তু বিশ শতকের গোড়ার দিকে এগুলোই হয়ে উঠেছে সঙ্কটের কেন্দ্রভূমি। বসরা, বাগদাদ, আলেপ্পো, দামেস্ক, বৈরুত, গাজা কিংবা সুয়েজ এ নামগুলো উচ্চারণ করা হলেই কয়েক প্রজন্মের সহিংসতা–বিপর্যয়ের চিত্র ভেসে ওঠে চোখের সামনে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে ১৯১৮ সালে। কিন্তু ওই যুদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যে যে সহিংসতা উসকে দিয়েছিল তার নানা মাত্রায় আরো বিস্তার ঘটেছে। কার্যত মধ্যপ্রাচ্যে এখন যা চলছে বিরতিহীনভাবে, তা আঞ্চলিক সঙ্ঘাতের একটি অধ্যায় মাত্র। যার পেছনে কাজ করছে সাবেক ঔপনিবেশিক শাসকের অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্ত।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগেই পেন্সিলের লাল–নীল দাগ টেনে ভাগ–বাটোয়ারা করে নেয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। সময়টি ১৯১৬ সালের মে মাস। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ যখন তুঙ্গে, তখন খুব গোপনে আজকের আরব বিশ্বের মানচিত্রের ওপর পেন্সিলের দাগ টেনে পরিকল্পনা নেয়া হয়েছিল বিশ্বযুদ্ধ শেষে এর কোন অংশটি কোন বৃহৎ শক্তির ভাগে পড়বে।
ওসমানীয় সাম্রাজ্যকে ভাগ করে নেয়ার এই গোপন পরিকল্পনাটি চূড়ান্ত করার জন্য ব্রিটিশ ও ফ্রান্স সরকার নিয়োগ দেয় স্যার মার্ক সাইকস ও ফ্রাঁসোয়া জর্জ–পিকটকে। কারণ, ওসমানীয় সাম্রাজ্য বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি তথা অক্ষশক্তির পক্ষ নিয়েছিল। এই পরিকল্পনায় রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সার্গেই সাঝোনভও সংশ্লিষ্ট ছিলেন।
মিত্রশক্তির যুদ্ধের অবস্থা তখন ভালো যাচ্ছিল না। ১৯১৬ সালের জানুয়ারি মাসে গ্যালিপোলি থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয় ব্রিটেন। যুদ্ধটা জাতীয় বিপর্যয়ের কারণ হয়ে উঠল অস্ট্রেলিয়া আর নিউজিল্যান্ডের কাছে। কারণ তাদের হাজার হাজার সৈনিক গ্যালিপোলিতে জীবন দিয়েছিল। এপ্রিলে মেসোপটেমিয়ার কুত্ এলাকা অবরুদ্ধ হওয়ার সাথে সাথে ব্রিটিশ সৈন্যরা স্রেফ আত্মসমর্পণ করে বসে।
তখন পর্যন্ত মিত্র শক্তি একমত ছিল যে, রাশিয়া পাবে ইস্তাম্বুল, কৃষ্ণসাগর থেকে ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত সমুদ্রপথ এবং আর্মেনিয়া। ব্রিটিশরা পাবে বসরা এবং মেসোপটেমিয়ার দক্ষিণ ভাগ। ফ্রান্সের ভাগে পড়বে মধ্যপ্রাচ্যের একাংশ। যাতে থাকবে– লেবানন, সিরিয়া ও সিসিলিয়া (বর্তমানে তুরস্কে)। প্যালেস্টাইন হবে আন্তর্জাতিক ভূখণ্ড। ফ্রান্স ও ব্রিটেনশাসিত অঞ্চলগুলোর মধ্যবর্তী যে বিস্তীর্ণ এলাকা, যার বেশির ভাগই মরুভূমি, তা এ দুই শক্তিধর দেশের মধ্যে তাদের কর্তৃত্বের ভিত্তিতে বণ্টন করা হবে। ১৯১৭ সালে এ ভাগাভাগির পরিকল্পনায় এসে জোটে ইতালি।
কিন্তু ১৯১৮ সালের ওসমানীয় সাম্রাজ্যের পতন ঘটলে সব পরিকল্পনাই ভণ্ডুল হয়ে যায়। কামাল আতাতুর্কের নেতৃত্বে তুরস্ক বিদেশী সৈন্যদের আনাতোলিয়ার বাইরে ঠেলে দেয়। এ সময় ফ্রান্সই সর্বপ্রথম মসুল শহরটি কব্জা করে নেয়। কিন্তু তুরস্ক দাবি তোলে যে, শহরটি তাদের। এক পর্যায়ে মসুলকে তুলে দেয়া হয় ব্রিটেনের হাতে এবং এর মাধ্যমেই শহরটির ভবিষ্যৎ গ্রথিত হয়ে যায় ইরাকের সাথে। মসুল নিয়ে এ ধস্তাধস্তির কারণ ছিল মসুলের তেল সম্পদ। একই কারণে, এমনকি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগেই মিসর, উত্তর আফ্রিকা ও আরব উপসাগরের তীরবর্তী এলাকা, প্রকৃত আরব ভূখণ্ড হয় কলোনি নতুবা প্রটেক্টরেট হিসেবে ভাগাভাগি করে নেয়া হয়েছিল।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কুশীলবরা তখনো জানতেন না অটোম্যান বা ওসমানীয় সাম্রাজ্যের পেছন অংশটা পৃথিবীর বৃহত্তম তেল রিজার্ভের ওপর ভাসছে। জানলে, মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধটা আরো সহিংস ও নিষ্ঠুর হয়ে উঠত। সেই সময়টাতে যুদ্ধের লক্ষ্য ঠিক হয়েছিল যে বিশ্বব্যবস্থার পরিকল্পনায়, সেটা পরবর্তী চার বছর মাত্র টিকে ছিল। বন্ধু দেশ রাশিয়ার সাথে একটা নৌরুট গড়ে তোলাই ছিল গ্রেট ব্রিটেনের লক্ষ্য। সেই সাথে সুয়েজ খাল আর পারস্য উপসাগর দিয়ে ভারতের সাথে যোগাযোগটা ঠিক রাখতে চেয়েছিল তারা। কিন্তু জার্মানরা চাইছিল ঠিক তার উল্টোটা।
এভাবেই সাইকস–পিকট পরিকল্পনা পরিণত হয় সাম্রাজ্যবাদী প্রতারণার উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্তে। আরব ইতিহাসবিদ জর্জ আন্তোনিয়াম একে বলেছেন ‘মর্মপীড়াদায়ক দলিল’, যা কি না পরিণামে নির্বুদ্ধিতার নামান্তর। আসলে এটি ছিল ফ্রান্স, আরব দেশগুলো ও ইহুদিদেরকে দেয়া, ব্রিটেনের তিনটি পৃথক অথচ অপরিবর্তনীয় প্রতিশ্রুতির একটি। ফলে যে মতভেদ সৃষ্টি হয় তার করুণ পরিণতি এখনো ভোগ করতে হচ্ছে।
চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে আরবরা, যারা কি না আশা করেছিল বিশাল এক হাশেমীয় সাম্রাজ্যের, তারা এর পরিবর্তে পেল কয়েকটি ক্ষুদ্র রাজ্য। ম্যারোনাইট খ্রিষ্টানরা পেল লেবাননের বিরাট অংশ যদিও তারা তা নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। কুর্দিরা আশা করেছিল, নিজেদের একটি স্বাধীন দেশ। কিন্তু সেটা তাদের পাওয়া তো হলোই না, বরং পুরো জাতিটিই চারটি দেশের মধ্যে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে পড়ল। আর ইহুদিরা পেল ফিলিস্তিন বা প্যালেস্টাইনের একটি টুকরো।
যে হাশেমীয়রা ব্রিটেনের সাহায্য নিয়ে ওসমানীয়দের বিরুদ্ধে আরব বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাদেরকেই সিরিয়া থেকে তাড়িয়ে দেয় ফ্রান্স। শুধু তা–ই নয়, তারা হিজাজের ওপর থেকে তাদের বংশানুক্রমিক কর্তৃত্বও হারিয়ে ফেলে, যে হিজাজের অংশ হলো পবিত্র মক্কা ও মদিনা নগরী। এর কর্তৃত্ব চলে যায় নজদের গোত্রপতি আবদুল আজিজ বিন সউদের হাতে, যাকে সহায়তা দিয়েছিল ব্রিটেন। তিনি পরে আধুনিক সৌদি আরব গড়ে তোলেন। অন্যদিকে পরাজিত ও বিতাড়িত হাশেমীয়দের একটি অংশ ইরাক শাসন করতে থাকে। তবে ১৯৫৮ সালে সেখানকার বাদশাহ দ্বিতীয় ফয়সল নিহত হন। অপর অংশটি কোনোমতে টিকে থাকে ট্রান্সজর্ডান নামে একটি ছোট রাজ্যে। ব্রিটিশরা এটিকে দ্রুত প্যালেস্টাইন থেকে আলাদা করে ফেলে। বর্তমানে ওই অঞ্চলটি জর্ডানের অন্তর্ভুক্ত।
এর আগে ১৯১৭ সালের ২ নভেম্বর ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর্থার জেমস বেলফোর গ্রেট ব্রিটেনের জায়োনিস্ট ফেডারেশনকে প্রতিশ্রুতি দেন ফিলিস্তিনে ইহুদিদের জন্য জাতীয় আবাস গড়ে তোলা হবে। ইউরোপে অবহেলিত ইহুদিদের জন্য অটোম্যান সাম্রাজ্যের এক টুকরো বরাদ্দ করতে রাজি হয়েছিল ব্রিটেন। এভাবে ইসরাইল নামক অবৈধ রাষ্ট্রের জন্ম দেয়ার কাজ সারে ব্রিটেন। পরে ধাত্রীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্স।
আরব দেশগুলোর সাথে ইসরাইলের প্রথম যুদ্ধটি হয় ১৯৪৮ সালে। এরপর ১৯৫৬, ১৯৬৭ ও ১৯৭৩ সালে আরো তিনটি যুদ্ধ হয় এবং প্রতিটিতেই ইসরাইল জয়লাভ করে। ১৯৮২ সালে ইসরাইলের সৈন্যদের লেবাননে অনুপ্রবেশ ছিল আরেকটি কলঙ্কিত অধ্যায়। ১৯৯৩ সালে অসলো চুক্তির মাধ্যমে ইসরাইল ও প্যালেস্টাইনের মধ্যে যে ‘শান্তি প্রক্রিয়া’ শুরু হয়, তা চলে দুই দশকেরও বেশি সময়। অবশেষে তা জন্ম দেয় স্বায়ত্তশাসিত একটি ‘অসুখী দ্বীপপুঞ্জ’ যা গঠিত হয়েছে ইসরাইল অধিকৃত পশ্চিম তীর ও গাজা এলাকা নিয়ে। আর এখান থেকে ব্রিটিশ–মার্কিন সমর্থন নিয়ে ইসরাইল ভূমিপুত্র ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদের প্রক্রিয়া চলছে সমান তালে।
সুয়েজ খাল এবং বিপুল তেলসম্পদ এই অঞ্চলটিকে স্নায়ুযুদ্ধের দিনগুলোতে আন্তর্জাতিক রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে রেখেছিলো। ১৯৫৬ সালে মিসরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ইসরাইলের পক্ষ নেয় ফ্রান্স ও ব্রিটেন। তবে আমেরিকার চাপে ফিরে যেতে বাধ্য হয় তারা। এরপর থেকে আমেরিকা ওই অঞ্চলের প্রধান বিদেশী শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয় এবং ইসরাইলের মূল অস্ত্র জোগানদাতা ও রক্ষাকর্তা হিসেবে কাজ করতে থাকে।
এদিকে সোভিয়েত শিবির ত্যাগ করে মিসর। এরপর মার্কিন মধ্যস্থতায় ১৯৭৯ সালে মিসর ও ইসরাইলের মধ্যে সম্পাদিত হয় শান্তি চুক্তি যা ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি নামে বিখ্যাত। ১৯৫৮ সালে আমেরিকা একবার লেবাননে হস্তক্ষেপ করেছিল। দ্বিতীয়বার করে ১৯৮২ সালে। ইরান–ইরাক যুদ্ধকালে পারস্য উপসাগরে চলাচলকারী তেলের ট্যাংকারকে নিরাপত্তা দিত আমেরিকান রণতরী। ১৯৯১ সালে ইরাককে কুয়েত থেকে বিতাড়িত করে আমেরিকা গেড়ে বসে সৌদি আরবে। উদ্দেশ্য ইরাকে প্রতিষ্ঠিত বিমান উড্ডয়নমুক্ত এলাকা (নো–ফ্লাই জোন) দেখাশোনা করা। ২০০১ সালের সেপ্টেম্বরে ওয়াশিংটন ও নিউ ইয়র্কে আল–কায়েদার হামলার পরপরই আফগানিস্তানে অনুপ্রবেশ করে আমেরিকা। এরপর ইরাকে অনুপ্রবেশ করে ২০০৩ সালে।
ইরাক থেকে চলে গেছে মার্কিন সেনাবাহিনী। কিন্তু সে দেশ পরিণত হয়েছে এক জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডে। সাদ্দাম হোসেনকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যার সাথে চলে যেতে হয়েছে লিবিয়ার মুয়াম্মার গাদ্দাফি আর হোসনি মোবারককে। তিউনিসিয়া থেকে শুরু হওয়া আরব বসন্তের আন্দোলনের ফল এখন আরো বেশি দৃশ্যমান। এর পেছনের কুশীলবরা আরেকটি রক্তাক্ত অধ্যায়ের সূচনা করেছে। লিবিয়া অনানুষ্ঠানিকভাবে ভেঙে পড়েছে। ইরাক থেকে ইসলামিক স্টেট বা আইএস নামে যুদ্ধবাজ এক গোষ্ঠীর আবির্ভাব ঘটেছে । একই সাথে ইরাক আর লিবিয়ায় নানা গোত্রে বিভক্ত বিভিন্ন গোষ্ঠীর যুদ্ধ চলছে। আর লিবিয়া থেকে আল–কায়েদার একটি অংশ চলে গেছে মালিতে; যেখানে জাতিসঙ্ঘের বাহিনী মোতায়েন করতে হয়েছে। এর মাঝে মিসর থেকে মোবারকের বিদায় আর তিউনিসিয়া থেকে বেন আলির পলায়ন ঘটেছে। গাদ্দাফিকে হত্যায় সরাসরি অংশ নিয়েছিল ফ্রান্সের গোয়েন্দারা। মোবারকের পতনে সমর্থন ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের। তাতে অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি। নির্বাচিত সরকারের পতন ঘটিয়ে মিসরে আবারো সেনাতন্ত্র জেঁকে বসেছে। ইয়েমেনে সৌদি প্রভাব বজায় রাখতে গিয়ে সেখানে উভয়পক্ষ পোড়ামাটি নীতি নিয়েছে। ইরাকে শিয়া–সুন্নি বিরোধ জিইয়ে রাখার পাশাপাশি তা যুদ্ধে রূপ নিয়েছে ইয়েমেনে। টিকে গেছেন শুধুই সিরিয়ার আসাদ। হাবিল–কাবিলের যুদ্ধ ক্ষেত্রে সঙ্ঘাতের শেষ কবে, কেউ জানে না। আর পেছনের খেলোয়াড়দের মাঝে বোঝাপড়ার হিসাব এখনো ঠিক হয়নি। ফলে এ অঞ্চলের সবচেয়ে কৌশলগত দেশ তুরস্ক এখন রাশিয়ার সাথে বন্ধুত্ব গড়েছে। চীন–রাশিয়া–তুরস্ক–পাকিস্তান নতুন বলয়ের ইঙ্গিত দিচ্ছে। অপরদিকে ইউরোপের অর্থনৈতিক সঙ্কট আর দুর্বল আরব শাসকদের নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে প্রভাব বিস্তারের শেষ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এর মাঝে নীরবে শক্তি অর্জন করছে সীমানাহীন রাষ্ট্র ইসরাইল। যে দেশটির সীমানার পরিধি শুধু বেড়েই চলেছে। এখন সাম্রাজ্যবাদী শক্তি বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, জার্মানি ও রাশিয়ার মধ্যে নতুন কোনো বোঝাপড়ার ওপর নির্ভর করছে মধ্যপ্রাচ্যের অন্তহীন যুদ্ধের আরেকটি পর্যায়। অবশ্যই সেখানে আবারো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছেন তুরস্কের ‘নতুন সুলতান’ এরদোগান।
সূত্রঃ দৈনিক নয়াদিগন্ত, ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৬