সমস্যা কোথায় ? মেয়েদের কাপড়ে নাকি পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গীতে?
মেয়েদের কাপড় চোপড়
তসলিমা নাসরিন : ভারতের পর্যটনমন্ত্রী বলেছেন, বিদেশি মেয়েরা যেন ছোট স্কার্ট পরে ঘোরাঘুরি না করে, তাদের নিরাপত্তার জন্যই এটি দরকারি। এ কথা বলে তিনি ভারতের পুরুষদের চরিত্র সম্পর্কে এক রকম বুঝিয়ে দিলেন যে ভারতের পুরুষদের চরিত্র খারাপ, মেয়েরা ছোট পোশাক পরলে পুরুষরা তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে যৌন নির্যাতন করে। সৌদি আরবে ঢুকলেও বিদেশি মেয়েদের মাথায় কাপড় দিতে হয়। ওখানেও এ রকম বিশ্বাস যে মেয়েরা চুল ঢেকে না রাখলে পুরুষরা এত উত্তেজিত হবে যে নিজেদের ধর্ষণেচ্ছাকে বাগে আনা অসম্ভব হয়ে পড়বে।
ভারত কি সৌদি আরব হতে যাচ্ছে? ভারত হিন্দুপ্রধান দেশ, সৌদি আরব মূলত মুসলিম দেশ। ধর্মে মিল না থাকলেও মেয়েদের দাবিয়ে রাখার বেলায় দু’পক্ষে বেশ মিল। আসলে নারী–বিরোধ সব ধর্মের মানুষের মধ্যেই আছে। অন্য কোনও বিষয়ে মতের মিল না থাকলেও নারী–বিরোধিতায় সব ধর্মের মানুষের মত প্রায় এক। নারীর শরীর নিয়ে, পোশাক নিয়ে, আচার ব্যবহার নিয়ে, চরিত্র নিয়ে তারা প্রায় একই মত প্রকাশ করে। মতটি পুরুষতান্ত্রিক। কোনও ধর্মই পুরুষতন্ত্রের বিপরীত কোনও কথা বলে না। পুরুষতন্ত্র আছে বলেই সর্ব ধর্মের সমন্বয় হওয়া সম্ভব। ধর্মের চেয়ে পুরুষতন্ত্র ঢের শক্তিশালী। পুরুষতন্ত্রই পারে সব ধর্মের মানুষকে এক জায়গায় জড়ো করতে।
মেয়েদের ওপর পুরুষের যৌন নির্যাতন নতুন কিছু নয়। পুরোনো কালে পুরুষরা যৌন নির্যাতন করতো না, একালেই হঠাৎ খারাপ হতে শুরু করেছে পুরুষ— আমার মনে হয় না এই তথ্যটি সঠিক। পুরোনো কালে যৌন নির্যাতনকে যৌন নির্যাতন বলে মনে হয়নি মানুষের। যৌন নির্যাতনকে পুরুষের স্বাভাবিক আচরণ বলে ধরে নেওয়া হতো। স্বামী পেটালে, মারলে, ধর্ষণ করলে ভাবা হতো এসবে স্বামীর অধিকার আছে। দীর্ঘ বছরব্যাপী নারীবাদী আন্দোলনের ফলে মানুষ এখন জানে কোনও নারীকেই কোনও রকম নির্যাতন করার কোনও রকম অধিকার কোনও পুরুষেরই নেই, সে পিতা হোক কী স্বামী হোক কী ভাই হোক কী পুত্র হোক। না, কোনও নারীরও সে অধিকার নেই। একসময় নারীরা সব নির্যাতন চুপচাপ সইতো, চুপচাপ সওয়াটাকেই নারীর গুণ বলে মনে করা হতো। এখনও যে হয় না তা নয়। রাস্তাঘাটে যৌন নির্যাতনের শিকার হলেও ‘পুরুষরা একটু ওরকমই হয়’, ‘পুরুষদের সেক্সটা একটু বেশি’– এসব ভেবে পুরুষের সব অন্যায়কে, সব অপকর্মকে, সব অপরাধকে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখা হতো। ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে সব অপরাধীকে দেখাটাকেও নারীর গুণ বলে ভাবা হতো, এখনও হয়। নারীবাদী আন্দোলনের ফলে নারীরা নিজের অধিকারের ব্যাপারে এখন খানিকটা সচেতন। তাই পুলিশে রিপোর্ট করে অনেকেই। সব নির্যাতিতাই রিপোর্ট করে না। এই যে কিছু রিপোর্ট করা হয়, এই যে মিডিয়া লেখালেখি করে বা বলাবলি করে এ নিয়ে, এতেই অনেকে মনে করে নারী নির্যাতনের হার বুঝি আগের চেয়ে অনেক বেশি বেড়ে গেছে। সত্য কথা হলো, নারীবিরোধীরা আগেও ছিল, এখনও আছে। আগেও নারীকে যৌন বস্তু হিসেবে দেখা হতো, এখনও দেখা হয়।
বিদেশি মেয়েরা ছোট স্কার্ট না পরলে কি তারা যৌন নির্যাতনের শিকার হবেন না? এ কথা কি হলফ করে বলতে পারবেন পর্যটনমন্ত্রী? ষাট বছর বয়সী যে বিদেশি মহিলাকে এক ট্যাক্সি ড্রাইভার ধর্ষণ করার পর হত্যা করেছিল, সেই মহিলা কি মিনি স্কার্ট পরেছিলেন? না, তিনি মিনি স্কার্ট পরেননি। বিদেশি নারী– যারা যৌন নির্যাতনের এবং ধর্ষণের শিকার হয়েছে এ যাবৎ, তাদের অধিকাংশই ছোট স্কার্ট পরা ছিলেন না। দোষটা স্কার্টের নয়, দোষটা পুরুষের নারী বিদ্বেষের, নারীকে যৌন বস্তু ভাবার মানসিকতার, নারীকে যা ইচ্ছে তাই করা যায়, পাশ্চাত্যের মেয়েরা ‘যার তার সঙ্গে সেক্সে আপত্তি করে না’– এই বিশ্বাসের।
ভারতে গত বছর নারী নির্যাতনের রিপোর্ট হয়েছে তিন লাখ সাতাশ হাজার। আমরা অনুমান করতে পারি, রিপোর্ট না হওয়ার সংখ্যাটা আরো বেশি। যে হারে ভারতীয় নারীরা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়, সে হারে বিদেশি নারী পর্যটক যৌন নির্যাতনের শিকার হয় না। জরিপে দেখা যায়, গত বছরে বিদেশি মহিলাদের ধর্ষণ করার হারটা আগের বছরের চেয়ে বরং কিছু কমেছে। কিন্তু এ তথ্য প্রমাণ করে না যে ভারত ধীরে ধীরে বিদেশি মেয়েদের জন্য নিরাপদ দেশ হয়ে উঠছে। যৌন নির্যাতনের ঘটনা ঘটবেই, দেশি মেয়েরা যৌন নির্যাতনের শিকার হলে বিদেশি মেয়েরাও শিকার হবে। দেশ নিরাপদ হলে দেশি বিদেশি সব মেয়ের জন্য নিরাপদ হবে, নিরাপদ না হলে কারও জন্যই হবে না।
দেশ যদি মেয়েদের জন্য নিরাপদ হয় মেয়েরা শরীরে কিছু না পরলেও নিরাপদ। উলঙ্গ মেয়ে রাস্তায় হেঁটে গেলেও কেউ কটু কথা বলবে না, কেউ যৌন হেনস্থা করবে না। যে দেশ স্কার্ট পরা মেয়েদের জন্য নিরাপদ নয়, সে দেশ বোরখা পরা মেয়েদের জন্যও নিরাপদ নয়। মেয়েদের জন্য নিরাপদ দেশ– মেয়েরা যা কিছুই পরুক, অথবা কিছু না পরুক– নিরাপদ। আর যে দেশ মেয়েদের জন্য নিরাপদ নয়– সে দেশে কোনও কাপড় চোপড় পরে নিরাপত্তা আনা যায় না। স্কার্ট বা লুঙ্গি তো পুরুষও পরে। উত্তর ভারতের গ্রামে গঞ্জে পুরুষরা স্কার্ট বা লুঙ্গি পরে। ভারতের তামিলনাড়ু আর কেরালার পুরুষরা ঘরে বাইরে তাদের জাতীয় পোশাক মুন্ডু পরেই থাকে। মুন্ডু আর লুঙ্গিতে পার্থক্য নেই। মুন্ডুটাকে ফোল্ড করে ছোট করেও পরে ওরা। ছোট করা মুন্ডু দেখতে অনেকটা ছোট স্কার্টের মতো। কই ছোট স্কার্ট পরে বলে তাদের নিরাপত্তার কোনও অভাব হয়নি তো! কোনও নারী তো ধর্ষণ করার জন্য তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে শুনিনি। দোষটা তাহলে স্কার্টের নয়। দোষটা নারীর নয়, কারণ নারীরা স্কার্ট পরা পুরুষকে যৌন নির্যাতন করে না। দোষটা নিশ্চিতই পুরুষের, কারণ স্কার্ট পরা এবং না–পরা মেয়েদের যৌন নির্যাতন করে পুরুষরাই। এই পুরুষদের মানুষ করার উপায়টা কি? কী করে মেয়েদের জন্য নিরাপদ দেশ বানানো যায় একটি দেশকে?
যত নারীবিদ্বেষ পুরুষ জন্মের পর থেকে শিখেছে– তা সবার আগে তাদের মস্তিষ্ক থেকে বের করে দিতে হবে। ওসব আবর্জনা মস্তিষ্কে রেখে নতুন বপন করে সুস্থ কিছু ফলানো সম্ভব নয়। নারীকে শ্রদ্ধা করো– এই শিক্ষা কোনও কাজে আসবে না, কারণ নারীকে ঘৃণা করো—এই শিক্ষা পেয়েই বেড়ে উঠেছে অধিকাংশ পুরুষ। আসলে ‘নারীকে শ্রদ্ধা করো, নারীও মানুষ’ ইত্যাদি যত না মাথায় প্রবেশ করানো দরকার, তার চেয়ে মাথা থেকে ‘নারী যৌন বস্তু, নারীকে যা ইচ্ছে তাই করার অধিকার পুরুষের আছে’— এই ধরনের বিশ্বাস মাথা থেকে বের করে দেওয়া বেশি দরকার।
মেয়েদের কাপড় চোপড় নিয়ে পুরুষের মাথা ঘামানো কিছু নতুন নয়। মেয়েদের কাপড় চোপড়ের ওপর দোষ চাপিয়ে নিজের দোষ ঢাকতে চায় ধর্ষক পুরুষ। অচেনা কারও সঙ্গে কোনও অনুমতি ছাড়াই যৌন সঙ্গমের ইচ্ছে হতেই পারে পুরুষের, কারও ওপর পেশির জোর দেখানোর ইচ্ছে হতেই পারে তাদের, কাউকে খুন করার ইচ্ছে হতেই পারে– কিন্তু এসব বদ ইচ্ছেগুলোকে সংবরণ করতে হবে। এছাড়া উপায় নেই। সভ্য মানুষ হতে হলে এর বিকল্প নেই। দেশের প্রতিটি মানুষ সভ্য না হলে দেশটিরও সভ্য হয়ে ওঠা হয় না। আমি অপেক্ষা করে আছি সেই দিনের, যে দিন একটিও নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটবে না। শুধু ভারতবর্ষে নয়, সারা পৃথিবীতে।
১ সেপ্টেম্বর, ২০১৬
সমস্যা মেয়েদের পোশাকে, নাকি পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গীতে?
বাংলাদেশে যেসব মেয়ে ঘরে বা ঘরের বাইরে যৌন হয়রানির শিকার হন, তাদের একটা বিরাট অংশই সেটা মুখ বুঁজে সয়ে যান। কিন্তু অবস্থা পাল্টাচ্ছে। অনেক মেয়েই এখন সংকোচ ঝেড়ে ফেলে তাৎক্ষণিক প্রতিবাদের পথ বেছে নিচ্ছেন, এমনকি উত্যক্তকারী পুরুষকে হাতে–নাতে ধরে নাকালও করছেন। বিবিসি বাংলার শায়লা রুখসানা কথা বলেছেন এ রকম কয়েকজন নারীর সঙ্গে:
প্রতিদিনের মতো কারওয়ানবাজারের অফিসে দিনের কাজ শেষে বাসে চেপে বাড়ি ফিরছিলেন সিরাজুম মুনিরা। বাসে নিত্যদিনের মতো সেদিনও বেশ ভিড়। সেই ভিড়ের মধ্যে সেদিন এক ভয়ংকর অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হলেন তিনি।
“আমি কিছুদূর যাওয়ার পর হঠাৎ করে অনুভব করছিলাম, আমার শরীরের পেছনের স্পর্শকাতর অংশে শক্ত কিছু এসে লাগছে। প্রথমে ভেবেছিলাম আমার পেছনের যাত্রীর হাতে হয়তো ফাইল জাতীয় কিছু আছে, যেটা আমার গায়ে লাগছে। অনেক ভিড় ছিল। আমি বুঝতে পারছিলাম না। বার বার সরে যাচ্ছিলাম।”
ব্যাপারটা ভালো করে বোঝার জন্য মুনিরা ঘুরে দাঁড়ালেন। দেখলেন, সুবেশি এক মানুষ, চোখে রিমলেস চশমা। এই মানুষটি এতক্ষণ তার পুরুষাঙ্গ ঘষছিলেন তাঁর পেছনে। মুনিরা ছেড়ে দেবার পাত্র নন। তিনি প্রতিবাদ করলেন। কিন্তু বিস্ময়ের সঙ্গে দেখলেন, উল্টো তাকেই দুষছেন লোকটি।
শিক্ষার্থী কিংবা চাকুরে কেউই হয়রানির বাইরে নন। তেমন অভিজ্ঞতার কথাই রিপোর্টারকে বলেছেন এই তিনজন তরুণী– লাভলি আখতার, আফরিনা খান ও রোকসানা আখতার “যে লোকটা আমার সঙ্গে এরকম একটা কান্ড করলো, সে উল্টো দাবি করতে লাগলো যে আমিই নাকি তাকে উত্তেজিত করেছি। কিন্তু একটু দূরে বসা অন্য দুজন যাত্রী ব্যাপারটা দেখেছেন। তারা আমার পক্ষে সাক্ষী দিলেন। এই দুজন আমার পক্ষে দাঁড়ানোর পরেই কেবল বাসের অন্য যাত্রীরা বিশ্বাস করলেন যে ঐ সুবেশি লোকটি আমাকে উত্যক্ত করছিল।
ঢাকায় গণপরিবহনে যে মেয়েদের চলাচল করতে হয়, তাদের সবার কম–বেশি এরকম অভিজ্ঞতা আছে। কারওয়ান বাজারে সিরাজুম মুনিরার অফিস থেকে বেরিয়ে আমি উঠে পড়ি মতিঝিল–গামী এক বাসে। সামনের দিকে মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত আসনে তিন মহিলা যাত্রী। পুরো বাসে আর সব পুরুষ যাত্রী।
পুরুষ যাত্রীর ভূমিকা
বাসের ভেতর যখন মহিলা যাত্রীদের এরকম যৌন হয়রানির শিকার হতে হয়, তখন সহযাত্রী পুরুষরা কি করেন? “আমি সব সময় প্রতিবাদ করার চেষ্টা করি, বাধা দেয়ার চেষ্টা করি’, বললেন এক তরুণ যাত্রী।
মেয়েরা এরকম ঘটনার শিকার হলে যখন প্রতিবাদ করেন, তখন কিন্তু অন্যান্য যাত্রীরা তার সঙ্গে প্রতিবাদে সামিল হন, দাবি করলেন আরেক পুরুষ যাত্রী।
কিন্তু তৃতীয় পুরুষ যাত্রী এ রকম ঘটনার দায় চাপালেন মেয়েদের ওপরই। “মেয়েরা কেমন পোশাকে ঘুরছে, সেটা তাদের খেয়াল রাখতে হবে। এটা তো বিদেশ নয়, বাংলাদেশ। তারা কেন বাংলাদেশে এমন পোশাকে ঘুরবে?”
সমস্যা আমাদের পোশাকে নয়, পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গীতে, জোরালো প্রতিবাদ জানিয়ে বললেন দুই মহিলা যাত্রী।
আমি বৃদ্ধ লোককেও দেখেছি মেয়েদেরকে উত্যক্ত করতে, ক্ষোভের সঙ্গে বললেন একজন।
“বাসে একটু বেশি ভিড় থাকলেই ইচ্ছে করে এসে ধাক্কা দিয়ে গায়ে পড়ে। তখন বলে যে বাস ব্রেক করায় ধাক্কা লাগছে”, বললেন অপরজন।
ধর্মীয় অনুশাসন মেনে পোশাক পরলেও রেহাই মিলছে না
বোরকায় সুরক্ষা?
বাসে উঠলেন এক বোরকা পরা মহিলা। তার কন্ঠে শোনা গেল একেবারেই ভিন্ন ভাষ্য। “আমরা মেয়েরা যদি উচ্ছৃঙ্খল আর খোলামেলা পোশাক পরি, তাহলে ছেলেরা এরকম করতেই পারে। আমরা যদি ধর্মীয় বিধান মেনে পোশাক পরতাম, চলাফেরা করতাম, তাহলে এ রকম ঘটতো না।”
আসলেই কি তাই? বোরকাই কি তাহলে যৌন হয়রানি থেকে বাঁচার একমাত্র উপায়?
ঢাকার শাহবাগ মোড়ে ব্যস্ত সময়ে বাসে উঠার চেষ্টা করছিলেন এক বোরকায় আবৃত মহিলা। কয়েকবার চেষ্টা করেও বাসে উঠতে পারলেন না। জানতে চেয়েছিলাম তার অভিজ্ঞতার কথা।
“একদিন আমি শাহবাগ থেকে কল্যাণপুর যাচ্ছিলাম। তখন রাত প্রায় নটা। বেশ ভিড় ছিল বাসে। আমি বাসে ওঠার সময় একটা লোক আমার গায়ে হাত দিল। আমি তো বোরকা পরি, পর্দা মেনে চলি, তারপরও এমন করলো। খুবই আপত্তিকর। শুধু আমার নয়, সব মেয়ের জন্যই এটা আপত্তিকর।”
প্রতিবাদী নারী
রাস্তাঘাটে এ রকম ঘটনার শিকার যারা হন, তাদের অনেকেই লজ্জায় মুখ বুঁজে সয়ে যান। কিন্তু অবস্থা পাল্টাচ্ছে, অনেক মেয়েই এখন প্রতিবাদ করছেন, প্রতিরোধেও পিছপা হচ্ছেন না।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত লাভলি তার এরকম এক অভিজ্ঞতার কথা শোনাচ্ছিলেন আমাকে।
“একদিন রাস্তার পার হওয়ার জন্য দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎ দেখি বাসের দরোজায় ফর্মাল কাপড়–চোপড় পরা এক পুরুষ আমাকে জিহ্বা দেখিয়ে কুৎসিত ইঙ্গিত করছে, ইশারা করে আমাকে তার সঙ্গে যেতে বলছে। আমি একটু ভাবলাম, তারপর এগিয়ে গিয়ে তার কলার চেপে ধরলাম। তাকে মারতে শুরু করলাম। বাস চলছে, তার মধ্যে আমি এই লোকটাকে পেটাচ্ছি।”
লাভলির মতো আরও অনেকেই এখন প্রতিবাদী হচ্ছেন, কিন্তু তাদের সংখ্যা হাতে গোণা, বলছেন ‘ব্রেকিং দ্য সাইলেন্স’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানের প্রধান রোকসানা সুলতানা। শিশুদের ওপর যৌন নির্যাতনের বিরুদ্ধে কাজ করছেন তিনি।
“আমরা কেবল ধর্ষণকেই কেবল যৌন নির্যাতন বলে গণ্য করি। কিন্তু মেয়েরা যে আরও কতরকমের যৌন নির্যাতনের মুখোমুখি হন, টাচিং, ফন্ডলিং, যৌনাঙ্গ দেখানো, যৌনাঙ্গ স্পর্শ করা—-এগুলোও তো যৌন নির্যাতন। কিন্তু কেউই আমরা এগুলো নিয়ে কথা বলি না লোকলজ্জার ভয়ে।”
“মুখ বুঁজে সয়ে গেলে এর কোন সমাধান নেই, প্রতিবাদে সোচ্চার হলেই কেবল এর প্রতিকার সম্ভব,”
সূত্রঃ বিবিসি বাংলা, মে ২০১৫
প্রিয় পুরুষ, আপনাকেই বলছি
হাবীবাহ্ নাসরীন : পাঁচ বছরের একটি শিশু ধর্ষিত হয়ে বিছানায় পড়ে আছে। জীবন–মৃত্যুর সঙ্গে বোঝাপড়া করছে সে। অথচ এখন তার অ, আ, ক, খ বুঝতে বিদ্যালয়ে থাকার কথা ছিল। হয়তো শিক্ষকের কড়া চক্ষু ফাঁকি দিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে খুনসুটিতে মেতে উঠতো, এর কলম দিয়ে ওর ব্যাগে একটুখানি দাগ টেনে দিতো। সেই নিয়ে নালিশ করতো তার বন্ধুটি, `স্যার, পূজা আমার ব্যাগে দাগ দিয়েছে, দেখেন!` না।
পূজা বিদ্যালয়ে যায়নি। পূজা পাশবিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে। তাকে `ধর্ষণ` করা হয়েছে। পাঁচ বছরের পূজা এখনও ছেলে আর মেয়ের তফাৎটাই বোঝে না, সেই কি না ধর্ষণের শিকার! প্রিয় পুরুষ, আপনারা কি দেখতে পাচ্ছেন, পূজার কুঁচকে যাওয়া মুখখানা, ঘৃণাভরা চোখ দুটি? জানি, আপনি ধর্ষক নন। কিন্তু একজন পুরুষ হিসেবে এই লজ্জার দায় আপনি এড়াতে পারেন না। যেমন আমরা পারি না একজন মানুষ হয়েও মানুষের নিরাপত্তাহীনতার দায় এড়াতে।
এ রকম একটা ঘটনার পরে অনেকেই বলে থাকেন, `কী দোষ ছিল মেয়েটির? তার পোশাকে তো সমস্যা ছিল না!` অথবা কোনো হিজাব পরা মেয়ে ধর্ষিত হলে বলে, `মেয়েটি তো পর্দা করতো, তাহলে তাকে ধর্ষণ করা হলো কেন!` এখন, আমার কথা হচ্ছে, একটি মেয়ে হিজাব না পরলে বা অশালীন পোশাক পরলে তাকে ধর্ষণ করা যাবে? মেয়েটি শালীন পোশাক না পরে যদি ভুল করে থাকে, আপনি তার দিকে অসংযত দৃষ্টিতে তাকিয়ে সমান অপরাধ করতে পারেন না নিশ্চয়ই।
ইসলাম শুধু মেয়েদেরকেই পর্দা করতে বলেনি বরং নারী–পুরুষ উভয়ের জন্যই পর্দাকে সমানভাবে ফরজ করেছে। পুরুষদেরকে তাদের গোপনাঙ্গের হেফাজত করতে এবং দৃষ্টি সংযত রাখতে বলা হয়েছে। এখন, আপনারা, পুরুষেরা সব মেয়ের দিকেই কামনা নিয়ে তাকাবেন আর মেয়েটি শালীন পোশাকে না থাকলে তাকে ধর্ষণ করা বৈধ হয়ে যাবে আর কালো বোরখায় আবৃত থাকলে আপনাদের লোলুপ দৃষ্টিসীমা থেকে বেঁচে যাবে, এই যুক্তি আপনারা কোথা থেকে এনেছেন?
নারীর পোশাকের প্রসঙ্গ এলেই আপনারা সবাই ইসলামী চিন্তাবিদ হয়ে যান। ইসলাম নারীকে যার যার সম্পত্তিতে যতখানি অধিকার দিয়েছে, একজন বোন হিসেবে, একজন মা হিসেবে, একজন স্ত্রী হিসেবে যতখানি অধিকার দিয়েছে, বুকে হাত রেখে বলুন, আপনি তার কতটুকু আদায় করতে পেরেছেন। একটু পিছনে তাকিয়ে দেখুন তো, আপনার পরিবারেই আপনার ফুফুকে অথবা বোনকে সম্পত্তির ভাগ ঠিকভাবে দেয়া হয়েছে কি না? ছেলে হিসেবে মায়ের প্রতি কতটুকু দায়িত্ব পালন করেছেন? বিয়ের আগে এবং পরে আপনার স্ত্রীর হক কখনো নষ্ট করেছেন কি না! এখানে যেতে পারবে না, ওই পোশাক পরতে পারবে না, এটা বলে আপনি আপনার `পৌরুষ` টিকিয়ে রাখতে পারেন, কিন্তু এর বদলে নারীদের কাছ থেকে শুধু ঘৃণাই পাবেন।
পরিবার হচ্ছে আমাদের প্রথম বিদ্যালয়। আপনি যদি আপনার পরিবারে নারীর অধিকার নিশ্চিত করতে পারেন, তবে নিশ্চিত থাকুন, পরবর্তীতে সময়ে আপনার দ্বারা কোনো নারী অসম্মানিত হবেন না। যে তার মাকে ভালোবাসে, বোনকে ভালোবাসে, প্রিয়তমাকে ভালোবাসে সে কখনো অন্য একজন নারীকে উত্ত্যক্ত করতে পারে না। আপনি একজন পুরুষ। আপনি একজন মানুষ। আপনার নিজের কি এতটুকু ব্যক্তিত্ব নেই যে, যে কারো সামনে আপনি উলঙ্গ হয়ে যেতে পারেন!
নারীরা খারাপ তাই তারা ধর্ষিত হয়, এই আপনাদের যুক্তি। কিন্তু কথা হচ্ছে এই ধর্ষণটা করে কারা? যে পুরুষটি ধর্ষণ করলো, কতখানি মানবিক অবক্ষয়ের শিকার হলে সে এই কাজটি করতে পারে, তা আপনাদের চিন্তাতেও আসে না। বিভিন্ন সময় লোকাল বাসে চড়তে গিয়ে আমি একটি বিষয় দেখেছি। একজন পুরুষ সে হয়তো অশালীনভাবে কোনো নারীর গায়ে স্পর্শ করেছে। নারীটি যখন এই কথা বলতে যাবে, বাসের অন্য পুরুষরাও তখন একজোট হয়ে যায়। সবাই পক্ষ নেয় অপরাধীর। যেন একজন পুরুষ দায়ী হলে, সবাই দায়ী হয়ে যায়।
সব পুরুষ কখনোই ধর্ষক নয়। আমি আমার নিজের জীবনেই প্রচুর ভালো পুরুষের দেখা পেয়েছি। আমাদের পরিবারে নারীকে পরিপূর্ণ সম্মান করা হয়। তাই আমার ভাইয়েরা কখনো নারীকে উত্ত্যক্ত করে না বা রাস্তাঘাটে টিজিং করে না। এই শিক্ষাটা সব পরিবারেই জরুরি। আপনি যখন ধর্ষকের পক্ষ নেন বা মৌন থাকেন, তখন বুঝতে হবে আপনি তার নীরব সমর্থনকারী।
অপরাধ করা আর তাতে সমর্থন দেয়া সমান অপরাধ। খাদিজাকে যখন কোপানো হলো, তখন অনেক পুরুষকেই দেখেছি মনে মনে খুশি হতে। যেন তারা তাদের প্রেমিকাদের প্রতি দীর্ঘ দিনের আক্ষেপ বদরুলের মাধ্যমে পূর্ণ করতে পেরেছেন! আমাদের সম্পর্কগুলো নারী কিংবা পুরুষের গণ্ডিতে আটকে না থেকে মানবিক হোক। আমাদের শিশুরা উঠোনজুড়ে নিরাপদে খেলা করে বেড়াক। আর কোনো নরপশু যেন ওদের শৈশব কেড়ে নিতে না পারে। শিশু না বাঁচলে আগামী বাঁচবে না, নারী না বাঁচলে পৃথিবী বাঁচবে না। একটি শিশুর জন্য, একজন নারীর জন্য, একজন
পুরুষের জন্য এককথায় বলতে গেলে একজন মানুষের জন্য একটি নিরাপদ পৃথিবী গড়তে হলে সবার আগে সচেষ্ট হতে হবে আপনাকেই। কেউ কোনো ভুলের মধ্যে থাকলে আপনি তাকে পরামর্শ দিতে পারেন সঠিক পথের। কিন্তু আপনি তাকে আক্রমণ করতে পারেন না। আপনি একজন পুরুষ, আপনি এই মুহূর্ত থেকে প্রতিজ্ঞা করুন, আপনার দৃষ্টি সংযত রাখবেন, লুকিয়ে অশ্লীল ভিডিও দেখবেন না, ইনবক্সে মেয়েদের নোংরা মেসেজ পাঠাবেন না, আপনি আপনার লজ্জাস্থানের হেফাজত করবেন, অশ্লীল বাক্য বিনিময় থেকে নিজেকে বিরত রাখবেন, অফিসে আপনার সহকর্মী নারীটি আপনার দ্বারা কোনোভাবেই নিপীড়িত হবে না, আপনার গৃহকর্মী মেয়েটির সামনে আপনি সুযোগ বুঝে হায়েনা হয়ে উঠবেনা না; আপনার বোন, আপনার মা, আপনার স্ত্রীর অধিকার আপনি নিশ্চিত করবেন। তাহলেই দেখবেন, আগামীকাল থেকে আর কোনো ধর্ষণের ঘটনা ঘটবে না।
লেখক : সাংবাদিক।
উৎসঃ জাগো নিউজ